নওরোযের উৎপত্তির ইতিহাস
পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০১৬
তিন হাজার বছর পূর্বে আযারবাইজানের শাসক তাহমুরসের ভাই জামশীদ্ নিজ জাতির জন্য একটি ঈদ বা আনন্দের দিন নির্ধারণ করতে চাইলেন। সূর্য নতুন বর্ষে প্রবেশ করার সময় তিনি এক বিরাট মিলনায়তনে মণি-মুক্তাখচিত সিংহাসনে আসন গ্রহণ করলেন। রং-বেরংয়ের হীরা-জহরতে অলংকৃত তাজ মাথায় ধারণ করলেন এবং সাধারণ জনগণকে সাক্ষাৎ প্রদান করলেন।
সূর্য যখন মাথার উপরে এল তখন এর কিরণ নানা ধরনের মণি-মুক্তার ওপর পতিত হলে ঝলমল করছিল আর উপস্থিত সকলের চোখে বিস্ময়ের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিল। কারণ, এর আগে তারা এমন জাঁকজমক আর দেখে নি। তাই তারা ঐ দিনটিকে ‘নতুন দিন’ (রুযে নোও) বলে আখ্যায়িত করে পরস্পর পরস্পরকে অভিনন্দন জানালো। ‘জামশীদকে ঐ দিন পর্যন্ত ‘জাম্’ বলা হত। ঐ দিন তার নামের সাথে ‘শীদ্’ (অর্থাৎ সূর্যকিরণ) সংযুক্ত হল।
জামশীদ্ জনগণকে সদুপদেশ দিলেন এবং তাদেরকে উত্তম অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য আহবান জানালেন ও ঐ দিনকে জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে নির্ধারণ করে দিলেন।
আভেস্তা-য় নওরোয
‘জাম্’ (উৎসব) কথাটির উৎপত্তি ‘ইয়াসনে’ অথবা ‘ইয়াসনা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ইবাদত, দোয়া ও আনন্দ। কারণ, নওরোযের অনুষ্ঠানে আনন্দসহকারে ইবাদত করা হয়।
যরথুস্ত্রীদের ধর্মগ্রন্থ ‘আভেস্তা’য় বলা হয়েছে যে, আহুরমায্দা বিশ্ব ও সৃষ্টিকুলকে কালের ছয় পর্যায়ে সৃষ্টি করেছেন :
১. বছরের পঁয়তাল্লিশতম দিনে (১৫ই ওর্দিবেহেশ্ত্) আকাশ সৃষ্টি করা হয়; এটাই সৃষ্টির শুরু।
২. বছরের একশ পঞ্চাশতম দিনে (১৫ই তীর্) পানি সৃষ্টি করা হয়।
৩. বছরের একশ আশিতম দিনে (৩০শে শাহরীভার্) ভূমি সৃষ্টি করা হয়।
৪. বছরের দুইশ দশম দিনে (৩০শে মেহ্র) বৃক্ষ-লতা সৃষ্টি করা হয়।
৫. বছরের দুইশ নববইতম দিনে (২০শে দেই) প্রাণিকুল সৃষ্টি করা হয়।
৬. বছরের তিনশ পঁয়ষট্টিতম দিনে (১লা ফারভারদিন্; নতুন বছরের শুরু) মানুষ সৃষ্টি করা হয় ও বিশ্বসৃষ্টির সমাপ্তি ঘটে।
আসমানী কিতাব তাওরাত ও কুরআনেও ছয় ধাপে বিশ্বসৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দৃষ্টিতে বসন্ত
মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘বসন্তের মৃদু সুবাতাসকে গনিমত মনে করো। কারণ, যেরূপে তা বৃক্ষরাজিকে দোলা দেয়, ঠিক সেরূপ তা তোমাদেরকেও ছুঁয়ে যায়।’
দার্শনিক ওমর খৈয়াম, আবু রায়হান আল-বিরুনী, তাবারী ও ফেরদৌসীও নওরোয সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
ইসলামে নওরোয
ইসলাম সমস্ত গোত্রীয় রং ও রীতিকে মুছে ও পাল্টে দিলেও নওরোযকে করেছে আরও বেশি উদ্ভাসিত। ইসলামী যুগ এতে নতুন অধ্যায় যোগ করে, একে বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে যে নওরোয ইরানী জাতির প্রাণে বেঁচে ছিল তা ধর্মীয় ‘আত্মা’ লাভ করে। জাতীয় ও গোত্রীয় রীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও জনগণের অন্তরে জাগ্রত শক্তিশালী নবপ্রেমের সাথে মিশে গিয়ে দৃঢ় ও পবিত্র হয় এবং বিশেষ দোয়ার সাথে নিষ্ঠা ও ঈমানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
নওরোয ছিল যরথুস্ত্রীদের ধর্মীয় সঙ্গীত ও ‘আভেস্তা’র বাণীগুলোর সাথে সংমিশ্রিত; ইসলামের আগমনের সাথে সাথে তা নতুন জীবন লাভ করল।
ইমাম সাদেকের দৃষ্টিতে নওরোয
ইমাম সাদেক (আ.) মু’আল্লা বিন খুনাইসকে বলেন : ‘হে মু‘আল্লা! নওরোয এমন এক দিবস যেদিন মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তারা তাঁর উপাসনা করবে, তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং ধর্মের ধারক ও বাহকদের সাথী হবে। এটি এমন এক দিবস যেদিন নূহের তরী পাহাড়ের ওপর এসে স্থির হয়।’
‘এদিন সূর্য কিরণ ছড়িয়ে দেয়, বাতাস প্রবাহিত হয় এবং ভূ-পৃষ্ঠ বিকশিত হয়।’
‘এটি এমন এক দিবস যেদিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে কাঁধে তুলে নেন যাতে তিনি কাবার মূর্তিগুলো ভাঙতে পারেন। এদিন মহানবী নিজের সাহাবীদেরকে হযরত আলীর হাতে বাই‘আত হতে বলেন (গাদীর দিবসে)। এদিন লোকেরা হযরত আলীকে খলিফা নির্বাচন করেছিল।’
‘এটি এমন এক দিবস যেদিন মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশের কায়েম ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত করুন) আত্মপ্রকাশ করবেন এবং দাজ্জালের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন ও তাকে হত্যা করবেন। এ দিন মুসলমানদের মুক্তি ও নিশ্চিন্ততার দিন।’
প্রকৃতির নবায়নের দিন
নওরোয এক মহান স্মৃতির স্মরণ, প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মীয়তার স্মৃতিচারণ। মানুষ নামক প্রকৃতির আত্মভোলা সন্তানেরা নিজ নিজ কাজে ডুবে থাকে আর প্রকৃতি-মাতাকে ভুলে যায়। মধুময় বসন্তের আগমনে তারা মাতৃক্রোড়ে ফিরে আসে এবং তাদের ফিরে আসা ও পুনর্মিলন উপলক্ষে উৎসবে মেতে ওঠে।
সন্তান নিজ মায়ের আঁচলে পুনরায় স্থান পায়। মা তার সন্তানদের কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয় আর আনন্দাশ্রু (বৃষ্টি) বর্ষণ করে, যৌবন ফিরে পায় আর নবজীবন লাভ করে, নব কিশলয়ের আগমনে ঘটে, বৃক্ষে সবুজের ছোঁয়া লাগে। তারা প্রিয়জনের সাক্ষাতে দৃষ্টিমান ও জাগ্রত হয়। দিন হয় নির্মল, আকাশ হয় মেঘমুক্ত।
অনুবাদ: মাঈন উদ্দিন