শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলাম ও মানবাধিকার

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৯, ২০২০ 

 

সিরাজুল ইসলাম
সারা বিশ্বে মানবাধিকার এখন অত্যন্ত আলোচিত একটি শব্দ। মানব সমাজের সব সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এমন এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। এ চর্চার মধ্য দিয়ে অন্যের মানবাধিকার নিশ্চিত হলেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত ও মানবতার কল্যাণ হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারকে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী ও তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে রাজনীতির বিরাট বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে মোটা দাগে বলা যায় যে, পশ্চিমা দুনিয়ার অন্যায্য ও কৌশলী আচরণের কারণেই বিশ্বে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
ইসলামে মানবাধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বোঝানো হয়, যেগুলো স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাকে প্রদান করেছেন। পৃথিবীর কেউ তা রহিত করার অধিকার রাখে না। এ অধিকার কখনো রহিত হওয়ার নয়। ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি; বরং তা প্রতিটি মুসলমানের বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ অংশও বটে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনব্যাপী সংগ্রাম করে সব মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
মানবাধিকারকে ইসলাম পদদলিত করে নি; বরং সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উচ্চে তুলে ধরেছে। ইসলাম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কোনোরূপ প্রতারণার আশ্রয় নেয় নি। জীবনের নিরাপত্তা লাভের অধিকার মানুষের সব অধিকারের মূল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করেছে ইসলাম। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো মতামত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো কারণে কেউ মানুষের এ মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না।
মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের মধ্যে রয়েছেÑ জীবন ধারণের অধিকার, ধর্মের অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, ন্যায়বিচার লাভের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি। এসব অধিকার লঙ্ঘিত হলে মানুষের বেঁচে থাকা অর্থহীন ও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় এবং এ সনদ কার্যকর করার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি ধারা মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য চমৎকারÑ সন্দেহ নেই। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেশে দেশে, সমাজভেদে ভিন্ন। এর বহু আগেই মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যে ইসলাম এনেছিলেন তাতে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সে অধিকার আদায়ের সঙ্গে পাপ-পুণ্যের ধারণা জড়িত। অর্থাৎ মানুষের অধিকার আদায়ে ইতিবাচক ভূমিকার সঙ্গে রয়েছে পুণ্যের সম্পর্ক তথা পরকালীন মুক্তি। আর মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে রয়েছে পাপের সম্পর্ক তথা আখিরাতের শাস্তি।
ইসলামে মানবাধিকারের বিষয়টিকে শক্তভাবে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। সহজ কথায়Ñ ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা শুধু কোনো ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইসলাম মানুষের অধিকার ও মর্যাদার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।
এই বিশ্বচরাচরে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান হচ্ছে মানুষ। তাকে অন্যসব সৃষ্টির তুলনায় উত্তমরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জগতের সমস্ত নিয়ামত ও শক্তিসমূহ মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করে তার সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কি দেখ না যে, আল্লহ আকাশম-লী ও ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে তার সবই তোমাদের কল্যাণে নিয়ন্ত্রণাধীন রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’Ñ সূরা লোকমান : ২০
মানবধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মানুষে মানুষে সকল বৈষম্য বিলোপের কথা এসেছে। ইসলাম ধর্মও এরূপ বৈষম্যের বিপক্ষে। ইসলাম মানবজাতিকে জন্মগতভাবে সমানভাবে সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ইসলামে বিবেচনা করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবন অতি পবিত্র এক সম্পদ। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ যে জীবনকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না। এবং যদি কেউ অন্যায়ভাবে মারা পড়ে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি ক্ষমতা দিয়েছি প্রতিকার করার। কিন্তু সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা অতিক্রম না করে। কেননা, সে সাহায্য পেয়েছে।’Ñ সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৩
ইসলাম মানুষের জীবনকে অসঙ্গত কারণে হরণ করতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষ হত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীর প্রাণ হরণ করলো।’Ñ সূরা মায়েদা : ৩২
ইসলামি শাসনব্যবস্থায় মানুষের ন্যায়বিচার পাবার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়তে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্রের কোনো পার্থক্য করা হয় নি। ইনসাফ এবং সাম্য ইসলামি বিচারব্যবস্থার অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে করবে।’Ñ সূরা নিসা : ৫৮
ইসলামে হালাল উপায়ে অর্জিত ও ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার স্বীকৃত। তবে এক্ষেত্রে শরিয়ত নির্ধারিত সমস্ত অধিকার ও কর্তব্য পালন করতে হবে। মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, নিকটাত্মীয়ের লালন-পালন ও দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার করো এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাসদাসীর প্রতিও।’Ñ সূরা নিসা : ৩৬
অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা যাবে না। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’Ñ সূরা বাকারা : ১৮৮
ইসলাম মানুষের বিবেক ও ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি মানুষের এক বিরাট অধিকার। মানুষ যার যার পছন্দমতো নিজের ধর্মমত ও পথ বেছে নিতে পারে। এ নিয়ে কারো ওপর কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।’Ñ সূরা বাকারা : ২৫৬
মহানবী (স.) তাঁর কথা ও কর্মের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব পরিম-লে চূড়ান্ত এবং বাস্তবরূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর রাসূল (সা.) দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানবম-লী! তোমাদের জন্য অপরের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রুর উপর হস্তক্ষেপ হারাম করা হলো।’ মানবাধিকারের বিষয়ে এর চেয়ে বড় ঘোষণা আর কী হতে পারে?
