কারবালা ঘটনার রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২, ২০১৯

মাহদি মাহমুদ : আমরা যদি আজকের জামানায় মুসলিম উম্মাহর দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব যে,এই জাতির অবস্থা একটি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত মুমূর্ষু মানুষের মতো। ভিন্ন ভিন্ন মাজহাবের ফেরকাবাজিতে বৈশ্বিক মুসলিম উম্মাহ যেমনি দুর্বল হয়ে পড়েছে, ঠিক তেমনিভাবে তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে ইসলাম ও রাজনীতির মধ্যে সুবিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে,কোথাওবা রাজতন্ত্র ইহুদিবাদী শক্তির তাঁবেদারিতে ব্যস্ত,কোথাও বা উপনিবেশকবলিত মুসলিম জাতি এখনো উঠে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।রাসূল(সা) প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এবং মুক্তি তো রূপকথার মতোই শোনাবে।ফিলিস্তিন,কাশ্মীর,আরাকান কিংবা ইয়েমেনের কোথাও ইহুদিবাদী শক্তি আর কোথাও তাদের সেবাদাস মুসলিম রাজা-বাদশা উমাইয়াদের প্রেতাত্মারহাতে রক্ত ঝরছে নিরীহ সাধারণ মুসলমানের।এই দুরবস্থার উৎস খুঁজলে আমরা দেখব এই দায় মূলত মুসলিম উম্মাহর আলেম,বুদ্ধিজীবী এবং নাগরিক- তিনটি শ্রেণির উপরই বর্তায়।আলেম সমাজ আর নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান পাদ্রি-পুরোহিত এবং সাধারণের মধ্যে সম্পর্কের ন্যায় আর বিরাট সংখ্যক বুদ্ধিজীবী কাজ করছে বিভিন্ন দেশ এবং মতবাদের হালুয়া-রুটিখোর নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীর মতোই।
আমরা যদি কারবালার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব যে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিপ্লব ছিল সাম্রাজ্যবাদী,নৈরাজ্যবাদী,রাজতন্ত্রী আলেম এবং রাজাদের কেনা এলিটদের বিরুদ্ধেই।তাঁর বিপ্লব ছিল উদাসীন এবং ঘুমন্ত মুসলিম নাগরিকদের জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে।ইতিহাসেআমরাকী দেখতে পাই, রাসূলে পাক(সা)-এর ওফাতেরঅর্ধশতবছর হতে না হতেই তাঁর দৌহিত্রকে হত্যা করা হলো।এর আগে বনি উমাইয়া দিনকে দিন ক্ষমতার রাজনীতির ময়দান দখল করে নেয়।আমরা দেখতে পাই হযরত উসমান(রা) এবং আমিরে মুয়াবিয়ার আমল থেকেই জনগণ ক্ষমতায় উমাইয়া আত্মীয়দের প্রভাবের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে।বাইতুল মালের অর্থ আত্মসাৎ এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলকে বংশীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে।এসময় বাইতুল মালকে জনগণের এবং উমাইয়াদের বাইতুল মা’ল হিসেবে ভাগ করে ফেলা হয়।জনগণের যাকাতের অর্থ ইয়াজিদের বায়াতের পক্ষে উৎকোচ-উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।আরব এবং পার্সি কিংবা ধনী এবং দাসদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে পারস্পরিক সহিংসতার বীজ বপন করা হয়। রাসূলে পাকের পবিত্র মিম্বরসহ ইসলামি ভূখণ্ডের প্রতিটি মসজিদে খুতবায় দাঁড়িয়ে আলী(কা)-এর উপর গালাগাল এবং অভিসম্পাতের সংস্কৃতি চালু করা হয়।যেসকল মহান সাহাবী এবং তাবেয়ী এসব অপচক্র-রাজতন্ত্রীকরণ মেনে নেন নি তাঁদেরকে কঠোর এবং নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়।আর উমাইয়াদের এই কর্মকাণ্ডের সমর্থনে এগিয়ে আসে একশ্রেণির দরবারি আলেম এবং এলিট শ্রেণি।
ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক।তিনি তাঁর কারবালার ঘটনা-পূর্ব ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘জেনে রাখ, এ শাসকদল(বনি উমাইয়া) শয়তানের আদেশ মেনে চলছে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করছে এবং দুর্নীতিকে প্রতিদিনকার নিয়ম বানিয়েছে।তারা অধিকারসমূহকে এক জায়গায় জমা করেছে। মুসলমানদের সম্পদের ভাণ্ডারকে(বাইতুল মা’লকে) তাদের নিজেদের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে এবং আল্লাহর হারামকে অনুমতি দিয়েছে এবং তাঁর হালালকে নিষেধ করে দিয়েছে।সব মানুষের চাইতে আমিই সবচেয়ে যোগ্য তাদের বিরোধিতা করাতে ‘ (তাবারী)
