শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক ইরানের ‘ইসলামী গার্ড বাহিনী’

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৫ 

news-image

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিপ্লবী বাহিনী গঠনের পর থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর কথাগুলোই বার বার প্রমাণিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বাহিনী গঠিত হয় ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে রক্ষা ও এগিয়ে নেয়ার প্রতি নিষ্ঠাবান ও উৎসর্গীকৃত মুসলিমদের নিয়ে।

মূলত ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর কাজ শুরু হয় স্থানীয় ভিত্তিতে। বিপ্লবের সূচনায় গঠিত এই বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে বিপ্লবকে প্রহরা দিত, দিনের চব্বিশ ঘণ্টাব্যাপী রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করত। ইসলামী বিপ্লবের অব্যবহিত পর সুবিধাবাদী দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য নাশকতা রোধের জন্য ঐ সময় কার্যকর পুলিশ বাহিনী ছিল না। অবশ্য, কোনো দেশে আকস্মিকভাবে কোনো বিপ্লব বা পরিবর্তন সংঘটিত হলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, লুটপাট ও চরম নিরাপত্তাহীনতাজনিত যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, অবিশ্বাস্যভাবে ইরানের বেলায় তা হয়নি বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে এই ইসলামী বিপ্লব এত বেশি গণভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছিল যে, সাধারণ নাগরিকরাই সে সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করেছে।

অনেকটা অনানুষ্ঠানিক হলেও অত্যন্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ ইসলামী বিপ্লবী গার্ড আজ অনেক পথ অতিক্রম করে এসেছে। বর্তমানে এই বাহিনী একদল সুসংগঠিত মুসলিম বাহিনী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এর কর্মততপরতা আরো ব্যাপক ও বিভিন্নমুখী হয়েছে। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী চাপিয়ে দেয়া ইরাকী যুদ্ধের সময় সম্মুখ সমরে থেকে যুদ্ধ করেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করেছে এবং ব্যাপকতর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত থাকে।

