শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ঐতিহাসিক ঈদে গাদিরের গুরুত্ব

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭ 

news-image
১৮ জিলহজ্ব ইসলামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ঈদে গাদির নামে এ দিনটি পরিচিত। দশম হিজরির এ দিনে রাসূলে খোদা (সা.) যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন তারই আলোকে এ দিনটি উদযাপিত হয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে।
 
আল্লাহর রাসূল এটা জানতেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান পূর্ণতা লাভ করার পর তিনি বেশি দিন ইহজগতে থাকবেন না। তাই নবম হিজরির পর থেকেই মূলত তিনি এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু করেছিলেন। ঐ সময় ইসলামের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা- দ্বন্দ ও সংশয় সৃষ্টির জন্যে কাফের মুশরেকদের পক্ষ থেকেও জোর তৎপরতা শুরু হয়েছিল। তারা প্রচার করতো ইসলামের নবীর কোন পুত্র সন্তান নেই কাজেই তার মৃত্যু হলে ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বও আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে পড়েবে। এমন এক অবস্থায় মুসলমানদের মনে কিছুটা অস্বস্তি বিরাজ করছিল। সাহাবায়ে কেরাম এটা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করতেন ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি জীবন বিধান । এটা চিরস্থায়ী এবং পূর্ণাঙ্গ। পবিত্র কোরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্যে সর্বশেষ ঐশি গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ (দ.) হচ্ছেন সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। কাজেই এই ধর্ম চিরকাল টিকে থাকবে । ইসলামের বিধান শ্বাশতঅমর ও অক্ষয়। যতদিন এ জগত থাকবে ইসলামের দেদীপ্যমান দ্বীপ্তি আলো বিকিরণ করে যাবে। এ আলো নিভিয়ে দেয়ার ক্ষমতা কোন শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়।
 
জাজ্বল্যমান এই বিশ্বাসকে ধারণ করার পরও মুসলমানদের মনে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। আল্লাহর রাসুলের ইহলোক ত্যাগের সম্ভাবনায় একদিকে তাদের মনে ছিল বিরহজনিত অন্তর্দাহ। অন্যদিকে ইহুদী, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের অব্যাহত চক্রান্তের কথা ভেবে তারা ইসলামের ভবিষ্যতের ব্যাপারেও নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন । সবার কাছে এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিলপ্রিয় নবীজী যখন এ জগতে থাকবেন নাতখন পবিত্র কোরআনকে ব্যাখ্যা করবেনমুসলমানরাই বা জীবন জিজ্ঞাসার জবাব জানার জন্যে কার দ্বারস্থ হবেন?
 
ইতোমধ্যে হজ্বের সময় ঘনিয়ে এল। রাসূলে খোদা মুসলমানদেরকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্ব পালন করলেন। এটাই ছিল আল্লাহর রাসুলের শেষ হজ্ব । বিদায় হজ্ব নামে যা আজও পরিচিত। হজ্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে নবীজী এবার লক্ষ মুসলমানদের কাফেলাকে সঙ্গে নিয়ে মাতৃভূমি মক্কাকে বিদায় জানালেনচলছেন প্রিয় মদিনার পথে।এমন সময় কাফেলা গাদিরে খুম নামক এক স্থানে এসে পৌঁছায় ।
 
ছোট্ট জলাশয় বা ডোবাকে আরবিতে গাদির বলা হয়। গাদিরে খুম নামক স্থানটি মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি একটি এলাকায় অবস্থিত । মরু আরবের মুসাফির বা বাণিজ্য কাফেলাগুলো সাধারণত এই ছোট্ট জলাশয়ের পাশে সাময়িক বিশ্রামের জন্যে অবস্থান করতো । আল্লাহর রাসুল যখন এই স্থানে এসে পৌঁছলেন তখন হযরত জিব্রাইল (আ) সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নিয়ে হাজির হলেন । বলা হলো- “হে রাসূল ! তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তুমি (সবার কাছে) পৌঁছে দাও যদি তা না কর তাহলে তো তুমি তার বার্তা প্রচার করলে না । 
 
