ইসলামী ঐক্য ও ইমাম খোমেইনী
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৬, ২০১৪
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2014/01/62.jpg)
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব এই যে, তিনি মুসলমানদের ঐক্য সাধনে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছেন। মুসলমানদের মাঝে সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের গড়া বিভেদপ্রাচীর চুরমার করে তিনি আরব-অনারব, শিয়া-সুন্নি ইত্যাদি নামে বিভক্ত মুসলিম জাতিকে ঐক্যের দিশা দিয়েছেন। ইসলাম ও মানবতার স্বার্থে ইমাম সর্বদাই বিতর্কিত বিষয়কে পরিহার করতেন। তাই তাঁর বাণীতে শোনা যেত, শুধু মুসলমানদেরকেই নয়, বরং প্রতিটি আল্লাহ-বিশ্বাসী মানুষকে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান। মুসলমানদের সাধারণ স্বার্থে সকলকে উজ্জীবিত করা এবং অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক করা- এটাই ছিল ইমাম খোমেইনীর জীবনের বৈশিষ্ট্য।
এ দৃষ্টিতে ইমামের নিম্নোক্ত বাণীগুলো অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য : ‘…আমি সবাইকে বলছি : একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, সুন্নি-শিয়া, আরব-অনারব, তুর্কি-অতুর্কি কেউ কারো ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে শুধু ন্যায়পরায়ণতা ও খোদাভীতির (তাকওয়া) কারণে। খোদাভীরু ও সৎ স্বভাবসম্পন্ন লোকেরা রাষ্ট্রে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকলে সকল সুবিধাবাদ ও কায়েমী স্বার্থ নির্মূল হতে বাধ্য। কেউ কারো চেয়ে বড় নয়। সবাইকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলাম তাদেরকে সম্মান দিয়েছে। ইসলাম সকল শ্রেণি ও গোত্রকে মর্যাদা দিয়েছে। কুর্দিসহ অন্যান্য ভাষাভাষী সকলেই আমাদের ভাই। আমরা তাদের সাথে আছি এবং তারাও আমাদের সাথে রয়েছে। আমরা সকলে একই ঈমানের সূত্রে বাঁধা একজাতি।’ (ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বাণী : ৩-৪-৭৯ ইং)
‘মুসলমানদের এক সম্প্রদায় শিয়া এবং অপর এক সম্প্রদায় সুন্নি নামে পরিচিত। এছাড়া হানাফী, হাম্বলী ইত্যাদি নামেও মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় দেখা যায়। গোড়া থেকেই এভাবে মুসলমানদের বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করা ঠিক হয়নি। যে জাতির (উম্মাহ) প্রতিটি মানুষই ইসলামের খেদমত করতে চায় এবং সকলেই যেখানে ইসলামের অনুসারী, সেক্ষেত্রে মুসলিম জাতিকে বিভক্ত করার কোন পরিকল্পনাই গ্রহণ করা উচিত নয়। আমরা সকলে ভাই ভাই এবং সবাই মিলে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি। এটা ঠিক যে, আপনাদের আলেম সমাজ কোন কোন বিষয়ে ফতোয়া দিয়েছেন, আপনারা সে ফতোয়া জেনে নিয়েছেন এবং হানাফী (ইমাম আবু হানিফার অনুসারী) হয়েছেন। অন্যেরা ইমাম শাফেয়ীকে মেনে চলেছেন, আবার কেউ কেউ হযরত ইমাম জাফর আস-সাদিকের ফিকাহ অনুসরণ করে শিয়া মতাবলম্বী হয়েছেন। এসব কিছু আসলে কোন বিরোধের প্রমাণ নয়। আমাদের অবশ্যই একে অপরের সাথে কোন বিরোধ বা বৈপরীত্য থাকা উচিত নয়। আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের ভাই। শিয়া ও সুন্নি মুসলিম ভাইদেরকে অবশ্যই পারস্পরিক বিরোধিতা ও মতদ্বৈধতা পরিহার করতে হবে। শুধু শিয়া মতবাদের অবিশ্বাসীদের সাথেই নয়; বরং যারা হানাফী মাযহাব বা অন্য কোন মাযহাব মানতে অস্বীকার করে, এমন ধরনের সকল লোকের সাথেই বর্তমানে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে। এসব লোক এপথেও চলতে চায় না বা অন্য কোন পথে যেতেও রাজি নয়। তারা আমাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। আমাদের অবশ্যই হুঁশিয়ার থাকতে হবে। কারণ, আমরা সবাই মুসলমান, আল-কুরআনের অনুসারী, তাওহীদের অনুসারী। পবিত্র কুরআন ও তাওহীদের জন্য আমাদের অবশ্যই কাজ করে যেতে হবে এবং সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।’ (কুর্দিস্তানের নওশাদ থেকে আগত একটি মুসলিম প্রতিনিধিদলের প্রতি)।
‘ঐক্য হচ্ছে এমন একটি আদর্শ যার দিকে পবিত্র কুরআন মানুষকে নির্দেশনা দিয়েছে এবং মহান ইমামগণও মুসলিমদের ঐক্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত ইসলামের প্রতি আহ্বান মানেই হচ্ছে ঐক্যের প্রতি আহ্বান, জনগণকে ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান। আপনারা জানেন যে, তারা (ইসলামের দুশমনরা) এ ধরনের ঐক্যকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে তারা কঠোরভাবে চেষ্টা করেছে যাতে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিরোধের আগুন প্রজ্বলিত হয়, কেননা, তাদের বিশেষজ্ঞগণ বুঝতে পেরেছে যে, যদি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ সংহত ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, তাহলে কোন শক্তিই তাদের মোকাবিলা করতে ও তাদের ওপর শাসন চালাতে সক্ষম হবে না। তাই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে বিভিন্ন ইসলামী দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করা।’ (গিলান প্রদেশ ও রাস্ত শহরের জুমআর ইমামদের উদ্দেশে প্রেরিত বাণী থেকে)
‘…ইসলাম আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত জাতি- তা আরব হোক, তুর্কি, ইরানী বা যা-ই হোক না কেন, সবাইকে নিয়ে দুনিয়ার এক মহান সম্প্রদায় গড়ে তোলা যার নাম ‘মুসলিম উম্মাহ’। তাদের সংখ্যা-শক্তির কারণে ইসলামী কেন্দ্র ও সরকারসমূহ এবং মুসলিম দেশসমূহে তাদের সেবাদাসরা মুসলিম জনগণকে বিভক্ত করার ও তাদের প্রতি মহান আল্লাহর নির্দেশিত ভ্রাতৃত্বকে বিনষ্ট করার পরিকল্পনা করে আসছে। এ সমস্ত পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে তুর্কি জাতি, কুর্দি জাতি, আরব জাতি ও ইরানী জাতি প্রতিষ্ঠার ছদ্মাবরণে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম জাতিকে বিভক্ত করা। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছে যা মূলত ইসলাম ও মহান গ্রন্থ কুরআন নির্দেশিত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত। সমস্ত মুসলমানই ভাই ভাই ও সমান এবং কেউই একে অন্য থেকে পৃথক নয়। সমস্ত মুসলমানকেই ইসলাম ও তাওহীদের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হতে হবে।’ (খুজিস্তান প্রদেশের আরব গোত্রপ্রধানদের উদ্দেশে বাণী)
‘…ইসলামের অভ্যুদয়ের পর থেকেই মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদগণ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়ে আসছেন যাতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। একজন মুসলমান তিনি যেখানেই বসবাস করুন না কেন, তাঁর উচিত অন্য মুসলমানদের সাথে পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি করা। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানুষকে সেই পথে ধাবিত হতে নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) এবং ইমামগণ (আ.)ও এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এসব নির্দেশ ও উপদেশের প্রেক্ষিতে সচেতন আলেমগণ মুসলমানদেরকে তাওহীদ ও ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’ (পাকিস্তানী অভ্যাগতদের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্য থেকে, ৭-১১-৮১ ইং)
