নারীর গৃহিনী হওয়া সম্পর্কে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি (২য় পর্ব )
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ১৮, ২০১৬

ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারে নারী ও পুরুষ পরস্পরের সহযোগী। এ ধর্মের মতে, স্বামী ও স্ত্রী পরিবার গঠনের মাধ্যমে পরস্পরের পাশে থেকে ইহকালীন ও পারলৌকিক সৌভাগ্য অর্জন করতে চান। তাই পরিবার নারী ও পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র নয় বরং সমবায় ও সহযোগিতার কেন্দ্র। এখানে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটে এবং বিকাশ ঘটে মানবীয় প্রতিভার। অন্য কথায় ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারের ভিত্তি হল ভালবাসা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নয়। দাম্পত্য জীবনসহ জীবনের সব দিকে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরকে সহযোগিতা করে এই ভালবাসার ভিত্তিতেই। সে জন্য পরিবারের সদস্যরা দায়িত্ব বা কাজগুলো ভাগ করে নেন। এভাবে বৃদ্ধি পায় পরস্পরের প্রতি ভালবাসা এবং দাম্পত্য জীবন হয় সুখময়।
ইসলাম স্বামী ও স্ত্রীর স্বভাব এবং শারীরিক প্রকৃতির আলোকে তাদেরকে একই ধরনের কাজ করতে বলে না। এ ধর্মের দৃষ্টিতে পুরুষ সংসারের বা পরিবারের প্রধান, আর স্ত্রী হলেন সচিব। পরিবারকে যদি একটি ভবনের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে এর ছাদটির কাজ হল বৃষ্টি ও ঝড়-তুফানের মত বাইরের নানা সংকট থেকে পরিবারকে রক্ষা করা। অন্যদিকে ভবনটির স্তম্ভের কাজ হল ছাদকে রক্ষা করা। ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষ হলেন পরিবারের ছাদ ও স্ত্রী হলেন স্তম্ভ। ছাদ স্তম্ভ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। আর ছাদ ছাড়াও স্তম্ভ সুরক্ষিত হয় না। পুরুষ দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে বেশি শক্তিশালী হওয়ায় বাইরের সংকটগুলো তাকে মোকাবেলা করতে হয়। বাইরের যে কোনো হামলা এবং প্রখর তাপ বা বৃষ্টি থেকে ঘরকে রক্ষা করা স্বামীর দায়িত্ব। স্বামী যদি এইসব দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে সংকট ছড়িয়ে পড়বে ঘরের ভেতরে। স্ত্রী বা নারী হলেন ঘরের স্তম্ভের মত। একই সময়ে স্ত্রী কী ছাদের ভূমিকাও পালন করতে পারেন? নারীর জন্য পুরুষালী কাজ করা যেমন কঠিন ও শোভনীয় নয় তেমনি পুরুষের জন্যও নারীসুলভ কাজ বা দায়িত্ব পালন করা শোভনীয় নয়।
যেসব কাজে অপেক্ষাকৃত বেশি শারীরিক শক্তির দরকার হয় ইসলাম সেইসব কাজ করতে বলে পুরুষকে। আর যেসব কাজের জন্য দয়া, স্নেহ ও ভালবাসা বেশি দরকার হয় সেসব কাজ তথা মাতৃত্ব ও সন্তান প্রতিপালন করতে বলে স্ত্রীকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ঘরের সব কাজই কী স্ত্রীকে বা নারীকেই করতে হবে?
