শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামি বিপ্লবের ৪১ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের বিস্ময়কর উন্নয়ন

পোস্ট হয়েছে: জুন ১২, ২০২০ 

সাইদুল ইসলাম

দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামি বিপ্লবের গৌরবময় ৪১ বছর পূর্তি হলো গত ১১ ফেব্রুয়ারি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এই বিপ্লব ইরানে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।বলা হয় এটি ছিল মানব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন বিপ্লব। যার মাধ্যমে পতন ঘটে আড়াই হাজার বছরের শক্তিশালী ও স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার। অবসান হয় মার্কিন কর্তৃত্বসহ পরাশক্তিগুলোর মোড়লিপনার। বহু বিশ্লেষকের মতে এ বিপ্লব বিগত এক হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব, যা ইরানি জাতির জন্য ফিরিয়ে আনে প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও উন্নয়নের বিরতিহীন অগ্রযাত্রার সেই গৌরবের ধারা।
কিন্তু এ বিপ্লবের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়া মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্ররা গত প্রায় চার দশক ধরে একের পর এক বিছিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল। এইসব ষড়যন্ত্র অনুযায়ী তারা কখনও পরোক্ষ যুদ্ধ আবার কখনও কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন ওইসব দাম্ভিক পরাশক্তির চাপিয়ে দেয়া এসব অবরোধ ও কূটকৌশলের কাছে নতজানু হওয়া দূরের কথা, বরং খাঁটি ইসলামের অদম্য শক্তির বলে দিনকে দিন ভেতরে ও বাইরে এবং বিশ্ব-অঙ্গনে শক্তিশালী হচ্ছে ইসলামি বিপ্লবের দেশ ইরান। বিশেষ
করে উন্নয়নের অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো বহু সাফল্য অর্জন করেছে দেশটি। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, পর্যটন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, মহাকাশ গবেষণা ও সামরিক খাতে ইরানের উন্নয়ন বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে চলেছে।
সম্প্রতি ইরান মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে নিজস্ব প্রযুক্তির সামরিক উপগ্রহ ‘নুর-১’। এর মধ্য দিয়ে ইরানের প্রতিরক্ষা শক্তির নতুন একটি অধ্যায় রচিত হয়েছে। সামরিক উপগ্রহ হিসেবে ‘নুর-১’ এর অবস্থান প্রথম হলেও এটি নিয়ে ইরান এ পর্যন্ত মহাকাশে পাঁচটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামি ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম। এই নিবন্ধে ইসলামি বিপ্লবের পর গত ৪১ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সার্বিক উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:

শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন
একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন জাতি যেকোন সময় যে কোন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। সব দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থান বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সায়েন্স-মেট্রিক্স এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বৈশ্বিক পরিম-লে ইরানের বাস্তবিক এই উন্নতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেশটিকে দ্রুতবর্ধণশীল দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। বিশ্বের সকল দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থানের তুলনামূলক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ইরানের অগগ্রতি সু¯পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
মর্যাদাপূর্ণ বিশ্লেষণধর্মী ওয়েবসাইট ও গবেষণা বুদ্ধিমত্তা প্ল্যাটফর্ম ওয়েব অব নলেজ এ নিয়ে দারুণ ফলাফল তুলে ধরেছে। ওয়েবসাইটটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান ১৯৭৮ সালে ৬৬৯টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বৈশ্বিকভাবে নিবন্ধ প্রকাশে ইরানের অবদান ছিল ০.০১ শতাংশ। একই সূচকে ইসলামি বিপ্লবত্তোর ইরান ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। ২০১৮ সালে ইরানি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ হাজার ৫০৯টিতে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮২ গুণ। এই আকস্মিক প্রবৃদ্ধিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রকাশনায় বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ১৬তম অবস্থানে উঠে আসে।
এসসিআইমাগো জার্নাল র‌্যাঙ্কিংয়ে, ১৯৯৬ সালে উদ্ধৃতযোগ্য বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ৫ম স্থান অধিকার করেছিল। ২০১৭ সালে সেখানে ইরান সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক ও ইহুদিবাদী ইসরাইলকে পেছনে ফেলে উদ্ধৃতযোগ্য বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশে মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে।
এদিকে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের ওপর পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির গবেষকরা এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ২শ’র অধিক প্রকল্প পরিচালনা করেছেন। ১ মে ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী রেজা মালেকজাদেহ এই তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, করোনাভাইরাসের ওপর গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে দারুণ সব বৈজ্ঞানিক পণ্য তুলে ধরেছি। বর্তমানে দেশে পরিচালিত করোনাভাইরাস গবেষণার অধিকাংশই ইন্টারভেনশনাল স্কিমের আওতায়। এর মধ্যে ৩৫টি স্কিম কোভিড-১৯ এর কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবন করছে বলে জানান ইরানি এই মন্ত্রী।
২০০৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় ইরানের অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ সালে অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান ছিল তৃতীয়, সেখানে ২০১৪-১৫ সালে একেবারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে দেশটি। ইরানে ২০১৪ সালে জ্ঞানভিত্তিক ফার্ম ছিল ৫২টি, ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৩২টিতে। এসব কো¤পানিতে ৯০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে, রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০২ সালে যেখানে মাত্র ১টি পার্ক ছিল এখন সেখানে রয়েছে ৩৯টি।
এক কথায় বলতে গেলে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্পসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। পরিবহন খাতে বিরাট উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ইরান হচ্ছে নির্মাণ, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন, অস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘সাফির’ নামে একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান সর্বপ্রথম কক্ষপথে তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সাফল্য অর্জন করে। নিজস্ব র্প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট ও দেশে নির্মিত লাঞ্চারের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণে বিশ্বে যে সাতটি দেশ সক্ষম ইরান এখন তার একটি। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান। অ্যারো¯েপইস সায়েন্সেও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম এবং বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। মহাশূন্যে নিজস্ব র্প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণি পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়।

ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার
কারিগরি ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে এখন ন্যানোর্প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সকল বিভাগেই এই ন্যানো প্রযুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। এই প্রযুক্তিতে বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ। মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, পশু চিকিৎসা, পরিবেশবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মলিকিউল, এমনকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। ন্যানো র্প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানে এখন অন্তত ৩০০টি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পণ্য ইরানের বাইরে ১৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শিল্প সরঞ্জাম, টেক্সটাইল সরঞ্জাম, লন্ড্রি বা ডিজারজেন্ট পণ্য সামগ্রী, কৃষি ও ভবন নির্মাণ সরঞ্জাম ইত্যাদি ন্যানো প্রযুক্তিজাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। টেক্সটাইল শিল্প পণ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ব্যবহৃত বেডশিটের কথা বলা যেতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্মিত এইসব বেডশিট অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল মানে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়া এসব চাদরে আক্রমণ করতে পারবে না। শিশুদের জামা-কাপড়ও এই ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট-রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ রশ্মি প্রতিরোধক কাপড়ও ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বায়ুম-লীয় ঠা-া প্লাজমা শিল্প মেশিনের কথা না বললেই নয়। এই শিল্পে এখন তাঁত শিল্পসহ খাবার, চিকিৎসা, প্যাকেজিং এবং স্টেরিলাইজ করা হয়। এমনকি পরিবেশবিজ্ঞানেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মহাকাশবিজ্ঞান
মহাকাশ প্রকৌশলেও ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালে বিশ্বে মহাকাশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ উৎপাদনে ইরান ৪৫তম অবস্থানে ছিল। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশটি দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করে। ২০১৭ সালে মহাকাশের ওপর বৈজ্ঞানিক উৎপাদনের দিক দিয়ে বিশ্বে ইরান ১১তম স্থান অর্জন করে। পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে ১৯৯৬ সালে মহাকাশের ওপর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশে ইরান ষষ্ঠতম স্থানে ছিল। ইসলামি প্রজাতন্ত্র সরকার বিজ্ঞানের উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ ও পরিবেশ নিশ্চিত করে। ফলে ২০১৭ সালে মহাকাশে বৈজ্ঞানিক উৎপাদনের দিক দিয়ে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে দেশটি প্রথম স্থান অধিকার করে। অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এক্ষেত্রে ইরান থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

