ঐতিহ্যবাহী ফারসি শিল্পকলার একটি হস্তলিপি বিদ্যা
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ৩১, ২০১৪
ইরানের প্রাচীন ঐতিহ্যময় শিল্পকলাগুলোর অন্যতম হলো হস্তলিপিবিদ্যা বা ক্যালিগ্রাফি। যান্ত্রিক মুদ্রণব্যবস্থা আবিষ্কারের পূর্বে কোনো খবর জনগণকে লিখিতভাবে জানানোর জন্য হস্তলিপিবিদদের সাহায্য নেয়া হতো। হস্তলিপিবিদগণ তাঁদের মনের মাধুর্য মিশিয়ে মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা তৈরি করতেন। ক্যালিগ্র্যাফি বা হস্তলিপিবিদ্যা তখন ইরানের জনপ্রিয় শিল্পকলাগুলোরও অন্যতম ছিল।
আধুনিককালে বিশেষ করে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পরে হস্তলিপিবিদগণের কাজের ক্ষেত্রের সঙ্কোচন ঘটে। কিন্তু তারপরও প্রচারমাধ্যমের সৌন্দর্যের উপাদানগুলো তাঁদের দখলে রয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের হস্তলিপি লিখনপদ্ধতি, যেমন : নাস্খ, নাসতালিক এবং সেকাশতেহ এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে এসব লিখনপদ্ধতির উন্নয়নে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। হস্তলিপিবিদ্যা ব্যবহার করে অনেকে ধর্মীয় পুস্তক (বিশেষ করে কুরআন) এবং সাহিত্যবিষয়ক পুস্তক (যার মধ্যে কবিদের বাছাই করা কবিতার সংকলনও রয়েছে) লেখা হচ্ছে। ইসলামী বিপ্লবোত্তর এক দশকে অনেক ঐতিহ্যবাহী বিষয়ের মধ্যে হস্তলিপিবিদ্যা নিজ গুণে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে এবং হাজার হাজার ছাত্রের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
অন্য যে কোন ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার তুলনায় হস্তলিপিবিদ্যাকে জাতীয় এবং ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও প্রচারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
গণশিক্ষা এবং পাঠ্যপুস্তকে হস্তলিপিবিদ্যাকে আগের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সমাজে এর চাহিদা এবং কদর দুই-ই রয়েছে। এই শাখার উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য হস্তলিপিবিদ্যাবিষয়ক বিদ্যালয়গুলোর প্রয়োজন শিল্পকলার অপরাপর শাখার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা। হস্তলিপিবিদ্যার দক্ষ শিক্ষক ও পরিশ্রমী ছাত্রদের মেধা ও মননের সাথে শিল্পের অন্যান্য শাখার সম্মিলন ঘটলে হস্তলিপিবিদ্যা নামক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে।
ইসলাম এবং ইরানের প্রাচীন শিল্প হস্তলিপিবিদ্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এর উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির মতামত সম্প্রতি ‘নামে ফারহাঙ্গ’ নামের একটি সংস্কৃতিবিষয়ক সাময়িকিতে প্রকাশ করা হয়েছে।
নামে ফারহাঙ্গ-এ প্রকাশিত হস্তলিপি শিল্পের বিদগ্ধজনদের মন্তব্য ও মতামত কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকার এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে এভাবে :
পণ্ডিত সালাহশূর : অনেকে আছেন যাঁরা শিল্পের বিভিন্ন শাখা, যেমন লেখালেখি, ভাস্কর্য, নাটক, কবিতা, চলচ্চিত্র, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন। তাঁদের জানার জন্য বলছি, একটি বিষয় শিল্প হিসাবে পরিগণিত হতে হলে যে সকল চারিত্রিক গুণ থাকতে হয়, হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের তা পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। চিত্রকলার সাথে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই কলমের ব্যবহার হয়।
মাস্টার জলির রাসুলী : ‘হস্তলিপিবিদ্যার বর্তমান আকারকে কোনভাবেই শিল্প হিসাবে গণ্য করা যায় না। অতীতে এই শিল্পের উন্নতি এবং বিকাশের জন্য বিভিন্ন রকম গবেষণা করা হয়েছে। বর্তমানে এই বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা পূর্বসূরিদের গবেষণালব্ধ ফলের ব্যবহার মাত্র। এই বিদ্যাকে তখনই শিল্প হিসেবে গণ্য করা যাবে যখন হস্তশিল্পবিদ্যা বিশারদরা তাঁদের মেধা ও মননের ব্যবহারের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রটির জন্য নতুন কিছু করবেন।
এইভাবে কি আমরা গতিশীল ও বৈচিত্র্যময় নতুন কোনো কাজের ধারা তৈরি করতে পারব? অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় প্রমাণিত যে, একজন কখনোই এ সকল নিযম মেনে কোন কিছু করতে পারেন না। মীর এমাদ লিখেছেন সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পালা (cross)। মানোত্তীর্ণ সর্বোত্তম বইগুলো লিখেছেন কালহর। সুন্দরতম লেখাগুলো রুচিসম্পন্ন করেছেন গোলাম রেযা এবং মীর হুসাইন তৈরি করেছেন শ্রদ্ধা জাগানো কাজগুলো। বর্তমানের হস্তলিপিবিদগণ ঐ শ্রেষ্ঠ কর্মগুলোর সাথে নতুন কি যোগ করতে পেরেছে? আধুনিককালের হস্তলিপিবিদদের ব্যক্তিগত মেধা-মন ও উদ্যোগের কতটুকু যোগ হয়েছে পুরনো একজনের সাথে? যদি আমরা বর্তমান প্রজন্মের নতুন কিছু পুরাতন প্রজন্মের কাজের সাথে যোগ করি তবেই হস্তলিপিবিদ্যাকে শিল্প বলা যাবে।