রাসূলে খোদা (সা.) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর দায়িত্বের এই বোঝা থেকে মুক্ত হতে উদ্যোগী হলেন। তিনি সবাইকে সমবেত হতে বললেন। যারা কিছুটা এগিয়ে ছিলেন তারা পেছনে ফিরে তাকালেন। আর যারা পেছনে ছিলেন তারা খানিকটা এগিয়ে এলেন। রৌদ্রস্নাত উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় সবাই ক্লান্ত অবসন্ন । তারপরও সকলেই প্রবল মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন আল্লাহর রাসূল কিছু একটা বলবেন । মুসলমানদের জন্যে নতুন কোন বিধান বা দিক নির্দেশনা দেবেন ।
 
আল্লাহর রাসুল উটের জিনকে মঞ্চের মত করে তাতে আরোহণ করলেন। এরপর সমবেত সকলকে লক্ষ করে বললেন, ”হে মুসলমানগণ! অচিরেই আমার জীবনের অবসান ঘটবেমহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এ জগত ছেলে চলে যেতে হবে আমাকে। আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল । আমি কি আমার উপর অর্পিত রেসালতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি?’ সকলেই সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন এবং এ পথে আপনি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন।’
 
এরপর আল্লাহর রাসূল (সা.) চারদিকে তাকিয়ে আলীকে খুঁজে বের করলেন এবং হযরত আলীর দুই হাত উত্তোলন করে বললেন, ‘মহান আল্লাহ হচ্ছেন আমার অলী এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী। আমি হচ্ছি মুমিন বিশ্বাসীদের অলী ও অভিভাবক,আর আমি যার নেতা ও অভিভাবকআলীও তার নেতা ও অভিভাবক। হে আল্লাহ! যে আলীকে বন্ধু মনে করে তুমি তাকে দয়া ও অনুগ্রহ করোআর যে আলীর সাথে শত্রুতা করেতুমি তার প্রতি একই মনোভাব পোষণ করো ।
 
রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর এই ভাষণের পরপরই হযরত জিব্রাইল (আ.) আবার অহী বা প্রত্যাদেশ বাণী নিয়ে এলেন। বলা হলো “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলামতোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন বা জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম ।’ (সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াত )
 
গাদিরে খুমের ঐতিহাসিক ঘোষণায় আল্লাহর রাসুল কার্যত হযরত আলীকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবেই নিযুক্ত করেছিলেন । রাসূলে খোদা (সা.)-এর অসংখ্য উক্তি বা বক্তব্যের আলোকে অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেনমহানবী (সা.)-এর পর মুসলমানদের নেতৃত্ব বা পবিত্র কোরআনের যথার্থ ব্যাখ্যার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল হযরত আলীর ওপর। তিনি মুসলমানদের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেনআর এই দায়িত্ব চূড়ান্তভাবে অর্পিত হয়েছিল গাদিরে খুমের ঐতিহাসিক স্থানে।
 
হযরত আলী সম্পর্কে নবী করিম (দ.) বলেছেনআলী প্রেম মানুষের পাপ এমনভাবে ধ্বংস করে যেমনি আগুন জ্বালানি কাঠ ধ্বংস করে দেয়। একবার হযরত আলীকে দেখে আল্লাহর রাসূল বলেছিলেনতিনটি এমন বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে যেটা আমারও নেইএই তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছেতুমি এমন একজনকে শ্বশুর হিসেবে পেয়েছেযা আমি পাইনিএমন একজনকে তুমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছেযে কিনা আমার কন্যাআর তৃতীয়টি হচ্ছে তুমি হাসান- হোসাইনের মত সন্তানের পিতা যেটা আমার নেই ।  সূত্র: পার্সটুডে