শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে : কিছু অনুভূতি

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ৩১, ২০১৮ 

আমিন আল আসাদ :

পারস্য বা ইরান দেশের কথা সর্বপ্রথম জেনেছিলাম ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে। ইরানের কবি শেখ সাদীর জীবনের ঘটনা নিয়ে একটি গল্প ‘পোশাকের গুণে’ পাঠের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইরানের নাম আমার চেতনায় স্থান লাভ করে। এছাড়া সপ্তম শ্রেণীর সাহিত্য পাঠে ‘সোহরাব রুস্তমের কাহিনী’ নামে একটি গল্প পাঠ করেছিলাম। বিদ্যালয়ের সেলিম স্যার কি দারুণভাবে পড়িয়েছিলেন গল্পটি আজো মনে আছে। গল্পটি ইরানের জাতীয় কবি মহাকবি ফেরদৌসীর শাহানামায় রয়েছে।
আমার মেজচাচা মরহুম জহুরুল করিম চৌধুরী একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বইপ্রেমিক ও পাঠপ্রিয়। তিনি আমাদেরকে নানা উপলক্ষে বই উপহার দিতেন। বার্ষিক পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ভালো রেজাল্ট করায় তিনি আমাকে ও তাঁর ছেলে মঞ্জুর-উল করিম চৌধুরীকে যথাক্রমে ‘ফুটলো গোলাপ ইরান দেশে’ এবং ‘শাহনামার গল্প’ নামে দুটি বই উপহার দেন। আমি পেয়েছিলাম মরহুম আখতার ফারুক সাহেবের লেখা ‘ফুটলো গোলাপ ইরান দেশে’ বইটি। দুটি বইই আমরা বিনিময় করে পড়েছিলাম। এভাবে শৈশব কৈশোর কাল থেকেই আমাদের স্বদেশের পাশাপাশি ইরান দেশটিও যেনো কেমন করে আপন হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনো ভাবিনি মহান আল্লাহ সেই ভালো লাগা দেশটি ভ্রমণের তওফিক দেবেন।
গিয়েছিলাম ইমাম খোমেনী (র)-এর ১৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ২০০৮ সালে। আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদি, বিশিষ্ট লেখক আহমেদুল ইসলাম চৌধুরী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি আহমেদ কায়সার, প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটুয়ারী, ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, মাওলানা সাবির রেজা, জনাব রাশেদুজ্জামান, জনাব আবু সায়িদ প্রমুখ। এর মধ্যে জনাব ্আবু সায়িদ আমাদের সাথে জাননি, তিনি ইরানেই থাকতেন। দেশে এসেছিলেন তাই ফিরছিলেন আমাদের সাথে। তিনিও যোগ দেবেন ইমাম খোমেনী (র)-এর মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। আমরা গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে তেহরান যাব। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইরানের উদ্দেশে আমাদের বোয়িং আকাশে উড়াল দেয়ার সাথে সাথে এক অভাবনীয় আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো দেহমনে। কারণ এটাই ছিলো জীবনে আমার প্রথম বিমান যাত্রা আর যাচ্ছি আমার আদর্শের প্রতিষ্ঠাভূমিতে। কারণ আমি যে সমাজের স্বপ্ন দেখি তা বিংশ শতাব্দিতে ইরানই করে দেখিয়েছে। যেখানে ঘটেছে এক আলোকের বিস্ফোরণ যা আলোকিত করেছে ইরানবাসীকে ও বিশ্ববাসীকে। হ্যাঁ আমরা যাচ্ছি, কবিতার দেশে ও বিপ্লবের দেশে পারস্য সভ্যতার দেশে। সাহাবী সালমান ফার্সী (রা)-এর দেশে। যে দেশ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী (সা) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যখন সুরা মুহাম্মদের শেষ আয়াত নাযিল হয়। ‘যদি তোমরা পেছন ফিরে যাও তবে আল্লাহতাআলা এমন এক জাতিকে বছাই করবেন যারা তোমাদের মতো হবে না। সাহাবীরা রাসূল (সা) কে বললেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! যদি আমরা পেছন ফিরে যাই তবে আল্লাহপাক কোন জাতিকে বাছাই করবেন?’ সালমান ফারসী (রা) রাসূল (সা)-এর পাশেই বসা ছিলেন। নবীজী (সা) সালমান ফারসী (রা)-এর উরুতে স্পর্শ করে বললেন এই ব্যক্তি ও তার জাতি। শপথ তাঁর, যার হাতে আমার জীবন, ঈমান যদি আকাশের সুরাইয়া তারকাতেও ঝুলে থাকে ফারসের মানুষ সেখান থেকে তা ছিনিয়ে আনবে’। সেদিনকার সেই ফারস-ই আজকের ইরান বা ফারসী বা পারস্য। সপ্তম শতকে মুসলিম বিশ্বে যত জ্ঞানী গুণী জন্মগ্রহণ করেছিলেন এর বেশীরভাগই পড়েছিলো ইরানী ভ’খন্ডে। তখন ইরান আরো বড় ছিলো। ইরাকের একটা বিরাট অংশ আর সমরকন্দ, বুখারা, তাজিকিস্তান, কাজাখিস্তান প্রভৃতি রাশিয়া অধিকৃত প্রদেশগুলোও ইরানের ছিলো। শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের পন্ডিতগণ ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মগ্রহণ করেন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, মহাকাশবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ প্রমুখ।
ইরানের কবিদের নাম বিশ্বসাহিত্যের আসরে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে অবস্থান করছে। বিশেষ করে ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসী ছাড়াও শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, নিযামী, রুদাকী, সুফী কবি মাওলানা রুমী, ফরিদউদ্দীন আত্তারের কথা বিশ্বের কবিদের মুখে মুখে বিরাজমান। মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী, চিকিৎসাবিদ ইবনে সীনা, মহাকাশ বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল বিরুনী, পদার্থবিদ আল ফারাবী, প্রমুখ জ্ঞানীগুণীরা ইরানে জন্মেছিলেন। আমাদের দেশে মরহুম সাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন ইরানের কবিদের নিয়ে লিখেছিলেন ‘ইরানের কবি’ নামে এক বিশাল বই। আর মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছিলেন ‘পারস্য প্রতিভা’। আমরা জ্ঞানীদের দেশ কবিদের দেশ এবং মহান ইমাম খোমেনী (র)-এর দেশ, মহান ইসলামী বিপ্লবের দেশ ইরানে যাচ্ছি। আমরা ঢাকা থেকে বাহরাইন এবং বাহরাইন থেকে তেহরান গেলাম।
আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বদেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের রয়েছে জাতীয় সংস্কৃতি। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পেয়েছি স্বাধীন স্বদেশ। তেমনি ইরানেরও রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। হাজার বছরের নানা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭৯ সালে মহান ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমেই সত্যিকার স্বাধীন দেশে পরিণত হয় ইরান। প্রকৃত স্বাধীনতা মানে কি? প্রকৃত স্বাধীনতা মানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত না করা। দুনিয়ার কোন দেশ বা কোন মানুষ আমার প্রভূ নয়; বরং বন্ধু হতে পারে। আমার দেশের সীমানা, আমার দেশের জনগণের ভাল মন্দ, আমাদের আয়-উন্নতি, শিক্ষা দীক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, ও ধর্মের ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাতে পারবে না। কেউ কিছু জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। এটাই হলো আসল স্বাধীনতা। কাজেই আমাদের স্বাধীনতাকে মজবুত করতে হলে আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। দৃঢ় শপথ নিতে হবে। কঠোর পরিশ্রমী ও সৎ হতে তবে। এটা ইরানী জাতি থেকে শেখার আছে। কারণ ইরান ও আমাদের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। যেমন আমরা বলি একুশ মানে মাথা নত না করা। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীর ভাষা সংগ্রাম আমাদেরকে মাথা নত না করার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। কারণ একজন দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত ঈমানদার কোন আধিপত্যবাদীর কাছে মাথা নত করতে পারে না। আমরা বাংলাদেশিরা যেমন নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ভাষা ও ইতিহাসের দাঁড়িয়ে সাহসি ও স্বাধীন চেতনার অধিকারী হয়েছি, ইরানীরাও ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যে ইসলামী বিপ্লব করেছে সেখান থেকে মাথা নত না করার শিক্ষা লাভ করেছে এবং দিনে দিনে উন্নতি লাভ করেছে। ইরানের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে জনগণের ধর্মবিশ্বাসের মিল, ইতিহাসের বিভিন্ন সময় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতেও ইরানের নানা বিষয় প্রবেশ করেছে। যেমন এদেশে যে সূফিগণ ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানী ভাবধারার। তারা সবাই ছিলেন নবীবংশের ভক্ত। বাংলা ভাষায় সাড়ে সাত হাজার ফার্সি শব্দ সরাসরি প্রবেশ করেছে নানা পরিভাষায়। আরো অনেক ফার্সী শব্দ এসেছে বাংলায় পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে।
এদেশের শাসকদের সাথেও ইরানের এবং ইরানের কবিদের সম্পর্ক ছিলো। আমরা জানি সোনারগা থেকে যে সব সুলতান বাংলা শাসন করতেন তাঁদের সাথে ইরানের বন্ধুত্ব ছিলো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ইরানের কবি হাফিজকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই মধ্য আকাশ থেকে আমরা ক্রমেই তেহরানের আকাশে এবং তেহরানের মাটির দিকে নেমে আসছিলাম। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম মধ্যদুপুরের সোনালী রোদে চকচক করছিলো তেহরানের রাস্তাঘাট, গাড়ি, বাড়িঘর, গাছপালা, বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, উঁচু গম্বুজ ইত্যাদি। আমরা অবতরণ করছি ইমাম খোমেনী (র) বিমানবন্দরে। কবিতার দেশ ও বিপ্লবের দেশ আর বিশ্বসেরা গোলাপের দেশ ইরানের মাটি স্পর্শ করতে করতে অপার এক আনন্দে দুলে ওঠলো মন এই ভেবে যে আমরা আমাদের স্পপ্নের ভূমিতে এসে পড়েছি। বিমানের চাকা তেহরানের মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথেই সকল যাত্রী সহ একসাথে দরূদ পাঠ করলাম নবীর শানে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মুহাম্মদ’। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ শেষ করে এগিয়ে যেতেই লক্ষ্য করলাম দু’জন যুবক আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন ইমামের ছবিযুক্ত এক প্লাকার্ড হাতে নিয়ে। তাতে ইংরেজীতে যা লেখা তার অর্থ হচ্ছে ‘আমরা ইমাম খোমেনী (রহ)-এর ঊনিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে বিদেশী অতিথিদের আগমনের অপেক্ষা করছি’। আমরা বললাম ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
তাঁরা বললেন ‘হ্যা, আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি।’ তাঁরা তাঁদের অতিথিদের নামের তালিকা বের করে আমাদের সাথে পরিচিত হলেন। যুবক দুজন তেহরান ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমাদের লাগেজগুলো খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করলেন তারা। এরপর আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে এলেন বিমান বন্দরের বাইরে। এখানে আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে চারটি মূল্যবান মোটর কার। হাত ইশারায় গাড়িতে চড়তে অনুরোধ করে বললেন ‘বেফারমাইদ’ অর্থাৎ দয়া করে ওঠুন। গাড়ী ছুটে চললো ‘কিয়াবানে ইমাম খোমেনী’ অর্থাৎ ইমাম খেমেনী (রহ) সড়কের উপর দিয়ে। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। দু’চোখ ভবে দেখলাম ইরানী বিকাল। তেহরান বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহর। চতুর্দিকে পাহাড় আর পাহাড়। পুরো তেহরান শহর ঘিরে আছে আল-বোর্য পর্বতমালা। এর আশ-পাশে ছড়িয়ে আছে ধুসর পাহাড়। পাদদেশে সমতল ভূমিও রয়েছে বিস্তীর্ণ। ছোট বড় পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা। আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে সত্তর কিলোমিটার গতিতে হু হু করে। অনেক গাড়ি আসছে যাচ্ছে। আমরা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মাজারের পাশ দিয়েই অতিক্রম করলাম। ড্রাইভার আমাদের হাত ইশারায় দেখালো ইমামের মাজার। এটাই বেহেশত জাহরা। এখানে শুয়ে আছেন সত্তর হাজারেরও অধিক শহীদান। যাঁরা ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্যে অকাতরে তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। তাঁরা মরে নি। তারা জীবিত। ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা শহীদ তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত’। আল কুরআনের বাণী অনুসারে কবিও বলেন সে কথা-
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই”
আমাদেরকে হোটেল ইস্তেকলাল-এ নিয়ে যাওয়া হবে। ইরানে তিনটি ফাইভস্টার হোটেল খুবই নামকরা। হোটেল ইস্তেকলাল, হোটেল আজাদী, হোটেল লালেহ। হোটেলগুলোর অন্য নাম ছিলো। বিপ্লবের পর এ ধরনের নামকরণ করা হয়েছে। ইস্তেকলাল মানে স্বাধীনতা, আজাদী মানে মুক্তি, আর লালেহ অর্থ লাল টিউলিপ- সংগ্রামের প্রতীক। আমাদের দেশে যেমন সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে পলাশ, শিমুল রক্তজবার কথা উল্লেখ করা হয়। আমরা হোটেল আজাদীর পাশ দিয়েই গেলাম। হোটেল আজাদী পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে। চলতি পথে একটি টাওয়ার দেখতে পেলাম। এর নাম বুরজে মিলাদ। বড় অট্টালিকাগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ইরানের কৃতি সন্তান যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের বিরাট ছবি আকা রয়েছে। শহীদ ড. বেহেশতি, শহীদ আয়াতুল্লাহ মোরতাজা মোতাহারী, শহীদ ড. মোস্তাফা চারমান, শহীদ ড. জাভেদ বাহোনার, শহীদ প্রেসিডেন্ট আলী রাজাই প্রমুখ। আরেকটি অট্টালিকার দেয়ালে দেখলাম ফিলিস্তিনের ইসলামী বিপ্লবের (হামাস) নেতা শহীদ শেখ মুহাম্মদ ইয়াসিন এবং সম্প্রতি শহীদ ইমাদ মগনিহ-এর ছবি যার পেছনে আল কুদস বা বায়তুল মুকাদ্দাসের বিশাল আকৃতির ছবি। এসব দেখতে দেখতে যখন হোটেল ইস্তেকলালে আমরা এসে পৌছলাম তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে।
বিশ্বসাহিত্যের আসর মাতানো শাহনামার দেশ, মসনবী শরীফের দেশ, গুলিস্তা, বুস্তা আর কারিমায়ে সাদীর দেশ, দীওয়ানে হাফিজ ও রুবাইয়াতে ওমর খৈয়ামের দেশ, আলো ঝলমল ও মোহময় পারস্য উপন্যাসের দেশ- সর্বোপরি ইমাম হোসাইন (আ)-এর বিপ্লবী চেতনার দেশ ইরান যেমন এক স্বপ্নের ভূমি, তেমনি এক আপোষহীন সংগ্রামেরও ভূমি। সেজন্যেই ইরান যেমন কবিতার দেশ তেমনি বিপ্লবের দেশ। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিলো একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায়। ইসলামের ইতিহাসের এক মহান আত্মত্যগের ঘটনা হলো কারবালায় সপরিবারে ইমাম হোসাইন (আ)-এর আত্মত্যাগ। কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ)-এর শাহাদত ও কালজয়ী বিপ্লবের চেতনাই সমগ্র ইরানী জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিলো। সেজন্যেই ইরানকে বলা হয় আশুরা সংস্কৃতির লালনভূমি।
