ইসলামের পুনরুজ্জীবনে ইমাম খোমেইনী (রহ.)
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৫

সাইয়্যেদ কাজেম নূর মুফিদী
পূর্বাভাস
ইমাম খোমেইনীর ন্যায় বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কথা বলা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। ইমাম খোমেইনী ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক কালজয়ী পুরুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন কেবল বড় বড় চিন্তাবিদ ও মনীষীদের দ্বারা সম্ভব। তাঁরাই নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যরে আওতায় বিভিন্ন আঙ্গিকে ইমামকে নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারেন। এক্ষেত্রে আমার মতে ইমাম খোমেইনী (রহ.) সম্পর্কে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার তা তাঁর জ্ঞানগত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মর্যাদা নয়। (অবশ্য এসব দিক নিয়েও গবেষণা-পর্যালোচনা প্রয়োজন) কেননা, ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে, শিয়াদের জ্ঞানী ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের তালিকায় এ ধরনের অনেক মহান ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত আমরা পাই, যাঁরা তাঁদের যোগ্যতা অনুসারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনীকে যে বৈশিষ্ট্যটি সবার ওপরে বিশ্বজনীন মর্যাদায় উন্নীত করেছে তা হলো ইসলামী বিপ্লব যা এ শতাব্দীর বিস্ময়। তিনি এ বিপ্লবকে সমকালীন ইতিহাসের গতিধারায় এক পূর্ণাঙ্গ সংযোজন হিসাবে বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেছেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি নিজের সীমিত সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে ইমাম সম্বন্ধে কিছু কথা তুলে ধরছি। আশা করি জ্ঞানী-মনীষী ও গবেষকগণ এক্ষেত্রে তাঁদের মূল্যবান অবদান রাখবেন।
আম্বিয়ায়ে কেরামের বংশধারার মহান পুরুষ ইমাম খোমেইনী
দীর্ঘ ইতিহাসে বহু আম্বিয়া, সংস্কারক ও খোদায়ী মহাপুরুষের আগমন হয়েছে। যাঁরা নিজ নিজ গ-িতে মানুষের উন্নতি ও পূর্ণতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তাদের মধ্যে এমন অনেকের সাক্ষাত পাবেন যাঁরা বিশেষ ধরনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার কারণে আল্লাহর খাস দয়ায় মানব জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন এবং খোদায়ী মানবীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। যার নিরিখে তাঁরা নতুন ইতিহাস ও নতুন সমাজব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন। যেমন হযরত নূহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.), ঈসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)। এক্ষেত্রে প্রিয় ইমাম খোমেইনী নিশ্চয় তাঁদের ন্যায় বা তাঁদের সমমানের কোনো ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তবে বলা যায় যে, তিনি তাঁদের আদলের ও নমুনার একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
ইসলামী আন্দোলনের সূচনা, বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম, বিপ্লবের বহু ভয়ানক ঘটনাপ্রবাহ পার হয়ে আসা এবং শেষ পর্যন্ত খোদায়ী আইন-কানুনকে সফলতার স্বর্ণদ্বারে পৌঁছানো আর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পার হওয়ার ক্ষেত্রে সমুন্নত পথযাত্রা সবগুলোর দিকে তাকালে ইমাম খোমেইনীর মাঝে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যটিই আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তন সাধন যে কোনো লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং এমন লোকের দ্বারাই তা সম্ভব যার মধ্যে বিশেষ ধরনের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক গুণগরিমা বিদ্যমান। ইমাম খোমেইনীর মধ্যে যেসব গুণ ছিল তার মধ্য থেকে কয়েকটি হলো :
১. আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে গভীর ও অটল ঈমান আর সুদৃঢ় প্রত্যয়।
২. ধৈর্য, উচ্চতর মনোবল, অবিচলতা এবং ক্লান্তিহীনতা।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পবিত্র লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার কর্মসূচি প্রণয়নে বিশেষ বিচক্ষণতা।
বিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বে বা বিপ্লব চলাকালে কিংবা বিপ্লব সফল হওয়ার পরবর্তী সময়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বরকতময় জীবন পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত তিনটি বৈশিষ্ট্য নবী-রাসূলগণের জীবনে চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্যমান ছিল আর ইমাম খোমেইনীর জীবনে তার আলোকচ্ছটা পরিস্ফুট ছিল যার কারণে তিনি শতাব্দীর এ বিস্ময়ের জন্ম দিতে পেরেছেন।
খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা
হযরত ইমাম খোমেইনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে, তিনি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলাম ও আমেরিকান ইসলামের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন।
একমাত্র ইমাম খোমেইনীই পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন যে, ইসলামী সমাজ তথা মুসলমানদের মধ্যে বর্তমানে ইসলামকে নিয়ে দু’ধরনের মূল্যায়ন রয়েছে। একটি হলো খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলাম। অপরটি ভেজাল ও জগাখিচুরিপূর্ণ ইসলাম। একটি দুশমনদের চোখের কাঁটাস্বরূপ এবং অপরটি তাদের পছন্দসই। বিষয়টি আরো খোলাসা করার জন্য ঐতিহাসিক মূল্যায়ন প্রয়োজন- যার অবকাশ এ নিবন্ধে নেই। তবে অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন গতিধারায় এমন কিছু অবাঞ্ছিত ও ছদ্মবেশী লোকের আবির্ভাব হয়, যারা জাহেলিয়াতের চিন্তা-চেতনা এবং নিজেদের অন্যায় কামনা-বাসনামাফিক চিন্তা ও বিশ্বাস দিয়ে ইসলামের চেহারাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে; তারা ঐগুলোকেই জনগণের মাঝে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়েছে।
এসব চিন্তাধারা যুগের গতিধারায় ক্রমান্বয়ে সকল ইসলামী সমাজে অনুপ্রবেশ করে ইসলাম নামেই চালু হয়েছে। পবিত্র ইমামগণ তাঁদের জীবদ্দশায় যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এসব চিন্তাধারা দূর করা। ইমামগণের জীবনধারাই এর বড় সাক্ষ্য। অতি দুঃখের সাথে স্বীকার করতে হবে যে, সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় এই বিভ্রান্ত চিন্তাধারা শিয়াদের চিন্তাধারার পরিম-লেও প্রবেশ করেছে। শিয়া চিন্তাধারা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং সন্দেহাতীত ও গ্রহণযোগ্য বিষয় হিসাবে এগুলো চালু হয়ে গেছে। ইমাম খোমেইনী ঐ বিষয়টি (খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের কথা) উত্থাপন করে ইতিহাসের রহস্যের এ পর্দাটি উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের জন্য দুর্লভ একটি বিষয় হাতের কাছে এনে দিয়ে ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনীষীদের জন্য এক কষ্টসাধ্য পথ উন্মুক্ত করেছেন যাতে ইসলামী সমাজ ও ফিকাহর ইতিহাসে ব্যাপক গবেষণার সাহায্যে ধারণা ও অনুমানের পর্দার আড়াল থেকে খাঁটি ইসলামকে উদ্ধার ও দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে পারেন। যদি এ কাজটি সম্পন্ন হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ইসলামের আকর্ষণ হবে বিশ্বজনীন। ইমাম নিজেই ছিলেন এই খাঁটি ইসলামের প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা। তিনি বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ের বর্ণনা দানের বেলায় উভয় ইসলামের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। যেমন রাজনীতি হতে ধর্মের অবিচ্ছিন্নতা, ইসলাম শাসনকার্যের ধর্ম, ধনী ও গরীবের সংঘাত প্রভৃতি যেসব বিষয় ইমাম খোমেইনীর ভাষণ ও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে তা এর মধ্যে শামিল।
ইমাম ও রাষ্ট্রীয় ফিকাহ
আমাদের বিশ্বাসমতে, ফিকাহ হলো জীবনধারণের আইন। যে কোনো যুগেই পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আইন-কানুনের মাধ্যমে সমাজ পরিচালিত হওয়ার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে দুঃখজনকভাবে আমাদের ফকীহগণ যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে দূরে ছিলেন এবং মালিক শাসকদের কারণে প্রত্যাখ্যাত ও একঘরে হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন সেহেতু তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কিত মাসআলা-মাসায়েল উদ্ঘাটন ও চর্চাতেই ব্যস্ত ছিলেন। সামাজিক বিষয়াদিতে যদি ইজতিহাদ করেও থাকেন তাও ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসাবে করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইনচর্চা হিসাবে নয়। যার কারণে আজ ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় আমরা বহু কমতি এবং আইনগত শূন্যতার সম্মুখীন। কাজেই আজ দীনি মাদরাসাসমূহের কর্তব্য হলো রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিকাহর মাসআলা-মাসায়েলের চর্চা করা এবং সমাজ পরিচালনার নিমিত্তে ইসলামী ফিকাহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলির সমাধান পেশ করা। ইমাম খোমেইনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যও এটাই। তিনি প্রথমে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফিকাহর সামাজিক মাসায়েল ও প্রয়োগ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়টি উত্থাপন ও এ চিন্তাধারার চর্চা ও প্রসার ঘটান। সম্ভবত ইমাম খোমেইনী বহুবার দীনি মাদরাসাগুলোর কাছে এ অনুযোগ করেছেন এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বর্তমানে দীনি মাদরাসাগুলোর প্রচলিত ফিকাহশাস্ত্র ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক প্রয়োজনের দাবি হলো নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিকাহশাস্ত্রের চর্চা।
