রবিবার, ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব (পর্ব-৫)

পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৩১, ২০২০ 

news-image
হযরত ইমাম হুসাইন (আ)’র কালজয়ী মহাবিপ্লব নানা কারণে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে এবং এইসব কারণে এই মহাপুরুষ ও তাঁর সঙ্গীরা মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ভালবাসা আর শ্রদ্ধার অক্ষয় আসন করে নিয়েছেন। এই কারণগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আন্তরিক চিত্তে যথাসময়ে জরুরিতম দায়িত্বটি পালন করা ও এ জন্য নিজের সন্তান ও জীবনসহ সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার মত সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার।
 
ইমামের অতুলনীয় বীরত্ব, সাহসিকতা ও আপোসহীনতাও এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ইয়াজিদের মত বর্বর ও নিষ্ঠুর শাসকের আনুগত্য অস্বীকারের পরিণতি কি হতে পারে তা ভেবে যখন অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব আতঙ্কিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন অথবা আপোস বা নীরবতার পথ ধরেছিলেন তখন ইমাম হুসাইন (আ) প্রকাশ্যেই এই চরম জালিম ও তাগুতি শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জনগণকে জাগাতে সচেষ্ট হন। এ সময় ইমামের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক সাহাবি ও এমনকি তাঁর এক সৎ ভাইও বিপ্লবী তৎপরতা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁকে।
 
ইসলাম এ কথা বলে না যে, কেউ অন্যায়ভাবে তোমার এক গালে চড় মারলে তুমি আরেক গাল পেতে দাও! যখন যুদ্ধ করার দরকার তখন যুদ্ধ করতে বলে ইসলাম এবং যখন পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে যুদ্ধ-বিরতি বা কৌশলগত শান্তি প্রতিষ্ঠার দরকার তখন তাও করতে বলে। আমরা জানি যে শহীদ-সম্রাট ইমাম হুসাইনের বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান (আ) মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতি বা কৌশলগত সন্ধি করেছিলেন! অনেকেই প্রশ্ন করেন: বড় ভাই যা করেছিলেন মুয়াবিয়ার সঙ্গে ছোট ভাই কেন তা করলেন না ইয়াজিদের সঙ্গে! এর উত্তর হল: মুয়াবিয়ার যুগের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও ইয়াজিদের সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতি মোটেই এক ধরনের ছিল না। ইয়াজিদ যেভাবে প্রকাশ্যে ইসলামের অবমাননা করে লাম্পট্যময় জীবন যাপন করতেন মুয়াবিয়া অন্তত প্রকাশ্যে তা করতেন না বা এ ব্যাপারে মুয়াবিয়ার কুখ্যাতি ইয়াজিদের মত অত ব্যাপক ও সর্বজনবিদিত ছিল না। ইয়াজিদ প্রকাশ্যে মদপান করত এবং নর্তকী, বানর ও কুকুর নিয়ে প্রকাশ্যেই অনাচার করত।
 
ইয়াজিদ ও মুয়াবিয়ার শাসনামলের পরিবেশ তথা ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের ইমামতের যুগের আরেকটি বড় পার্থক্য হল: ইমাম হাসান মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে পিতা হযরত আলীর মতই যুদ্ধ অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সেনাদের উৎসাহ দিতে তিনি তাদের বেতন ১০০ শতাংশ বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেছে যে সেনারা আর যুদ্ধ করতে উৎসাহী ছিল না এবং এমনকি তার প্রধান সেনাপতিসহ শীর্ষস্থানীয় সেনা-কর্মকর্তারা মোয়াবিয়ার কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়ে ইমাম হাসানকে অর্থের বিনিময়ে মুয়াবিয়ার হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছিল! সহযোগীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে গুরতর আহতও হয়েছিলেন ইমাম হাসান (আ)। এ অবস্থায় ইমাম মুয়াবিয়ার প্রস্তাবিত যুদ্ধ-বিরতি মেনে নিতে বাধ্য হন ঈমান দুর্বল হয়ে পড়া তার সেনা ও সমর্থকদের চাপের মুখে, যদিও তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন: মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতির শর্তগুলোতে আমাদের জন্য যেমন সম্মান নেই তেমনি তাতে ন্যায়বিচারও নেই, ..! (সূত্র: সুন্নি জগতের বিখ্যাত বই হেদায়া ও নেহায়া)
 
