সোমবার, ৩রা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

নারীর হিজাব বা পর্দা : মানবীয় ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৯, ২০২০ 

শাহনাজ আরফিন

ইসলাম একটি ঐশী ধর্ম, তাই এ ধর্মের চিন্তাধারাগুলো নির্ভুল এবং মানুষের জন্য কল্যাণকামী। ইসলাম মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্য ও নৈতিক সুষমা এবং সামাজিক সুস্থতা রক্ষার জন্য হিজাব বা পর্দার বিধান অবশ্য পালনীয় হিসাবে নির্ধারণ করেছে। ‘পর্দা’ শব্দটি মূলত ফারসি যার আরবি প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আড়াল, অন্তরায়, আচ্ছাদান, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া, আবৃত করা বা গোপন করা ইত্যাদি।
ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়, নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা ও আত্মিক শুদ্ধতা অর্জনের জন্য উভয়ের মাঝে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলা হয়। আবার অনেকে বলেন, নারীর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপলাবণ্য ও সৌর্ন্দয পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা ইসলাম প্রণয়ন করেছে তাকে পর্দা বা হিজাব বলা হয়।
মূলত হিজাব বা পর্দা শুধু পোশাকের আবরণই নয়, বরং সামগ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে অপবিত্র ও অবৈধ স¤পর্ক এবং নারীর প্রতি পুরুষের অন্যায় ও অশালীন আচরণ রোধের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের বহু চিন্তাবিদ ও মনীষীও সমাজে নারী ও পুরুষের উপস্থিতি ও তাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নারীর পর্দা বা শালীন পোশাকের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
অনেকে মনে করেন, পর্দার বিধান শুধু নারীর জন্য। এ ধারণাও ঠিক নয়। পুরুষের জন্যও পর্দা অপরিহার্য। তবে উভয়ের পর্দার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। যে শ্রেণির জন্য যে পর্দা উপযোগী তাকে ঠিক সেভাবেই পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পোশাকের শালীনতা বা পর্দা নারীর ব্যক্তি জীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বমহিমায় অবস্থান ও অগ্রগতির জন্য উপযুক্ত বিধান। নারী-পুরুষের মাঝে রয়েছে সৃজনগত ও প্রাকৃতিক ভিন্নতা। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অনন্য। একজন নারী তার কর্মগুণে হতে পারেন পুরুষর চেয়েও অনেক বেশি মর্যাদাবান। ইসলাম নারীকে অশিক্ষিত, অবরোধবাসিনী হতে বলেনি। হিজাব বা পর্দার বিধান পালন করে নারী নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষাঙ্গনে, শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে।
মূলত হিজাব বা পর্দা নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক। তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও শুদ্ধতা রক্ষার হাতিয়ার। নারী-পুরুষ উভয়ের পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায় হল ইসলামের পর্দা বা হিজাবের বিধান। এই বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই হৃদয়-মনের শুদ্ধতা ও পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। পর্দার এই সুফল স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন। সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্øাহ বলেছেন :
      ক্স  
‘তোমরা ঘরের ভেতরে অবস্থান করবেÑ প্রথম অজ্ঞতার যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।’
সুতরাং মানবসমাজকে পবিত্র ও পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে পর্দা-বিধানের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমান সমাজের যুবক ও তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা ও নারীজাতির নিরাপত্তার জন্য পর্দা-বিধানের পূর্ণ অনুসরণ প্রয়োজন। যে কোনো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিই কুরআন ও সুন্নাহর পর্দা স¤পর্কিত আয়াত ও হাদীস গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন নিঃসন্দেহে তিনিই এই বাস্তবতা স্বীকার করবেন যে, ইসলামে পর্দার বিধানটি অন্যান্য হিকমতের পাশাপাশি নারীর সম্মান ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষার জন্যই দেওয়া হয়েছে।
হিজাব বা পর্দা স¤পকে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদীসগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, ইসলামে পর্দার বিধানটি নারীর আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকের সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীর মতে, মানুষের বিকাশ বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত। মানুষ তার বিকাশের প্রতিটি ধাপেই কিছু চাহিদার বিষয় উপলব্ধি করে। তার এই চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা যদি যথাযথভাবে না মেটে, তাহলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার মানসিক ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে পারে অর্থাৎ তার মানসিক বিকাশ একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায় এবং সেখানেই স্থবির হয়ে পড়ে। যদিও তার বয়স বাড়ে, শারীরিক বিকাশও ঘটে, কিন্তু মানসিক স্থবিরতার ঐ ধাপ সে আর অতিক্রম করতে পারে না, সেখানেই ঘুরপাক খেতে থাকে। এটা ¯পষ্ট যে, ছেলেদের ও মেয়েদের মানসিক বিকাশের এই পর্বে তাদের ব্যবহারে, আচার-আচরণে পর¯পরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ছেলেরা এই সময় নিজেদেরকে অন্যদের উপর প্রভাবশালী ভাবতে থাকে এবং সে অনুযায়ী তারা উগ্র এবং অশালীন আচরণও করে। কিন্তু মেয়েরা ঠিক ছেলেদের বিপরীতে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। তাদের প্রতি অন্যদের আকর্ষণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। আকর্ষণীয় পোশাক পরা, সাজগোজ করা ইত্যাদি প্রবণতা মেয়েদের এ বয়সের বৈশিষ্ট্য। মনোবিজ্ঞানীদের মতে এই সময় যেসব মেয়ের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায় তারা আসলে এক ধরনের ব্যাধিতে ভোগে যা তাদের উন্নতির পথরোধ করে দাঁড়ায়। ইসলাম নারীদের মেধা ও শক্তিকে নষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং তাদেরকে কেবল আত্মসজ্জার মধ্যে মগ্ন না থেকে মানবীয় পূর্ণতা অর্জনের দিকে আহ্বান জানায়। ইসলামের নির্দেশিত শালীন পোশাক পরিধান, নারীর এ মর্যাদা রক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম।
ইরানের বিশিষ্ট লেখক ও মনোবিজ্ঞানী ডাক্তার শাহরিয়ার রূহানী বলেছেন, নারীর প্রতি কোনো কোনো পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এবং কোনো কোনো নারীর সাজগোজের ব্যাপক ঝোঁক তাদের মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হবারই প্রমাণ। তবে স্বামীর জন্য স্ত্রীর সাজগোজের ব্যাপারটি ইতিবাচক ও পছন্দনীয়। কেননা, এর মাধ্যমে পরিবারে শান্তি ও সৌহার্দের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ স¤পর্কে বলেছেন, ‘নারীর সাজসজ্জা যদি কেবল স্বামীর জন্য হয় এবং সে নিজেকে যদি কেবল স্বামীর জন্যই সাজায় তাহলে তাতে একদিকে যেমন সাজগোজের নিজস্ব স্বাভাবিক ইচ্ছাও মিটল অপরদিকে স্বামীকেও অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হবার প্রবণতা থেকে রক্ষা করল…।’
আধুনিক বিশ্বের অনেকেই মনে করেন, সমাজে মেয়েদের উপস্থিতির জন্য হিজাবের কোনো প্রয়োজন নেই। আবার অনেকে বলেন, হিজাব নারীর উপর অন্যায় ও বৈষম্যের নামান্তর। এ ধারণাগুলোর সমাধান খোঁজার জন্য প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে কেন নারীরা যুগে যুগে পর্দা ও হিজাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।
ডাক্তার শাহরিয়ার রূহানী এ স¤পর্কে বলেছেন, ‘নারী-পুরুষের পোশাকের পার্থক্য থেকে অনেকেই নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব খোঁজার চেষ্টা করেন, অনেকে আবার নারী-পুরুষের অধিকারে বৈষম্য খোঁজেন কেউবা আবার মনে করেন এটা নারীর বন্দিত্ব ও তুচ্ছতার শামিল। তারা এ বাস্তবতার ব্যপারে উদাসীন যে, ছেলে এবং মেয়ের বেড়ে উঠা এবং তাদের মানসিক বিকাশের পথ স¤পূর্ণ আলাদা। আর নারীদের জন্য উপযুক্ত হিজাব তাদের মানসিক পরিপক্বতার সাথে জড়িত এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীরে এর শেকড় প্রথিত।’
নারীর মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তাঁদের মতে নারীরা সৃষ্টিগতভাবে তাঁদের সতীত্ব ও পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী। পর্দার বিধান নারীকে তাঁর এ সহজাত প্রকৃতি অনুযায়ী চলতে সাহায্য করে।
এ প্রসঙ্গে মহান স্রষ্টা বলেন :
            