তবে একদল লোক, সানাতন ফিকাহর পক্ষপাতি। কতিপয় লোক ফিকাহশাস্ত্রের নতুনত্বের জন্য আগ্রহী। কিন্তু ইমাম যে ফিকাহতে আগ্রহী তা যেমন সনাতন, তেমনি পরিপূরক আধুনিকও। এ কথার অর্থ এই যে, একজন ফকীহর উচিত ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কাজ করা এবং ফকীহদের কাঠামোর মধ্যে বিচরণ করা। এই নিয়ম-কানুনের বাইরে তিনি যেতে পারেন না। এ অর্থে আমাদের ফিকাহশাস্ত্র সনাতন ধারার। তবে এর অর্থ এ নয় যে, বর্তমানকালের ফকীহগণ বিভিন্ন বিষয় ও মাসআলাকে পূর্ববর্তী ফকীহগণের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করবেন। বর্তমানে অনেক বিষয়ের ধরন পালটে গেছে। উদাহরণস্বরূপ কাফেরদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারটি অতীতে একটি সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে ছিল। কেবল দু’জন ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের ফকীহরাও কিছু কিছু দলিলের ভিত্তিতে সেই সম্পর্ককে বৈধ বলে মনে করতেন। কিন্তু আজ বিষয়টিকে অত সহজভাবে দেখা যাবে না। আজকের দিনে বিশ্বের বুকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিশ্ব শয়তানি চক্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও নীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ায় ধরন পালটে গেছে। কাজেই ফতোয়া দেওয়ার সময় ফকীহকে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে হবে। দেখতে হবে যে, এই সম্পর্ক ও লেনদেনের কারণে বিজাতীয় আধিপত্য চেপে বসছে কিনা? ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে স্থান ও কালের অংশীদারিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এর অন্যতম অর্থও তাই। অর্থাত একটি বিষয় দুই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম ও সিদ্ধান্ত বহন করে। ইমাম বলেছেন যে, ফকীহকে যে কোনো স্থান ও কালের বাস্তবতাগুলোকে সামনে রেখে ইজতিহাদ করতে হবে যাতে সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা ও সংকটগুলোর সমাধান দেয়া সম্ভব হয়। যদি ফকীহ বিদ্যমান বাস্তবতার বাইরে গিয়ে ফতোয়া দেন তাহলে নির্ঘাত ফিকাহ ও মাসআলা জীবনবিচ্ছিন্ন ও একঘরে হয়ে যাবে। তাতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যা দুশমনদের একান্ত কাম্য। অর্থাত তারা বলবে যে, আজকের দিনে ফিকাহ সমাজের চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। তবে আমাদের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য, আল্লাহর কোনো হুকুমে পরিবর্তন সাধন নয়। অথবা যুগের তালে তালে কথা বলার জন্যও বলা হচ্ছে না। আসল কথা হলো, আল্লাহর হুকুমে কোনো পরিবর্তন নেই। রদবদলের প্রয়োজনও নেই। বিষয়টি নিয়ে যে কোনো সন্দেহ-সংশয় এড়ানোর জন্য আমি এখানে একটি উদাহরণের শরণাপন্ন হচ্ছি।
ধরে নিন, দু’জন ইঞ্জিনিয়ার জ্ঞান, তথ্য ও অভিজ্ঞতায় একই স্তরের। তাঁদেরকে এলোমেলো আয়তনের একটি জমির ওপর কয়েকটি ভবন নির্মাণের প্লান করার দায়িত্ব দেয়া হলো। তখন একজন ইঞ্জিনিয়ার সরেজমিনে এসে দেখে গেলেন। অপর ইঞ্জিনিয়ার সরেজমিনে আসলেন না; বরং নিজের অনুমান বা আপনার দেয়া ধারণার ভিত্তিতে একটি প্লান তৈরি করলেন। এখন চিন্তা করে বলুন, কার প্লানটি বাস্তবসম্মত হয়েছে। আর কোনটি বাতিল হয়ে যাবে।
বিষয়টি অতি পরিষ্কার। উভয় ইঞ্জিনিয়ার প্লান তৈরির নিয়ম ও মূলনীতি অনুসরণ করেছেন। অথচ কার্যক্ষেত্রে একজন বাস্তবের সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে সফলকাম হয়েছেন আর একজন বাস্তবতা থেকে দূরে থাকার কারণে অকৃতকার্য হয়েছেন। বস্তুত ইজতিহাদের ক্ষেত্রে সময় ও স্থানের অংশীদারিত্বকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়।
মোটকথা, ফকীহ যদি বছরের পর বছর মাদরাসার চার দেয়ালে বসে কাটান এবং চলমান যুগের সাথে পরিচিত না হন তাহলে তাঁর ইজতিহাদ হবে নীরস এবং স্থান ও কালের প্রয়োজন ও চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে জড়িত মাসআলাগুলোর ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত ও ফতোয়াগুলো সেই ইঞ্জিনিয়ারের প্লানের মতো, যিনি সরেজমিনে না দেখে কোনো জায়গার জন্য মাস্টার প্লান তৈরি করেন। এটা কিছুতেই কার্যকর হবে না, হতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে এ বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মধ্যেই ইমাম খোমেইনীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিহিত। আমরা খুব কম ফকীহর কথাই জানি যাঁরা এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিয়েছেন। আশা করি ইমামের শিষ্যদের মধ্য থেকে সম্মানিত ফকীহগণ এ বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করবেন।
ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনে ইমাম খোমেইনী
পূর্ববর্তী আসমানী ধর্মগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে আমাদের সামনে একটি সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা হলো ধর্মের অবস্থান ছিল সমাজ ও জীবনের এক প্রান্তে। সমাজের মধ্যখানে নয়। ধর্মের একমাত্র কর্তব্য ছিল ব্যক্তি ও খোদার মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করা। মানব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এর কোনো ভূমিকা ছিল না। এ বাস্তবতাটি খ্রিস্টধর্মে খুব পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান ছিল এবং ইসলামের মধ্যে তা ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে। অবশ্য খ্রিস্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মে এবং ইসলামে এ অবস্থা সৃষ্টির পেছনে বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান ছিল। আমরা এখন তা নিয়ে আলোচনা করব না। তবে এক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বিস্ময়টি সৃষ্টি করেন তা হলো জীবনের প্রান্তসীমা থেকে তিনি ধর্মকে জীবনের ঠিক মাঝখানে নিয়ে আসেন। এমনকি তিনি পৃথিবীর একটি দেশে এ ধর্মকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত করেন। এর ফলে প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষের মনে সকল আসমানী ধর্মের প্রতি একটি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। খুব সংক্ষেপে এখানে তার একটি দৃষ্টান্তই উল্লেখ করছি।
ইমামের বরকতময় অবস্থায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিনিধি দলে শামিল হয়ে একবার জার্মানিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হজ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ সেমিনারে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও মনীষীরা উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে একজন ছিলেন অস্ট্রিয়ার নও মুসলিম প্রফেসর। আমি তাঁর কাছে মুসলমান হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে খ্রিস্টান ছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম যে, খ্রিস্টানদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা অর্থাত পোপ বিশ্বের যালিম অত্যাচারীদের হাতে হাত মিলিয়েছেন এবং কথায় ও কাজে তাদের যুলুম ও অন্যায়ের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন তখন সবকিছুকে আমি ধর্মের ঘাড়ে নিয়ে ফেলতাম। ফলে ধর্মের নামগন্ধওয়ালা যে কোনো কিছুর প্রতি আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে কিছুকাল বস্তুবাদী চিন্তাধারার সিদ্ধান্তহীন জীবনযাপন করেছিলাম। এহেন পরিস্থিতিতেই একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে ইমাম খোমেইনীর আহ্বান কানে এসে বাজে। তিনি খ্রিস্টধর্মীয় নেতাদের ঠিক বিপরীত অবস্থান থেকে কথা বললেন। ফলে আমি আমার চিন্তা ও বিশ্বাসকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে লাগলাম। নিজে নিজে বললাম, খ্রিস্টধর্মের অনুসারী প্রথম ব্যক্তিটি যেখানে বিশ্বলুটেরা ও যালেমদের সমর্থনকারী সেখানে ইসলামের হয়ে কথা বলার এ ব্যক্তি বিশ্বব্যাপী লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের আওয়ায তুলেছেন।’
‘এ কারণে আমি নতুনভাবে ইসলাম নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি। এতে কোনো কোনো বই আমাকে ইসলামের দিকে নিয়ে আসার উসিলা ও সেতুর ভূমিকা পালন করে। তবে যে বইগুলো আমার হৃদয়ে নূরের বাতি প্রজ্বলিত করে তা ছিল আয়াতুল্লাহ শহীদ মোতাহহারীর গ্রন্থাবলি। মোটকথা, আমার মুসলমান হওয়ার পেছনে কারণ ছিলেন ইমাম খোমেইনী।’
ইমাম খোমেইনীর বরকতময় জীবনে এ ধরনের অহরহ ঘটনা খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়। আমি আশা করি, এক্ষেত্রে উত্তরোত্তর গবেষণা ও পর্যালোচনার পরিধি বিস্তৃত হবে এবং বিশ্বের মযলুম মানুষের জন্য হেদায়াতের এই উৎসের ঝরনাধারায় যেন তাঁরা অবগাহন করতে পারেন। ইমামের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার তথা ইসলামী বিপ্লব ইনশাআল্লাহ হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর সুযোগ্য নেতৃত্বে তার দুর্বার যাত্রা অব্যাহত রাখবে এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিপ্লবের সাথে এ বিপ্লব একদিন যুক্ত হবে।