নিঃসন্দেহে হস্তলিপিবিদ্যা এক নতুন দিগন্তে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এটি শিল্পের বিস্ময়কর জগতে প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা তা নির্ভর করে শিল্পীর ব্যক্তিগত বোধশক্তি ও রুচিবোধ এবং সৃষ্টিশীলতার ওপর। কিভাবে একজন শিল্পী সম্ভাবনা ও ক্ষমতাময় শিল্পটিকে ব্যবহার করবেন তার ওপর নির্ভর করে এর ভবিষ্যৎ।
মাস্টার আত্তারিয়ান : শিল্পকে যদি সংজ্ঞায়িত করা হয় আদর্শ ও ইচ্ছার প্রকাশ মাধ্যমরূপে তবে আমরা সকল শিল্প, যেমন : সংগীত, চিত্রকলা এবং কবিতাকে এগুলোর নিজস্ব সাধারণ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে পারি। উদাহরণ হিসাবে ফারসি কবিতার কথা বলা যায়। ফারসি গীতি-কবিতা, লোকগাথা ও শোকগাথায় চতুস্পদী শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে।
সকল শিল্পের নিজস্ব নির্মাণশৈলী ও উপাদান রয়েছে। সঠিক নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করে শিল্পের যাবতীয় উপাদানকে ব্যবহারের মাধ্যমে মানোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম তৈরি করা সম্ভব। শিল্পের উপাদান বলতে এখানে সামঞ্জস্য, সাদৃশ্য বা তুল্যতা, ভারসাম্যপূর্ণ গঠন, আরোহণ ও অবরোহণ ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।
প্রতিটি শিল্পের নিজস্ব উপাদান বলতে ঐ সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদানকে বোঝানো হচ্ছে যার প্রতি যথাযথ মনোযোগ সম্পাদিত কর্মটিকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। যেমন : কবিতার বেলায় শব্দ, সংগীতের বেলায় সুর, চিত্রকলার বেলায় আলো এবং রং ও হস্তশিল্পের বেলায় ডট বা বিন্দুর ব্যবহার।
এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, উপাদান কখনো নিজের গতিতে শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। একটি শিল্পের উপাদানগুলো তখনই শিল্প বলে স্বীকৃত হয় যখন শিল্পকলার ঐ ক্ষেত্রে শিল্পী তাঁর অনুভূতিকে নির্দিষ্ট শিল্পের যাবতীয় উপাদান ও কলাকৌশল দ্বারা গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য করে গড়ে তোলেন। এই অর্থে হস্তলিপিবিদ্যা একাধারে একটি শিল্প ও একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের ওপর কী মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছে, এই সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে হস্তলিপিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ফুরাদি বলেন : এক সময়ে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্প হিসাবে স্বীকৃত ছিল। তাই একে কোনভাবেই চিত্রকলা কিংবা হাতের লেখার সাথে তুলনা করা উচিত নয়। এ সকল শিল্পের সবগুলোই নকশা বা চিত্রময় যোগাযোগ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত।
এটি হস্তলিপিবিদ্যাকে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু এর শিল্পমাধুর্যের মানের অবনতিও ঘটিয়েছে। এটি মিথ্যার আবরণ চড়িয়ে অতিপ্রাকৃতভাবে হস্তলিপিবিদ্যাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। অন্যদিকে এর বস্তুনিষ্ঠ সুন্দর ও শৈল্পিক ভাবমূর্তিকে বিপথে পরিচালিত করেছে। হস্তলিপিবিদ্যার মূল্যায়ন ও উন্নয়ন অনেকাংশে ঘটেছে পবিত্র কুরআনের ওপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে অন্য উপাদানগুলো হলো পুস্তক লিখন, উৎকীর্ণলিপি, সে সাথে এই অকৃত্রিম শিল্পের নিবেদিত শিল্পীদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধর কথা উল্লেখ করতে হয়।
হস্তলিপিবিদ্যা শিল্প শুধু ইসলামী ইরানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অবদান রাখেনি। এর পাশাপাশি শিল্পটি বহির্বিশ্বেও শিল্প হিসেবে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছে। হস্তলিপিবিদ্যা তাইমুর আমলে সাফল্যের শিখরে ওঠে, কিন্তু সাফাভী রাজবংশের শাসনামলে এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। শিল্পটি আরো একবার সাফল্যের মুখ দেখেছিল শাহ আব্বাসের শাসনামলে। কিন্তু পুনরায় যেন্দ, আফসার এবং কাজার রাজবংশের শাসনামলে এ শিল্পটিকে অবহেলা করা হয়। নাসির উদ্দিন শাহের আমলে শিল্পটি পুনরায় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। আবার এর ক্রান্তিকাল শুরু হয় রেযা শাহ এবং মোহাম্মদ রেযার আমলে। ইসলামী বিপ্লবের পরে এ শিল্পটি সর্বকালের সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
ইসলামী বিপ্লবের আগে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পথ চলছিল। যন্ত্রের বহুল ব্যবহারে সকল ধরনের হস্তশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে হস্তলিপিবিদ্যা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির অস্তিত্বের বিষয়টি হুমকির সম্মুখীন হয়। দেশে ইসলামী বিপ্লবের পর এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের অনেক উন্নতি ঘটেছে। এক্ষেত্রের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে এবং প্রচুর সংখ্যক লোক হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের ওপর লেখাপড়া করছে।