আর এরই প্রেক্ষাপটে ইমাম হোসাইন তাঁর সংগ্রাম শুরু করেন,যেন অনাগত কালে মুসলিম উম্মাহ যখনই এরূপ নৈরাজ্য এবং রাজতন্ত্রের উত্থান দেখবে তখনই যেন তারা তাঁর মতো করেই রুখে দাঁড়ায়।
ইমাম হোসাইন তাঁর বিপ্লব ও সংগ্রামের উদ্দেশ্য সবিস্তারে তুলে ধরেছেন মিনায় প্রদত্ত ভাষণটিতে- মূলত যেটির উপর ভিত্তি করে আজকের এই আলোচনা। এই ভাষণটি অনাগত কালের মানুষের জন্যে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
ভাষণটি ইমাম হোসাইন দিয়েছিলেন তাঁর মক্কা থাকাকালীন। আমির মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর যখন ইয়াজিদের পক্ষে বায়াত করার জন্যে তাঁর উপর জোর-জবরদস্তি শুরু হয়,তখন তিনি মদিনা ত্যাগ করেনএবং মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা দেন।তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একাধারে হজ পালন করা এবং হজের জন্যে আগত মুসলিম বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়া, বনি উমাইয়ার মাত্রাছাড়া জাহেলিয়াত,সুন্নাহবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদেরকে সচেতন করা।সেই লক্ষ্যেই ৬০ হিজরির জিলহজ মাস নাগাদ মিনায় ইমাম হোসাইন এই ভাষণটি প্রদান করেন।
ভাষণে তিনি ‘হে লোকসকল বা জনগণ’ সম্বোধনে শুরু করেন। অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করেন, ‘কেন ধার্মিক ব্যক্তিরা (আল্লাহওয়ালা আলেমগণ) এবং পণ্ডিতগণ তাদের পাপের কথা ও নিষিদ্ধ বস্তু ভক্ষণ হতে নিষেধ করে না? নিশ্চয় তারা যা করছে তা অত্যন্ত জঘন্য।’ (সূরা মায়িদা : ৬৪)
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, ইমাম হোসাইনের ভষণটি সামগ্রিকভাবে তৎকালীন এবং অনাগত যুগের সচেতন জনগণের উদ্দেশে এবং নির্দিষ্ট করে বললে, মুসলিম আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশেই ছিল। এভাষণে তিনি আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে ‘হে শক্তিমান সম্প্রদায়! যারা জ্ঞানে বিখ্যাত’ বলেও সম্বোধন করেছেন। আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে তিনি শক্তিমান মনে করেন। কেননা, তাঁদের আছে প্রজ্ঞা। জনগণ তাঁদেরকে ভরসা এবং সম্মান করে। তিনি বলছেন, ‘মর্যাদাবান ব্যক্তি তোমাদেরকে (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) মূল্যায়ন করে এবং দুর্বল ব্যক্তি তোমাদেরকে শ্রদ্ধা করে।… তোমরা সম্রাটদের শান সহকারে এবং বুজুর্গদের সম্মান সহকারে রাস্তায় পথ চল।’ কিন্তু কেন? তিনি নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, ‘এসব কি এজন্যই নয় যে, জনগণ তোমাদের প্রতি আশা রাখে যে, তোমরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করবে?’
আলেমগণের শ্রদ্ধার মাপকাঠি জনগণের নিকটে এজন্য হওয়া উচিত যে, তাঁরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠার জ্য আন্দোলন করেন। জনগণকে সংগঠিত করেন। দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে যেখানেই নিপীড়িত মানুষ রয়েছে, যেখানেই যালেমরা মযলুমের রক্ত ঝরাচ্ছে সেখানেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে আলেম এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ।
ইমাম তাঁর ভাষণের এই পর্যায়ে আবারো হুশিয়ার করে দিচ্ছেন যে, আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার ও ক্ষমতা এজন্য নয় যে, তাঁরা বেশি বেশি নামায পড়েন কিংবা ব্যক্তিজীবনে ঈমানদারির পরিচয় দেন।
ইমাম বলছেন, ‘আল্লাহর প্রতি ঈমানদার বান্দা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু জনগণ তাদের শ্রদ্ধা করে না। আর তোমরা আল্লাহর কারণে জনগণের মাঝে সম্মানের পাত্র। এখন তোমরা স্বচক্ষে আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকারসমূহকে ভঙ্গ হতে দেখেও কেন ভয় করছ না?’
