রবিবার, ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ঢাকায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪ 

news-image

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ (১২-১৭ রবিউল আউয়াল) উপলক্ষে শনিবার বিকেলে রাজধানী ঢাকায় এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল অডিটোরিয়ামে আয়োজিত আলোচনা সভায়  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।  বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশিঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান ও সাবেক জেলা দায়েরা জজ আলহাজ মো. ইসমাইল মিয়া।ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মাদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা লুৎফর রহমান। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে নাতে রাসুল পরিবেশন করেন শিল্পী শাহনাওয়াজ তাবিব।অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্বারী আহমদ বিন ইউসুফ আল আজহারী।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের  উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেনআমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই। তিনি বলেনমুসলিম উম্মাহ যদি একত্রিত হতে পারে তাহলে নতুন পৃথিবী উপহার দিতে পারবে। ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে আল-আকসা উদ্ধার করতে সমর্থ হবে। মুসলিম বিশ্বে আমাদের সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। আমরা যদি এই সমস্ত সম্পদ বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহার করতে পারি তাহলে মুসলিম বিশ্ব নতুন শক্তি নিয়ে জেগে উঠবে।

ধর্ম উপদেষ্টা বলেনহযরত মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন তিনি ছিলেন মানবতার ও সমগ্র বিশ্বের নবী। তিনিই প্রথম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রায় এক হাজার ৪০০ বছর পূর্বেই তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগমনের পূর্বে পৃথিবীতে মানুষের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম ঘোষণা করেনআরবের ওপর অনারবের কিংবা অনারবের ওপর আরবেরসাদার ওপর কালোর কিংবা কালোর ওপর সাদার বিশেষ কোন মর্যাদা নেই। পৃথিবীর সব মানুষ সমান এবং আল্লাহ ভীতিই একমাত্র শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড। ধর্ম উপদেষ্টা আরো বলেনমহানবী (সা.) এর আগমনের পূর্বে নারীদের কোন সম্মান ও মর্যাদা ছিলো নাবরং তাদেরকে সকল অনিষ্টের মূল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেনমায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তার এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়ানবী করিম (সা.) পৃথিবীতে প্রথম যুদ্ধনীতি ঘোষণা করে বলেন, যুদ্ধের ময়দানে নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করা যাবে না এবং মন্দিরগির্জা ও প্যাগোডাতে ধর্মযাজকদেরকে হত্যা করা যাবে না। উপদেষ্টা বলেনমহানবী (সা.) যেটা বলেছেন সেটা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। এর ব্যতিক্রম কখনো ঘটেনি। তিনি সমগ্র-জীবনে ইসলামের তত্ত্বকে বাস্তবে রূপায়ণ করেছেন। আমরা যদি রাসূল (সা.) এর আদর্শ অনুসরণের করতে পারি তাহলে আমাদের ব্যক্তিগতপারিবারিকসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন আলোকিত ও মহিমান্বিত হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি বলেনমহান আল্লাহ  হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে সারাবিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন।  পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল (সা.)-কে রাহমাতুল্লিল আলামীন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রাসূল (সা.) হলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত পূর্ণাঙ্গ রহমতস্বরূপযার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তার এই রহমত তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি জীবের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বলেনকোন বিশেষ জাতি বা যুগ নয়বরং রাসুলের মাধ্যমে  প্রেরিত এই রহমতের ধারা কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য বহমান থাকবে। রাষ্ট্রদূত বলেনমহানবী (সা.) ছিলেনসর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তার চারিত্রিক মাধুর্যে মূর্তি-পূজারিরাও আকৃষ্ট হয়েছে এবং তিনি বিধর্মী কাফেরমুশরিক ও মুর্তিপূজারীদেরকে ইসলামের পতাকাতলে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজকে মুসলিম বিশ্বে যেসব বিভেদ রয়েছে তা দূর করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই রাসুলের পথ অনুসরণ করতে হবে এবং তার নির্দেশ মেনে চলতে হবে  রাসুল (সা.) সবসময় মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার উপর গুরুত্ব দিতেন তিনি বলেছেন,  “তোমরা ঐক্যের রশিকে শক্ত করে ধরো,  ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।বিশ্বের মুসলমানরা যদি মহানবী (সা.) এর এই বাণী অনুসরণ করে এবং নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে  তবেই বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যার সমাধান  সম্ভব।

অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মাদী  বলেন,  ইসলামি ঐক্য শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং কুরআনের একটি নির্দেশ পবিত্র কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার যে নির্দেশনা রয়েছে তা অনুসরণ করতে চাইলে মুসলমানদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে

তিনি বলেনফিলিস্তিন ইস্যু এবং এই ইসলামি ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বিশেষ করে গাজা উপত্যকার মানুষের দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতি আজ ইসলামি বিশ্ব ও মুসলমানদের প্রথম ও প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের সকল মুসলিম জাতি ও ইসলামি সরকারগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কয়েক দশকের এই সংকট  নিরসন করা কঠিন

সাইয়্যেদ মীরমোহাম্মাদী বলেন, ইতিহাসের এই সংকটময় মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের ও ইসলামি বিশ্বের এই ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিবাদী কর্তৃক মর্মান্তিক গণহত্যা অভিযান ইসলামি ঐক্যের উপর জোর দেওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে দ্বিগুণ করেছে  আশা করা যায় যে সমস্ত ইসলামি দেশ ও জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ইহুদিবাদীদের উপর চাপ সৃষ্টি করবে যাতে মুসলমানদের উপর ইসরাইলের দশকের পর দশক ধরে চলা বর্বর অত্যাচার ও নির্যাতনের অবসান ঘটে এবং মুসলমানরা তাদের প্রথম কেবলা আল-আকসা মসজিদে ঐক্যের কাতারে ঐতিহাসিক জামাতে নামাজ আদায় করতে পারে

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেনআইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে মানবতা যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল তখন মহান আল্লাহ তায়ালা মক্কার কুরাইশ বংশে মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে প্রেরণ করেছেন। যিনি এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর মানুষকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিলেন।মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি বলেন,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্মের মূল কাণ্ডারী হিসেবে সবার জন্য যেসব পরামর্শ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে গেছেন তাতে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করাই ইসলামি উম্মাহর ঐতিহাসিক ও অগ্রসরমাণ পথ চলার মূল কথা যা মুসলমানদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও বিভাজনকে দূর করে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম

অনুষ্ঠানে সাবেক জেলা দায়েরা জজ আলহাজ মো. ইসমাইল মিয়া তার বক্তব্যের শুরুতেই ফারসি ও উর্দু ভাষার দুটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে রাসুলের উচ্চ মর্যাদা তুলে ধরেন তিনি বলেনরাসুল (সা.) ছিলেনসর্বোত্তম চারিত্রিক ও মানবীয় গুণাবলির অধিকারীকে্উ কেউ বলেনরাসুল (সা.)আমাদের মতোই মানুষ।কিন্তু মহানবী হরত মুহাম্মদ (সা.) এবং আমাদের মত সাধারণ মানুষের মাঝে ২৭ টি স্তরের ব্যবধান রয়েছে৷ যেমন, পৃথিবীর সব ধর্মের অনুসারীরাই মানুষ বা বাশার। কিন্তু যারা রাসূলকে অনুসরণ করে  ঈমান আনল তারা হয়ে গেল মুমিন। এই মুমিনরা যখন ইবাদত করে তখন তারা হয়ে যায় আবেদ। আর আবেদ ও মুমিন যখন আল্লাহর রাস্তায় তার নিজের জান মালকে কোরবান করে দেয় তখন সে হয়ে যায় সহিহ সহির উপরে হল মুত্তাকিন এর দরজা। মুত্তাকিন এর উপরে হলো মুজতাহিদের দরজা। এরকম ২৭ টি দরজা বা স্তর রয়েছে ইসলামের এই সকল স্তর অতিক্রম করেই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হয়েছেন। তার জীবন আদর্শ পৃথিবির শ্রেষ্ঠ আদর্শ তাকে যেভাবে মর্যাদা দেয়া দরকার আমরা যদি তাকে সেই মর্যাদা দেই এবং তার জীবন আদর্শকে সঠিকভাবে মেনে চলি তাহলে বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা লুৎফর রহমান বলেনপৃথিবীর সমস্ত দ্বীনের উপর শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিজয়ী করতেই মহান আল্লাহতাআলা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেনআমরা যদি মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর জীবনী ও তার আদর্শকে ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলেই একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সবসময় ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিতেন কাজেই বিশ্বের মুসলমানরা যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর আদর্শ ও দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে নিজেদের মধ্যকার সকল মতবিরোধ দূর করে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলেই কেবল মুসলিম বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে তিনি বলেনবাংলাদেশে ইরানের বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচারণা রয়েছে। তবে আমি ইরান সফর করেছি এবং দেখেছি দেশটির বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। যা অন্য মুসলিম দেশের জন্য মডেল হতে পারে তিনি ইরানের মুসলিম জাতির একতার প্রশংসা করে বলেনইরানে ইসলামের সকল মাজহাবের অনুসারিরা যদি নিজেদের মধ্যকার সকল বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হতে পারে তাহলে আমি মনে করি এটা বাংলাদেশেও সম্ভব