সোমবার, ৩রা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

কবি আল মাহমুদ ও তাঁর ইরান ভাবনা

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৯, ২০২০ 

 

আমিন আল আসাদ

কিশোর বয়সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কবি আল মাহমুদ এর রক্তে যে সংগ্রামী চেতনা বিরাজমান ছিল তা এসেছিল তাঁর পূর্ব-পুরুষদের থেকে যাঁরা এ উপমহাদেশে এসেছিলেন জনগণকে মুক্তি দিতে, ইসলামের সুমহান আলো নিয়ে। পৌত্তলিক জাহেলিয়াতের শোষণ-বঞ্চনার ঘন অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্তিদান করতে আসা হযরত শাহ জালাল (র.)-এর অনুসারী বাহিনী বীর, পীর আওলিয়ার কাফেলার অন্যতম শাহ গেছুদরাজ (র.) ওরফে কল্লা শহীদ (র.)-দের রক্তধারা থেকেই কবি আল মাহমুদের রক্তধারায় এসেছে সংগ্রামী চেতনা। আল মাহমুদ-এর জন্মজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা বাংলাদেশের মুসলমানেরা সেসব বীর, পীর, মুজাহিদদের সম্মানের সাথে স্মরণ করে থাকেন। ভুখা-নাঙ্গা, ক্ষুধিত-বঞ্চিত গণমানুষের মুক্তির চেতনা আল মাহমুদের রক্তধারায় প্রবহমান ছিল। সেই চেতনা থেকেই তিনি একদা সাম্যবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একদা তিনি সেই সাম্যবাদী চেতনার মুখপত্র ‘দৈনিক
গণকণ্ঠ’-এরও স¤পাদক হন। তিনি দেশের মানুষের ন্যায্য মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শোষিত-বঞ্চিত, হতদরিদ্র, মানুসের মুক্তির লক্ষ্যে, মৌলিক মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগ্রামী চেতনা ছিল একটি নির্মোহ চেতনা। কোনো বৈষয়িক স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভের জন্য নয়। তাই তাঁর বিবেক ছিল নিরপেক্ষ। ভুখা নাঙ্গা, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, বৈষম্যপীড়িত গণমানুষের মুক্তির চিন্তাভাবনা থেকে একদা যিনি সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে পছন্দ করেছিলেন, একসময় তিনি দেখতে পেলেন সাম্যবাদ যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের চেতনা থেকে মানুষের বৈষয়িক মুক্তির কথা বলে তাতে মানুষের আত্মিক মুক্তির কোনো ফয়সালা নেই। কারণ, তা মানুষের তৈরি করা একটি মতবাদ। যা তাঁর ধমনীতে প্রবহমান রক্তধারার সাথে যায় না। এই সমাজতান্ত্রিক মতবাদ নিরন্ন মানুষের মুক্তির কথা বলে ঠিকই, কিন্তু এটাকে কেমন যেন অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়। যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কোনো মূলমন্ত্র নেই। এই গণমুক্তির চেতনা, মানুষের পার্থিব ও বৈষয়িক সমস্যার সমাধান, অর্থনৈতিক সাম্য সমতা অর্জনের আন্দোলনের সাথে যদি মানুষের আত্মিক মুক্তি, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির কোনো মূলমন্ত্র যুক্ত করা যায় তবেই সেটা একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তির আন্দোলন হতে পারে।
আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি লক্ষ্য করেন তাঁর ধমনীতে প্রবহমান রক্তধারার ভেতরে যে চেতনা লুক্কায়িত রয়েছে, যা এসেছে তাঁর পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে, সেই চেতনার ভেতরেই রযেছে মানুষের মৌলিক সমস্যার সকল সমাধান, মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির বাণী। তিনি বহুদিন হারিয়ে আবার খুঁজে পেলেন পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন ইসলামকেÑ যা কেবল একটি আচারস্বর্বস্ব ধর্ম নয়; বরং বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বাণী। যা কেবল কোনো একটি ধর্ম মাত্র নয়। মানুষের মুক্তির ঐশী মতবাদ।