ইমাম হুসাইনের ৭২ জন সঙ্গীর মত দৃঢ়চেতা, একনিষ্ঠ বিশ্বাসী, আস্থাশীল বা নির্ভরযোগ্য ও সাহসী সহযোগী যদি ইমাম হাসানের সঙ্গেও থাকত তাহলে তিনি মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করতেন না! যাই হোক, ইমাম হাসান কখনও মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে মেনে নেননি ও সন্ধি-পত্রেও তার উল্লেখ ছিল না। পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে তিনি মুয়াবিয়ার প্রকৃত চেহারা তুলে ধরার জন্য অপেক্ষা করার নীতি অনুসরণ করেন ও তা সফল হয়। কিন্তু ইমাম হুসাইনের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কুফায় ও ইরাকে তাঁর বিপুল সংখ্যক সমর্থক ছিল যদিও তাদের বেশিরভাগই ছিল অনির্ভরযোগ্য! ইমাম হুসাইনের একনিষ্ঠ অনুরাগী ও অনুসারীর সংখ্যাও খুব নগণ্য ছিল না। কারবালার যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে বনি-আসাদ গোত্রের ৯০ ব্যক্তি ইমাম শিবিরে যোগ দিতে এসে এক ব্যর্থ যুদ্ধের শিকার হয়েছিল। দূরাঞ্চল থেকেও আরও অনুরাগী কারবালায় আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল কিন্তু তাঁরা পৌছার আগেই আশুরার ঘটনা ঘটে।
 
ইয়াজিদের প্রকাশ্য অনাচার ও জুলুম চরমে উপনীত হওয়ায় জালিম সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব করার জন্য বিপুল সংখ্যক কুফাবাসী ও ইরাকিদের আহ্বান উপেক্ষা করাও ইমাম হুসাইনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নীরবও থাকতে পারতেন না ও আপোসও করতে পারতেন না!  
 
ইমাম হাসানের অনুসারী সেনাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা মুয়াবিয়ার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে নবী-পরিবারের বাইরে ইমাম হুসাইনের সহযোগীদের যে ক্ষুদ্র অংশ শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে থেকে যান তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল যে: আগামীকাল দশই মহররম যখন যুদ্ধ শুরু হবে তখন আমরাই আগে যুদ্ধে জড়িত হব যাতে নবী-পরিবারের কোনো সদস্যের গায়ে শত্রুর একটি আঁচড়ও না লাগে! এর আগে যুদ্ধ করতে সক্ষম নবী-পরিবারের সদস্যরা এক গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন যে আমরাই আগে যুদ্ধে জড়িত হব যাতে মহানবী এ কথা না বলেন যে তোমরা আমার পরিবারের সদস্য হয়েও আমার উম্মতকে আগে যুদ্ধে পাঠালে! তাই মহানবীর উম্মতরা আগে শহীদ হলে আমরা কি করে নানাজী তথা রাসুলকে মুখ দেখাব?
 
রাসুলের বৃদ্ধ সাহাবি ও ইমাম হুসাইনের ক্ষুদ্র বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি হাবিব ইবনে মাজাহেরের চাপের মুখে ইমাম হুসাইন (আ) নবী-পরিবারের বাইরের সদস্যদেরকেই আগে যুদ্ধে জড়িত হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। তাদের অনুভূতি ছিল এমন যে: আমরা বেঁচে থাকতে নবী-পরিবারের সদস্যরা আগে শহীদ হবেন? আর আমরা পরে শহীদ হব?! তাহলে আমরা কি করে নবীজীর কাছে মুখ দেখাব? দেখুন পারস্পরিক ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতা এবং পরস্পরের জন্য আত্মত্যাগের কি অনন্য প্রতিযোগিতা! কারবালা বিপ্লব এরকম আরো বহু কারণে বিশ্ব-ইতিহাসে অনন্য!