ইমাম হোসাইন তৎকালীন এবং অনাগত যুগের আলেম এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন- ‘তোমাদের ব্যাপারে আমার আশংকা হয় যে, ঐশী কোনো প্রতিশোধ তোমাদের ওপর নেমে আসবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের ওপর দুর্দশা অন্যদের চেয়েও বড়। কারণ, তোমরা যারা আলেম এবং পণ্ডিত, তোমরা তোমাদের জ্ঞান এবং মর্যাদাকে রক্ষার দায়িত্বে ব্যর্থ হয়েছ।’
কী এমন অপরাধ যার কারণে ইমাম হোসাইন এভাবে হুশিয়ার করে আশংকা করছেন যে, তাঁদের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হবে? কি ছিল আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকার এবং আল্লাহর অধিকার-যা প্রতিনিয়ত ভঙ্গ হচ্ছিল এবং আজকের যুগেও হয়ে চলেছে?
ইমাম হোসাইন নিজেই কোরআন মজীদের দুটি আয়াত দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। আল্লাহর বাণী মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
ঈমাম হোসাইন বলছেন, “মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে ভয় করো না। ভয় করো আমাকে।’ (সূরা মায়িদা : ৪৪)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘মুমিন নরনারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজে আদেশ করে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে। (সূরা তওবা : ৭১)।”
ইমাম হোসাইন এরপর বলছেন, ‘আল্লাহ সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করাকে ফরজ করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি এই ফরজটি পালন করা হয় বা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সহজ-কঠিন সব ফরজই পালন করা হবে।’
এই ‘আম্র বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ আসলে কোন্গুলো? মানুষকে জোর করে নামাযে ধরে নিয়ে যাওয়া? জবরদস্তি করে ইসলামের পথে আনা? ধরে-বেঁধে জোর করে ধর্মীয় মজলিশে নিয়ে যাওয়া? না।
অতঃপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন, এসকল ‘আম্র বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ বলতে আল্লাহ তাআলা কোন্গুলো বুঝিয়েছেন।
‘সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ হলো অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (এর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করা), যালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মাল ও গনিমত বণ্টন, যাকাতের নিসাব থেকে যাকাত গ্রহণ এবং তা যথার্থ খাতে ব্যয় করা।’
তিনি ভাষণেরই আরেক স্থানে বলছেন, ‘সকল জনপদে অন্ধ, বোবা আর দুর্বলেরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে এবং তাদের ওপর দয়া করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তোমরাও তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবী) পদ অনুযায়ী এবং দায়িত্ব মোতাবেক কাজ করছ না। আর যে ঐ কাজ করছে তাকেও সাহায্য করছনা। যালিমদের সাথে আঁতাত ও আপোস করে নিজেদেরকে ঝামেলামুক্ত রাখছ। এসবই হলো সেই সকল জিনিস যেগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।’
এরপর ইমাম হোসাইন আলেম সমাজের নখদন্তহীন দুর্বল এবং সম্মানহানীর কারণ তুলে ধরেন।
‘নির্দেশাবলি ও বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন আল্লাহর জ্ঞানে পণ্ডিত ও বিদ্বানের ওপর ন্যস্ত যারা তাঁর হালাল ও হারামের বিশ্বস্ত রক্ষক এবং শাসনকর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকতে হবে। সুতরাং তোমরা হলে তারাই যাদের থেকে সেই পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তোমরা সত্যপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছ এবং যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নীতিপন্থা সম্পর্কে মতবিরোধ করেছ।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেরাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছ এবং খোদায়ী শাসনকর্তৃত্বকে তাদের (যালিমদের) হাতে সোপর্দ করেছ যাতে তারা সংশয়প্রণোদিত কাজ করে এবং স্বীয় কামনার বশীভূত হয়ে চলে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের মৃত্যুভয় এবং দুনিয়ার জীবন যা তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই তাদেরকে এই পদে আসীন করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারা (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) তাদের সময়ে যারা যালিম ছিল তাদের নোংরা ও জঘন্য কাজ প্রত্যক্ষ করত, কিন্তু তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করত নাÑ তাদের হাতে যা ছিল তার লোভে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে।’
এর ফলশ্রুতিতে মুসলিম সমাজের কী অবস্থা হলো?
‘তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের) এরূপ মানসিকতা (উদাসীনতা) এবং জীবনপদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই তোমরা অক্ষমদেরকে তাদের (যালিমদের) অধীন করেছ। ফলে অক্ষমদের একদল এখন তাদের গোলামি শুরু করেছে। আরেকদল এক লোকমা খাবারের সন্ধানে নিরুপায় হয়ে পড়েছে। এবং এসকল শাসক তাদের মতো করে রাষ্ট্রকে ওলট-পালট করে এবং পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে।’
অতঃপর ইমাম হোসাইন যুগের আলেম ও বুদ্ধিজীবীদেরকে তাঁদের হৃত সম্মান ও ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পথ বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘তোমরা যদি (যালেমদের) নিপীড়নে ধৈর্যধারণ করো এবং আল্লাহর পথে সহনশীল হও তাহলে শাসনকর্তৃত্ব তোমাদের হাতে ফিরে আসবে এবং তোমাদের পক্ষ থেকেই বাস্তবায়ন হবে এবং তোমরাই জনগণের বিষয়াদির সমাধানস্থলে পরিণত হবে।’
পরিশেষে ইমাম হোসাইন বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার থেকে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে তা শাসনকর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয় এবং দুনিয়ার পণ্যের লোভেও নয়। এজন্য যে, তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত দেখব এবং তোমার রাজ্যে সংস্কার করব আর তোমার নিপীড়িত বান্দাদেরকে চিন্তামুক্ত করব এবং তোমার ওয়াজিব এবং (নবীর) সুন্নাত এবং বিধিবিধান পালন করব।’
এই ভাষণে জনগণের উদ্দেশে তাঁর শেষ কথা ছিলÑ ‘তোমাদের উচিত আমাদের সহায়তা করা। আমাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। যালিমদের শক্তি তোমাদের ওপর রয়েছে। তারা তোমাদের নবীর নূরকে নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। আর আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ওপরেই ভরসা করি, তাঁর দরবারেই প্রত্যাবর্তন করব। শেষ পরিণতি তাঁরই অভিমুখে।’
মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের কারণ বর্তমান উমাইয়াপন্থি রাজতন্ত্র,সেকুলারিজম আর ওলামায়ে-সু’দের কর্মকাণ্ডেই নিহিত।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ডঃ কলিম সিদ্দিকীর ‘উপনিবেশবাদ কবলিত মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আচরণ’ শীর্ষক বক্তৃতার দুটি উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই।
তিনি বলেন, ‘ধর্মকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের অধিকতর শক্তিশালী হওয়া ইসলামে অসম্ভব।তাই ধর্মের মুখোশ পরে রাষ্ট্রনীতির কুটকৌশল শুরু করে সর্বপ্রথম উমাইয়ারা।তখন থেকেই অন্য শাসকরা নিজেদের বংশগত স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহারের প্রয়াস পায়।কালক্রমে এই ধরনের বংশীয় শাসকেরা অধিক হারে সেকুলার ধারার রাজনৈতিক আচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে।তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়ে।শেষ পরিণতিতে দেখা যায় বংশীয় শাসকদের চরম পরাজয় এবং তাদের রাষ্ট্রসমূহের বিলুপ্তি।’
অপর এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘একটি রাষ্ট্র ততক্ষণ পর্যন্ত সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ যে,সে কোরআন বর্ণিত ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার এবং অন্য যৌথ দায়িত্বাবলির সম্পাদন করবে না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এই মানদণ্ড বর্তমানে এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের জন্যেও প্রযোজ্য।’
শেষ করছি বিংশ শতাব্দীর হোসাইনী আন্দোলনের জনক এবং ইরানে কোরআন এবং রাসূলের সুন্নাতের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী ইমাম খোমেইনীর ‘বেলায়াতে ফকিহ’ শীর্ষক আলোচনার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে, ‘আলেমগণ যদি নিজেদের জড়তা ভেঙ্গে দিয়ে যুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান,মুসলিম জাহানের সমস্ত স্থান ও দিক থেকে টেলিগ্রাম পাঠান এবং তার মাধ্যমে শাসনকর্তৃত্বের অত্যাচারমূলক কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান তাহলেই বা তাঁরা কতটা বিপদে পড়বেন বলে ধারণা করা যায়?আমি মনে করি,এই চাপের মুখে অত্যাচারী শাসকেরা ভীত হয়ে নিশ্চয়ই অত্যাচারমূলক কাজ ত্যাগ করবে।কেননা,সকলেই জানে ওরা আসলে দুর্বল,ভীত।…আলেমরা যখনই ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং তাঁদের পেছনে থাকবে সমগ্র দেশের জাগ্রত জনতা,তখন অত্যাচারী শাসকেরা অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকবে বা থেমে যাবে।’