শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়েছে -ড. জাভেদ মাজলোমি

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৩, ২০১৬ 

news-image

ইরানের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ড. জাভেদ মাজলোমি ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছেন। বাংলাদেশে ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সম্প্রতি যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো ঠাঁই নেই। ইসলাম সম্পর্কে যাদের জ্ঞানের অভাব আছে তারাই জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলমানদের মধ্যে সামান্য মতপার্থক্য আছে। বাইরের লোকেরা এটাকে বড় করে

প্রচার করে। আর এই ফাঁদে অনেক মুসলমান পা দেয়। এ কারণে আজকে হানাহানি হচ্ছে।

প্রশ্ন : মুসলমানদের মধ্যে কেন এত বিভেদ?

জাভেদ মাজলোমি : মুসলমানরা সবাই ভাই। একটি পরিবারে দুই কিংবা তিন ভাই থাকলে সবাই এক রকমের হয় না। কেউ মোটা, কেউ স্লিম, কেউ লম্বা হতে পারে। তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তারা সবাই ভাই। ইসলামী সমাজও একই রকমের; এখানে ভিন্ন ভাষা, ভূখণ্ড, ব্যবস্থা আছে; কিন্তু সবাই আমরা ভাই। যিনি এক আল্লাহ বিশ্বাস করেন ও মুহাম্মদ (সা.)কে নবী মানেন তিনিই মুসলমান। সব মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, সব মুসলমানের কেবলা হল ক্বাবা, সবাই হালাল গোশত খান- এসবে মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ শিয়া বা সুন্নি আছেন। ইরানে মুসলমানদের ১০ শতাংশ সুন্নি। এটা রাতারাতি হয়নি, তারা ইরানে চৌদ্দ শতক ধরে বাস করছেন। আমরা পরস্পর শান্তিতে বাস করছি। আমাদের উভয় গোত্রের মধ্যে সব রকমের সম্পর্ক আছে। শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে। এসব বিষয়ে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। যারা বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, তাদের মধ্যে সমস্যা হচ্ছে। গোত্রের এমনকি নিজেদের মধ্যে পার্থক্য থাকে। সব হানাফি মাজহাবের লোক কি একই চিন্তা করে? মোটেও তা নয়। এই উপমহাদেশের কথাই চিন্তা করেন। এখানে দেওবন্দি আছেন, তারা কি সবাই এক চিন্তা করেন? শত্র“রা আমাদের বিভক্ত করছে। কখনও তারা বলে, শিয়া আর সুন্নি। কখনও বলে, আরব কিংবা নন আরব। এই বিভাজন ঠিক নয়। ইরানে অনেকেই রোম থেকে এসেছেন।

প্রশ্ন: ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলায় আপনারা কী ভূমিকা পালন করছেন?

জাভেদ মাজলোমি : উগ্রবাদ মোকাবেলায় চিন্তাবিদ হিসেবে আমাদের অবশ্যই ভূমিকা আছে। এ ভূমিকা রাজনীতিকদের থেকে আলাদা। ইসলাম কি বলছে সেটা নিজেরা জানা এবং ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান সম্পর্কে জনগণকে ধারণা দেয়া আমাদের দায়িত্ব। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। ইসলাম হল রহমানের (আর্শীবাদ) ধর্ম। এই শিক্ষা চিন্তাবিদরা ছাত্র-ছাত্রীসহ জনগণের কাছে দেয়ার পর উগ্রবাদ মোকাবেলায় রাজনীতিকদের করণীয় বিষয়ে একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। রাজনীতিকদের কাজটা হল বাস্তবায়নের কাজ। এটা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ হল ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

প্রশ্ন: জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে কারা, তা নিয়ে নানা মত লক্ষ্য করা যায়…