মহান ইমাম খেমেনী (রহ) ইরানী জাতির মাঝে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভোরের আকাশে সূর্যের মতো। তাঁর আসল নাম সাইয়েদ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা মুসাবী আল খোমেনী। তিনি ছিলেন নবী বংশের সন্তান। ইমাম হোসাইন (আ)-এর বংশধারায় জন্ম নেয়া ৭ম ইমাম মুসা কাজেম (আ)-এর বংশধর। ইরানের জনগণ তাঁর মতো মানুষের নেতৃত্ব পেয়ে বিশ্বের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো- যেনো কুয়াশা আর বরফে আবৃত শীতের জড়তা ভেঙে জেগে ওঠলো হাজারো পুষ্প কানন। মানুষ তার অধিকার ফিরে পেলো। ইরানের জনগণের উপর চেপে থাকা অত্যাচারী শাহ দেশ ছেড়ে পালালো। ইমাম খোমেনী শুধু ইরানী জাতিকেই ঝাকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেননি, গোটা বিশ্বের মুসলমান ও নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে নুতন করে আশা জাগালেন। বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে এসে পৃথিবীর দিকে দিকে দেশে দেশে মুসলমানদের জাগরণ আমরা দেখতে পেয়েছি। ইরানের ইসলামী বিপ্লব সেইসব জাগরণকে নুতনভাবে প্রেরণা দিলো। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর ইহুদীদের নির্যাতন বর্বরতার সকল সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ইমাম এসব কঠিন মুহূর্তে মুসলিম জাতিকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিলেন। ইমাম সকল দেশ-ভাষা, বর্ণ ও মাজহাবের মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হবার উপদেশ দিলেন। মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-কুদস বা বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের মুক্তির ব্যাপারে সকল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে প্রতি বছর মাহের রমজানের শেষ শুক্রবার তথা পবিত্র জুমাতুল বিদা-কে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করলেন। এখনো প্রতি বছর বিশ্বের সবকটি মুসলিম দেশে আল-কুদস দিবস পালিত হয়। ইমাম বলেছিলেন ‘বিশ্বের সব মুসলমান যদি ঐক্যবদ্ধ হতো আর ইসরাইলের উপর সকলে মিলে একবালতি করে পানিও ঢেলে দিতো তবে ইসরাইল বাণে ভেসে যেতো।’ আমরা দেখেছি সালমান রুশদী নামের এক কুখ্যাত বৃটিশ লেখক মহানবী (সা) সম্পর্কে যখন খারাপ মন্তব্য করে স্যাটানিক ভার্সেস নামে এক বাজে বই লিখে তখন একমাত্র ইমাম খোমেনী (রহ) পরাশক্তির সকল ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে সালমান রুশদীর মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া দিলেন। আমরা দেখেছি ইমামের ফতোয়া ঘোষণার মাধ্যমেই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সালমান রুশদী ও তার স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। পৃথিবীতে একই বিষয় নিয়ে একই সাথে সব মানুষের এমন আন্দোলন আর দেখা যায়নি। আমাদের দেশের মুসলমানরাও সালমান রুশদী বিরোধী আন্দোলন করেছিলো।
ইরানের রাজধানী তেহরানের পুরোটাই ইমাম ও ইসলামী বিপ্লবের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তেহরানের রাস্তাঘাট, মেহেরাবাদ বিমান বন্দর, আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকিলাব, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, খোনে ইমাম বা ইমামের বাসগৃহ, সর্বোপরি বেহেশত যারা সহ স্মৃতিময় প্রত্যেকটি স্থান যেনো বিপ্লবের এক একটি সৌধ। বাতাসে কান পাতলে আজো যেনো শোনা যায় উত্তাল জনতার আকাশ কাঁপানো স্লোগান যা ফেরাউনরূপী শাহ, হামানরূপী আমেরিকা ও কারূণরূপী ইসরায়িলের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলো। মাটিতে হৃদয় বিছালে আজো পাওয়া যায় বীর শহীদদের বক্ষ থেকে ছিটকে পড়া রক্তের উত্তাপ। আমি আর হাদী সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়তাম রাস্তায়। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতাম। কল্পনায় খুঁজে বেড়াতাম সেই দৃশ্যগুলো। মনে হতো যেনো এই ফ্লাইওভারের উপরে ও নীচের রাস্তায় লক্ষ জনতার মিছিল। এই সব রাস্তাঘাটেই ইমামের মুক্তির দাবীতে, ইমামের নির্বাসনের বিরুদ্ধে, ইমামকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্যে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই নেমে এসেছিলো। ‘মোর্গ বর শাহ’ অর্থাৎ শাহের পতন হোক। কিংবা ‘আজাদী,নাজাতি, জমহুরীয়ে ইসলামী’ অর্থাৎ স্বাধীনতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র। কিংবা ‘আজ মুক্তির দিন’ ‘শহীদদের আত্মাদের ফিরে আসার দিন’ ‘শাহের পতন হোক’ ‘খোমেনী স্বাগতম’ ‘হয় খোমেনী না হয় মৃত্যু’। আমরা পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে আর তেহরান ইউনিভার্সিটি ও ময়দানে ইনকিলাবে গিয়ে বিপ্লব চলাকালিন সময়ের ময়দান্ েইনকিলাব ও তেহরান ইউনিভার্সিটির কথা মনে করলাম যা ছিলো জনতার প্রতিরোধ দূর্গ। এই তো সেই জুমার নামাজের স্থান যেখানে আজো জাতীয়ভাবে জুমআর নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মেহেরাবাদ বিমানবন্দরে গেলাম। মেহেবাবাদ বিমান বন্দর ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে এক অক্ষয় মনুমেন্ট। এই বিমান বন্দর দিয়েই অত্যাচারি শাহ ইমামকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলো। অদৃষ্টের অবধারিত পরিণামে ইরানী জনগণের ঘৃণা অবজ্ঞার আবর্জনা মাথায় করে শাহ সপরিবারে এই বিমান বন্দর দিয়েই পালিয়েছিলো। এবং এ বিমান বন্দরেই ইমাম অবতরণ করেছিলেন বীরের বেশে। ইমামকে জীবিতাবস্থায় না দেখলেও আমার মনে হলো যেনো আমি দেখছি ওই তো এয়ার ফ্রান্সের সিড়ি বেয়ে ইমাম দৃঢ়তার সাথে বীরের বেশে নামছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বদেশের মাটিতে। সারা বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য, ফটোসাংবাদিক, পত্রিকার রিপোর্টার ও টেলিভিশন ক্যামেরাম্যানদের দারুণ ব্যস্ততা। মেহেরাবাদ থেকে আযাদী স্কোয়ার পর্যন্ত লক্ষ মানুষের ভিড়। তিল ধারণের ঠাই নেই। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও এসেছে। প্রত্যেকের হাতে রক্তগোলাপ, লাল টিউলিপ আর কারনেশন। মেহেরাবাদ বিমান বন্দরের অদূরেই আযাদী স্কোয়ার মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ওইতো এখানে ইরানী জাতি সম্বর্ধনা জানাচ্ছে ইমামকে। ইমাম জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন। জনতা সেøাগান দিচ্ছে। ‘আল্লাহু আকবার, খোমেনী রাহবার’। আযাদী স্কোয়ারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে নিরবে অনুভব করা যায় সেদিনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা।
রাজধানী তেহরানের এক প্রান্তে পাহাড়ের উপর যে মহল্লায় ইমামের বাড়ি তার নাম জামারান। ইমাম এখানে থাকতেন বলে তাঁকে বলা হতো জামারানের পীর। এখানে একটি ছোট্ট ঘরে ইমাম থাকতেন। ইরানের শাহ যেখানে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছিলো বিশাল রাজপ্রাসাদ। সেই জাতীর নেতৃত্ব দিয়ে ইমাম দিন কাটাতেন গরীবের বেশে। ইমামের ঘরে রয়েছে একটি সাধারণ সোফা সাদা কভারে আচ্ছাদিত, একটি ছাতা, ইমামের ছেলে মোস্তফা খোমেনীর ছবি, একটি ঘড়ি ও সাদাকালো একটি টেলিভিশন। পাশেই রয়েছে মসজিদ। যেখানে উপরে একটি চেয়ার পাতা রয়েছে। এখানে বসে ইমাম ভাষণ দিতেন। আমার মনে হলো আমি তাঁর বয়ান শুনতে পাচ্ছি। ইমামকে সরাসরি না দেখলেও তাঁর স্মৃতিবিজড়িত একেকটি স্থানে গিয়ে গিয়ে তাঁর জীবিতকালের দৃশ্যগুলোই আমি কল্পনার পর্দায় দেখতে লাগলাম। ইমামের বাসস্থানের পাশেই একটি ঘরে ইমামের অন্তিম জীবনের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে যা ইমামের হাসপাতাল জীবনের শেষ দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। ওই তো সেই বেড যেখানে অসুস্থাবস্থায় ইমাম শুয়েছিলেন। ওই তো সেই স্যালাইনের বোতল ও পাইপগুলো যা অক্ষত রাখা হয়েছে। এই সেলাইনের বোতল ঝোলানো অবস্থায়ও ইমাম তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেছেন, রূকু সেজদা দিয়েছেন। পেছন থেকে ডাক্তার ইমামের রূকু সেজদার সাথে সাথে স্যালাইনের বোতলটি সাবধানে উঠাচ্ছিলেন-নামাচ্ছিলেন যাতে ইমাম কষ্ট না পান।
ইমামের বাড়িটি দেখলাম আবার পাশাপাশি আমাদেরকে রেজা শাহ পাহলভীর জৌলুষপূর্ণ জীবন যাপনের প্রমাণ স্বরূপ শাদাবাদ প্যালেস যাদুঘরও দেখানো হলো। সমস্ত ইরানবাসীকে শোষণ করে শাহ কিভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো কিভাবে শাহ ও তার বংশধর সাঙ্গ-পাঙ্গরা ইরানী জাতিকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করছিলো আমেরিকার তাবেদারী করে সেটা না দেখলে বোঝানো যাবে না।
ইমামের মৃত্যু দিবস ৩রা জুনে বেহেশত জাহরায় জড়ো হয়েছে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ। সারা ইরানের বিভিন্ন শহর থেকে গাড়ী বোঝাই করে জনতা ছুটে এসেছে ইমামের রওজায়। ইমামের মাজারের পশ্চিম পার্শ্বে উপরে স্থাপিত হয়েছে মঞ্চ। আমরা মঞ্চের সামনে ছিলাম। ইরানের নেতৃবৃন্দ ভাষণ দিলেন। আলেমগণ বয়ান রাখলেন। ইমামের নাতি সৈয়দ হাসান খোমেনী ভাষণ দিলেন প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিলেন। মুহুর্মুহ দরূদ, দোয়া, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে এবং কিছুক্ষণ পরপর আমেরিকা ও ইসরাইল বিরোধী সেøাগানে এক অন্যরকম দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। অবশেষে রাহাবার ভাষণ দেয়ার জন্যে দাঁড়ালেন তখন জনতার সেøাগানের আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো।
এই সেই বেহেশত জাহরা। এখানে আমরা দাঁড়িয়ে। এখানে শুয়ে আছেন দুই লক্ষেরও অধিক শহীদান, যাঁরা আমেরিকার নির্দেশে ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। যাঁরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্যে অকাতরে তাঁদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এতো শাহাদাত, এতো রক্তদান কিন্তু ইরানী জাতিকে ভয় পাইয়ে দেয়নি বরং কারবালায় সত্যের জন্যে ইমাম হোসাইন (আ)-এর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে এই ত্যাগকে খুব সামন্যই মনে করেছেন তারা। ইমাম হোসাইন (আ)-এর শাহাদতের চেতনায় নুতনভাবে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছেন। মনে হলো ওই তো জনতা সেøাগান দিচ্ছে ‘হররোজ আশুরা, হরজমিন কারবালা’।