সাম্যবাদ যা বলে বা বলতে চায়, এর সবটুকুই এখানে আছে। তবে তা অন্যভাবে আছে। এই মহামুক্তির মহাবাণীগুলো যদি মানুষ পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করে তবে যে কোনো মানব সমাজ লাভ করবে মুক্তির ফল্গুধারা। এ তো সেই ইসলাম যা তাঁর হৃদয়ের ভেতরেই ছিল, কিন্তু দেখতে তিনি পাননি। রবী ঠাকুরের ভাষায়Ñ ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলো দেখতে আমি পাইনি।’ যে ‘পলেতারিয়েত’ বা বঞ্চিত মানুষদের অধিকারের কথা কমিউনিজম বলে, সেই পলেতারিয়েত বা বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথা ইসলামও বলে। তিনি তা টের পেয়েছিলেন বলেই তিনি বলতেনÑ ‘আসছে এক শাশ্বত ঐশী আদর্শ নিয়ে নুতন বিপ্লব। বিশ্বকে কাঁপিয়ে আসছে আবার মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলাম। যা আগেও ছিল, এখনও আছে। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আসছে ইসলাম।’ তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি কবি নজরুলের ভাষায়, ‘দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দ্বীন ইসলামী লাল মশাল/ ওরে বেখবর তুইও জেগে ওঠ তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল’ বাণীর শাশ্বত আহ্বান।
কবি আল মাহমুদ-এর স্মৃতিচারণা ও মানুষের মুক্তি প্রসঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশের শিকড় সন্ধানী কবি আবদুল হাই শিকদার বলেছিলেনÑ ‘ইসলাম অব দা পলেতারিয়েত, বাই দা পলেতারিয়েত, ফর দা পলেতারিয়েত’। ইসলাম বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের মধ্য থেকে, বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষদের দ্বারা ও বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষদের জন্য।’
মহানবী (সা.) আরবের বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষদের নিয়েই ইসলামের বিজয় সূচিত করেছিলেন। যে চেতনা বহুদিন বক্ষে ধারণ করে রেখেছিলেন রাসূল (সা.)-এর আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের উত্তরসূরি হয়রত আলী (রা.), রাসূলের মশহুর সাহাবী, খলিফা ও রাসূলের বংশধরেরা। কিন্তু পড়ে একসময় মুসলমান কেবল নামে মুসলমান হয়ে থাকে। গণমুক্তির চেতনার ইসলাম দর্শন আর তাদের বক্ষে থাকেনি। যদিও পোশাক রয়েছে গায়ে। আরবের বর্তমান রাজতান্ত্রিক বিলাসের জন্য ইসলাম আসে নাই। নজরুল বলেছেন, ‘তুমি চাও নাই আমরা হইবো বাদশা নওয়াব কভু।’ কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য মুসলমানরা ইসলাম ভুলে গিয়ে বিলাস ব্যসন আর অত্যাচারী রাজতন্ত্রের তাঁবেদারি করতে থাকে। অথচ ইসলাম এসেছে দরিদ্র মানুষের মুক্তির জন্য। মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির পথ দেখাতে।
সাম্যবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত আল মাহমুদের মাঝে যে ধনতান্ত্রিক শোষণ, আধিপত্যবাদ, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা বিকশিত হয় তা তিনি প্রকৃত ইসলামের মাঝেও দেখতে পান। তাইতো তাঁর শাশ্বত উচ্চারণ ‘আসছে এত শাশ্বত পুরাতন ঐশী আদর্শ নিয়ে নুতন বিপ্লব। বিশ্বকে কাঁপিয়ে আসছে আবার মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলাম। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্যে আসছে ইসলাম।’
যেমনিভাবে তাঁর পূর্বসূরি কবি নজরুল দেখেছিলেন, ‘জাগিল আবার ইরান তুরান মরক্কো আফগান মেশের/ সর্বনাশের পর পৌষ মাস এলো কি আবার ইসলামের।’
১৯৭৯ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। সাইয়্যেদ আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে ইরানে ঘটে এক ইসলামি গণজাগরণ। সারা পৃথিবীকে ঝাঁকুনি দিয়ে ইরানের মাটিতে সংঘটিত হয় এই মহান গণবিপ্লব। যা ফেরাউনরূপী শাহকে উৎখাত করে আড়াই হাজার বছরের ইসলামবিরোধী রাজতন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলে।
