‘নবীবংশের ইমামগণ ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মহান ব্যক্তিত্ব ও ঐশী মহামানব’
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ১৪, ২০১৯
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2019/07/IMG_9800.jpg)
‘নবীবংশের ইমাগণ ছিলেন ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মহান ব্যক্তিত্ব ও ঐশী মহামানব। নবীবংশের সব ইমাম তাঁদের সময়ের কোরবানিবা আল্লাহর পক্ষথেকে নেয়া তাদের ত্যাগের পরীক্ষায় ধৈর্যশীলদের কাতারে ছিলেন। তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্ট বা রাজি ছিলেন। ইমাম রেযা (আ.) ছিলেন নবীবংশের অষ্টম ইমাম। ইমাম রেযা (আ.) ছিলেন ধৈর্যের পরীক্ষা ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠায় উন্নীত পুরুষ। ‘রেযা’ শব্দের অর্থই হলো সন্তুষ্ট বা রাযি ব্যক্তি। রাযি থেকেই রেযা। যিনি নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করেন। রেযা মানে আল্লাহর রেযামন্দি হাসিলকারী।
আহলে বাইত তথা নবীবংশের ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর-এর বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কালচারাল সেন্টার এবং আহলুল বাইত ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হুজ্জাতুল ইসলামশাহাবুদ্দিন মাশায়েখী রাদ এ কথা বলেন। তিনি ইরানের আল মোস্তফা আন্তুর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশস্থ প্রতিনিধি।
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আফতাব হোসেন নাকাভীর সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী ফায়েক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক গোলাম গাউস আল কাদেরী ও বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম আবদুল কুদ্দুস বাদশা। ইমাম রেযা (আ.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি আমিন আল আসাদ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত নাত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী মেহেদী হাসান এবং মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন।
প্রধান অতিথি জনাব মাশায়েখী আরো বলেন,আহলে বাইতের ইমামগণের জীবন ছিল শাশ্বত নূরের তাজাল্লিতে উজ্জ্বল। তাঁদের জীবনে রয়েছে মানবজাতির জন্য শিক্ষা। ইমামগণ একই নূরের থেকে জন্মগ্রহণ করলেও তাদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্টম-িত মর্যাদার অধিকারী। তাঁদের কর্মকা-গুলো আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ছিলনা। তাঁরা প্রত্যেকে যে সময়ের মাঝে ছিলেন ঠিক সেই সময়েরই সঠিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ইমাম হোসাইন (আ.) যদি ইমাম রেযার সময়ে আসতেন তবে ইমাম রেযা যে কাজ করেছেন তিনি তাই করতেন। আবার ইমাম রেযা যদি ইমাম হোসাইনের সময় আসতেন তবে তিনি ইমাম হোসাইনের মতোই কারবালায় জীবন দিতেন। স্থানকাল পাত্র ভেদে কার্যক্রম ও কর্মপদ্ধতি ভিন্ন এবং ত্যাগের পরীক্ষার রূপ ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। ইমাম রেযা (আ.) যে যুগে এসেছিলেন সে যুগ ছিল আব্বাসী খলিফা মামুনের যুগ। মামুন মার্ভ তথা ইরানের মাশহাদে বাস করত। ইমাম রেযা থাকতেন মদিনায়। মামুন তাঁকে তাঁর স্বদেশ ছেড়ে মার্ভ তথা মাশহাদে ডেকে পাঠায়। ইমাম রেযা (আ.) অনিচ্ছা সত্ত্বেও মার্ভে আসতে বাধ্য হন। মামুন তাঁকে যুবরাজের পদ গ্রহণ করতে চাপ প্রয়োগ করে যা ছিল স¤পূর্ণ তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থের কৌশল। ইমাম বুঝতে পেরেও চুপ থাকলেন এবং এক এক করে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে থাকলেন। মামুনের নীতির সাথে ইমাম কোনভাবেই একমত ছিলেন না, কিন্তু আল্লাহর ফায়সালাকে তিনি মেনে নিলেন। তিনি শহীদ হন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে এক বিন্দু নড়েন নি। ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবন থেকে এই রেযাইত সন্তুষ্টির শিক্ষা আমাদেরকে অর্জন করতে হবে।
ইমাম রেযা (আ.) ছিলেন আলেমে আলে মুহাম্মদ। ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবন আমাদেরকে শেখায় পূর্ণ মুমিন হতে। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে। আল্লাহর মারেফাত ও মুহব্বত লাভের স্তরগুলো অতিক্রম করতে। আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার চেতনা বৃদ্ধি করতে।
সভাপতির বক্তব্যে হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আফতাব নাকাভী বলেন, ইমাম রেযা (আ.) তাকওয়ার চরম শীর্ষে উপনীত হয়েছিলেন বিধায় তিনি দুনিয়ার শাসককে ভয় করেননি। শহীদ হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন, কিন্তু ঈমানের মুকুটকে ভূলুণ্ঠিত করেন নি। আর যিনি আল্লাহকে ভয় করেন জগতের কোন ভয় তাঁকে গ্রাস করতে পারেনা। যেমন বিংশ শতকের শেষভাগে ইমাম খোমেইনী (র.) জগতের সব শক্তিকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি সাহসের সাথে ইরানিজনগণের বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমেরিকাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। বর্তমান রাহবারও বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তৃতায় বলেছেন, আমেরিকার সাথে কোন যুদ্ধই হবেনা। আমেরিকা কিছুই করতে পারবেনা। তাকওয়ার শক্তিতেই তাঁরা সেই সব বলেন এবং তাকওয়ার শক্তিতেই তাঁরা কোন অপশক্তিকে পরোয়া করেন না। তাকওয়ার শক্তিতেই তাঁরা ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অপশক্তি তাঁদের কিছুই করতে পারেনা।