ইসলাম ধর্মে শিশু অধিকারের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে সুসন্তানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এ কারণে ভালো ও ধার্মিক সন্তান পেতে হলে কী করা উচিত তা নিয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সুসন্তানের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা শুরু করতে হবে বিয়ের আগে থেকেই। একজন নারী ও পুরুষ যদি সুসন্তান পেতে চায় তাহলে তাকে প্রথমেই ভালো ও ধার্মিক জীবনসঙ্গী বেছে নিতে হবে। ইসলামের সব মাজহাবেই এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনে সতর্কতার ওপর বারবার গুরুত্ব দেয়ার কারণ হচ্ছে নতুন দম্পতি যাতে পৃথিবীকে সুসন্তান উপহার দিতে পারে। ইসলাম ধর্মে বিয়ের বিধান রাখার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সন্তান জন্মদান। শুধু সন্তান জন্মদানই যথেষ্ট নয়, সেই সন্তানকে সৎ ও ধার্মিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে মায়ের গর্ভে ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়। এ কারণে ধর্মে ভ্রূণ সংক্রান্ত নানা দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নবীবংশের অন্যতম সদস্য ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলÑ কোনো নারী যদি গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে ওষুধ খায় এবং গর্ভপাত ঘটায় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য কিনা। উত্তরে তিনি বলেছেন, কারোরই এ ধরনের অধিকার নেই। ইমাম বাকের (আ.) এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, কোনো নারী যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভপাত ঘটায় এবং সেই গর্ভজাত সন্তানের হাড়ের ওপর যদি মাংস গজিয়ে থাকে তাহলে এর জন্য রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে। স্বামীকে না জানিয়ে এ কাজ করে থাকলে সন্তানের বাবা হিসেবে ওই নারীর স্বামী রক্তমূল্য পাবে। রক্তমূল্যের কোনো অংশই ওই নারীর জন্য প্রযোজ্য হবে না, কারণ, সে হচ্ছে গর্ভের সন্তানের হত্যাকারী। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ও গর্ভপাতকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে রক্তমূল্য পরিশোধের কথা বলেছেন।
ইসলাম ধর্মে গর্ভে থাকা অবস্থাতেই একটি মানব সন্তান বিভিন্ন ধরনের অধিকারের আওতায় আসে এবং এ অধিকার লঙ্ঘিত হলে এর জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে। গর্ভপাতের কারণে রক্তমূল্য পরিশোধের নির্দেশ এ ধরনেরই একটি বিধান। ইসলামি দ-বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো গর্ভবতী নারী যদি এমন শাস্তির আওতায় পড়ে যা তার ভ্রূণ বা গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে তাহলে ওই নারীর শাস্তি শুরুর সময় পিছিয়ে দিতে হবে। নারী যদি অবৈধভাবে সন্তানের অধিকারী হয়ে থাকে তাহলেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কারণ, অপরাধী হচ্ছে ওই নারী। তার গর্ভে যে মানব সন্তান রয়েছে সে কোনো অপরাধ করে নি। ওই নারীর কারণে সন্তানের ক্ষতি করা যাবে না। কাজেই ইসলাম ধর্মে একটি মানব সন্তান ভ্রূণ অবস্থাতেই আলাদা একজন মানুষ হিসেবে আইনি অধিকার লাভ করে। এই অধিকার এমন যে, গর্ভে ধারণকারী মা নিজেও ওই সন্তানের কোনো ক্ষতি করার অধিকার রাখে না। ঐশী আইন অনুযায়ী গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করার পর থেকেই মানব সন্তানের শিশুকাল শুরু হয়।
মানবাধিকারই হচ্ছে ইসলামি আইনের মূল ভিত্তি। ইসলাম শুধু মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথাই ঘোষণা করে নি; বরং মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্বের ব্যাপারেও অবহিত করেছে। আল-কুরআন হচ্ছে ফুরকানÑ সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। কুরআন মানুষকে সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করতে শেখায়। কুরআন মানুষকে কল্যাণ ও আলোর পথ দেখায়। মানুষের অধিকার আদায়ে সত্যের পক্ষে থেকে পাপাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এর বিপরীতে ইসলাম শুধু মানবাধিকারের রূপরেখাই পেশ করে নি, আল্লাহ তাআলার হুকুম এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তরিকা হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তা মানার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে এবং সেসকল অধিকার পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করেছে।
মানবাধিকারের রূপরেখা পেশ করা এবং তার ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, পৃথিবীর কোনো আইন ও সংবিধান, কোনো ধর্ম ও মতবাদ, কোনো প-িত ও বিজ্ঞজন যা অস্বীকার করতে পারবে না। ইসলাম মানবাধিকারের সীমাকে এত প্রশস্ত করেছে যে, পুরো জীবন এর মাঝে এসে পড়ে। পিতা-মাতার হক, সন্তানের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, নারীর অধিকার, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষদের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, এতিম-মিসকিনের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি।