১৭৮৯-৯৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৮৫৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী সিপাহি বিপ্লব, ১৮৮৬ সালের শিকাগো শহরের শ্রমিক বিপ্লব, ১৯১৮ সালের রুশ জারতন্ত্র উচ্ছেদকারী সোভিয়েত কমিউনিস্ট বলশেভিক আন্দোলনের পর ১৯৮৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মতো দুনিয়া কাঁপানো বড় ঘটনা বিশ্ববাসী আর দেখেনি। তাই গণমানুষের মুক্তির এই ইরানি বিপ্লবের শত্রু হয়ে যায় সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি, যায়নবাদী ইসরাইল, বৈষয়িক ও ভোগবাদী রাজতান্ত্রিক আরব বিশ্বসহ দুনিয়ার তাবৎ কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের শিল্পরূপকার কবি, গণমানাুষের মুক্তির চেতনার কবি আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদও তাঁর বাণী : ‘আসছে এত শাশ্বত ঐশী আদর্শ নিয়ে নুতন বিপ্লব। বিশ্বকে কাঁপিয়ে আসছে আবার মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলাম। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আসছে ইসলাম।’ এই কথার সফল বাস্তবায়ন দেখতে পান। মানুষের মুক্তির ভিত্তি আবার দেখতে পান। তিনি ইরানি বিপ্লবকে সেই নুতন মুক্তির প্রথম ধাপ হিসেবে দেখেন।
তিনি বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায় ও কলামে তা প্রকাশ করেন। তিনি ‘সাপ্তাহিক বিক্রম’ এ একটি কলাম লিখতেন ‘আল মাহদুদের কলাম’ নামে।
আল মাহমুদ একজন কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফর করেন ইরানের রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তায়। তিনি তাঁর লেখা ‘কবিতার জন্যে বহুদূর’ এ সেই কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তিনি ইরান থেকে ফিরে আলোচনা অনুষ্ঠানে ইরানের বিপ্লব, ইরানের সংস্কৃতি, ইরানের কবিদের সাহিত্য ভাবনা ও স্বপ্নের শক্তিকে প্রকাশ করেন। তিনি ফেরদৌসী, হাফিজ, রূমী, ওমর খৈয়াম, জামি, ফরিদউদ্দীন আত্তার এর সাহিত্য স¤পর্কেও কথা বলতেন তাঁর আলোচনায়।
কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদ, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি আবদুস সাত্তার পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্রের আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের কবিদের সাথে ইরানের কবি তাহেরা সফরজাদেহও এসেছিলেন। তাঁর (আল মাহমুদ) ধমনীতে যে সুফি ভাবধারা ছিল যা তাঁর কাব্যে কোথাও কোথাও এসেছে, এই সুফিজমের সুতিকাগারও ইরান। তিনি বিপ্লবের পর ইরানে গিয়ে বিপ্লবের নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ খোমেইনী (র.)-কে কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর আধ্যাত্মিক কবিতারও বাংলায় অনুবাদ করেছেন। কবিতাটি নি¤œরূপ :
আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনীর কবিতা
গজল
‘হে প্রিয়তম সুহৃদ আমার
তোমার ওষ্ঠের তিল চিহ্নটি আমায় করেছে মোহাবিষ্ট
তোমার কাতর দৃষ্টিতে আমিও কাতর
আমার আমিত্ব থেকে মুক্ত আমি এবং
বোল তুলেছি ‘আনাল হক’-এর তবলায়।
মনসুরের মতো আমিও আমার জন্য কিনেছি ফাঁসিকাঠ
প্রিয়ের বিচ্ছেদ আমার অন্তরে আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছে
আর আমি আমার আত্মার কাছে ফিরে শুনি
আমাকে নিয়ে বাজারে গুঞ্জন।
আমার জন্যে দাও শুঁড়িখানার কপাট খুলে দিনরাত
মসজিদ আর মাদ্রাসার প্রতি আমি বেজার।
আমি দেহ থেকে খুলে ফেলেছি খোদাভীতি ও লোকদেখানো
ধার্মিকতার পোশাক।
এবং পরে নিয়েছি নিরাসক্ত পীরের মোটা আলখেল্লাহ, শালীন।
