বৃহস্পতিবার, ২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে মানবতার ঐক্য ও ইসলামি ঐক্য

পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১ 

নূর হোসেন মজিদী –
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيهِ إِلا الَّذِينَ أُوتُوهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ فَهَدَى اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا لِمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘(আদিতে) মানবম-লী একটিমাত্র উম্মাহ্ (আদর্শিক জনগোষ্ঠী) ছিল। অতঃপর আল্লাহ্ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে নবীদেরকে উত্থিত করলেন এবং তাদের সাথে সত্যতা সহকারে কিতাব নাযিল করলেন যাতে তারা লোকদের মধ্যে তাদের মতপার্থক্যের বিষয়ে ফয়সালাহ্ করে দেয়, আর যাদের কাছে অকাট্য নিদর্শনাদি এসে যাওয়ার পরে তা দেয়া হয়, তারা নিজেদের মধ্যে বিদ্রোহাত্মকভাবে ব্যতীত সে ব্যাপারে মতপার্থক্য করে নি। অতঃপর আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে তাদের মতপার্থক্যের বিষয়ে সত্যতা সহকারে পথপ্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ্ যাকে চান সরল-সঠিক-সুদৃঢ় পথে পরিচালিত করেন।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ২১৩)
এ আয়াতের ভাষা থেকে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ্ তা‘আলার এটাই পছন্দ যে, সমস্ত মানুষ একটি অভিন্ন উম্মাহ্ হিসেবে থাকবে, কিন্তু সীমালঙ্ঘনকারীরা তথা আল্লাহ্ তা‘আলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীরা মতপার্থক্য করে এবং এর ফলে সেই আদি উম্মাহ্ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীকালে মানব প্রজাতির ব্যাপক বিস্তারের ফলে অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অতীতের নবী-রাসূলগণের (আ.) পরিচয় ও শিক্ষা হারিয়ে যায়, বা বিকৃত হয়ে যায়, বা তাদের কাছে যা ছিল তা পরিবর্তিত কালের দাবি পূরণের জন্য যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু এ অবস্থায় নতুন আগত নবী-রাসূলগণের (আ.) নবী-রাসূল হওয়ার ব্যাপারে তাদের অনেকের জন্য ইতমামে হুজ্জাত হয় অর্থাৎ তারা নতুন আগত নবী-রাসূলগণের (আ.) নবী-রাসূল হওয়ার ব্যাপারে ইয়াক্বীনের অধিকারী হয়, কিন্তু অপর অনেকের কাছে, বিভিন্ন বাধার কারণে, যেমন : নতুন আগত নবী-রাসূলগণের পরিচয় সঠিকভাবে না পৌঁছা বা বিকৃতভাবে পৌঁছার কারণে, তাঁদের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত হয় নি। এমতাবস্থায় প্রথম ধরনের লোকদের মধ্যে যারা ইখলাসের অধিকারী তারা নতুন আগত নবী-রাসূলগণের ওপর ঈমান এনেছে এবং দ্বিতীয় ধরনের লোকদের মধ্যে যারা ইখলাসের অধিকারী তারা সহজাত প্রবণতা ও সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি (عقل)-এর রায় অনুসরণ করেছে।
এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদের শুরুতে দুই ধরনের লোককে মুত্তাক্বী তথা আহ্লে নাজাত বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের পক্ষে কোরআন মজীদ থেকে হেদায়াত লাভ করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন।
এরশাদ হয়েছে :
ذَلِكَ الْكِتَابُ لا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘এই কিতাব্- যাতে কোনো রকমের সন্দেহ-সংশয় নেই; এটি মুত্তাক্বীদের (সাবধানী লোকদের) জন্য পথপ্রদর্শনকারী- যারা ঈমান পোষণ করে ইন্দ্রিয়াতীত সত্তায়, সালাত্ কায়েম রাখে এবং আমি তাদেরকে যে রিয্ক্ব্ দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। আর (তারাও মুত্তাক্বী/ সাবধানী হিসেবে এ কিতাব থেকে পথনির্দেশ পাবে) যারা (হে রাসূল!) আমি আপনার প্রতি যা নাযিল করেছি এবং আপনার পূর্বে যা কিছু নাযিল করেছি তাতে ঈমান পোষণ করে। আর তারা (সকলেই) আখেরাতের অস্তিত্বে ঈমান পোষণ করে। এরাই স্বীয় রবের হেদায়াতের ওপর রয়েছে এবং এরাই সফলকাম।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ২-৫)