দেশব্যাপী ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা এই সংস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্মদিবসকে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়। এ উপলক্ষে প্রতি বছর এই দিনে ইরানী জনগণ সারিবদ্ধভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড সদস্যদের কুচকাওয়াজকে অভিনন্দন জানায়। এই বাহিনীর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ সম্ভবত এই সংস্থার খাঁটি ইসলামী বৈশিষ্ট্য এবং এর সদস্যদের চরিত্র।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পর্যায় থেকে। অবশ্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। এর প্রতিটি সদস্যকে অত্যন্ত যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বিবেচনা করে অত্যন্ত আন্তরিকতাসম্পন্ন ও নিষ্ঠাবান লোকদেরকেই এই সংস্থায় ভর্তি করা হয়ে থাকে। যে কেউই ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন জানাতে পারে, তবে ঐসব আবেদনপত্র বিবেচনা করে ও সতর্কতামূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কোনো আবেদনকারীকে ভর্তি করা হলে তাকে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কোনো একটি ব্যারাকে রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক কোর্সের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে এই কোর্সে অংশ নিতে হয়। কোর্সে বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ ও ইসলামী ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়। সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের এই কোর্স শেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পছন্দ, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী মূলত একটি আধা-সামরিক সংস্থা। ইরাক কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে তারা সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের ততপরতা ছিল। জনগণকে সংগঠিত করার জন্য দায়িত্বশীল হিসেবে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ‘বাসিজ’ নামে আরেকটি সংস্থা গড়ে তোলে এবং এ উদ্দেশ্যে তারা রণাঙ্গনে কাজ করতে ইচ্ছুক লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবীকে ভর্তি, সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণ দান করে। বাসিজের সকল সদস্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ব্যাপক সামরিক দক্ষতা অর্জন করে। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডারগণ নিয়মিত সেনাবাহিনীর সহায়তায় রণাঙ্গনে যুদ্ধ ও সামরিক কর্মকাণ্ডে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী গার্ড বাহিনীর বিশেষ ও অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে পদমর্যাদার দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য করা হয় না এবং এর কমান্ডারগণ যুদ্ধের সময় সর্বদা সম্মুখ সারিতে অবস্থান করেন। একটি আধা-সামরিক বাহিনীর জন্য এটি একটি সাধারণ নিয়ম হলেও রণাঙ্গনে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ভূমিকা ব্যতিক্রমধর্মী।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা সমগ্র যুদ্ধের সময় এক উল্লেখযোগ্য যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। এর একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত হচ্ছে খয়বর সেতু। ‘জিহাদ সাজেন্দেগী’র সহযোগিতায় ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী মাত্র দশ দিনের মধ্যে তেরো কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করে। যুদ্ধের ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে বৃহত্তম সেতু। খয়বর সেতু ইরানের জোফেয়ার অঞ্চলের সাথে ইরাকের মজনুন দ্বীপকে সংযুক্ত করে, যা ইরানী যোদ্ধারা ইরাকের কাছ থেকে দখল করে নেয়। খয়বর অভিযানের সময় তুমুল যুদ্ধের মধ্যে ঐ সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রকৌশল শাখা অন্যান্য রণাঙ্গনেও বেশ সক্রিয় ছিল। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় তারা সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার সরবরাহ সড়ক ও বহু সেতু নির্মাণ করে। এছাড়া তারা বেশ কিছু ভূগর্ভস্থ টানেল তৈরি ও খাল খনন করে।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী সামরিক দক্ষতার ক্ষেত্রে এই পরিমাণ অগ্রগতি অর্জন করে যে, এখন তা একটি উন্নত যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ সামরিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ইসলাম গার্ড বাহিনীর বিমান বিভাগও যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই বিভাগের মাধ্যমে ইরানী লোকদের দ্বারাই বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দান করা হয়। শাহের আমলে এ ধরনের কাজ করত কেবল বিদেশীরা। এই বিভাগ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বিমান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে এবং যুদ্ধে অভিযান চালায়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর সদস্যরা তাদের অন্যান্য সহযোদ্ধার মতো অন্যসব ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। তারা তাদের নিষ্ঠা ও দক্ষতা দিয়ে সরকারের অন্যান্য সংস্থার কাজেও সহযোগিতা করে থাকে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কেবল নিজেদের সদস্যদেরই প্রশিক্ষিত করে তোলেনি বরং দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ইসলামী বিষয়াদি প্রচারের কাজও আঞ্জাম দিয়ে থাকে। তাদের সাপ্তাহিক রেডিও- টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো খুবই জনপ্রিয়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড ছাত্রদের জন্য হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধাঁচের সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এদের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে : প্রদর্শনী, খেলাধুলা, সেমিনার ও চলচ্চিত্র। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রকাশিত বই ও পত্র-পত্রিকা দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে পঠিত হয় এবং ফারসি ভাষায় তারা তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে থাকে। রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর আরবি ও ইংরেজি ভাষায়ও বই-পত্রিকা প্রকাশ করা হয়।

গঠনের পর থেকে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এত বেশি বিকাশ ও অগ্রগতি অর্জন করতে থাকে যে, এর আর্থিক ও নির্বাহী দিকগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হয়। প্রকৃতিগতভাবে বিপ্লবী এই অনন্য প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের এক অনানুষ্ঠানিক পর্যায় থেকে এখন একটি দক্ষ ও সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। আর এর সদস্যরা সকলেই ঈমানে বলীয়ান মুসলমান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছে কয়েকটি গবেষণা কেন্দ্র এবং একটি সুসজ্জিত আধুনিক কম্পিউটার কেন্দ্র। উন্নত পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, খাঁটি ইসলামী চরিত্র ও নিষ্ঠায় সমৃদ্ধ ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ইসলামের পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে এক ব্যাপকতর কল্যাণের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে।