তরুণ সমাজ কারবালা সম্পর্কে জানে না
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৫, ২০১৫

‘আর ঘোষণা করে দাও! সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হওয়ারই কথা।’ (বনি ইসরাঈল, ১৭:৮১।)
হিজরি ৬১ খ্রিস্টাব্দে ১০ মহররম ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে পাপিষ্ঠ এজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুসলিম উম্মাহকে শিখিয়েছেন- ‘বাতিলের সামনে মাথা বিলিয়ে দেব, ঈমান বিকিয়ে দেব না।’ সেদিন রাজতন্ত্রের জনক কুখ্যাত এজিদের কাছে বায়াত গ্রহণ না করার ফলে যুগ যুগ ধরে বিশ্ব মুসলমান ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক’ হিসেবে স্মরণ করছে ইমাম হোসাইনকে (রা.)।
কোরআনের পরিবেশে বেড়ে ওঠা ইমাম হোসাইন (রা.) খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছেন, এজিদের দাবি মেনে নেয়া মানে হল ন্যায়-ইনসাফ ও তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খেলাফতের কবর রচনা
করা এবং স্বৈরাচার-জুলুমবাজ শাসনের পত্তন ঘটানো। পাপিষ্ঠ এজিদের ক্ষমতারোহণের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের যে বিষবৃক্ষ রোপণ হয়েছে, তার সুদূরপ্রসারী ফল আজ বিশ্ব মুসলমান ভোগ করছে। নিরাপত্তার জন্য আজ হাহাকার চলছে স্বয়ং নিরাপদ নগরী মক্কায়। শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হয়েও অশান্তির আগুন জ্বলছে বিশ্ব মুসলমানদের ঘরে ঘরে। লাঞ্ছনা আর অপমানের বেড়ি ঝুলছে প্রত্যেক মুসলমানের গলায়। তবুও ঘুম ভাঙছে না কোরআন ভুলা, কারবালা ভুলা মিল্লাতে ইবরাহিম উম্মতে মুহাম্মাদীর।
যে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নবী পরিবারে দুগ্ধপোষ্য শিশু পর্যন্ত জীবন দিল, মুসলমানরা আজ সে সত্য ভুলে গিয়ে শিয়া-সুন্নিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইমাম হোসাইন শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য ন্যায়ের প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। বিশ্বের সব ধর্ম-বর্ণের সত্য প্রেমিকদের আদর্শ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের প্রেরণা ইমাম হোসাইন (রা.)। কিন্তু হায়! ইমামের জীবন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শাহাদাতের তাৎপর্য সম্পর্কে জানে না ইমামের অনুসারী দাবিদার মুসলমান। ইমামের সঙ্গে জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্নচারী তরুণ বন্ধু জানে না সেদিন কী ঘটেছিল কারবালার প্রান্তরে। রাজনীতির কালো থাবায় ছাত্রজীবন শেষ করা যুবক যদি জানত, ফোরাত নদীর তীরে সত্য-সুন্দর ও ন্যায়ের রাজনীতি অপেক্ষা করছে তার জন্য। নেশায় বুঁদ হওয়া হতাশাগ্রস্ত তরুণ যদি জানত, তাকে ভালোবেসে নবীর দুলাল জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। তবে দৃঢ় বিশ্বাস, তরুণ-যুবকদের সার্বিক জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হতো। তরুণরা ফিরে আসত ধর্মের নেতৃত্বে। দেশ পরিচালিত হতো ন্যায়ের ভিত্তিতে। শান্তির পায়রা খুঁজে পেত আপন নীড়। মুসলমান আবার হয়ে উঠত প্রকৃত বীর।
জান্নাতি যুবকদের সর্দার আপসহীনতার প্রতীক ইমাম হোসাইনের ত্যাগ ও আদর্শ প্রত্যেক তরুণ হৃদয়ে কীভাবে জাগ্রত করা যায়? তরুণদের কীভাবে হোসাইনি চেতনায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে গড়ে তোলা যায়? হোসাইনি নৌকায় তরুণদের কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করা যায়- এসব বিষয়সহ মহররম ও আশুরার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছি দেশবরেণ্য একজন হোসাইনপ্রেমী ইসলামী চিন্তাবিদের সঙ্গে।
ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান
অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশ্ন : আজকের তরুণ ইমাম হোসাইনের ত্যাগ-আদর্শ ও শাহাদাতে কারবালা সম্পর্কে জানে না- এর কারণ কী?
উত্তর : ইতিহাসের কলংক ও রাজতন্ত্রের জনক পাপিষ্ঠ এজিদ বাহিনী কর্তৃক নবী পরিবারের সদস্যদের শাহাদাত লাভের নির্মম-মর্মান্তিক ইতিহাস যুগ যুগ ধরে শিক্ষিত সমাজ এবং সচেতন নাগরিকদের ভুলিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে এজিদের উত্তরসূরিরা ইতিহাস বিকৃতির এই ঘৃণ্য কাজটি করে আসছে। বর্তমান বিশ্বের আরব রাষ্ট্রগুলো রাজতন্ত্রের নামে এজিদি শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা আলেম বেশধারী ধর্ম ব্যবসায়ীরা এজিদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এসব নামধারী আলেমদের চটকদার কথায় তরুণ সমাজ প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে তারা কারবালার প্রকৃত ইতিহাস এবং হোসাইনি আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারছে না।
প্রশ্ন : যুব সমস্যা মোকাবেলায় শাহাদাতে কারবালা এবং ইমাম হোসাইনের জীবনাদর্শের ভূমিকা কতটুকু?
উত্তর : সত্য-ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানব জাতিকে চির উন্নত করে গড়ে তোলায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। অসত্য-অসুন্দরের কাছে সত্য-সুন্দর কখনও মাথা নত করে না, বায়াত গ্রহণ করে না- এ ছিল হোসাইন (রা.)-এর কালজয়ী আদর্শ। শত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পরও হোসাইন (রা.) তার আদর্শ থেকে এক চুল পরিমাণ বিচ্যুত হননি। আজকের যুব সমাজ অন্যায় ও অসুন্দর পরিহার করে হোসাইনি রং ধারণ করতে পারলে যুব সমস্যা মোকাবেলায় শতভাগ সফলতা আসবে।
প্রশ্ন : আপনি কী মনে করেন, শাহাদাতে কারবালার শিক্ষা ও ইমাম হোসাইনের আদর্শ চর্চার মাধ্যমেই দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব?
উত্তর : প্রথমেই এমন বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসন যদি ইমাম হোসাইনের ত্যাগ-আদর্শের আলোকে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, জনগণের অধিকারের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ হন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করার নীতি গ্রহণ না করেন, দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন, তবে অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
প্রশ্ন : মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ সম্পর্কে আমাদের সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে- এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে চাই।
উত্তর : ‘বিষাদ সিন্ধু’ মীর মশাররফ হোসেনের অসাধারণ সাহিত্যকর্ম। এটিকে সাহিত্যের মাপকাঠিতেই বিচার করেত হবে। কোরআন-হাদিস বা ইতিহাসের আলোকে বিচার করা কিংবা এর সত্যতা যাচাই করা ঠিক হবে না। কারবালার বিভৎসতা ও নিষ্ঠুরতা বুঝানোর জন্যই সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনা করেছেন। সূত্র: যুগান্তর