শনিবার, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

একটি স্বর্গীয় বিয়ে এবং বিয়ে বার্ষিকী উদযাপন

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১ 

শাহনাজ আরফীন

আরবি যিলহজ মাসের প্রথম দিন মুসলমানদের জন্য অনাবিল আনন্দ আর উৎসবমুখর একটি দিন। এদিনে এ ধরাপৃষ্ঠে এমন দুজন স্বর্গীয় মানব ও মানবীর শুভ বিবাহ হয়েছিল যার খুশি আর আনন্দে মেতে উঠেছিলেন খোদ আসমানের ফেরেশতারাও।
হ্যাঁ, ঐতিহাসিক ওই বিয়ের বর ছিলেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) আর কনে ছিলেন নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (সা. আ.)। পবিত্র যিলহজ মাসের এক তারিখে রোজ শুক্রবার নবীনন্দিনী ফাতেমা যাহরার সাথে শেরে খোদা আলী (আ.)-এর ভালোবাসার নিবিড় বন্ধন ও শুভ বিবাহ স¤পন্ন হয়। মহান স্রষ্টা নিজ মনোনীত বান্দা রাসূলে পাক (সা.)-কে এ অভিনব ও স্বর্গীয় বিয়ের সাক্ষী হিসেবে স্থির করেন। এ ঐশী বিয়ের আনন্দ ও সুখময় স্মৃতি সূর্যের আলোকরশ্মির মতোই আলো বিকিরণ করবে ও প্রেরণা যোগাবে প্রতিটি খোদাপ্রেমী মানুষকে।
মা ফাতেমা ও আলী (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী ইরানে ‘বিয়ে দিবস’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। স্বর্গীয় এ দুজন মহামানবের প্রেম-প্রীতির অপূর্ব এ বন্ধনকে চির অম্লান রাখা এবং তাঁদের শুভ পরিণয়ের আদর্শ অনুসরণের জন্য এ দিবস উদ্যাপনের উদ্যোগ সত্যিই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
হযরত ফাতেমা (সা.) আরবি ২০শে জমাদিউস সানী হযরত খাদিজাতুল কোবরার গৃহ আলোকিত করে এ ধরার বুকে আগমন করেন। জন্মের পর রাসূল (সা.) তাঁর নাম রাখেন ‘ফাতেমা’। ‘ফাতেমা’ নামটির অর্থ হলো সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। এ মহীয়সী নারী বহু মানবীয় গুণের অধিকারী ছিলেন বলে তাঁকে সিদ্দিকাহ বা সত্যবাদিনী, মুবারাকাহ বা বরকতময়ী, তাহেরাহ বা পবিত্রা, যাকিয়াহ বা পরিশুদ্ধতার অধিকারী, রাজীয়া বা সন্তুষ্ট, মার্জিয়া বা সন্তোষপ্রাপ্ত মুহাদ্দিসাহ বা হাদিস বর্ণনাকারী এবং যাহরা বা দীপ্তিময় উপাধিতে ডাকা হতো। এছাড়া তিনি উম্মুল হাসান, উম্মুল হুসাইন, উম্মুল মুহসিন, উম্মুল আয়েম্মা এবং উম্মে আবিহা নামেও পরিচিত ছিলেন। হযরত ফাতেমা ছিলেন রাসূলে খোদা (সা.)-এর অতি আদরের কন্যা। ফাতেমা স¤পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেন : ‘ফাতেমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রুহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর।’
অন্যদিকে, হযরত আলী (আ.) ছিলেন রাসূলে খোদার চাচা আবু তালিবের পুত্র। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই রজব তিনি পবিত্র কাবাগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের তিনদিন পর বালকটির মা ফাতিমা বিনতে আসাদ তার নাম রাখেন আলী। চাচা আবু তালিবের দুর্দিনে রাসূল (সা.) ছোট্ট বালক আলীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। রাসূল খোদা যখন নবুওয়াত পান, তখন কিশোর আলীই তাঁর প্রতি প্রথম ইমান আনেন। শুধু তাই নয়, নবীজিকে তিনি সবসময় ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তাঁর বীরত্ব, জ্ঞান-গরিমা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতায় রাসূল (সা.) ছিলেন মুগ্ধ। খোদ রাসূল (সা.) আলী স¤পর্কে বলেন : ‘আমি জ্ঞানের শহর আর আলী হচ্ছে তার দরজা।’
রাসূলে খোদা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার দুবছর পর অনেকেই তাঁর কাছে ফাতিমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তাঁদের মধ্যে আরবের বহু স্বনামনধন্য প্রথিতযশা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিও ছিলেন। কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই রাসূলে খোদা (সা.) জানান যে, তিনি এ ব্যাপারে আল্লাহর ওহীর দিকনির্দেশনার প্রত্যাশা করছেন। প্রাচীন আরবে বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামীর ধনস¤পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মোটা অংকের দেনমোহরকে নারীর জন্য সম্মানের মাপকাঠি এবং স্বামীর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.)