বুধবার, ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

নওরোজ, ফারসি সাহিত্যে অনুপ্রেরণাদায়ক ইরানি আচার অনুষ্ঠান

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ২১, ২০২৩ 

news-image

সাইয়্যেদ রেযা মীরমোহাম্মদী : ঈদে নওরোজইরানি সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য ও আচার অনুষ্ঠান যা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। তবে এই আচার অনুষ্ঠানটি এতো দীর্ঘকালের পুরনো হলেও কোন বিস্মৃতি  বা বার্ধক্যের ছাপ এর চেহারায় দেখা যায় না। বরং এটি এখনও আনন্দনতুনত্ব ও পুনরুজ্জীবনের বার্তাবাহক। ইতিহাসজুড়ে নওরোজের দীর্ঘায়ু ও টেকসই হওয়ার রহস্যও নিহিত রয়েছে এই আনন্দ ও নতুনত্বের বার্তার মধ্যে যা  মানবের আত্মা ও সহজাত প্রবৃত্তির সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে এবং গৌরবময় এই ঐতিহ্যকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।

নওরোজ হলো ঋতুরাজ বসন্তের সূচনা এবং প্রকৃতির পুনরুজ্জীবন। সতেজতা ও নতুনত্বের প্রতি মানুষের যেহেতু একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে তাই  বসন্ত ও প্রকৃতির সতেজতা মানুষের অস্তিত্বে সতেজতা ও পুনরুজ্জীবনের প্রেরণা যোগায়। এ কারণেই বসন্তের আগমন  এবং নওরোজের  এই  সৌন্দর্য ও মোহনীয়তা সর্বদা ইরানিদের যেমন আকৃষ্ট করছে তেমনি ফারসি কাব্য-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রেখে চলেছে বিশেষ অবদান। বার্তাবাহী ও অনুপ্রেরণাদায়ক নওরোজ বিভিন্ন দিক থেকে ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত ও মহান ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং বলা যেতে পারে সকল ফারসি কবি ও সাহিত্যিক প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ও বার্তাবাহি ও প্রেরণাদায়ক নওরোজকে তাদের লেখনিতে ও সাহিত্যকর্মে তুলে ধরেছেন।  তুস নগরীর বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক ফেরদৌসি তাঁর ‘শাহনামা’ কাব্যগ্রন্থের সিয়ভাস গল্পে সর্বকালের মানুষের জন্য নওরোজ বা নতুন দিন কামনা করে কাব্য রচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন..

প্রতি বছর তোমার ভাগ্যের হোক জয়

তোমার সারাটা জীবন হোক শুভ নওরোজ

এই কবিতায় নওরোজকে সুখ ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে মানুষের সারাজীবনের ও বছরের প্রতিটি দিনের  শুভ কামনা করা হয়েছে। এটি অন্যের জন্য সৌভাগ্য কামনা করার রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। শেখ সাদী শিরাজীও নওরোজকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং বলেছেন:

ভোরের স্নিগ্ধ সমীরণ নিয়ে এলো নওরোজের সুঘ্রাণ

আমার প্রিয়জনের জন্য তা নিয়ে আসুক সৌভাগ্যের বারতা

আশীর্বাদে পূর্ণ হোক তোমার এ বছর ও প্রতিটি বছর,  

সমৃদ্ধ হোক তোমার আজকের এই দিন ও প্রতিটি দিন।

শেখ সাদী তার এই কবিতায় নওরোজের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মানুষের প্রতিটি দিন নওরোজের মতো সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠকু এই কামনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই কবিতায় নওরোজ সম্বন্ধে সাদীর দৃষ্টিভঙ্গি কবি ফেরদৌসির  দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ এবং এই দিনটি একটি শুভ ও বরকতময় দিন হিসেবে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিনের সমৃদ্ধি কামনা করা হয়েছে।

মৌলানা রুমি তার দেওয়ানে শামস-এ নওরোজ সম্পর্কে  জ্ঞানতাত্ত্বিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন এবং নওরোজকে সৃষ্টিকর্তার বাণির নিদর্শন ও এমনকি খোদার অস্তিত্বের নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন।  

তিনি তার কবিতার ছন্দমিল করেছেন মাতালপ্রেমতারুণ্য এবং আমাদের বন্ধু এই অভিধাগুলো দিয়ে। যার মাধমে তিনি মূলত নওরোজ ও বসন্তের সূচনাকে মেষ রাশির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বসন্ত ও প্রকৃতির নতুন প্রাণের সঞ্চারকে আল্লাহর প্রদত্ত বলে মনে করেন এবং বলেন,  

টিউলিপ আর তুলসীর পাতাগুলো আজ পেলো পানপেয়ালার আকৃতি

আমার রব ব্যতীত এমন অনন্য শোভার কারিগর আর কে হতে পারে?  