পরমাণু প্রযুক্তি
ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের আরও একটি ক্ষেত্রে ইরান উল্লেখযোগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সেটি হলো পরমাণু প্রকৌশল ও বিজ্ঞান। এসসিআইম্যাগো জার্নালের তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে ইরান বৈজ্ঞানিক উৎপাদন ও পেপারের দিক দিয়ে বিশ্বে ৭০তম স্থানে ছিল। ইরানি স্কলার ও বিশেষজ্ঞদের প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালে এই ক্ষেত্রে ইরান ৩৫৪টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বিশ্বে ১২তম অবস্থানে উঠে আসে ইরান। বর্তমানে পরমাণু প্রকৌশল ও জ্বালানির ওপর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের সংখ্যায় পশ্চিম এশিয়ায় ইরান প্রথম স্থানে রয়েছে।

শিক্ষা
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে ইরানে শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশটির শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও র্প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে।বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ইরানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫৪টি, পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি, বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬৭টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৪টি। এর মধ্যে বিশ্ব সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। ইনফরমেশন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) এক জরিপে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে তেহরান মেডিকেল সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, ইরান পলিমার অ্যান্ড পেট্রোকেমিকেল ইনস্টিটিউট, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অন্যতম।

চিকিৎসা
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে চিকিৎসাখাতে ইরানের উন্নয়ন যেকারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, স্বাস্থ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে ইরান বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি ও বিশাল অগ্রগতি লাভ করেছে। সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ৫০ বছর থেকে বেড়ে ৭৫ এ ছুঁয়েছে। বিপ্লবের আগে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি হাজারে মৃত্যু হার ছিল ১৮৫। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কমে হাজারে ১৪ দশমিক ৯ জনে নেমে এসেছে। এছাড়া ইরানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে দেখা গেছে। বিপ্লবের আগে সাধারণ মানুষদের উচ্চ শিক্ষা, বিশেষত মেডিসিনে পড়ালেখা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কেবল অভিজাত শ্রেণির মানুষজন এই সুযোগ পেতো। সেই সময় গোটা দেশে মাত্র ৫ হাজার ৮৯০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেশটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষত নারী চিকিৎসকদের সংখ্যাই ৩৬ হাজারে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ইরান ২০১৯ সালে হাসপাতালের সংখ্যা ও মানের দিক দিয়ে বিশ্বে ২১তম স্থান অর্জন করে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় দেশের স্বীকৃত লাভ করে। ইরানের সেনিটেশন ও মেডিকেল অগ্রগতির অবস্থা এত প্রশংসনীয় যে, এই ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ইউনিসেফ ইরানকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ইরানের অবস্থান তুলে ধরে দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, বিশ্বের বহু উন্নত দেশ করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেলেও ইরানে এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও করোনা রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছে তেহরান।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত থমসন রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সেরা ১ ভাগ চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে অন্তত ৩৬ জন ইরানি গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। থমসন রয়টার্স প্রতিনিয়ত বিশ্বের চিকিৎসা গবেষকদের একটি তালিকা আপডেট করে থাকে। গত ১০ বছরের চিকিৎসা গবেষণার কর্ম থেকে গবেষকদের এ ধরনের তালিকা করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা ইরনার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশটি বর্তমানে বিশ্বের ৪৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। সম্প্রতি ইরানের চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিকারকদের ইউনিয়নের সচিব মোহাম্মাদ রেযা জানিয়েছেন, প্রতি বছর বিশ্বের ৪৪টি দেশে তিন কোটি ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম ইরান থেকে রপ্তানি হয়। রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়ানোর ইচ্ছে রয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, ইরানের চিকিৎসা সরঞ্জাম জার্মানি ও ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। এসব সরঞ্জাম ইউরোপীয় মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিই-র অনুমোদনপ্রাপ্ত।
এদিকে, ইরানের চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত জৈব পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি সংস্থার পরিচালক আমির হোসেইন কারাগাহ জানিয়েছেন, ইরান কেবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে তা-ই নয়, একই সাথে দেশটি জৈব ওষুধ প্রস্তুত সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতাও রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, এ জাতীয় র্প্রযুক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে ইরানের জৈব ওষুধ উৎপাদনের উচ্চ সক্ষমতাই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে ইরান এ জাতীয় ওষুধ নির্মাণের প্রযুক্তি তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া, কাযাকস্তান এবং রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রপ্তানি করছে। গত কয়েক বছরে ইরান প্রায় এক ডজনের বেশি জৈব ওষুধ উৎপাদন করেছে। এতে ইরান প্রায় ৭০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণে অর্থ বিদেশে যাওয়া থেকে সাশ্রয় করতে পেরেছে।
এ ছাড়াও ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণে ইরানের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছে। ফলে ইরান এক্ষেত্রে বিশ্ব অঙ্গনে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের পরই নিজের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তেহরানের কে এন তূসি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ন্যানো র্প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি যৌগ আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মানবদেহে ক্যান্সার চিহ্নিত করা যাবে। এধরনের যৌগ উৎপাদন করা যাবে বেশ সস্তায় এবং এতে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা স¤পন্ন করা যাবে।
হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ইরান বছরে প্রায় ১০০ হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এছাড়া অঙ্গ ও কিডনি প্রতিস্থাপনে ইরানি চিকিৎসকদের খ্যাতি এখন বিশ্বজুড়ে।২০১৬ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে আড়াই হাজার মানুষের কিডনি ও ৩৩শ’ মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ইরানে বর্তমানে ২৯টি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, যকৃত প্রতিস্থাপনে ৭টি কেন্দ্র, ৮টি হৃদযন্ত্র ও ২টি ফুসফুস প্রতিস্থাপন কেন্দ্র কাজ করছে।