তেহরানের পথে প্রান্তরে ইমাম খোমেনী (র) ও ইসলামী বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো যেমন স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সুযোগ পেয়েছিলাম ইমামের বাড়ীঘর ও মাজার যিয়ারতের, তেমন আমরা সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম মাশহাদ প্রদেশে গিয়ে নবীবংশের ৮ম ইমাম রেজা (আ)-এর মাজার যিয়ারতের। এই মহান ইমাম ও ওলী-আল্লার রূহানী বরকত ইরানবাসী সবসময় পাচ্ছে। ইমামগণ, ওলী-আল্লাহগন, শহীদগণ অমর এবং তাঁদের আত্না সর্বদা সজীব ও জিন্দা। সেটি পবিত্র কোরানে আছে। ‘আল্লাহর পথে যারা জীবন দিয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত’’। আল্লাহর পথে থেকে তারা ইহকালে যেমন অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি মৃত্যুর পরও তাঁরা তা পাচ্ছেন। ইমাম রেজা (আ)-এর মাজারে সবসময় হাজার হাজার লোকের ভিড় লেগেই আছে।ইমাম রেজা (আ)-এর মাজার যিয়ারত করে পেলাম আত্নার প্রশান্তি।
ইমাম রেজা (আ)-এর পূর্বপুরুষ ইমাম মুসা কাজেম (আ)। এ বংশেই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা মহান ইমাম খোমেনী (র)। তাঁর মতো মানুষ কালে ভদ্রে জন্মায়, যিনি ছিলেন ইসলামী জনতার জন্যে মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কারণ তিনি ঘুমন্ত জাতিসমূহকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। আজ পৃথিবীর সকল অপশক্তি ও পরাশক্তির বিরুদ্ধে সকল নির্যাতিত মানুষের পক্ষে একা দাঁড়িয়ে আছে ইরান। আল্লাহর প্রতি গঠন বিশ্বাস স্থাপনের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযু্িক্ত সকল ক্ষেত্রে ইরান এগিয়ে গেছে। অজস্র সংগ্রামী মানুষের রক্তে পবিত্র যে দেশের মাটি তা আজ দুনিয়ার মুসলমানদের গর্ব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের ভরসা ও আশ্রয়স্থল। ইমাম খোমেনী (রহ) আজ আর নেই, কিন্তুু তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
কথায় আছে যে ছুটি যত লম্বাই হোক না কেনো একদিন তা শেষ হয়। বেড়ানোর দিনগুলোও তাই শেষ হয়ে আসে এক সময়। আমাদের পনর দিনের ভিসাও একদিন শেষ হয়। শেষের দিকে এসে দেশে ফিরে যাবার জন্যে প্রাণ টানছিলো। একদিকে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও সেখানে রেখে আসা প্রিয়জনদের টান অন্যদিকে স্বপ্নের ভূমি ইরানের প্রতি গভীর মমতার দোটানার ভেতরেই স্বদেশের উদ্দেশে উড়াল দিলাম আবারো সেই ‘ফুরুতগাহে ইমাম খোমেনী (র)’ বা ‘ইমাম খোমেনী (র) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। স্মৃতিতে সঙ্গে করে আনলাম ইরান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি।
কবিতার দেশ ও কবিদের দেশ ইরান। বিপ্লবের দেশ ও বিপ্লবীর দেশ ইরান। ওলীদের দেশ, সুফিদের দেশ ইরান। হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের দেশ ইরান। টিউলিপ আর বিশ্বসেরা গোলাপের দেশ ইরান। গানের দেশ প্রাণের দেশ ইরান। বাস্তবিক ইরান দেশটি খুবই সুন্দর। সুন্দর এর প্রকৃতি, পাহাড় ও মালভূমি। সুন্দর এর শহরের রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, বাড়িঘরগুলো। তেমনি সুন্দর ইরানের মানুষের মন। তাদের আতিথেয়তার তুলনা হয় না। পথচারী, দোকানদার, বাসকন্ডাক্টার, ট্যাক্সি ড্রাইভার সবার কাছেই সুন্দর আচার-ব্যাবহার পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। বিদেশি পেয়ে কোথাও ঠকানো তো দূরের কথা যেখানেই গিয়েছি তারা বলেছে, ‘শুমা মেহমানে মা’ আর্থাৎ আপনারা আমাদের মেহমান। তেমনি আতিথেয়তা পেয়েছি বিভিন্ন কাজে ও বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে আমাদের গাইড হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আল্লামা তাবাতাবায়ী ও তেহরান উনির্ভাসিটির ছাত্র ছাত্রীদের থেকে। হোটেলের বাইরে ফুটপাথে ও খোলা স্থানে হাঁটতে গিয়ে স্কুলের ছোট দুটি ছেলে-মেয়েও আমাদেরকে হেল্প করেছে পথের পাশে টেলিফোন বুথ থেকে কথা বলার কৌশল শিখিয়ে দিয়ে। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের একপ্রস্থ স্মৃতির কথা কোনদিনই ভুলবো না।