তেহরান : প্রাচীন গ্রাম আধুনিক নগরী
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৬, ২০১৩
ইরানের রাজধানী তেহরানের বয়স দুই শত বছরের বেশি। কিন্তু ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এর আকৃতি ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং তাতে পাশ্চাত্যের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান ছিল। মোটামুটিভাবে এককালে তেহরানের পরিবেশ ও ভাবধারা ছিল প্রাচ্যের একটি মফম্বল শহরের মতো।
ইতিহাসবিদরা ইরানের বর্তমান রাজধানীকে নবম শতাব্দীকালের একটি ছোট গ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু গ্রামটি কালক্রমে তার পার্শ্ববর্তী আলবুর্জ পাহাড়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর- শাহরে রে-এর সাথে একীভূত হয়ে পড়ে। মোঙ্গল শাসকদের ব্যাপক ভাঙাগড়ার মধ্যে তেহরান ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে যেসব লোক বেঁচে যেতে সক্ষম হয় তারা তেহরানে চলে আসে। প্রকারান্তরে বহু বছর ধরেই তেহরান একটি প্রাদেশিক শহর হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে।
বিশ্বের সর্বাধিক বিখ্যাত শহরগুলো সম্পর্কে লেখা ইয়াকুত হামারীর সুপরিচিত গ্রন্থ মুজামুল বুলদানে ইরানের রাজধানী সম্পর্কে বেশ কিছু মজার কথা লেখা রয়েছে। বলা হয়েছে : তেহরান ছিল একটি বৃহৎ গ্রাম, যার কাঠামো নির্মিত হয়েছে ভূগর্ভে এবং বাসিন্দারা অনুমতি না দিলে কেউ ঐ গ্রামে প্রবেশ করতে পারত না।
তেহরান কিভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং ধীরে ধীরে আজকের এই বড় শহরে রূপ নিল? জানা গেছে, ঐ অঞ্চলের তদানীন্তন শাসক শাহ ইসমাইলের পুত্র শাহ তাহমাসব সাফাভী যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। তিনি প্রায়ই সাফাভী রাজবংশের শাসকদের প্রথম রাজধানী কাজভীন বেড়াতে যেতেন। এছাড়া তাঁর প্রপিতামহ মরহুম সাইয়্যেদ হামজার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রে শহরস্থ শাহ আবদুল আজিমে যেতেন। ফেরার পথে তিনি তেহরান হয়ে যেতেন এবং শিকার করতেন। ধীর ধীরে তিনি সে স্থানটির বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং ঐ শহরের চারদিকে দুর্গ প্রাচীরের মতো বেষ্টনী গড়ে তোলেন। দুর্গ প্রাচীরটির পরিধি ছিল পনের হাজার ফুট।
বাদশাহর ধর্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা সংখ্যার সাথে সমাঞ্জস্য রেখে নগরীর চারিদিকে ১১৪টি টাওয়ার নির্মাণের আদেশ দেন। নির্মিত প্রতিটি টাওয়ারে পবিত্র কুরআনের এক একটি সূরা লিপিবদ্ধ করা হয় যাতে ঐ শহর এবং শহরের বাসিন্দারা দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পায়। এছাড়া নির্মাণ করা হয় দু’টি তোরণ এবং দুর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরস্থ দু’টি জায়গা থেকে মাটি সরিয়ে দু’টি গহ্বর সৃষ্টি করা হয়। গহ্বর দু’টির একটির নাম দেয়া হয় ‘চালে ময়দান’ (স্কোয়ার গহ্বর) এবং অপরটির নাম দেয়া হয় ‘চালে হেসার’ (দুর্গ গহ্বর)। আজকের দিনে ঐ গহ্বর দু’টি ভরাট হয়ে গেলেও ঐ জায়গাগুলোর নাম পূর্ববতই রয়ে গেছে।
কাজার শাসনামলের বিশিষ্ট লেখক ও রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ মোস্তাফী তাঁর ‘দি স্টোরি অব মাই লাইফ’ গ্রন্থে লিখেছেন, তাহমাসব প্রাচীর ধ্বংস এবং শহরটি বেড়ে উঠলে পর কাজার শাহীবংশের প্রতিষ্ঠাতা আগা মুহাম্মদ খান নগরীর চারিদিকে একটি নতুন দেয়াল নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর অভিষেকের দিন ১৭৮৩ সালের ২১ মার্চ তেহরানকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তখন তেহরানের লোক সংখ্যা ছিল মাত্র দশ থেকে বিশ হাজার।
১৯২৫ সালে রেজা শাহ ক্ষমতায় আরোহণ করে তেহরানকেই দেশের রাজধানী হিসাবে বহাল রাখে এবং শহরটিকে আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা চালায়।
১৯৪৫ সাল থেকে তেহরান শহর উত্তরদিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। আলবুর্জ পাহাড়ের পাদদেশে তেহরান ও শেমিরানের মধ্যবর্তী সমস্ত মরু এলাকায় নতুন নতুন উপশহর সৃষ্টি হতে থাকে।
পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে উপশহর ও বড় বড় দালান-কোঠা গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে তেহরান একটি বিভিন্নমুখী আধুনিক মেট্রোপলিটন শহর হিসাবে বেড়ে উঠতে থাকে। দক্ষিণে মরুভূমি ও পতিত জমি অঞ্চলে আবহাওয়া অতি উষ্ণ থাকায় নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়নি। তবে ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং বিশেষ করে দ্রুত নগরায়ণের প্রয়োজনীয় ইট ও অন্যান্য সামগ্রীর কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলে ব্যাপক শিল্প চুল্লীর দরুন বায়ূ দূষিত হয়ে পড়ে এবং সেখানে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাত্রা খানিকটা অসুবিধাজনক।
এই অবস্থার মধ্যে প্রাদেশিক শহর এবং অন্যান্য মফস্বল এলাকা থেকে হাজার হাজার লোক নির্মাণ কাজে অংশ নিতে এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় ব্যবসা ও শিল্পখাতে আকৃষ্ট হয়ে তেহরান শহরের দিকে ঝুঁকতে থাকে।
নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তেহরান শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার নগর কর্তৃপক্ষের পক্ষে সকল লোকের গৃহসংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। তেহরান শহরের বর্তমান সৌন্দর্য-শোভা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার সংমিশ্রণ এবং জীবনযাত্রার বহুমুখী সুযোগ-সুবিধার দরুন সকলে সহজেই তেহরানের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। খুব শীঘ্রই তেহান হয়ে ওঠে একদিকে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অপরদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গতিশীল কেন্দ্র। তৈরি হয় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এভাবে তেহরান কেবল দেশের অভ্যন্তরে নয়, গোটা বিশ্বের মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ আসন করে নেয়। ইউরোপীয় শহরগুলোর মতো তেহরানেও সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হয়।
খোলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হাজার হাজার ছাত্র আসে মফস্বল এলাকা থেকে। অর্থশালী পরিবারগুলো আরো ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তাদের ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার সুবিধার্থে তেহরানে এসে বসবাস করতে শুরু করে।
বিগত চার দশকে তেহরান বিশ্বের একটি দ্রুত বর্ধমান রাজধানী শহরে পরিণত হয়েছে। এটি এমন একটি শহর যেখানে প্রতিবছরই ব্যাপক হারে লোক আসছে বসবাস করতে এবং এর বাসিন্দাদের যা চাহিদা তা পূরণ করা কর্তৃপক্ষের জন্যে অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতসবের মধ্যে দ্রুত উন্নয়নের প্রমাণ মিলে প্রায় সর্বত্র। নজরে পড়ে গগনচুম্বী অট্টালিকা, প্রশস্ত জনপথ, বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান-পাট, সিনেমা হল, বাড়িঘর এবং সেগুলোর সাথে ঘোরানো পেঁচানো রাস্তা আর রাস্তায় রাস্তায় দ্রুত ধাবমান যানবাহন। ত্রিশ বছর আগে এই শহরের আকৃতি যা ছিল তার তুলনায় বর্তমান আকার পাঁচগুণ।
তেহরান শহরে লোকসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় তুলনামূলকভাবে বাড়ি ঘরের সংখ্যা কম। তাই ভাড়া বেড়ে গেছে এবং আশেপাশের জমির দামও বেড়ে গেছে। তাই চাহিদা পূরণের জন্য মূল শহরে নির্মাণ কাজের ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
শহরের আশে পাশে গড়ে উঠেছে অনেক উপশহর। কিন্তু জনসাধারণ তাদের প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বাড়ি ঘর গড়ে নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, জাপানের রাজধানী টোকিওর পর এখন তেহরানই বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল শহর। এখানে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মোটরগাড়ি আর বিপুল সংখ্যক কল-কারখানা। পরিস্থিতি এমন যে, যানবাহন চলাচলের ভীড় এড়ানোর জন্য সরকারকে একটি নয়া ট্রাফিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। এই পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী বাসসমূহের টার্মিনালসমূহ নগরীর কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং নির্ধারিত ট্রাফিক জোনগুলোতে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত বেসরকারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাই আজ তেহরান একটি মেট্রোপলিটন শহর। সরকার এর উন্নয়নে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯২২ সাল পর্যন্ত যে শহরে কোন মেয়র ছিল না সেই শহরকে সুশৃঙ্খল করে গড়ে তোলার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে সযত্ন পৌর পরিকল্পনা।
পরিবেশ রক্ষার জন্য তেহরান পৌরসভা ইতিমধ্যেই অর্থাৎ ১৯৯১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে পূর্বের পনের হাজার হেক্টরের স্থলে ২৫ হাজার হেক্টর জমিকে রাজধানী শহরের গ্রীন-বেল্ট হিসাবে গড়ে তুলেছে।
চলতি পাঁচসালা পরিকল্পনায় প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মসূচিতেই রয়েছে তেহরানের পয়ঃনিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে রয়েছে রাজধানীর আট হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু এবং উত্তর ও দক্ষিণ তেহরানে দু’টি বিশাল আকৃতির পয়ঃনিষ্কাশন লাইন স্থাপন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তেহরান, কারাজ, ভারামিন ও শাহরিভারের খামার জমিতে ব্যবহার উপযোগী একশা কোটি ঘনমিটার নিষ্কাশন লাইন প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্যে ২৫ কোটি ডলার ও ৮০ কোটি রিয়াল ব্যয় সাপেক্ষ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলা হয়েছে, তেহরানে প্রতি বছর ৬০ কোটি ঘনমিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি এবং নগর উন্নয়নের ফলে প্রয়োজনীয় খাবার পানির চাহিদা মেটানোর জন্যে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আরো ১৫ কোটি ঘন মিটার পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া জনসাধারণের বিনোদন সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান পার্কগুলোর উন্নতি সাধন নতুন একটি পার্ক প্রতিষ্ঠা এবং একশ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।
(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯২)