নৈতিক, মানসিক এবং আবেগ –অনুভূতিগত দিক থেকে ঘরের কাজগুলো সম্পাদন করা নারীর জন্য বেশি উপযোগী বা মানানসই। তবে আইনগত দিক থেকে পুরুষ এইসব কাজ করতেও নারীকে বাধ্য করতে পারে না। এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে নারীর রয়েছে নির্বাচনের স্বাধীনতা। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারে নারীর একমাত্র দায়িত্ব বা কর্তব্য হল স্বামীর দেখাশুনা করা ও তার প্রতি অনুগত থাকা। কিন্তু বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো, কাপড় ধোয়া ও ঘরদোর পরিষ্কার করা নারীর দায়িত্ব নয়। এ যুগের বিশিষ্ট আলেম এবং ইরানের ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (র.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন: কোনো স্বামী ঘরের কাজে লিপ্ত হতে স্ত্রীকে বাধ্য করার অধিকার রাখেন না।
ইসলাম গৃহস্থালী কাজ করার দায়িত্ব কখনও নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়নি। তবে নৈতিক উপদেশ হিসেবে ঘরের কাজ করতে সক্রিয় বা উদ্যোগী হওয়ার জন্য নারীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এবং এ ধরনের কাজ করাকে ইবাদতের সমতুল্য বলে উল্লেখ করেছে। কারণ, পরিবারে ভারসাম্য রক্ষার জন্য কাজ ভাগ করে নেয়া বা শ্রম-বিভাজন জরুরি। আর এরই আলোকে ঘরের বাইরের কঠিন কাজগুলো করা পুরুষের দায়িত্ব। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নারীদের বলেছেন: যে নারী বা স্ত্রী যখন স্বামীর ঘরের কোনো জিনিষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয় তথা কোনো কাজ করে ঘরের সংস্কার বা উন্নয়নের লক্ষ্যে সে সময় আল্লাহ তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। আর আল্লাহ যার দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন তাকে তিনি শাস্তি বা আজাব দেবেন না।
পরিবারের কাজে শ্রম বিভাজনের বিষয়ে মহাপুরুষদের জীবনের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য আদর্শ। আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.) এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)’র মতামত চাইলে তিনি ঘরের কাজগুলো করতে ফাতিমা (আ.)-কে এবং বাইরের কাজগুলো করতে আলী (আ.)-কে পরামর্শ দেন। ফাতিমা (আ.) এতে অত্যন্ত খুশি হয়ে বলেছিলেন: আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না যে আমি এই শ্রম-বিভাজনে কতটা খুশি হয়েছি, কারণ আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে পুরুষের সাথে সম্পর্কিত কাজ কিংবা যেসব কাজ করতে ঘরের বাইরে পুরুষদের মধ্যে যেতে হয় সেসব কাজ করা থেকে বিরত রেখেছেন।
হযরত ফাতিমা (আ.)’র এই বক্তব্য থেকেই স্বামী ও স্ত্রীর কাজের ধরণ কেমন হওয়া উচিত তা ফুটে উঠেছে। তাই এটা স্পষ্ট ইসলাম নারী ও পুরুষের স্বভাব বা প্রকৃতির আলোকেই নারী-পুরুষের কাজের মধ্যে ভিন্নতার কথা বলে। এই ভিন্নতা ও পার্থক্যের মধ্যে বৈষম্য বা ভেদাভেদের কোনো সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে গিন্নিপনা ও স্বামীর দেখাশুনা করার মত শৈল্পিক কাজের মধ্যে রয়েছে পুণ্য বা সাওয়াব। স্ত্রী যখন এটা জানবেন যে স্বামীর দেখাশুনা ও শিশুদের প্রতিপালনে রয়েছে ইবাদতের সাওয়াব তখন তিনি আনন্দ চিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় এইসব কাজ করবেন এবং এইসব কাজ করতে কখনও ক্লান্তি বোধ করবেন না বা এ ধরনের কাজকে চাপিয়ে দেয়া কাজ বলে মনে করবেন না।
এ ছাড়াও ইসলাম ঘরের কাজকর্মে স্ত্রীকে সহায়তা করতে স্বামীকে পরামর্শ দিয়েছে। ঘরের কাজ করা কেবল স্ত্রীর দায়িত্ব –এমনটি ভাবতে নিষেধ করে ইসলাম। আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) ঘরের কাজে ফাতিমা (আ.)-কে সহায়তা করতেন বলে বহু বর্ণনা রয়েছে। তিনি ঘরের চুলার জন্য লাকড়ি বয়ে আনতেন, ঘরের জন্য পানি আনতেন এবং ঘরে ঝাড়ু দিতেন। অন্যদিকে ফাতিমা (আ.) আটা বানাতেন, খামির করতেন ও রুটি তৈরি করতেন।
ইসলাম সব সময়ই নারী ও পুরুষকে মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা দিয়েছে। ঘরের কাজের তথা নারীর মূল কাজের ক্ষতি না হলে নারীরা সামাজিক নানা কাজেও অংশ নিতে পারে বলে এ ধর্ম ঘোষণা করেছে। এমনকি নারী ধর্ম রক্ষা ও সংসারের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গিয়ে অর্থনৈতিক ততপরতাও চালাতে পারে। তবে মুসলিম নারীর এ ধরনের কাজের উদ্দেশ্য পশ্চিমা নারীদের মত বস্তুবাদ-ভিত্তিক নয়। ইতিহাসে দেখা যায় হযরত ফাতিমা (আ.) যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করেছেন। কখনও মসজিদে গিয়েছেন ও আলী (আ.)’র নেতৃত্বের বৈধতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছেন। সূত্র: পার্সটুডে