কবি হাফিজ ও নজরুলের মানবপ্রেম একই সুরে গাঁথা: ড. এম শমশের আলী
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২

বিশ্বখ্যাত ইরানি কবি হাফিজ ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিশ্বমানবতার কবি।দুজনের কাব্যেই ধ্বনিত হয়েছে মানবপ্রেম ও মানবতার মিলনের একই সুর। সোমবার বিকেলে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম শমশের আলী এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, হাফিজ বিশ্বনন্দিত একজন মহান কবি। তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এতটাই গভীর দর্শন বিশিষ্ট ছিল যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ জ্ঞানীরা তার কাব্যভাষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা ধরতে অপারগ হয়েছেন।
তিনি বলেন, আজকের মানবসমাজ সংঘাত, সংঘর্ষ ও স্বার্থপরতার যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ভালোবাসা। সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসার চেয়ে ভালো ভাষা পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আর এ কথাটি মহাকবি হাফিজ শত শত বছর আগেই তার ‘দিওয়ান’ এ বলে গেছেন। সুতরাং তিনি যে কত বড় মানবতাবাদী কবি ছিলেন, সেটি নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
একই সুর ধ্বনিত হয়েছে নজরুল ইসলামের কাব্যেও। আজ যদি নজরুল বেঁচে থাকতেন, তাহলে দেখতে পেতেন যে, আমরা সাধারণ মানুষরা আজ তার কাছ থেকে কি অসাধারণ জিনিস পেতাম।
তাই হাফিজ আর নজরুল যে মানবপ্রেম ও মানবতার মিলনের একই সুরে গাঁথা সেটি নিয়েও কোন সংশয় থাকতে পারে না।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির ভাষণে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, নিঃসন্দেহে কবি নজরুল গভীর শ্রদ্ধা করতেন কবি হাফিজকে। সেই শ্রদ্ধাটি এতটাই ছিল যে, নজরুল দিওয়ানে হাফিজের উৎসর্গ পত্রে বলেছেন – সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলেও আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয় নি। তিনি বলেন, ‘তিনি সেপথ দিয়ে এলেন যে পথে আমার পুত্রের জানাযার শবযান চলে গেছে। তিনি এলেন, আর তার চরণ সিক্ত হলো আমার চোখের জলে।
যে কবি হাফিজের চরণ সিক্ত করতে চান তার চোখের জলে, সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই তিনি হাফিজকে কি পরিমাণ শ্রদ্ধা করতেন।
হাফিজ বিশ্ববিখ্যাত, বিশ্বশ্রুত, বিশ্বনন্দিত কবি। আমরা অনেকেই হয়তো জ্ঞানের স্বল্পতাবশত হাফিজ আর নজরুলকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। আসলে ব্যপারটা এরকম নয়। শুধু নজরুল নয়, নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেবেরও শ্রদ্ধেয় কবি ছিলেন হাফিজ। নিঃসন্দেহে তিনি গজলসম্রাট।
কালচারাল রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক এবং বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি হোসনে মোবারক। তিনি অনুষ্ঠানে আগত সকলকে স্বাগত জানান এবং এই সেমিনার আয়োজনের মুখ্য উদ্দেশ্য সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তরুণ সমাজের সাথে নজরুল এবং হাফিজের মতো বিশ্বের বড় বড় মানবতাবাদী সাহিত্যিকদের ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাই এই আয়োজনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি চায়না-বাংলা কালচারাল সোসাইটির সভাপতি জাহিদ আবেদিন দেশ ও সময়ের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও হাফিজ ও নজরুলের জীবনের ঘটনা পরম্পরায় যে ঐশ্বরিক মিল দেখা যায়, সেটি তার বক্তব্যে তুলে ধরেন।
ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও কালচারাল রিসার্চ সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ‘নজরুল ও হাফেজ: মিলনের সুর’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান। তিনি বলেন- স্রষ্টা প্রেমে বিশ্বাসী কবিদের কোন বিশেষ দেশ বা জাত হয় না। তারা যে সময়ে বা যে দেশেই জন্ম নিক না কেনো, তারা হন সমগ্র বিশ্বের, সমগ্র মানবতার। প্রেম, ভালবাসা, দুঃখ-বিরহ তাদের সাহিত্যে এ সবকিছুর প্রকাশ একই হয়। নজরুল আর হাফিজও তার ব্যতিক্রম নন। আর তাই তাদের কাব্যের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় মিলনের সুর।ড. কামরুল হাসান ফারসি সাহিত্যের বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি ফিলিস্তিন, তুরস্ক ইত্যাদি মুসলিম দেশের মানবতাবাদী কবিদের নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে কাজ করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আহসানুল হাদী ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ জিহাদ উদ্দিন। তারা দুজনেই তাদের বক্তব্যে নজরুলের কাব্যসাহিত্যে হাফিজের প্রভাব ও তাদের উভয়ের কবিতার ভাষা, বিষয় ও বৈশিষ্ট্যে যে মিল রয়েছে সে বিষয়টি প্রাঞ্জল আলোচনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে বক্তারা সকলেই এ ধরনের আয়োজন আরো বেশি এবং ঘন ঘন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, আজ বিশ্বব্যপী যে সংঘাত-সংঘর্ষ, মানুষের মন থেকে অধ্যাত্মবাদের চেতনা হারিয়ে যাওয়া হলো তার মূল কারণ। আর সেজন্যই আমাদের আরো বেশি বেশি হাফিজ আর নজরুলের মতো মানবতাবাদী কবিদের সাহিত্যচর্চা করা উচিত।
অনুষ্ঠানটি ছিল আগ্রহী শ্রোতা-দর্শকে পূর্ণ। সম্মানিত অতিথিদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ছিল মনোজ্ঞ কবিতা আবৃত্তি ও নজরুল সংগীতের আয়োজন। বিশিষ্ট শিল্পী লিটন হাফিজ চৌধুরী, শাহ নওয়াজ তাবিব, রাজিন শরাফি-র নজরুল সংগীত পরিবেশনার পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তি করেন কবি মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, আবুল খায়ের নায়েম উদ্দিন, জাফর পাঠান, আতিক হেলাল, ইসমাইল হোসেনসহ আরো অনেকে। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চলচ্চিত্র ও জনসংযোগ বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন ক্বারী আলমগীর হোসেন।