এছাড়া কোরআন মজীদে বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ব্যবহারের ওপর বার বার তাকিদ করা হয়েছে এবং সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধি (عقل سليم عمومی)-এর দলিলের সাহায্যে তাওহীদ, আখেরাত ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর দাও‘আত পেশ করা হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে : তারা কি কোনো সৃষ্টি-উৎস ছাড়াই সৃষ্ট হয়েছে, নাকি তারা নিজেরাই স্রষ্টা? তিনিই পুনঃসৃষ্টি করবেন যিনি প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন। মুহাম্মাদ (সা.) তো (নবুওয়াত-দাবির) পূর্বে গোটা জীবনই মক্কাবাসীদের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। (তো তারা কি তাঁর পক্ষে কোরআনের মতো গ্রন্থ রচনা করা সম্ভবপর বলে মনে করে?) তারা যদি কোরআনকে গ¦ায়রুল্লাহ্র রচিত বলে মনে করে তাহলে এর সমমান সম্পন্ন একটি সূরা রচনা করে আনুক। এগুলোর সবই সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির দলিল বা অকাট্য যুক্তি।
মোট কথা, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের জন্য নাজাতের ভিত্তি করেছেন তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান এবং যথাযথ কর্ম (‘আমালে সালেহ্) সম্পাদনকে। যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর সাধ্যাতীত দায়িত্ব প্রদান করেন না এবং তিনি জানেন যে, বিভিন্ন বাধার কারণে অনেক লোকের জন্য নবুওয়াতের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত না-ও হতে পারে। অবশ্য কারো জন্য নবুওয়াতের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত হওয়া সত্ত্বেও সে নবুওয়াতে ঈমান না আনলে তা হবে নেফাক্বের পরিচায়ক এবং সে ধরনের লোকেরা নাজাত লাভ করবে না। অন্যদিকে কোনো মুখলিস লোকের কাছে কোনো নবী-রাসূলের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত না হলেও তাঁদের ব্যাপারে সে সতর্কতার (তাক্বওয়ার) নীতি অনুযায়ী সসম্মান আচরণ করবে এবং এ সম্ভাবনা পোষণ করবে যে, হয়তো তিনি নবী ছিলেন, কিন্তু তাঁর পরিচিতি ও শিক্ষা বিকৃত হয়ে গিয়ে থাকবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে তাওহীদের ভিত্তিতে আহ্লে কিতাবের সাথে ভদ্রজনোচিত ও সসম্মান সহাবস্থানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে :
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلا نَعْبُدَ إِلا اللَّهَ وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
‘(হে রাসূল!) বলুন : হে আহ্লে কিতাব! তোমরা এসো এমন একটি কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান, তা হচ্ছে : আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত কারো দাসত্ব-উপাসনা করব না এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করব না, আর আল্লাহ্ ব্যতীত আমাদের কতক অপর কতককে রব হিসেবে গ্রহণ করব না। অতঃপর তারা যদি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে তো (হে ঈমানদারগণ!) তোমরা বল : তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম (আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পিত)।’ (সূরা আলে ‘ইম্রান্ : ৬৪)
নিঃসন্দেহে যাদের সাথে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য চেষ্টা করতে হবে তাদেরকে কাফের, মুশরিক, গোমরাহ্ ইত্যাদি মন্দ অভিধায় অভিহিত করা জায়েয হতে পারে না। এছাড়াও, যেহেতু মুসলমানদের দায়িত্ব অন্যদের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত আল্লাহ্র দ্বীনের পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ সংস্করণ পৌঁছানো ও এর প্রতি আহ্বান জানানো সেহেতু তাদেরকে মন্দ অভিধায় অভিহিত করা হলে তাদের দ্বারা এ দ্বীন গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই তাদের অনুসৃত ধর্মের ভুলত্রুটি নির্দেশও ভদ্রজনোচিত পন্থায় করতে হবে; এমনকি বিতর্কের ক্ষেত্রেও তারা যে ভাষায় কথা বলে তার চেয়ে উত্তম ভাষায় জবাব দেয়ার জন্য কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এই যেখানে অবস্থা সেখানে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর খাতমে নবুওয়াত ও কোরআন মজীদের পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত ঐশী কিতাব হওয়ার ওপরে ঈমান পোষণকারী মুসলমানদের জন্য অন্য কোনো কোনো ব্যাপারে মতপার্থক্যের কারণে