কবিতার এই লাইন দুটির ধারাবাহিকতায় তিনি অপর দুটি চরণে বলেন

লিলি ফুল বললো কানে গুল্মলতাটিরে

রবের ছায়া থেকে যেন না যাই কভু সরে।

কবি শেখ সাদীও তার একটি চমৎকার গজলের প্রথম স্তবকে নওরোজ সম্পর্কে একই মারেফাতি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন এবং নওরোজকে এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার উপহার (সৃষ্টি) হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন,  

পূবাকাশের সূর্যোদয় আর দখিনা বাতাসে নওরোজের ভেসে আসা ঘ্রাণ

প্রকৃতির এই অপরূপ রূপেসৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে আমার প্রাণ

নওরোজের অনুপ্রেরণা এবং বসন্তে প্রকৃতির পুনরুজ্জীবন মানুষের অন্তরকেও পুনরুজ্জীবিত করে এবং প্রকৃতির এই পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে অর্থপূর্ণ ও শিক্ষণীয় বার্তা কবি হাফেজ শিরাজির কবিতায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ফারসি সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র তার একটি চমৎকার গজলে বলেন:

বন্ধুর গলি থেকে নওরোজের মৃদু বাতাস ভেসে আসছে

যদি এই বাতাসের সাহায্য নাওতবে তা তোমার হৃদয়কে আলোকিত করবে

মরুসাহারায় ঝেড়ে ফেলে এসো হৃদয়ে জমে থাকা সব ধুলো 

আর ফুল বাগানের বুলবুলির কাছে শিখে নাও হৃদয়কাড়া গান।  

হাফেজ এই কবিতায় মানুষকে বসন্তে প্রকৃতির পুনর্জন্মকে অনুকরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন  এবং  প্রকৃতির মতো নিজের দুঃখ ও ধূলিকণা দূর করে হৃদয় ও আত্মায় আলোর প্রদীপ জ্বালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।  

আমীর খসরো দেহলাভীও তার কবিতায় বলেন,  

অন্তরকে পরিষ্কার করার একটি  কারণ বা বাহানা তুলে ধরে ঈদে নওরোজ। নতুন দিনের আগমন ও বসন্তের সূচনায় প্রকৃতি যেমন নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে নতুন জীবন লাভ করে তেমনি মানুষেরও উচিত প্রকৃতির এই অর্থপূর্ণ ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্তরের ঘরকে ঝাড়া দেওয়া ও স্র্রষ্টার বিরোধী  বিশ্বাস থেকে নিজের অন্তরকে পবিত্র করা। তিনি তার কবিতায় চমৎকারভাবে বলেছেন,  

তোমার নাম ছাড়া আর কারো নাম আমি ডাকি নি

তোমাকে ছাড়া আর কারো সাথে থাকি নি

নওরোজের এই শুভক্ষণেসব করেছি সাফ 

শুধু তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই রাখি নি। 

ফারসি কাব্য-সাহিত্যে বসন্তের আগমন ও নওরোজের অন্যান্য বার্তার মধ্যেও রয়েছে কঠিন ও ক্লান্তিকর দিনগুলো কেটে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। শীতকাল তার একটি রূপক। প্রতিটি কঠিন ও কষ্টকর সময়ের পর মানুষের জীবনে যেমন অপেক্ষা করে সুখ ও আনন্দময় দিনগুলি। এই দিক থেকে বলা যায়নওরোজ আগামী দিনের আশার বার্তা নিয়ে আসে এবং মানুষকে আশাবাদী হতে আমন্ত্রণ জানায়। নিচের কবিতার লাইন গুলোতে কবি সাদী শিরাজী নওরোজের এই অর্থ ও উপলব্ধি চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করেছেন।

বিদায় নিচ্ছে শরৎ-বসন্তবিষণ্নতা রয়েছে ঘিরে

পাপিয়াকে বললাম- দুঃখ কোরো না’  

নওরোজের দিনটিউলিপ 

আর তুলসীর দিনআবারও আসবে ফিরে 

উপরের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে নওরোজ সম্পর্কে যেসব অর্থ ও ধারণা পাওয়া গেল তা  ফারসি কাব্য সাহিত্যের মহান ব্যক্তিদের নওরোজ সম্পর্কে গভীর ধারণা ও অনুপ্রেরণার উহাদরণ। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় বসন্তের আগমন এবং নওরোজ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও  এর একটি ধর্মতাত্ত্বিক দিকও রয়েছে এবং এটি আল্লাহর নিদর্শনের একটি।

ঋতুরাজ বসন্ত এবং নওরোজের পরিপূর্ণ ধারণা নিতে বলা যায়,  প্রাকৃতিক এই ঘটনাটি পুনরুত্থানের একটি অনুস্মারক এবং  প্রকৃতি যেমন শীতকালীন মৃত অবস্থা থেকে বসন্তে পুনরুজ্জীবিত হয় মানুষও  তেমনি মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবিত হবে এবং যে জীবনের কোন শেষ নেই এবং এই জীবন অনন্তকালের (চিরন্তন )। মানুষের চিরন্তনতা সেটাই যা মানুষের সত্তাকে অর্থপূর্ণ করে এবং তার জীবনকে উদ্দেশ্যপূর্ণ করে।

এই নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে এসে এটি না বললেই নয় যেনওরোজের প্রচলিত কিছু রীতিনীতি রয়েছে যেমন ঘর ও আসবাবপত্র  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা,  নতুন জামাকাপড় পরাএকে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করাউপহার ও ঈদি দেয়া ইত্যাদি যা ইসলাম সমর্থিত এবং ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় এ ধরনের বিষয় ও কাজের সুপারিশ করা হযেছে। কেননাو এটি মানবিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে এবং বন্ধুত্ব ও উদারতা বৃদ্ধি করে।

 

লেখক:  কালচারাল কাউন্সেলর

সাংস্কৃতিক কেন্দ্রইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসঢাকা।