কারবালায় আবরাইনে সর্ববৃহৎ মানবসমাবেশ
পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ১, ২০১৬
আরবাইন বা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশতম দিন উপলক্ষে প্রতি বছর কারবালার ময়দান অভিমুখে শোকযাত্রা গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের সর্বশেষ আরবাইন পর্যন্ত প্রতি বছরই ‘বিশ্বের বাৎসরিক সর্ববৃহৎ শান্তিপূর্ণ মিলনমেলা’ হিসেবে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে। যেমন, উইকিপিডিয়ার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মানব-জমায়েতের তালিকায় দু’ নম্বরে রয়েছে ২০১৫ সালের আরবাইনের অবস্থান- যেখানে জঙ্গীহামলার হুমকিকে উপেক্ষা করে অন্তত ২৬ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ মানব-জমায়েতের তালিকায় ‘আরবাইন’ দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বাৎসরিক সর্বোচ্চ মানব-জমায়েতের তালিকায় এর অবস্থান প্রথমে। কেননা, হিন্দু ধর্মাবলম্বিগণের কুম্ভমেলা- যা মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ জনসমাগম (২০১৩), সেটি প্রতি তিন বছর অন্তর একবার করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
উইকিপিডিয়ায় ‘List of Largest peaceful gathering in history’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ (সর্বশেষ) পর্যন্ত বছরগুলোতে কারবালায় আরবাইনে অংশ নেয়া মানুষের সংখ্যা যথাক্রমে ১০-১৪ মিলিয়ন (২০০৯), ১০ মিলিয়ন (২০১০), ১৫ মিলিয়ন (২০১১), ১৫ মিলিয়ন (২০১২), ১৫-১৮ মিলিয়ন (২০১৩), ২০-২২ মিলিয়ন (২০১৪) এবং ২৬ মিলিয়ন (২০১৫)। তাকফিরি জঙ্গিদের হুমকি, হামলা ও আগ্রাসনকে উপেক্ষা করে সারা দুনিয়া থেকে ছুটে আসছেন হযরত ইমাম হোসাইনের প্রেমিকগণ এবং প্রতি বছর তাঁদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। আরো উল্লেখ যে, আরবাইন ও ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনায় শোকপ্রকাশ শিয়া মুসলমানগণের ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও আরবাইন উপলক্ষে কারবালায় ছুটে আসছেন অসংখ্য সুন্নি মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু, ইয়াযিদি, যরথুস্ত্র এবং সাবেয়ি ধর্মের অনুসারী ইমাম হোসাইন-প্রেমিকগণ।
হাফিংটনপোস্টে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মাহদি আল মুদাররেসি তাঁর নিজ কলামে কারবালার পথে আরবাইনের পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে নিজের অনুভূতি এমনভাবেই প্রকাশ করেছেন, ‘নারী-পুরুষ এবং শিশুদের পদযাত্রা যেন তুষারধসের মত (এগিয়ে চলেছে)। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, কালো চাদরে ঢাকা নারীদের অবস্থানÑ দিগন্তের একমাথা থেকে আরেক মাথা অবধি বিস্তৃত।’
তাঁর আরবাইন শীর্ষক কলাম(World’s Biggest Pilgrimage Now Underway, And Why You’ve
Never Heard of it!) যেটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, তাতে এটিও জানা যায় যে, বসরা থেকে কারবালা পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪২৫ মাইল পথ দু’ সপ্তাহের প্রচেষ্টায় পায়ে হেঁটে পার করেন অনেক শোকযাত্রী।
বিনামুল্যে সকাল-দুপুর ও রাতের খাবার এবং অন্যান্য সেবা
মাহদি আল মোদাররেসির কলামে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তীর্থযাত্রীদের জন্য যাত্রাপথের অন্যতম আকর্ষণ হলো অস্থায়ী রান্নাঘরযুক্ত হাজার হাজার তাঁবু, যেগুলো পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীরা তীর্থযাত্রীগণের খেদমতের জন্য পত্তন করে থাকেন। তাঁবুগুলোতে তীর্থযাত্রীগণ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে শুরু করে বিশ্রামের স্থান পর্যন্ত সবই। বিদেশে ফোন-যোগাযোগের সুবিধা, বাচ্চাদের ডায়াপারÑ সবই বিনামূল্যে। ৪০০ মাইল যাত্রাপথে তীর্থযাত্রীদের এককথায় কোন কিছুই নিজ থেকে বহন করা লাগে না। এরচেয়েও অভাবনীয় হচ্ছে, যেভাবে তীর্থযাত্রীদের খাদ্যগ্রহণে নিবেদন করা হয় সেটি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে যাত্রীকে পথরোধ করেন এলাকাবাসী ইমাম-ভক্তগণ এবং বিনামূল্যে খাদ্যগ্রহণে বাধ্য করেন তাঁরা। যেই খাবার প্রায়ই একজনের জন্য ‘রাজার খাবার’ পরিমাণে হয়ে থাকে। তবে তার আগে ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রীর পা ম্যাসেজ করে দেবেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরপর তাঁরা পদযাত্রীকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করবেন- যতক্ষণ তারা (স্বেচ্ছাসেবিগণ) তাঁর (যাত্রীর) জামা-কাপড় ধুয়ে-শুকিয়ে ইস্ত্রী করেন সেই পর্যন্ত (পুরোটাই যাত্রীর সম্মানে বিনামূল্যে)।… একজন স্বেচ্ছাসেবীর ভাষায়, ‘ইসলামের শিক্ষা স¤পর্কে জানতে চাইলে, কতিপয় জঙ্গির দিকে নজর না দিয়ে বরং আরবাইন উপলক্ষে নিঃস্বার্থ ত্যাগের নজিরগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়াটাই বাঞ্ছনীয়।’
আরবাইন উপলক্ষে ইমাম হোসাইনের ভক্তগণ কারবালা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন কেউ বা নাজাফ শহর থেকে যেখান থেকে কারবালার দূরত্ব ৫৫ মাইল আর কেউ বা যাত্রা শুরু করেন বসরা শহর থেকে; কারবালা পৌঁছতে সেক্ষেত্রে অতিক্রম করা লাগে ৪২৫ মাইল। এই বিশাল দূরত্বে পদে পদে পুঁতে রাখা বোমার ভয়, অপহৃত হওয়ার ভয়। সেই ভয়কে জয় করে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণীর নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক, মৃত্যুপথযাত্রী কিংবা গুরুতর পঙ্গু-বধির-অন্ধ হোসাইন-প্রেমীরা সমস্বরে ¯ে¬াগান তোলেন, ‘যদি তারা দেহ হতে আমাদের পা এবং হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তবুও আমরা এই পবিত্র ভূমির পানে ছুটে আসবই!’
কেনো এই দু’কোটি ষাট লক্ষ মানুষের শান্তিপূর্ণ মিলনমেলা? যেখানে কোন তীর্থব্যবসা নেই। কোন চটকদার দুনিয়াবী আকর্ষণ নেই। নেই সুরম্য অট্টালিকা- শততলা স্কাইস্ক্র্যাপার।
কী উদ্দেশ্যে হুইলচেয়ারে কিংবা ক্রাচে নির্ভর পঙ্গু কিংবা হাতে লাঠি নিয়ে একজন অসহায় অন্ধ ৪০০ মাইল পার হয়ে কারবালায় ছুটে আসেন? কী জন্য একজন বৃদ্ধ পিতা তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানকে কাঁধে করে বসরা থেকে কারবালা অবধি ছুটে আসেন? কী জন্য মিম্বরের সাদা পাগড়ি পরা আলেম স্বেচ্ছাসেবিগণের সাথে রাস্তায় বসে তীর্থযাত্রীদের মাঝে ফল বিতরণ করেন কিংবা তাদের জুতো পালিশ করেন? কেনো ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া থেকে দুই কোটির অধিক মানুষ কারবালায় ছুটে আসেন! শুধু ইমাম হোসাইনের প্রেমে; যখন এই তীর্থযাত্রা মোটেও কোনো অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার নয়!
না! মিডিয়ায় মুহররম বলতে চাকু দিয়ে নিজের পিঠে আঘাত করে যে রক্তপাত দেখানো হয় সেই উদ্দেশ্যে এই তীর্থযাত্রা নয়। শুধু ক্রন্দন কিংবা ‘ইয়া হোসাইন’ বলে বুক চাপড়ানোও উদ্দেশ্য নয়। এই বিপদসংকুল পদযাত্রার পেছনে কোনো ‘বিষাদ সিন্ধু’ শ্রেণির কাহিনী প্রেরণা-দর্শন হিসেবে নিহিত নেই।
‘মানবতাকে জাগ্রত কর; অতঃপর সবাই হোসাইনকে নিজের বলে দাবি করবে।’- ‘পদ্মভূষণপ্রাপ্ত সাহিত্যিক জস মালিহাবাদি
সংকলন : মাহদী মাহমুদ