-এর বিয়ের ঘটনা তো ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শকে তুলে ধরবে এবং সেই সাথে অন্ধকার ও জাহেলী যুগের রীতি-নীতি ও প্রথাগুলোর মূলোৎপাটন করে ইসলামি মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত করবে। তাই বিশ্বনবী (সা.) সমাজের এসব বৈশিষ্ট্য ও মাপকাঠিকে অগ্রাহ্য করে প্রচলিত প্রথায় আঘাত হানেন। আরবের বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি আবদুর রহমান ইবনে আওফ যখন ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং দেনমোহর হিসেবে মোটা অংকের অর্থ প্রদানের কথা ঘোষণা করেন, রাসূলে খোদা (সা.) ভীষণ রাগান্বিত হন।
যখন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) হযরত ফাতেমা (সা.)-এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন তখন লজ্জায় তাঁর চেহারা মোবারক গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছিল। রাসূল (সা.) আলীর অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বলেন : ‘আমার কাছে কি কোনো কাজে এসেছ?’ কিন্তু আলী (আ.) লজ্জা ও সংকোচের কারণে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করতে পারলেন না, বরং নীরব থাকলেন। মহানবী (সা.) আলীকে বলেন : ‘ফাতেমার প্রস্তাব নিয়ে এসেছ।’ আলী (আ.) বলেন, ‘জী, এ উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি।’ আলী (আ.)-এর কোনো ধনস¤পদ ছিল না এবং আরবের জাহেলী প্রথানুযায়ী ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যও তাঁর ছিল না। তারপরও মহানবী এ প্রস্তাবে খুব খুশি হলেন। তিনি বলেন : ‘হে আলী! তোমার আগেও অনেকে ফাতেমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কিন্তু যখনই আমি তাদের প্রস্তাব ফাতেমার কাছে উপস্থাপন করেছি সে না-সূচক জবাব দিয়েছে। এখন তোমার বিষয়টিও তার কাছে তুলে ধরব।’
হযরত আলীর প্রস্তাব নিয়ে মহানবী কন্যা ফাতেমার কাছে এলেন। তিনি আলীর অসাধারণ চারিত্রিক গুণ ও মর্যাদা উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করলেন : ‘মা, তুমি কি আলীকে বিয়ে করতে রাজি আছ? আল্লাহ আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন।’ হযরত ফাতেমা একথা শুনে খুশি হলেন। কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না। কেবল মাথা নিচু করে সম্মতি জানালেন। মহানবী মেয়ের সম্মতি জানতে পেরে খুশিতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠলেন।
এটা সত্য যে, এ বিবাহটি ছিল একটি ঐশী সিদ্ধান্ত। কিন্তু সাধারণভাবে সহধর্মী নির্বাচনে নারীদের মতামতের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য রাসূল (সা.) হযরত ফাতেমার সাথে পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা পদক্ষেপ নেননি।
এরপর দ্বিতীয় হিজরির পহেলা যিলহজ, শুক্রবার হযরত আলীর সাথে হযরত ফাতেমার শুভ বিবাহের দিন ধার্য করা হয়। এ বিবাহ অনুষ্ঠানে বহু আনসার ও মুহাজির উপস্থিত ছিলেন। আলীর সাথে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় মুহাজিরদের অনেকেই এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) সাহাবীদের উদ্দেশে বলেন : ‘আল্লাহর আদেশে আমি ফাতেমার সাথে আলীর বিয়ে দিচ্ছি।’ এরপর মহানবী (সা.) হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘এমন কিছু কি আছে যা দ্বারা তোমার স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করবে?’ আলী (আ.) বলেন : ‘আপনি আমার জীবন-যাপন স¤পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন। আমার নিকট একটি তরবারি, একটি ঢাল ও একটি উট ছাড়া আর কিছুই নেই।’
রাসূল (সা.) বলেন : ‘ঠিক আছে, ইসলামের শত্রুদের সাথে যুদ্ধের সময় তোমার তরবারি প্রয়োজন হবে। আর খেজুর বাগানে পানি দেবার জন্য এবং সফরের সময় তোমার উটের প্রয়োজন হবে। অতএব, অবশিষ্ট থাকে শুধু ঢালটি, আর তা দিয়েই তোমার স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করবে। আমি আমার কন্যা ফাতেমাকে কেবল উক্ত ঢালের বিনিময়ে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। হে আলী, তুমি কি এতে রাজি আছ?’ হযরত আলী সম্মতি জানিয়ে বললেন : ‘জী, আমি রাজি।’