জাভেদ মাজলোমি : ইসলাম সম্পর্কে যাদের জ্ঞানের অভাব আছে তারাই জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝার জন্যে আমাদের একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। অবহেলার কারণেও অনেকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এখানে এক বক্তৃতা দেয়ার পর আমাকে অনেক চিন্তাবিদ এ বিষয়ে বই লিখতে বলেছেন। ঐক্য মানে সবই এক রকমের হতে হবে এমন নয়। মতের ভিন্নতা থাকলেও একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াই ঐক্য। পৃথক পৃথক ধারণা অবশ্যই থাকতে পারে। আবার অভিন্ন অনেক কিছু থাকতে পারে। এগুলোর মধ্যে একটি লক্ষ্য স্থির করা যায়। একে অন্যের মধ্যে আলোচনা করে তাত্ত্বিক বিষয়ে সমস্যা থাকলে তা দূর করা যায়। এভাবেই বাস্তবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সম্ভব। আমাদের অবশ্যই আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। মতপার্থক্য থাকলে সেই মতপার্থক্য কতটুকু সেটা দেখা দরকার। মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ, ব্যাকগ্রাউন্ড এসবে ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি বিশ্বাস ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনেও ভিন্নতা থাকতে পারে।

প্রশ্ন: পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?

জাভেদ মাজলোমি : মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে সামান্য কিছু মতপার্থক্য থাকলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরের লোকেরা এই মতপার্থক্যকে খুব বড় করে তোলে। তারা আমাদের দুর্বল করে তাদের লক্ষ্য হাসিল করতে চায়। পরাশক্তি মুসলমানদের কোনো একটি গ্র“পকে অর্থ দিয়ে সমর্থন দিয়ে থাকে। মনে করেন, একটি পরাশক্তি শিয়াদের আবার অন্য পরাশক্তি সুন্নিদের অর্থ দিয়ে সমর্থন করছে। এতে করে শিয়ারা সুন্নিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছে, সুন্নিরা শিয়াদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছে। এসব বক্তব্যে এক গোত্র অন্য গোত্রের প্রতি মর্মাহত হচ্ছে। এসব পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পরাশক্তিগুলো টিভি চ্যানেল আর মিডিয়ায় প্রচার করছে। এমনও দেখেছি, একটি গোত্রের প্রচারে ৬/৭টি ব্যয়বহুল চ্যানেল পরিচালনা করা হচ্ছে পশ্চিমা দেশ থেকে। তারা এসব চ্যানেলে প্রচার করার সুযোগ দিচ্ছে যা অন্যকে আহত করে। আমাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস থাকবে। তার মানে এই নয় যে, অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করতে হবে। কিন্তু যারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছে, তারা অন্যের মতকে হারাম বলছে। অন্যের চিন্তাকে এমনকি অন্যের ধর্মকে নিষিদ্ধ বলে আঘাত দিচ্ছে। কেউ অন্যের বিশ্বাসে বিশ্বাসী না হলে ভদ্রভাবে বলতে পারেন, আমি এটা বিশ্বাস করি না। কিংবা আমার এটা বিশ্বাস না করার কারণ আছে। এটাই উলামারা বলেন। যাদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা নেই, তারাই উস্কানি দিয়ে বক্তব্য দেয়। যারা উস্কানি দিয়ে বক্তব্য দেয় তাদের জিজ্ঞাসা করুন, কতদিন ধরে আপনি ইসলাম চর্চা করেছেন। দেখা যাবে তাদের অধিকাংশেরই এ ক্ষেত্রে খুব সামান্য জ্ঞান আছে। অনেকে আবার পশ্চিমা দেশে দুই বছর পড়ালেখা করে ইসলামের জ্ঞান দেয়। এটা কীভাবে সম্ভব- তারা কি ফতোয়া দিতে পারে? এগুলো অমুসলিমদের আর্থিক সমর্থনে হয়ে থাকে। আমরা মুসলমানরা এতটুকু চালাক নই। ফলে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে দেই।

প্রশ্ন: এবার বলুন, বাংলাদেশ সফরে এসে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