বকবাজ শহুরে মোল্লাদের উপদেশে আমি তিতিবিরক্ত
আর সাহায্যটুকু তো মদাসক্ত মাতালের নিঃশ্বাস থেকেই পেয়েছি
আমাকে সেই মন্দিরের স্মৃতি ব্যক্ত করতে দাও
যে আমি জেগে উঠেছিলাম শুঁড়িখানার মূর্তিমতীর হাতের ছোঁয়ায়’
বিপ্লবী নেতা ও আধ্যাত্মিক কবি আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর উক্ত কবিতাটি একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক কবিতা। এখানে ব্যবহৃত কিছু শব্দের বাহ্যিক অর্থ দিয়ে কবিতাটি বোঝা যাবে না। অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক অর্থ দিয়ে কবিতাটি বুঝতে হবে। বোঝার সুবিধার্থে তা উল্লেখ করা হলো ।
যেমন ওষ্ঠের তিল বলতে খোদায়ী নূরের আকর্ষণকে বোঝানো হয়েছে। শুঁড়িখানা বলতে ইহজগতের সকল কিছু থেকে ভিন্ন সেই সুমহান খোদায়ী জগৎকে বোঝানো হয়েছে যেখানে আল্লাহর সবচাইতে প্রিয় বন্ধুগণ তাঁর সাক্ষাতে হাজির হন। কাতর দৃষ্টি বলতে বোঝানো হয়েছে যে দৃষ্টি প্রেমের স্বর্গীয় উৎস থেকে আসে। মূর্তিমতি বলতে বোঝানো হয়েছে আধ্যাত্মিক জগতের সেই নূর, যে নূরের ছোঁয়ায় খোদাপ্রেমিকদের হৃদয় আন্দোলিত হয়।
আয়াতুল্লাহ খোমেইনী কবিতার সংকলন ‘দিওয়ানে ইমাম’ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। ইরান গবেষক, ইসলামি চিন্তাবিদ কবি ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ২৫০ পৃষ্ঠার এই ‘দিওয়ানে ইমাম’ বাংলা ভাষায় ইমাম খোমেইনী (র.)-এর কবিতার সবচেয়ে বড় বই। এই গ্রন্থে ইমামের লেখা ১৪৭টি গজল, ২২৮টি রূবাই, ২টি মুসাম্মাত, ১টি তারজীবান্দ, কয়েকটি কিতআ ও কতিপয় বিক্ষিপ্ত বয়েত সংকলিত হয়েছে। এর আগে লেখক, কবি, গবেষক মরহুম ফরিদ উদ্দীন খান প্রকাশ করেছিলেন ‘ইমাম খোমেনীর কবিতা’ নামে ছোট একটি সংকলন গ্রন্থ।
যা হোক ড. ঈশা শাহেদী অনূদিত এই কাব্য সংকলন ২০১৮ সালো আলোর মুখ দেখলেও এর কাজ তিনি শুরু করেছিলেন এক দশক আগে থেকেই। এই বিশাল অনুবাদ কর্মে কবি আল মাহমুদ-এর হাতের ছোঁয়াও লেগেছিলো। প্রায় অর্ধশতাধিক কবিতা কবি আল মাহমুদ স¤পাদিত। ড. ঈশা শাহেদী নিজেই বলেন, ‘ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর ড. রেযা হাশেমীর পরামর্শে আমার অনুবাদের কাব্যরূপ পরিমার্জনায় বরেণ্য কবি কবি আল মাহমুদের সহায়তা নিয়েছি। তাকে আমি পড়ে শোনাতাম। আর তিনি প্রয়োজনীয় শব্দ সংযোজন বা বিয়োজন করতেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রথম দিককার ৩৩টি কবিতার কাব্যরূপ সমন্বিত করা হয়।’
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত চল্লিশ বছরে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ইহুদি যায়নবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু ইরানি জনতার আত্মচেতনা আর কবি আল মাহমুদ-এর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবিতাসমূহের চেতনা মূলত অভিন্ন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) ফিলিস্তিনি গণ-মানুষের মুক্তির লড়াইকে সমর্থন দেন। ইসরাইলের সাথে স¤পর্কচ্ছেদ করে ইসরাইলের দূতাবাস উচ্ছেদ করে সেই ভবনে ফিলিস্তিনের দূতাবাস স্থাপন করেন। ইসরাইলের পতাকা নামিয়ে ইরানি বিপ্লবীরা উড়িয়ে দেয় ফিলিস্তিনি পতাকা। অসংখ্য নবী-রাসূলের (আ.) স্মৃতি বিজরিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস তথা আল কুদস পুনরুদ্ধারের জন্য মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল কুদস দিবস ঘোষণা’ করে সারা দুনিয়ায় আল কুদস পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের চেতনাকে ছড়িয়ে দেন।
এই ধনতান্ত্রিক ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে কবি আল মাহমুদও লিখেন অম্লান সব কবিতা।
