জেনারেল কাসেম সোলাইমানির প্রথম শাহাদাৎ বার্ষিকী
পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ৩১, ২০২০

আমরা বিশ্বের মজলুম ও নিপীড়িতদের জন্য নিবেদিত, সাহসী ও আত্মত্যাগী অনন্য সেনানায়ক জেনারেল কাসেম সোলাইমানির কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তির (৩ জানুয়ারি) দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি। যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষায় এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং অবশেষে সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছেন।
বিশ্ববাসী সাক্ষী যে, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূলোৎপাটনের জন্য তাঁর সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন। মুসলিম দেশ ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল – যা দখল করে আইএস ঐ দেশ দু’টিকে তাদের তথাকথিত ইসলামি সরকারের ভূমি বলে ঘোষণা করেছিল – তিনি শাহাদতের সূধা পান না করা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
জেনারেল সোলাইমানি এমন এক সময় ইরাকে ইসলামি ঐক্যের দুশমনদের হামলার শিকার হন যখন তিনি ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে ইরাক সরকারের মেহমান হিসেবে বাগদাদে গিয়েছিলেন।
মেয়ে ফাতিমার কাছে জেনারেল কাসেম সোলাইমানির লেখা একটি চিঠি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বাবার প্রথম শাহাদাৎ বার্ষিকীর প্রাক্কালে ফাতিমা নিজেই তা প্রকাশ করেছেন। মেয়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বারবারই মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন।
চিঠিতে এটা স্পষ্ট-তিনি মৃত্যুর জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পবিত্র মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিলেন। জেনারেল সোলাইমানি মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আকুতি জানিয়ে চিঠির একাংশে লিখেছেন, ‘মৃত্যুর মুহূর্তটি খুবই উপভোগ্য! এই মুহূর্তটি আমার পরম ভালোবাসার। হে খোদা, আমি ৩০ বছর ধরে এই মুহূর্তটির জন্য চেষ্টা চালিয়েছি। সুপারিশকারীদের শরণাপন্ন হয়েছি। হে মৃত্যু, হে প্রিয়তম তুমি কোথায়?’ ফাতিমার কাছে লেখা সোলাইমানির চিঠিটি পড়ে মনে হলো- মৃত্যু যেন তাঁর কাছে অনন্ত সুখের হাতছানি, সুন্দর-সুরম্য বর্ণিল ঠিকানা। মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্য কেউ এভাবে আকুতি জানাতে পারে তা কাসেম সোলাইমানির বক্তব্য না শুনলে বা চিঠি না পড়লে আমি হয়তো কখনও বিশ্বাসই করতাম না। এখনও যখনই ভাবি যেকোনো মুহূর্তে আমার মৃত্যু হতে পারে। তখনি এক অজানা ভয় আঁকড়ে ধরে। মনে হয় পৃথিবীকে বিদায় জানানোর মতো কোনো প্রস্তুতিই এখনও সম্পন্ন করা হয়নি। জেনারেল সোলাইমানি অনেক আগেই সে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পবিত্র মৃত্যুর পেছনে ছুটেছেন। কিন্তু মৃত্যুই যেন তাকে ধরা দিতে ভয় পেয়েছে। মৃত্যুই যেন এই মহাবীরকে আলিঙ্গনের সাহস হারিয়ে ফেলেছিল!
কাসেম সোলাইমানি নিজের মৃত্যু বলতে সব সময় শহীদী মৃত্যুকে বুঝিয়েছেন। তাঁর ছেলে আলী রেজা গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হতো। বাবা কথায় কথায় বলতেন তিনি শহীদ হওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু শাহাদাৎ তাকে ধরা দিচ্ছে না।’ স্বামীর মৃত্যুর পর কাসেম সোলাইমানির স্ত্রী এক কবিতায় লিখেছেন, ‘সোলাইমানি শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অবশেষে তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে।’ কয়েক বছর আগে সিরিয়ার আলেপ্পোতে জঙ্গি-বিরোধী যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন ইরানের হোসেন মেহরাবি। তার মেয়ে যেইনাব মেহরাবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বাড়িতে কাসেম সোলাইমানিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। জেনারেল সোলাইমানিকে সামনে পেয়ে তাঁর হাতের আংটিটি চেয়ে বসেছিলাম। বলেছিলাম, চাচা আপনার আংটিতো বেশ সুন্দর। ওটা কি আমাকে দেবেন? আংটি তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। আংটিটি তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আংটি আমি দিচ্ছি, কিন্তু শর্ত হলো আমি যাতে শহীদ হতে পারি সেই দোয়া তোমাকে করতে হবে। যেইনাব আংটিটি নেয়ার পর শর্তের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ কারণে আবার জেনারেল সোলাইমানির কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, চাচা, এই শর্ত মেনে আংটি আমি নিতে পারব না। কারণ আপনার জন্য এ ধরণের দোয়া করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চাই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার আগে আপনি এ পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যাবেন না। জেনারেলের উত্তর ছিল, ‘মাগো আমি শহীদ হতে চাই। শাহাদাতই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা।’
২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি জেনারেল সোলাইমানির জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। শেষ পর্যন্ত পরম কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাকে ধরা দেয়। ওই ঘটনার পর এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। প্রতিনিয়তই তার জীবন ও অবদান নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ হচ্ছে।
সোলাইমানিদের মৃত্যু যেহেতু অপ্রস্তুত-মৃত্যু নয়, সে কারণে তারা শূন্যতা তৈরি করে বিদায় নেন না। তাদের মৃত্যু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণ সঞ্চারীর ভূমিকা পালন করে। সোলাইমানিদের মৃত্যু কখনো কখনো রণাঙ্গনে অফুরন্ত শক্তির উৎস হয়ে দেখা দেয়। যোদ্ধারা হয়ে উঠেন আরও বেশি নিঃস্বার্থ, বুঝতে পারেন তাদের নেতা বা কমান্ডার কেবল অধীনস্থদেরকেই সামনে ঠেলে দেননি, নিজেও জীবন দিয়েছেন।
সোলাইমানির মতো কমান্ডারেরা বিনয়েরও পরম শিক্ষা দিয়ে যান, সব সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেকে সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতে সম্মানিতবোধ করেন। সোলাইমানির কবরের পাথরখণ্ডে সৈনিক শব্দের সঙ্গে ‘বেলায়েত’ শব্দটি যোগ করে তা খোদাই করেছিলেন কবরস্থান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা তা মেনে নেননি। কারণ তিনি ওসিয়তনামায় স্পষ্টভাবে বলেছেন, নামের আগে শুধু সৈনিক লিখতে হবে, অন্য কোনো পদবী নয়। অবশেষে তাই হয়েছে। সোলাইমানির কবরে লেখা হয়েছে ‘সৈনিক কাসেম সোলাইমানি’। ওসিয়ত অনুযায়ী তার এক সময়ের অধীনস্থ ইউসুফ এলাহির পাশেই শায়িত আছেন সোলাইমানি। তাঁর সান্নিধ্যে শহীদ ইউসুফ এলাহিও এখন ইরানে এক পরিচিত নাম। ইউসুফ এলাহির পবিত্র আনুগত্য ও আত্মত্যাগের প্রতিদান হয়তো এভাবেই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এই বীর সেনানী।