মঙ্গলবার, ৪ঠা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

চোখজুড়ানো শাপলার বিল

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮ 

news-image

লাল আর সবুজের মাখামাখি দূর থেকেই চোখে পড়বে। কাছে গেলে ধীরে ধীরে সবুজের পটভূমিতে লালের অস্তিত্ব আরো গাঢ় হয়ে ধরা দেবে। চোখ জুড়িয়ে দেবে জাতীয় ফুল শাপলার বাহারি সৌন্দর্য। আগাছা আর লতাগুল্মে ভরা বিলের পানিতে ফুটে আছে হাজার হাজার লাল শাপলা। সূর্যের সোনালি আভা শাপলাপাতার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বিলের সৌন্দর্য। নৌকা কিংবা হাঁটুপানি মাড়িয়ে বিলের ভেতর ঢুকলে মনে হবে বাতাসের তালে তালে এপাশ-ওপাশ দুলতে দুলতে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে শাপলারা। সে হাসিতে বিলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আনন্দধারা।

বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম। গ্রামের নামেই বিলের নাম—সাতলা বিল। তবে শাপলার রাজত্বের কারণে সেটি এখন শাপলা বিল নামেই বেশি পরিচিত। ইতিমধ্যে বরিশালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিলের কথা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে শহরে ইট-

পাথরে বন্দি জীবন কাটানো মানুষ প্রশান্তির আশায় ছুটে আসে এ বিলে। শীত মৌসুমে পর্যটকের ভিড় বাড়ে।

পর্যটকদের প্রশান্তি বিলানো ছাড়াও এই বিল ও তার শাপলা স্থানীয়দের অন্নেরও জোগান দেয়। সম্প্রতি বিল ঘুরে দেখা যায়, আগাছা ঠেলে অনেকেই নৌকা নিয়ে বিলের গহিনে যাচ্ছে। বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছে নৌকায়। কেউ বা ব্যস্ত মাছ ধরায়। বিল থেকে শাপলা তুলে অনেকে তা বিক্রি করে স্থানীয় বাজারে। মাছ বিক্রি করেও সংসার চালায় অনেকে।

প্রায় ছয় বছর ধরে এ বিল নিয়ে কাজ করছেন আরিফুর রহমান। পেশায় সংবাদকর্মী হলেও শখ তাঁর ঘুরে বেড়ানো। সঙ্গে করে পর্যটক নিয়ে বিলে তাঁর আসা-যাওয়া নিয়মিত। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, উজিরপুরের সাতলা এবং পাশের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বিছিয়ে আছে শাপলার বিল। বিলের সঠিক আয়তন জানা নেই কারো। তবে স্থানীয়দের মতে, প্রায় ২০০ একর জমির ওপর প্রাকৃতিকভাবে বিলটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের অনেকে জীবিকার জন্য বছরের একটা বড় সময় বিলের মাছ ও শাপলার ওপর নির্ভরশীল।

বিলে ঠিক কত আগে থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে, সে তথ্যও দিতে পারেনি স্থানীয়রা। সাতলার পাশের বাগধা গ্রামের যুবক সুমন পাটোয়ারী বলেন, তাঁদের জন্মের পর থেকেই বিলে এভাবে শাপলা ফুটতে দেখছেন তাঁরা। এ বিলে তিন ধরনের শাপলা জন্মে—লাল, সাদা ও বেগুনি রঙের। তবে লাল শাপলাই বেশি। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিলে শাপলা থাকে।

সাতলা গ্রামের গৃহিণী হেলেনা বেগম বলেন, লাল শাপলার কদর থাকলেও এটি রান্না করতে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হয়। লাল শাপলা সরাসরি রান্না করার পরও কিছু কালচে রং থাকে। তাই রান্নার আগে তা সিদ্ধ করে নিতে হয়। তিনি বললেন, আগে বিলে প্রচুর শাপলা জন্মালেও এখন পলি পড়ে বিল ভরাট হতে থাকায় পানি কমে যাচ্ছে, ফলে আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে শাপলার উত্পাদন। বিলের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কারণেও শাপলা কমে যাচ্ছে।

বিলসংলগ্ন পশ্চিম খাজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা রমেশ ঘরামী তাঁর ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে প্রতিদিনই বিলের পানিতে মাছ ধরেন। তিনি জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ বড়শি পেতে তিনি মাছ ধরেন। কই, খলিশা, টাকি, শোল, পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। মাছ বিক্রি করে দিনে প্রায় ৪০০ টাকা আয় হয় তাঁর।

দক্ষিণ বাগদা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর জব্বার জানান, তিনি অন্যের জমিতে কাজ করেন। তবে শাপলার মৌসুমে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করেন। সেই টাকায় তাঁর সংসার চলে। তাঁর মতো শতাধিক পরিবার এভাবে টিকে আছে। তিনি জানান, ১৫ থেকে ২০টি শাপলার একটি আঁটি তিন থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি হয়। শাপলা বিক্রি করে দিনে তাঁর প্রায় ৩০০ টাকা আয় হয়। এ বিলের শাপলা বরিশাল, পিরোজপুর ও ফরিদপুরের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পর্যটনবিষয়ক গ্রুপ ‘বেড়াই বাংলাদেশ’-এর প্রশাসক মাহমুদ হাসান খান বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মৌসুমি পর্যাটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। বেড়াই বাংলাদেশ মূলত অজপাড়াগাঁয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটক টানতে কাজ করছে। শাপলা বিলের স্থিরচিত্র দেখে অনেকেই সেখানে যাচ্ছে। – কালের কণ্ঠ।