‘যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’Ñ সূরা আহযাব : ৫৩
নারীর অপরাপর সহজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে লজ্জাশীলতা, শালীনতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি অন্যতম।
আর এ জন্যই নারীর শালীন পোশাক তথা পর্দার গুরুত্ব স¤পর্কে স্বয়ং আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন :
 ক্স                      
‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’Ñ সূরা আহযাব : ৫৯
এ আয়াতে শালীন পোশাক পরে চলাফেরা করার উপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে যে, পর্দার বিধান মেনে চলাফেরা করলে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। ফলে পর্দানশীন নারীকে কেউ হেয় ও উত্যক্ত করার সাহস করে না। অন্যদিকে যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে অধিকাংশ সময় তারাই ইভটিজিং সহ নানা রকমের নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।
এছাড়াও পর্দা-বিধান স¤পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের হিফাযত হয়। পারিবারিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় হয়।
পর্দা পালনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পরকিয়াবিহীন পবিত্র জীবন গঠিত হয় এবং চরিত্রহীনতা ও অবিশ্বাস তাদের থেকে বিদায় নেয়।
পর্দাহীনতার কারণে আজ বিভিন্ন দেশে আত্মপ্রদর্শনীর সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি সমাজে পরকিয়া, চরিত্রহীনতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, অপকর্ম ও ব্যভিচারের মতো নিকৃষ্ট ব্যাধির সংক্রমণ ব্যপক হারে বাড়ছে। পশ্চিমা অনেক দেশেই নারীকে পণ্যের মতো দেখা হয়। আর তাই সেখানে নারীর উপর নির্যাতন ও যৌন সন্ত্রাস প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার বাস্তব চিত্র প্রতিদিনের খবরাখবর ও সংবাদপত্র খুললেই চোখে পড়ে।
এরই আলোকে বলা যায় যে, নারীদের জন্য হিজাবের বিধানটি তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তথা সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম হাতিয়ার। এটি ইসলামের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও মানবীয় অবদান, যা শুধু ধর্মীয় অনুভূতি নয়, বরং বিশ্বমানবের জাতীয় সত্তার রক্ষকও বটে ।
লেখক ও গবেষক