ইমাম রেযা (আ.) ছিলেন কামালিয়াতপ্রাপ্ত নিষ্পাপ ইমাম। তিনি ছিলেন গারীবুল গুরাবা। তবে তিনি প্রচলিত অর্থে গরীব ছিলেন না। তিনি গরীব কারণ, তাঁকে তাঁর জন্মভূমি মদিনা ত্যাগ করে ভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়। তিনি যখন মার্ভে আসেন তখন পথে তাঁকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। তারা নবীর আওলাদকে দেখতে এসেছে। তারা ইমার রেযা (আ.)-এর কণ্ঠে নবী (সা.)-এর কণ্ঠ শুনতে চেয়েছে। ইমাম রেযা (আ.) তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা শুনে নাও সেই মহান বাক্য যা আমি শুনেছি আমার পিতা মূসা কাযেম থেকে তিনি তাঁর পিতা জাফর সাদেক থেকে, তিনি তাঁর পিতা বাকের থেকে, তিনি তাঁর পিতা যায়নুল আবেদীন থেকে, তিনি তাঁর পিতা হোসাইন থেকে তিনি তাঁর ভ্রাতা হাসান থেকে, তিনি তাঁর পিতা আলী ইবনে আবি তালিব থেকে, তিনি তাঁর চাচাতো ভাই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকে, তিনি জিবরাইল থেকে জিবরাইল মহান আল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন : ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এমন এক দুর্গের নাম যে দুর্গে প্রবেশ করলে কেউ ধ্বংস হবেনা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী ফায়েক বলেন,আলে রাসূল ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবনাদর্শ আমাদেরকে অনুসরণ করতে হবে। তাঁদের মহান জীবন পদ্ধতি, তাঁদের সীরাত,তাঁদের আত্মিক গুণাবলি স¤পর্কে জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। ইমাম রেযা (আ.)-এর বদান্যতা, তাঁর আচরণ ছিল অনন্যসাধারণ। তিনি ছিলেন জ্ঞানের আধার। খলিফা মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে মদীনা থেকে মার্ভে ডেকে নিয়ে যায়। খলিফা মামুন বিভিন্ন ধর্মের প-িত, ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবের আলেমদের মধ্যে কিংবা বিভিন্ন ধারার জ্ঞানীগুণীদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। এসব বিতর্কে ইমাম রেযা (আ.)-কে অবতীর্ণ হতে বলা হতো। তিনি সকল ধর্ম বা ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবের পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথে শুভেচ্ছ বিনিময় করতেন। তাঁর যুক্তিগুলো পেশ করতেন আর প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলো খ-ন করতেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রজ্ঞাবান। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ততা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত ভিন্ন মত, মাযহাব ও ভিন্নধর্মের পণ্ডিতগণ স্বীকার করতে বাধ্য হতেন যে, ইমাম রেযা (আ.) যা বলেছেন সেটিই সঠিক।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক গোলাম গাউস আল কাদেরী বলেন,আমাদের দেশের বৃহত্তর পরিসরে নবীবংশের ইমামদেরকে কেউ চেনেনা। তাঁদের জীবন আলোচনা হয়না বললেই চলে। অথচ ইমামগণের জীবনী বিস্তারিতভাবে ও ব্যাপক পরিসরে আলোচিত হওয়া উচিত। ইমামগণ ছিলেন সর্বজনীন। সমগ্র কায়েনাতের জন্য নিবেদিত। দল, মত, মাযহাব, তরীকা, দেশ, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যই তাঁদের জীবনের আলো দরকার। তাঁদের শিক্ষা সকলের জন্যই দরকার।
হুজ্জাতুল ইসলাম আবদুল কুদ্দুস বাদশা বলেন,ইমাম রেযা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ১৪৮ হিজরিতে। তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম মূসা কাযেম (আ.) আর ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ছিলেন তাঁর দাদা। তাঁর দাদা ইমাম জাফর সাদেকের শাহাদাতের ১১ দিন পর তিনি দুনিয়াতে আগমন করেন। ইমাম রেযা (আ.)-এর পাণ্ডিত্যের ব্যাপারে রাসূল (সা.)-এর ইশারা ছিল যে, একজন প্রজ্ঞাবান পুরুষ এই বংশে আগমন করবেন। ইমাম রেযা (আ.)-কে বলা হয় ‘আলেমে আলে রাসূল (সা.)’। ইমাম রেযা (আ.) মানবীয় মহৎগুণাবলির অধিকারী ছিলেন। তিনি কখনো উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেননা। পা লম্বা করে বসতেন না। খাদেম বা গোলামদেরকে সাথে নিয়ে তিনি একত্রে খেতে বসতেন। মৃদু হাসতেন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। তিনি গরীব-দুঃখীদের সহায়তা করতেন। কেউ তাঁর কাছে এলে খালি হাতে ফিরে যেতনা।
বর্তমান সময়েইরানি জাতি ইমাম রেযা (আ.)-কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এটি একটি যুগান্তকারী কাজ। ইমামদের জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করেআল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে হবে। ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারকেন্দ্রিক বিশাল কর্মসূচি রয়েছে ইরানে। ইমাম রেযা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নানা দেশে ইমাম রেযার জীবনালোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।