শুধু মানুষেরই নয়, ইসলাম চতুষ্পদ জন্তু ও অবলা প্রাণীর অধিকারও নিশ্চিত করেছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বান্দার হক এবং আল্লাহর হক আদায় করার নামই হচ্ছে ইসলাম।
ইসলাম মানুষকে অধিকার আদায়ের চেয়ে অধিকার প্রদানের বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। বর্তমান সমাজের বড় একটি দুর্বলতা হচ্ছে, সমাজের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধিকারের তালিকা হাতে নিয়ে তা আদায়ের স্লোগান দেয়। কিন্তু অন্যদের যেসকল হক তার উপর রয়েছে তা আদায়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু অন্যের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে থাকবে গাফেল তখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা হবে তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল, যা বর্তমান পৃথিবীতে একেবারেই স্পষ্ট। ইসলাম প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গুরুত্বের সাথে অন্যের হক ও অধিকার আদায়ের অনুভূতি জাগ্রত করে। কারণ, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
নারীদের কী কী অধিকার পুরুষের ওপর আছে সে ব্যাপারে ইসলাম পুরুষদের সচেতন করে; কিন্তু নারীদেরকে অধিকার আদায়ের নামে রাস্তায় নামার উস্কানি দেয় না। স্ত্রীদেরকে স্বামীর হকের কথা মনে করিয়ে দেয়; স্বামীকে নিজ হক আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করতে বলে না। ইসলাম শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করে দেয়ার জন্য মালিককে উৎসাহিত করে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ ছেড়ে রাস্তায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে প্ররোচিত করে না। মোটকথা ইসলামে প্রতিটি মানুষকে তার ওপর অন্যের যে হক রয়েছে তা আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক সঠিকভাবে আদায় করছে কি না সে ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। এভাবে ইসলাম পুরো দেশ ও সমাজকে শতভাগ অধিকার প্রদানকারী হিসাবে দেখতে চায়। অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শতভাগ সরব, কিন্তু অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নীরবÑ সমাজের এ দৃশ্য ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান সমাজে যে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে তা ইসলামের এ শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বিমুখ হওয়ারই ফল।
দায়িত্ব ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ইসলাম শুধুই আইন ব্যবহার করে না; বরং মানুষের হৃদয়ে এমন বোধ ও চেতনা জাগ্রত করে, যা ব্যক্তির মাঝে দায়িত্ব পালনের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি সৃষ্টি করে। ফলে শুধু আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা ও অসন্তুষ্টির ভয় এবং কিয়ামতের ময়দানে জবাবদিহিতার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে নিজ থেকে সকলের হক ঠিক ঠিকভাবে আদায় করে দেয়।
ইসলাম বলে, দুনিয়াতে কেউ যদি অন্যের কোনো ক্ষতি করে তাহলে কিয়ামতের দিন প্রতিটি অণু-পরমাণুর হিসাব নেয়া হবে; কড়ায় গ-ায় সমস্ত হক শোধ করতে হবে। এমনকি কোনো শিংওয়ালা বকরি যদি শিংবিহীন বকরিকে দুনিয়াতে আঘাত করে থাকে তাহলে কিয়ামতের দিন উভয়কে জীবিত করে শিংবিহীন বকরির বদলা দেয়া হবে। যখন বিবেকহীন প্রাণীদের মাঝে পর্যন্ত ইনসাফ করা হবে, প্রত্যেককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে তাহলে যেসব মানুষ সজ্ঞানে ও জাগ্রত বিবেকে অন্যের হক আত্মসাৎ করেছে তাদের সাথে কিয়মতের দিন কেমন আচরণ হবে?
ইসলাম অমুসলিমদেরকে যথাযথ নিরাপত্ত ও অধিকার, শিক্ষার অধিকার, মান সম্মানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকারসহ সব রকমের অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধর্মীয় অধিকার সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে, তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে মন্দ বলবে।’Ñ সূরা-আনআম : ১০৭। অন্য এক আয়াতে আল্লাহপাক বলেনÑ ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’Ñ সূরা বাকারা : ২৫। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একবার নাজরানের একদল লোক (নাসারা) নবীজির নিকট মেহমান হিসেবে আগমন করে। রাসূল (সা.) মসজিদে নববীতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন, তাদের নিয়মানুযায়ী সেখানে উপাসনা করারও অনুমতি দিয়েছিলেন।
মোটকথা, ইসলাম তার পবিত্র শিক্ষার মাধ্যমে মানবাধিকারকে এ পরিমাণ সংরক্ষণ করেছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হক্কুল্লাহর তুলনায় হক্কুল ইবাদকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মুসলমানদের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টি করতে চায় যে, কারো মনে যেন অন্যের হক নষ্ট করার চিন্তাও না থাকে। ভুলবশত কারো হক নষ্ট হয়ে গেলে তা শোধরানো পর্যন্ত মনে শান্তি না আসে।
লেখক  সাংবাদিক ও কলামিস্ট