মেডিক্যাল ট্যুরিজম
মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পে ইরান এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এখন সারা বছর জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ইরানে আসছেন। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে চিকিৎসার গুণগত অবস্থা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশী সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ২ লাখ রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ইরান সফরে আসে এবং ইরানের উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছে। ইরানের অন্তত ৬০টি হার্ট অপারেশন কেন্দ্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকে আকৃষ্ট করছে। কেবল ওপেন হার্ট সার্জারিই নয়, আরো বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন বেশ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে।

রপ্তানি খাত
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এই খাতে যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ। আর এক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির ইতিবাচক গতিধারায়। তেলের ওপর নির্ভরতাই ছিল এক সময় দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু সেই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে দেশটি। ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত ৪১ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিষ্ঠুর অবরোধ সত্বেও দেশটি গত ফারসি বছরে বিশ্বের ১২৮টি দেশে পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) প্রেসিডেন্ট মেহদি মির-আশরাফি বলেন, গত বছর ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৫ দশমিক ১০৭ বিলিয়ন ডলার। ইরান গত ফারসি বছরের প্রথম দশ মাসে কেবল (২১ মার্চ ২০১৮ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০১৯) প্রতিবেশী ১৫টি দেশে ৫৭ দশমিক ২৮ মিলিয়ন টনের তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে প্রায় ৩০বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ৩৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শুল্ক প্রশাসন প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের প্রথম দশ মাসে ইরান সর্বমোট ৫০ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে ২০ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
ইরানে তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানির তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জৈব রাসায়নিক পণ্যসামগ্রী, তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আকরিকসহ ধাতব দ্রব্যসমূহ, চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফলমূল ও বাদাম। এছাড়া ইরানের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে আয়রন ও স্টিল, কপার, সার, লবণ, সালফার, পাথর ও সিমেন্ট, পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য, খনিজ ও ওষধি পণ্য উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বে উদ্যোক্তা বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচে ইরান
বিশ্বে উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সূচকের অবস্থা পর্যবেক্ষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। ইরানের বিজ্ঞান, র্প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সূচকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালের জন্য এই র্যা ঙ্কিং প্রকাশ করা হয়।ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্যোক্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম ইরান।