তখন নবীজী দুহাত তুলে তাঁদের জন্য এবং তাঁদের অনাগত বংশধরদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন।
এ দুজন মহামানবের বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সাদামাটা। তাই হযরত উম্মে আইমান এসে মহানবীর কাছে দুঃখ করে বললেন : ‘সেদিনও তো আনসারদের এক মেয়ের বিয়ে হলো। সে অনুষ্ঠানে কত জাঁকজমক ও আনন্দ ফুর্তি হলো! অথচ বিশ্ববাসীর নেতা মহানবীর মেয়ের বিয়ে কিনা এত সাধারণ ও সাদাসিধেভাবে হচ্ছে!’ উম্মে আইমানের কথা শুনে রাসূল (সা.) বললেন : ‘এ বিয়ের সাথে পৃথিবীর কোনো বিয়ের তুলনা হয় না। পৃথিবীতে এ বিয়ের কোনো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান না হলেও আল্লাহর আদেশে আসমানে এ বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক উৎসব হচ্ছে। বেহেশতকে অপূর্ব সাজে সাজানো হয়েছে। ফেরেশতারা, হুর-গেলমান সবাই আনন্দ করছে। বেহেশতের গাছপালা থেকে মণি-মুক্তা ঝরছে!’ একথা শুনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের মুখ খুশিতে ভরে উঠল।
হযরত আলী ও হযরত ফাতেমার স্বর্গীয় বিয়ের শিক্ষাগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :
১. বিয়ের ক্ষেত্রে সমাজের রীতিনীতি ও মানুষের মতামতের চেয়ে স্রষ্টার মতামত ও সন্তুষ্টিকেই প্রাধান্য দেওয়া।
২. সঠিক ও উপযুক্ত পাত্র ও পাত্রী নির্বাচন।
৩. বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাহুল্য ও অপচয় থেকে দূরে থাকা।
৪. বিয়ের মোহরানা যথাসম্ভব সহনীয় ও সাধ্যের মধ্যে নির্ধারণ করা, নারীদের মোহরানা উচ্চ হারে না ধরা।
৫. বিয়ের আনুষাজ্ঞিক বিষয়গুলো সহজ ও স্বাভাবিক রাখা।
৬. পাত্র ও পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে খোদাভীতি, সদাচরণ ও মানবীয় গুণাবলিকে প্রাধান্য দেওয়া।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যপার হলো আমাদের বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিয়ের অনুষ্ঠানমালায় পবিত্রতা ও ধার্মিকতা অনেকাংশে লোপ পেয়েছে। বর্তমানে বিয়ের অনুষ্ঠান যেন মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়েতে কে কত বেশি জমকালো আয়োজন করতে পারে, অর্থ ব্যয় করতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা চলে সবার মধ্যে। বিয়ের অনুষ্ঠান লৌকিকতা এবং নিছক আনন্দ-উল্লাসের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর অপর দিকে বিয়ের শর্তাবলি কঠিন ও ব্যয়বহুল হবার কারণে বিয়ের ব্যাপারে যুবক-যুবতীদের অনীহা তৈরি হচ্ছে এবং নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ক্রমশ বাড়ছে।
অথচ বিবাহ একটি শুভ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা পালনের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা হয়। বিয়ে হচ্ছে রাসূলে খোদা (সা.)-এর পবিত্র একটি সুন্নত। মানবতার ধর্ম ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পুতঃপবিত্র জীবন যাপনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যবস্থা করেছে। উচ্ছৃঙ্খলতা ও অশালীনতার অভিশাপ থেকে সুরক্ষা পেতেই ইসলাম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে জোর তাগিদ প্রদান করেছে। কাজেই বিয়ের মতো শুভ ও পবিত্র একটি ঐশী বিধানকে নির্মল, সুন্দর ও সার্থক করার জন্য নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ একান্ত জরুরি। বিশ্বনবী (সা.) ঐশী নির্দেশে এবং নিজ তত্ত্বাবধানে কন্যা ফাতেমার সাথে আলীর বিয়ে দিয়েছেন। তাই বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে উত্তম আদর্শ আর কি হতে পারে? তাই মা ফাতেমা ও হযরত আলীর বিবাহ বার্ষিকীকে ‘বিয়ে দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন সত্যিই প্রশংসনীয়। যাঁরা নিজেদের দা¤পত্য জীবনকে ঐশী দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করতে চান এবং নিজেদের পারিবারিক জীবনকে বরকতময় ও স্বর্গীয় সুষমা দিয়ে ভরে তুলতে চান তাঁদের জন্য ফাতেমা ও আলীর বিয়ে বার্ষিকী হতে পারে সর্বোত্তম ও শুভ দিন।