জাভেদ মাজলোমি : বাংলাদেশ সফরে অধ্যাপক ও ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এসব বৈঠক থেকে আমরা একে অন্যে অনেক কিছু শিখেছি। আমরা একে অন্যের ধারণা নিয়েছি। আমাদের মধ্যে অভিন্ন অনেক কিছুই রয়েছে। আমার বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ইসলামী ঐক্যের ক্ষেত্রে চিন্তাবিদদের ভূমিকা। পার্সি ভাষা এখানে খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে হাফেজ ও মওলানা সাহেবদের মধ্যে। এখানে অনেকের পার্সি কবিতা আছে। কাজী নজরুল ইসলাম পার্সি ভাষা জানতেন। আমাদের দুই সভ্যতার মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্কের ক্ষেত্রে পার্সি ভাষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের অভিন্ন দিক হল, আমাদের দু’দেশের মানুষের ধর্মই ইসলাম। উভয় দেশের মধ্যে মধ্যপন্থী ইসলামের চর্চা হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে কয়েক শতক আগেও যারা ইসলাম চর্চা করেছেন, তারা ছিলেন সুফি মতবাদে বিশ্বাসী। এ সুফিদের অনেকেই ইরান থেকে এসে তা চর্চা করেছেন। ইরানি সাহিত্য এখানে খুবই প্রচলিত। আমাদের দু’দেশের মধ্যে একাডেমিক কর্মকাণ্ডসহ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ আছে। দু’দেশই উগ্রবাদকে প্রতিরোধ করে থাকি। দু’দেশেই মুসলমানদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গোত্র রয়েছে। আমাদের কর্মকাণ্ডের জন্যে এগুলো অভিন্ন বিষয়। আমি লক্ষ্য করলাম, ইরান ও বাংলাদেশের একটি অভিন্ন বিষয় আশুরা উদযাপন। এখানে আশুরায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দেন। এটি একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন। মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র হোসেন ইবনে আলী এদিনে আÍত্যাগ করেছিলেন। এ দিনটিকে আমরা খুবই সম্মান দেই। এখানে এসে দেখলাম, এদেশেও দিবসটি মর্যাদাপূর্ণ। ইরান ও বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নি উভয়ের মধ্যে এই বোধ প্রবলভাবে বিদ্যমান।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য কী করা প্রয়োজন?

জাভেদ মাজলোমি : বাংলাদেশে ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। আমাদের দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াতে এই কেন্দ্র দায়িত্ব পালন করে থাকে। আমি তাদের আমন্ত্রণে এদেশে এসেছি এ সহযোগিতাকে অধিক কার্যকর করে তোলার জন্যে। ইরানি চলচ্চিত্র এখানে খুবই জনপ্রিয়। এসব চলচ্চিত্র বেশি করে বাংলায় অনুবাদ করা প্রয়োজন। এখানে অনেক টিভি চ্যানেল আমাদের চলচ্চিত্র দেখাতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্সি ভাষার বিভাগ থাকায় অনেক পার্সি বই, সাহিত্য অনুবাদ হচ্ছে। পার্সি অনেক মৌলিক সাহিত্য এই বিভাগের অধ্যাপকরা অনুবাদ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্সি ভাষা শেখানোর একটি ভবন হয়েছে। আমরা এটি নির্মাণে আর্থিক সমর্থন দিয়েছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা কেমন?

জাভেদ মাজলোমি : এ ব্যাপারে আমার খুব ভালো জ্ঞান নেই। কারণ বিষয়টা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে আমি শুনেছি, দু’দেশের বিভিন্ন গ্র“প ইরান থেকে গ্যাস আনার জন্যে আলাপ-আলোচনা করছে। গ্যাসের উৎপাদনের ব্যাপারে আমাদের অনেক সক্ষমতা আছে। বাংলাদেশের গ্যাসের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ থেকে গত বছর কয়েকজন মন্ত্রী ইরান সফর করেছেন। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। আমাদের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে। ইরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে যাওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে পারে।

প্রশ্ন: পর্যটন শিল্প ক্ষেত্রে সম্ভাবনা দেখেন?

জাভেদ মাজলোমি : পর্যটন ক্ষেত্রে ইরান ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের নৈসর্গিক দৃশ্য খুবই সুন্দর। এখানে বনভূমি আছে। ইরানে একটা দিক আছে যেটাকে বলা হয়Ñ একসঙ্গে চার ঋতু। পর্বতে গেলে দেখবেন বরফ আর বৃষ্টি পড়ছে। একই সময়ে মরুভূমিতে গেলে দেখবেন অনেক গরম। একই সময়ে বনাঞ্চলে অন্যরকম আবহাওয়া, আবার অনেক স্থান আছে ঠাণ্ডা। এ বিষয়টা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। অনেকে আবার ইরানের পুরনো সভ্যতা, ঐতিহ্য আর ইতিহাস দেখতে পছন্দ করেন। আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী মনুমেন্ট রয়েছে। এসব বিষয় মিডিয়ায় প্রচার হলে লোকে বেড়াতে যেতে চাইবে। উভয়পক্ষ একে অন্যকে জানলে পর্যটন বাড়বে। সূত্র: যুগান্তর