কৃষি উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে কৃষিখাতে ইরানের অগ্রগতির চিত্র রীতিমত বিস্ময়কর। ২০১৭ সালে বিশ্বে কৃষি পণ্যের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। এছাড়া ইরানের তুলনামূলক রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটির কৃষি খাত। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (টিপিও) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাওর তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া কঠিন অবরোধের মধ্যেও গত ফারসি বছর (২১ মার্চ ২০১৯ থেকে ২০ মার্চ ২০২০) ইরানে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের কৃষি খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি হয়েছে।

বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ইরানি কৃষিপণ্য
পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান কৃষিপণ্যের একটি জাফরান। যাকে ইরানের ‘লাল স্বর্ণ’ বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত জাফরানের প্রায় ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার যাকে ‘কৃষ্ণ সোনা’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে সেটি উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিশ্বে উটপাখির মাংস উৎপাদনে ইরান দ্বিতীয়। বৈশ্বিকভাবে ডিম উৎপাদনের র‌্যাঙ্কিংয়ে ১২তম অবস্থানে রয়েছে ইরান। মধু উৎপাদনে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। খেজুর উৎপাদনে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম খেজুর রপ্তানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বে বর্তমানে তৃতীয় বৃহত্তম কিসমিস রপ্তানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বের শীর্ষ আক্সগুর উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করেছে ইরান। পৃথিবীতে যত দামী ফল বিশেষ করে বাদামজাতীয় ফল রয়েছে পেস্তা তার অন্যতম। এই ফলটির নাম উঠলেই যে দেশটির কথা সবার আগে উচ্চারিত হয় তার নাম ইরান। আখরোট উৎপাদনে ইরান বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

সামরিক শক্তি
ইরান সারা বিশ্বে এখন যেসব কারণে বিশেষ আলোচিত তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর সামরিক শক্তি। সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, ইরানের রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য। এছাড়া আছে সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ, যার সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরান যেকোনো সময় দশ লাখের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা মোবিলাইজ করতে পারে এবং এ সুবিধা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের রয়েছে। ইরানের হাতে রয়েছে নিজস্ব সামরিক শিল্প-কারখানা যেখানে ট্যাংক, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, গাইডেড মিসাইল, সাবমেরিন, সামরিক নৌযান, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গিবিমান তৈরি করা হয়। এছাড়া ইরানের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে হুত, কাউসার, জেলযাল, ফতেহ-১১০, শাহাব-৩ ও সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের ড্রোন।

ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি
ইরানের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান স্তম্ভ হলো অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইরান বিশ্বের যত বড় পরাশক্তির হাতেই আক্রান্ত হোক না কেন দেশটির ব্যালিস্টিক ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা আঘাতগুলো প্রতিপক্ষের জন্য হজম করা হবে খুবই কঠিন এবং অসহনীয়। তাই ইরানের শত্রুরা এ দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রেখে সামরিক হামলার কথা খুব কমই ভাবতে বাধ্য। উল্লেখ্য, ইরান এর আগে নিজস্ব র্প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে ‘ইমাদ’ ও ‘ফজর’ এর মতো উন্নত র্প্রযুক্তির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

বিদেশী হুমকি মোকাবিলায় ইরানের প্রস্তুতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি বলেছেন, শত্রুর যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় তাঁর দেশের সামরিক প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।তিনি আরো বলেন, মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়েছে; এর মাধ্যমে একথা পরিষ্কার হয় যে, শত্রুর নিষেধাজ্ঞা ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে কোনো রকমের বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমনকি এখন আমেরিকা ও তার আঞ্চলিক পুতুল সরকারগুলো ইরানের সামরিক শক্তিকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।