পৃথিবীর বুকে ইহুদিবাদ এবং বিগত শতাব্দীতে উদ্ভূত সম্প্রসারণবাদের ইহুদি সংস্করণ ‘যায়নবাদ’ মানব সমাজের শান্তি এবং ভারসাম্যপূর্ণ স¤পর্ক বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নীতিতে ইহুদিরা অভিশপ্ত করে তুলেছে ধরাপৃষ্ঠকে এবং নিজেরাও হয়েছে অভিশপ্ত। কোরআনে আল্লাহপাক এই ইহুদি জাতিগোষ্ঠীটিকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অভিশপ্ত জাতি হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছেন। কবি আল মাহমুদের অনুভবেও তাই অনুরণিত হয়Ñ
‘অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে যায়
চারিদিকে ডাইনীদের ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস
আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতংকে আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়
ঠিক তখনি ইহুদীরা হেসে ওঠে।’
[ইহুদীরা/কাব্যগ্রন্থ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না ]
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৩ জুন ২০০৭ তারিখে ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের কালচারাল কাউন্সেলর ড. হাশেমীর সভাপতিত্বে বিশিষ্ট সাংবাদিক অধ্যাপক সিরাজুল হক সাহেবের পরিচালনায় এক আন্তর্জাতিক মানের কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি আল মাহমুদ। কবিতা পাঠে অংশ নেন কবি কে.জি. মোস্তফা, কবি এরশাদ মজুমদার, কবি আবদুল মুকিত চৌধুরী, কবি অধ্যাপক সিরাজুল হক, কবি আ.স.ম. বাবর আলী, কবি হাসান আলীম, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি ঈসা শাহেদী, কবি মাওলানা মাহবুবুর রহমান, কবি শাহনেওয়াজ তাবীব, কবি আমিন আল আসাদ, কবি ও রম্য লেখক লিয়াকত আলী, ড. আবদুস সবুর খান, ড. তারিক সিরাজী। আসরে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, আরবি কবিতা পঠিত হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘ইমাম খোমেইনী (রহ) ছিলেন এক সুমহান ব্যক্তিত্ব যাঁর ভেতর সুপ্ত ছিল প্রজ্ঞার এক মহাসমুদ্র। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, ধর্মীয় প্রজ্ঞা, আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস ঐতিহ্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল। তিনি জ্ঞানী ছিলেন। একই সাথে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও দার্শনিক ছিলেন। সেকারণে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে ইসলামি বিপ্লবের বিশ্বয়কর সফলতার দ্বার উন্মোচন। শুধু তাই নয়, তিনি একজন কবিও ছিলেন। তবে তিনি শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন আধ্যাত্মিক পুরুষ ও কবি। তাঁর কবিতাগুলো আধুনিক ফারসি সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর কবিতা আধ্যাত্মিকতা এবং প্রেমের দ্বৈত সম্মিলন ঘটিয়েছে। হতে পারে সেটা খোদার সাথে গভীর প্রণয়। আমি ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর একটি কবিতা অনুবাদ করেছিলাম। তা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। [ ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিশাল স্মারক গ্রন্থ ‘আলোর স্মারক’-এ সেটি আছে।] আমি ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি আমার একটি কাব্যগ্রন্থে সেই অনূদিত কবিতাটি প্রকাশ করেছি। এছাড়া আমার কবিতাসমগ্রেও তা আছে। আমি একবার কলকাতায় একটি সাহিত্যের অনুষ্ঠানে ছিলাম। সেখানকার কয়েকজন বড় কবি, যাঁরা আমার অনূদিত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর কবিতা পড়েছিল, আমাকে তাঁরা বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেছেন ইমাম খোমেইনী কবিতা লিখতেন!