পরস্পর বহুধাবিভক্ত হওয়া এবং পরস্পরকে কাফের, মুশরিক, মুরতাদ, গোমরাহ্ ইত্যাদি মন্দ অভিধায় অভিহিত করা কোনোভাবেই জায়েয হতে পারে না। কারণ, যে সব বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে সে সব বিষয়ে সঠিক মতের ব্যাপারে বিভিন্ন বাধার কারণে কারো কারো জন্য ইতমামে হুজ্জাত না-ও হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর প্রতি ঈমান পোষণ না করা সত্ত্বেও আহ্লে কিতাবের সাথে যে ধরনের ভদ্রজনোচিত ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যখন আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তখন মুসলমানদের পরস্পরের ক্ষেত্রে তার বরখেলাফ আচরণ জায়েয হতে পারে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে বলেছেন যে, আল্লাহর কাছে দ্বীন একমাত্র ইসলাম এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন কবুল করা হবে না। বস্তুত আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে যা ইসলাম তা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে প্রেরিত কোনো নতুন দ্বীন নয়, বরং হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূলের দ্বীন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে তাকে পূর্ণতা দেয়া হয়েছে। ইসলাম তা-ই যা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে উপস্থাপন করেছেন।
মানুষের গড়া ধর্মসমূহ ও আল্লাহ্র দ্বীনের মানুষের কৃত বিকৃত রূপসমূহ থেকে কোরআন মজীদে উপস্থাপিত আল্লাহ্র দ্বীনের পার্থক্য নির্দেশক অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা সকল প্রকার পক্ষপাতিত্ব ও গোষ্ঠীগত সঙ্কীর্ণতা থেকে প্রমুক্ত, সেহেতু মানুষের গড়া ধর্মসমূহের বিপরীতে এ দ্বীনে মানুষের সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, কোরআন মজীদে মুসলমানদেরকে একটি একক উম্মাহ্ (আদর্শিক জনগোষ্ঠী) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের জন্য অনৈক্য ও বিভেদ-বিভক্তিকে হারাম করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ
‘নিঃসন্দেহে তোমাদের এ উম্মাহ্ হচ্ছে এক উম্মাহ্ এবং আমি তোমাদের রব, সুতরাং তোমরা আমারই দাসত্ব কর।’ (সূরা আল্-আম্বিয়া’ : ৯২)
অন্যদিকে কোরআন মজীদে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হওয়াকে মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মু’মিনদেরকে এ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
‘আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না – যারা তাদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে ও নিজেরা বিভিন্ন দল হয়ে গিয়েছে এবং প্রতিটি দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।’ (সূরা র্আ-রূম্ : ৩১-৩২)
অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا
‘আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহ্র রশি দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ (সূরা আলে ‘ইমরান্ : ১০৩)
এছাড়া বিভক্তির অন্যতম প্রধান কারণ যে ঝগড়া-বিবাদ তা থেকেও নিষেধ করা হয়েছে; এরশাদ হয়েছে :
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ
‘আর তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করো না, তাহলে তোমরা হীনবল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রাণবায়ু (শক্তি ও প্রাভাব) হারিয়ে যাবে।’ (সূরা আল্-আন্ফাল্ : ৪৬)
এ থেকে সুস্পষ্ট যে, কোরআন মজীদে তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান পোষণকারী এবং যথাযথ কর্ম (‘আমালে সালেহ্) সম্পাদনকারী জনগোষ্ঠীসমূহের সাথে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে বহুর মধ্যে সমঝোতা (اتحاد), কিন্তু নবুওয়াতে মুহাম্মাদীতে ঈমান পোষণকারীদের জন্য সে ধরনের সমঝোতার নির্দেশ দেয়া হয় নি, বরং তাদেরকে একটি উম্মাহ্ – একটি অবিভাজ্য সত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং বিভক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। অর্থাৎ কোরআন মজীদ উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য এককত্বের (وحدة) প্রবক্তা।