পর্যটন শিল্প
আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নিল পৃথিবীর অজানা কোন সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোন শিল্পকর্মের সুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোন দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন স¤পর্কে তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’। অর্থাৎ ইরান সফরের ৩৪টি অবিশ্বাস্য সুন্দর কারণ। ইরানের ৩৪টি আকর্ষণীয় নিদর্শনের বর্ণনা দিয়ে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়। এমন একটি দেশে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ দেশটিকে বিশ্বপর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্তমানে ইরান বিশ্বের সেরা ১০ পর্যটন গন্তব্যের অন্যতম।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৪টি নিদর্শন। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচির্ত্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচির্ত্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত-এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। শুধু পারস্য উপসাগরের কিশ দ্বীপ ভ্রমণ করেন প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি বিদেশী পর্যটক। গত ইরানি বছরের প্রথম তিন মাসে বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশটিতে বিদেশী পর্যটক আগমনের হার বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ফারসি দৈনিক দোনিয়া-ই-ইকতেসাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম তিন মাসে ইরানে মোট ২০ লাখ ৩০ হাজার ৫২৩ জন বিদেশী পর্যটক ইরান ভ্রমণ করেছেন। আগের বছরের একই সময়ে পর্যটকদের এই সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫১ জন। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি।

ইরানের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ১১.৮ বিলিয়ন ডলার
ইরানের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের অবদান ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিগত ফারসি ১৩৯৭ সালে পর্যটন শিল্প থেকে এই অর্থ আয় হয়েছে। ইরানের পর্যটন সংস্থার প্রধান আলি-আসকার মুনেসান এই তথ্য জানিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইরান’ এর তথ্যমতে, গত বছর ইরানের জিডিপিতে পর্যটন শিল্প ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এছাড়া একই বছর জিডিপিতে হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি থেকে যোগ হয় আরও ৬শ মিলিয়ন ডলার।
মুনেসান বলেন, পর্যটন শিল্প থেকে যেসব ক্ষেত্রে লাভবান হওয়া গেছে তার মধ্যে এই খাতে টেকসই কর্মসংস্থানের বিষয়টি অন্যতম। গত বছর ইরানের কর্মসংস্থান তৈরিতে যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার অন্যতম ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা (সিএইচএইচটিও)। বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ইরানের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪৫৪.০১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিএইচএইচটিও প্রধান মুনেসান জানান, ফারসি বছর ১৩৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা ইরান ভ্রমণে ব্যয় করেছে ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।

গ্রামীণ উন্নয়ন
আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানের ৭৪ শতাংশ মানুষ শহরে এবং ২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তবে শহরের মতো গ্রামের মানুষও সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে বাড়ির মালিক হচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এখন ইরানের গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় চলে এসেছে।তিন বছর আগে অর্থাৎ ফারসি ১৩৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরানের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার, বিপ্লবের আগে ছিল ২২ হাজার ২৪৬টি। গত চার দশকে ডে-নাইট স্কুল ৯টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৮৭টি। শাহ সরকারের আমলে গ্রামে খেলার মাঠ ছিল মাত্র ১২টি, বর্তমানে ২ হাজার ১৮২টি। বিপ্লবের আগে গ্রামে পাকা রাস্তা ছিল মাত্র ২০০ কিলোমিটার, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। আধাপাকা রাস্তা ছিল ৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার আর এখন ১ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার। বিপ্লবের আগে ইরানের গ্রামাঞ্চলের জন্য কোনো ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্র ছিল না, বর্তমানে ৩৮০টি গ্রামে ফায়ার সার্ভিস সেবা চালু আছে। সেসময় ইরানের ৩১২টি গ্রামে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে ইরানের ৫ হাজার ৩১২টি গ্রামের মানুষ টেলিফোন ব্যবহার করে। দেশটিতে গত ৪০ বছরে ৩৩ হাজার ৫০০ পল্লি উন্নয়ন পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইরানের গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা
যে কোনো দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই তো সারা বিশ্বের নজর আজ শান্ত ও স্থিতিশীল ইরানের দিকে, দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার দিকে। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট, তালাক প্রভৃতি যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। এখানে নেই কোন মারামারি, নেই চুরি-ছিনতাই, গোলাগুলি-অস্ত্রবাজি। প্রতিদিনের পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে খুন-হত্যাকা-ের খবর ‘মাস্ট আইটেম’ হিসেবে থাকে না- যা অনেক উন্নত দেশেও কল্পনা করা যায় না। এখানে মানুষ অনেক বেশি নিরাপদে পথ চলে। সেই নিরাপত্তা দিনে-রাতে একই রকম। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভয় নেমে আসে না। নিশ্চিন্তে পথ চলা যায় একাকী। ভাবতেও হয় না- ‘কেউ জানতে চাইবে কাছে কী আছে!’বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই নিরাপত্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সমান। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। পথ চলতে গেলে ডাকাত-ছিনতাইকারীর সামনে পড়ার ভয় নেই। রাস্তায় নেই কোন উটকো মাস্তানি। কেউ পথ আগলে দাঁড়াবে না, কেউ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবে না বা শিস দেবে না। এ এক অন্যরকম সমাজ; সামাজিক নিরাপত্তাই যার বড় বৈশিষ্ট্য। সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ইরানকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।

চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন
চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশেরই জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। গণযোগাযোগ বা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি খুব সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আবার সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির চলচ্চিত্র এখন বিশ্বমানের। অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়¯পর্শী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। ১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেলসম্যান’। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অস্কার জিতলেন ছবিটির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এর আগে ‘অ্যা সেপারেশন’ তাঁকে এনে দেয় এই সম্মাননা।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র এই উৎসবের ৭০তম আসরে সিনেফন্ডেশন পুরস্কার জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অ্যানিমল’। গত কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনও হয়েছে ইরানি চলচ্চিত্র দিয়ে এবং এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও জিতে নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসরে দুই অ্যাওয়ার্ড জয় করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর পরিচালক চলচ্চিত্রকার ভাহিদ জলিলভান্দ এবং সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহ।
ভারতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কার্গিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অ্যাওয়ার্ড জেতে ইরানের চারটি ছবি।পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে ইরান। সেরা ছায়াছবি, সেরা অভিনয় ও শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে পুরস্কার জিতে নেয় ইসলামি প্রজাতন্ত্রের এই দেশটি।এক কথায় বলতে গেলে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে সর্বত্র ইরানি চলচ্চিত্রের জয়জয়কার।

আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য
নারীর উন্নয়নে বিশ্বের যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ফারসি ১৩৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানে সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন। যার ৫০ শতাংশই নারী। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। এক হিসাব মতে, বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা স¤পন্ন করেন ইরানের অর্ধেকেরও বেশি নারী। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, র্প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে øাতক স¤পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় শতাংশে অনেক বেশি। লেখিকা সাদিয়া জাহিদি তাঁর নতুন বই ‘ফিফটি মিলিয়ন রাইজিং’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেন।
কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। বর্তমানে ইরানের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স ইরান এয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। কর্মক্ষেত্রে নারীর এমন সফলতার কারণে চাকরির বাজারে দেশটির নারীদের চাহিদা বাড়ছে। ইরানের চাকরির বাজারে বিগত তিন বছরে নারীদের উপস্থিতির সংখ্যা বেড়েছে ৪০ ভাগ। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফারসি বছরে আন্তর্জাতিক কো¤পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় নারী কর্মচারীদের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ ভাগ। অন্যদিকে, বেসরকারি মালিকানাধীন কো¤পানিগুলোতে বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ শতাংশ। প্রতিবেদন মতে, ইরানে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ নারী কর্মরত রয়েছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা পদে রয়েছেন ১৯ শতাংশ নারী। এছাড়া দেশটিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কার্যনির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। বিদেশী ভাষা থেকে অনুবাদের কাজে কর্মরত রয়েছেন ৫০ শতাংশ নারী। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের অপর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্প ক্ষেত্রে কাজ করছেন। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেয়া হয়।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য
যে-কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব স¤পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, ক¤িপউটার প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। বাস্তবতার নিরিখে এ সকল উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয় একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় হাজার মেগাওয়াট। ২০১৫ সালে দেশটিতে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার মেগাওয়াট সেখানে ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার ৭৯৫ মেগাওয়াটে। এর মধ্য দিয়ে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বর স্থানে রয়েছে। আর সারা বিশ্বে দেশটির অবস্থান ১৪ নম্বরে।
এছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে যেকথা না বললেই নয় তা হচ্ছে, শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি ও ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ উজমা খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ইরানি জাতি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে উন্নয়নের ধারায় যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে দেশটি একদিন বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।