আমি বিপ্লব-পরবর্তীকালে ইরানে গিয়েছিলাম । ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, তাঁর চিন্তা ও দর্শন একটি জাতিকে কীভাবে আলোড়িত করেছিল আমি তা স্বচক্ষে দেখে এসেছি। তিনি গোটা ইরানি জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ইসলামি দুনিয়ায় তিনি এক জ্বলন্ত ইতিহাস হয়ে আছেন। আমি তেহরান গিয়েছি। ইসফাহান গিয়েছি, সিরাজে গিয়েছি, কাশানে গিয়েছি, দামাভান্দ-এ গিয়েছি। তেহরান ইউনিভার্সিটিতে জুম্মার নামাজে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে আছে। সেবার ছিল একটি বরফে ঢাকা দিন। প্রচ- বরফ পড়ছে। আমি গায়ে দিয়েছিলাম একটি প্যারাসুট কাপড়ে তৈরি চাদর। এ ধরনের চাদর যেসব দেশে বরফ পড়ে সেসব দেশের মানুষেরা পরিধান করে। চতুর্দিকে বরফ আর বরফ। প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পূর্বে একজন বক্তা বক্তৃতা করলো। বক্তব্যের অভিব্যক্তি তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল। সে কেদে কেদে বক্তৃতা করছিল। তার অন্তরাত্মা থেকে যেন আগুন-জলোচ্ছাস উপচে পড়ছিল। আমি অভিভূত হয়ে শুনেছি সে বক্তৃতা। আমার ফারসি-জানা বন্ধু বক্তব্যের ভাবার্থ আমাকে সাথে সাথে বুঝিয়ে বলছিল।
কবিদের কাজ কী? মানুষের জন্য স্বপ্ন নির্মাণ করা। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষের জীবনে যতটুকু বাস্তবতা তার তিন গুণ স্বপ্ন দ্বারা পরিবেষ্টিত। স্বপ্নহীন মানুষ নিশ্চল পাথরের মতো। স্বপ্ন মানুষের ফিতরাত। আর কবিদের কাজ হলো মানুষের ভেতরের স্বপ্নকে উজ্জীবিত করা। তাকে আন্দোলিত করা। আমি সারা জীবন তাই করেছি। ইমাম খোমেইনী (রহ.) যেমন বিপ্লবী ছিলেন তেমনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপও দিয়েছিলেন। তিনি একই সাথে বিপ্লবী,
মুজতাহিদ ও কবি। সে কারণেই কাজটি তিনি শৈল্পিকভাবে সুস¤পন্ন করতে পেরেছিলেন। আমি আর কি বলব তাঁর স¤পর্কে? আমি একজন নগন্য মানুষ। তিনি ছিলেন বিরাট সমুদ্রতুল্য। বিশাল বটবৃক্ষ ছিলেন তিনি ইরানি জাতির কাছে। তিনি শুধু ইরানি জাতির নেতাই নন। তিনি গোটা মুসলিম বিশ্বকে আত্মসচেতন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
আমি খুবই অসুস্থ। ঘরের বাইরে খুব একটা যাই না। আগের মতো এতো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারি না। আমি একজন প্রায়ান্ধ মানুষ। কানেও কম শুনি। ৭২ বছর বয়স হয়েছে আমার। ডাক্তার আমাকে বলেছে, ‘হায়াত-মওত-এর মালিক আল্লাহ। তবে আরো কয়েকটা দিন যদি সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চান তবে বিছানা ছেড়ে এবং ঘর থেকে কোথাও যাওয়া যাবে না। চুপ-চাপ শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতে হবে। এহেন অবস্থায়ও আমি ছুটে এসেছি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মতো এক মহান আধ্যত্মিক ব্যক্তিত্বের স্মরণসভায়। একজন মুসলমান হিসেবে আমার বিশ্বাস আজকে যেসব কবি এখানে তাঁকে নিবেদিত কবিতা পড়লেন এবং উপস্থিত শ্রোতাম-লী যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন এবং আজকে যাঁরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজক তাঁরা নিশ্চয়ই এ জন্য মহান প্রভুর কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। এই মহাত্মার পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করে এবং সেই সাথে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের কল্যাণ কামনা করে বক্তব্য শেষ করছি।’ [ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে আয়োজিত নিবেদিত কবিতা পাঠের আসরে কবি আল মাহমুদ/ সূত্র : জুন-জুলাই সংখ্যা, নিউজলেটার, ২০০৭]