সুতরাং সুস্পষ্ট যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য বহুধাবিভক্ত হওয়া কোনোমতেই জায়েয হয় নি। কিন্তু অবাঞ্ছিত বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, তা সত্ত্বেও তারা বহুধাবিভক্ত হয়েছে। 
বাস্তবে আমরা মুসলমানদের এই বিভেদ ও অনৈক্যের বিষময় পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। 
বর্তমানে বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা পৌনে দু’শ’ কোটি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈশ্বিক অঙ্গনে তাদের তেমন কোনো প্রভাব নেই। এ কারণেই, তারা যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে আছে শুধু তা-ই নয়, ইসলাম ও মুসলমান আজ আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক দিক থেকে দুশমনদের হামলার শিকার। বিশেষত ইসলামের প্রথম ক্বিবলা বাইতুল মুক্বাদ্দাসসহ পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি কাল যাবত যায়নবাদীদের অবৈধ দখলে, কিন্তু পৌনে দু’শ’ কোটি মুসলমান তা উদ্ধারের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে নি। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) মুসলিম উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে মাহে রামাযানের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব ক্বুদস্ দিবস এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১২ই থেকে ১৭ই রাবী‘উল আউয়ালকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতে দ্বীনদার মুসলমানদের অনেকে সাড়া দিলেও বিশ্বের মোট মুসলিম জনশক্তি অনুপাতে তা মোটেই যথেষ্ট নয় এবং তা চৈন্তিক অনৈক্যের কারণেই।  
মুসলমানদের এই বিভেদ-অনৈক্যের কারণেই ইসলামের আদর্শিক সীমান্ত বার বার দুশমনদের গুরুতর আগ্রাসনের সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি তাদের দুঃসাহস এতোই বেড়ে গিয়েছে যে, তারা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-কে অবমাননা করতেও দ্বিধা করছে না। এর সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফরাসি সাময়িকী ‘শার্লি এবদো’তে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে অবমাননা করে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ। কেবল যে সাময়িকীটি তার পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত এ ব্যঙ্গচিত্রটি পুনঃপ্রকাশ করেছে তা নয়, এটি ফ্রান্সের বিভিন্ন সরকারি ভবনেও প্রদর্শিত হয়েছে। এমনকি স্বয়ং ফরাসি প্রেসিডেন্ট মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে এটি নিষিদ্ধ করতেই কেবল অস্বীকৃতি জানান নি, সরকারি ভবনে প্রদর্শন বন্ধ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে ইসলামবিদ্বেষী জঘন্য মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ ফ্রান্সসহ সমগ্র পাশ্চাত্যে তথাকথিত হলোকস্ট সম্পর্কে অনুসন্ধানী তথ্যাদি প্রকাশ নিষিদ্ধ; এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা ভুলে যায়। অধিকন্তু কোনো পবিত্র ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ তথা অবমাননা করা কখনোই মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানকে নিষিদ্ধ করার সময়ও তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা মনে ছিল না।
সর্বপ্রথম ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ ব্যঙ্গটিত্র পুনঃপ্রকাশ ও প্রদর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। এরপর সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকে ফরাসি পণ্য বর্জন করছেন। এটা আশার কথা। কিন্তু সার্বিকভাবে বিশে^র মুসলিম জনগণ ও সরকারগুলোর পক্ষ থেকে যে ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল তা এখনো গৃহীত হয় নি।
আসলে উম্মাহ্র মূল সমস্যা যে চৈন্তিক ক্ষেত্রে বিভেদ-অনৈক্য তার নিরসন হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অবমাননাসহ ইসলামের আদর্শিক সীমান্তে আগ্রাসন চালানোর মতো দুঃসাহস ইসলামের দুশমনদের হতো না। তাই এ সমস্যার সমাধানকেই সব কিছুর ওপরে অগ্রাধিকার দেয়া অপরিহার্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্যার নিরসনের জন্য করণীয় কী?
সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীনকে ঠিক সেভাবে দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে যেভাবে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে উপস্থাপন করেছেন। এর ভিত্তিতে নিজেদের জন্য উগ্রপন্থা (ইফ্রাত্ব) ও শিথিলপন্থা (তাফ্রীত্ব) হতে মুক্ত একটি মধ্যমপন্থী উম্মায় তথা ভ্রাতৃসম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে Ñ ঠিক যেমনটি আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন :
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যমপন্থী উম্মাহ্ বানিয়েছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য শাহীদ (সত্যের সাক্ষী/ দ্বীনের মূর্ত প্রতীক) হও এবং রাসূল তোমাদের জন্য শাহীদ (সত্যের সাক্ষী/ দ্বীনের মূর্ত প্রতীক) হন।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ১৪৩)
এর ভিত্তিতে, ‘আক্বায়েদের ক্ষেত্রে শাখা-প্রশাখাগত বিষয়াদিতে মতপার্থক্য সত্ত্বেও খোদাদ্রোহী ব্যতীত উম্মাতে মুহাম্মাদীর সদস্যদেরকে আন্তরিকভাবেই আহ্লে নাজাত গণ্য করতে হবে এবং তাদের কাউকে ও অন্য কোনো আহ্লে নাজাতকে কাফের, মুশরিক, মুরতাদ, মুনাফিক্ব ইত্যাদি গণ্যকরণ ও অভিহিতকরণ পরিহার করতে হবে।
উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে একক উম্মাহ্র অনুভূতি গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। বিশেষ করে সকল ক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়ের সপক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং খোদাদ্রোহীদের (তাদের জন্মগত ধর্মীয় পরিচয় যা-ই হোক না কেন), বিশেষত আল্লাহ্র বান্দাদেরকে স্বীয় দাসে পরিণতকারী বলদর্পী ও আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বিভক্তি দূরীভূত করে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে কোরআন মজীদে কাক্সিক্ষত একক ও অবিভাজ্য উম্মায় পরিণত করার বিষয়টি জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয় এবং সেভাবে তা অর্জন করা সম্ভবও নয়, বরং সে জন্য এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে যাতে স্বাভাবিক পন্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ফাটল ও বিভক্তি দূরীভূত হয়ে উম্মাতে মুহাম্মাদী পুনরায় সুসংহত একক অবিভাজ্য সত্তায় পরিণত হতে পারে। আর বলাই বাহুল্য যে, তা হতে হবে চৈন্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক এককত্বের মাধ্যমে- যা কেবল ‘ইল্মী পন্থায় অর্জিত হতে পারে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ইসলামি উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন। বিশেষত তিনি সব সময়ই ইসলামের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল্ মুক্বাদ্দাসসহ ফিলিস্তিন ভূমিকে মুক্ত করার জন্য উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন; ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি, তিনি উম্মাহ্র মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব ক্বুদ্স্ দিবস ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ ঘোষণা করেন। 
বস্তুত ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্রসমূহের আলোকে ‘আক্বায়েদের শাখা-প্রশাখাসমূহ এবং মৌলিক ফরয/ ওয়াজিব্ ও হারামের ক্ষেত্রে বিরাজমান মতপার্থক্যসমূহ নিরসন করা সম্ভব হলে প্রায়োগিক (ফরয/ ওয়াজিব্ ও হারাম সংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়নের শর্তাবলি) এবং গৌণ বিষয়াদির (মুস্তাহাব্ ও মাক্রূহ্র) ক্ষেত্রে বিরাজমান মতপার্থক্যসমূহ কোনো সমস্যা নয়।
অত্র নিবন্ধকারের দৃষ্টিতে, ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্র চারটি যার সাহায্যে ‘আক্বায়েদ ও তার শাখা-প্রশাখাসমূহ এবং মৌলিক ফরয/ ওয়াজিব্ ও হারামসমূহ প্রমাণিত হতে পারে। তা হচ্ছে : (১) সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধি, (২) কোরআন মজীদ, (৩) মুতাওয়ার্তি হাদীস ও (৪) শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে উম্মাহ্র মধ্যে শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা অভিন্ন মত ও আমলসমূহ (ইজ্মা‘এ উম্মাহ্)।
এ জ্ঞানসূত্রগুলো এমন যা সকল মুসলমানের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া অপরিহার্য। কোরআন মজীদে সকল মুসলমানই ঈমান পোষণ করে, অন্যদিকে শেষোক্ত দু’টি জ্ঞানসূত্র নিঃসন্দেহে সুন্নাতে রাসূল (সা.)-এর উদ্ঘাটনকারী। তবে সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধিকে ইসলামের অন্যতম অকাট্য জ্ঞানসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা, বিশেষত ক্রমের দিক থেকে প্রথমে স্থান দেয়ার ব্যাপারে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে কেবল এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, কোরআন মজীদ বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ব্যবহারের ওপর বার বার গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং ‘আক্বলী দলিলের ভিত্তিতে লোকদেরকে তাওহীদ, আখেরাত, নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা.) ও কোরআন মজীদের প্রতি ঈমানের আহ্বান জানিয়েছে, আর একজন অমুসলিম – যে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর ও কোরআন মজীদের প্রতি ঈমান পোষণ করে না – সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে ইসলামের সত্যতায় উপনীত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। সুতরাং সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধি ইসলাম-গৃহে প্রবেশের দরজাস্বরূপ। তাই সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধির আলোকে যা কিছুকে সত্য জেনে একজন অমুসলিম ইসলামে ঈমান এনেছে অতঃপর ইসলামের অন্য কোনো জ্ঞানসূত্র থেকে, এমনকি কোরআন মজীদ থেকেও এর বরখেলাফ কোনো তাৎপর্য গ্রহণ করা যেতে পারে না।