‘…প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশ্বশোষকদের জন্য প্রধান ভীতির কারণ হচ্ছে ইসলাম। কেননা, ইসলামই হচ্ছে এমন শক্তি যা দুনিয়ার মুসলমানদেরকে তাওহীদের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম। ইসলামই পারে মুসলিম দেশসমূহ ও দুনিয়ার বঞ্চিত মানুষের ওপর থেকে বিশ্বঅপরাধীদের হস্তকে ধ্বংস করতে। ইসলামই পারে বর্তমান পৃথিবীর সামনে এক ঐশী প্রগতিশীল ও উচ্চতর চিন্তাধারা ও ব্যবস্থা উপস্থাপন করতে।’ (হজযাত্রীদের প্রতি প্রদত্ত বাণী, ৬-৯-৮১)
‘…আমাদের বিরোধীরা মযলুম জনগণের মধ্যে, ইসলামী বা অনৈসলামী দেশ যাই হোক না কেন, অনৈক্যের বীজ ছড়ানোর চেষ্টা করছে এবং তারা চায় মুসলিম জাতিসমূহকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে। এজন্যই তাদের মুসলিম নামধারী মুখপাত্ররা, যারা প্রকৃতপক্ষে ইহুদিবাদের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ তারা চেষ্টা চালাচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে। এসব হচ্ছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও কৌশল, যা পরাশক্তিবর্গ উদ্ভাবন করছে যাতে মুসলিম দেশগুলোতে তাদের সেবাদাসরা তা প্রয়োগ করতে পারে।’ (দেশ গড়ার অভিযানের সদস্যগণের উদ্দেশে প্রদত্ত বাণী)
‘… মুসলমানদের মধ্যে যেসব বিরোধ ও জটিলতা রয়েছে সেগুলোরে উৎস সম্পর্কে আমরা স্বীকার করি যে, এসব ব্যাপারে গোপন হাত রয়েছে। শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে কাফের ও মুশরিকদের মোকাবিলায় যে পরিমাণ ঐক্য থাকা প্রয়োজন তা নেই। এ সমস্ত হাত এখনও সক্রিয় রয়েছে। কেননা, এখনও অনেক বিরোধ পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলে বিরাজমান। একথা স্পষ্ট যে, এসব বিরোধও মুসলমানদের দুর্বল করছে এবং আধিপত্যবাদীদেরকে শক্তিশালী করছে। আমরা আশা করি, তাঁরা (ঐ সমস্ত দেশের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ) তাঁদের নিজ নিজ দেশে ও পার্শ্ববতী সরকারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ দূর করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালাবেন যাতে মুসলমানরা কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।’
‘বিশ্বজোড়া যালেম সম্প্রদায় চায় ইসলামকে ধ্বংস করতে যাতে আমাদের ইসলামী গুণাবলি বিনষ্ট হয়ে যায়। এখন আমাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করা উচিত নয়, যেখানে মুসলমানদেরকে কাফের, মুশরিক ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হচ্ছে। যদি একশ’ কোটি মুসলমান তাদের বিরাট এলাকাসহ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয় এবং একই ফ্রণ্টে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে উপনিবেশবাদীর পক্ষেও নিশ্চিতভাবে কোন মুসলিম দেশ আক্রমণ করা সম্ভব নয়।’ (বাংলাদেশী কয়েকজন মুসলিম নেতার উদ্দেশে বাণী, ১-৯-৮২ ইং)
‘ইসলামী দেশসমূহে যেসব নাপাক লোকজন শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল, যারা ইসলামী দেশসমূহকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।’
(নিউজলেটার, সেপ্টেম্বর ১৯৯১)