শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

  ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদের চল্লিশ বছর

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৯, ২০২০ 

নূর হোসেন মজিদী

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো একজন মুজতাহিদ ফক্বীহ্র নেতৃত্বে গণবিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের বুকে ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের ফলে ইরানের বুকে একদিকে যেমন দীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী ত্বাগূতী রাজতান্ত্রিক শাসনের বিলোপ ঘটে, সেই সাথে দেশটির ওপর থেকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পরোক্ষ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণেরও অবসান ঘটে।
বিপ্লব-পূর্ব শাহী সরকারের গুপ্ত পুলিশ সংস্থা সাভাক ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র দিকনির্দেশে হাজার হাজার বিপ্লবী নারী-পুরুষকে হত্যা করেও যখন ইসলামি বিপ্লবের বিজয় রোধ করা সম্ভব হয় নি তখন আমেরিকা আশা করেছিল যে, ইরানের ওলামায়ে কেরাম দেশ শাসনে সক্ষম হবেন না, ফলে বিপ্লবোত্তর ইরানে শেষ পর্যন্ত মার্কিন সেবাদাস পাশ্চাত্যপন্থীরাই শাসন ক্ষমতার ওপর নিযন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। কিন্তু ইসলামি ইরানের একনিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার বিপ্লবী জনগণ আমেরিকার সে আশাকে হতাশায় পরিণত করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বিপ্লবের বিজয়ের পর পরই ইসলামি সরকার কর্তৃক যায়নবাদী ইসরাঈলের ওপর থেকে স্বীকৃতি প্রত্যাহার ও ইসরাঈলি দূতাবাসকে ফিলিস্তিনী দূতাবাসে পরিণত করা হলে এবং এর অত্যল্পকালের মধ্যেই হযরত ইমাম খোমেইনীর অনুসারী বিপ্লবী ছাত্ররা তেহরানন্থ দূতাবাস নামক মার্কিন গুপ্তচর বৃত্তির আখড়াটি দখল করে নিলে আমেরিকার পক্ষে ইরানের অভ্যন্তর থেকে বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র কার্যকর করা অধিকতর কঠিন হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় আমেরিকা ইসলামি বিপ্লবকে অকার্যকর করা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ইরানকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ইরানের কুর্দিস্তান, বেলুচিস্তান ও খুযেস্তান এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তৈরি করা হয় এবং পরিকল্পনাটি পুরোপুরি কার্যকর করার লক্ষ্যে ইরানের সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার অঘোষিত এজেন্ট ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত কমরেড সাদ্দাম হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরই ভিত্তিতে ১৯৮০ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর ইরাকের বাথপন্থী বাহিনী আকস্মিক হামলা চালিয়ে ইরানি ভূখ-ের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। এভাবে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সাদ্দাম হোসেন যে বাহানায় ইরানের ওপর হামলা চালান তা ছিল পুরোপুরি অযৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এর আগে ইরান ও ইরাকের মধ্যে স্বভাবতঃই সীমান্তবিরোধ ছিল। ১৯৭৫ সালে আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে এ বিরোধের নিষ্পত্তি করা হয়। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ইরানের পক্ষে তৎকালীন শাহ্ মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভী ও ইরাকের পক্ষে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। এ চুক্তি অনুযায়ী ইরান ও ইরাকের সীমান্তবর্তী নদী র্আবান্দ রূদ বা শাতিল ‘আরাবের গভীর পানির মধ্যরেখাকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের জন্য ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের আগ্রহী হবার পিছনে দু’টি প্রধান কারণ ছিল। প্রথমত, শাহের মনোনীত প্রধানমন্ত্রী শাপুুর বাখতিয়ার শাহী সরকারের পতনের আগের দিন, আমেরিকার কাছ থেকে ইরানের ক্রয়কৃত সাড়ে তিনশ’ কোটি ডলার মূল্যের কয়েকশ’ জঙ্গী বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র মূল্য ফেরত ব্যতীতই আমেরিকার কাছে ফিরিয়ে দেয়, বিপ্লবোত্তর বাযারগান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার মেয়াদ দুই বছর থেকে কমিয়ে এক বছর করে এবং ইরানে ১৯৮০ সালের ৯ই জুলাইর সামরিক অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ফাশ হয়ে যাবার পর এর সাথে জড়িত সামরিক অফিসারদেরকে বরখাস্ত করা হয়; এ পরিপ্রেক্ষিতে সাদ্দাম মনে করেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, সাদ্দাম হোসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজিনস্কির সাথে সাক্ষাতে খুযেস্তান প্রদেশ দখল করার পরিকল্পনার কথা জানালে ব্রেজিনস্কি তাঁকে নিশ্চয়তা দেন যে, খুযেস্তানকে ইরাকভুক্ত করা হলে তাতে আমেরিকার কোনো আপত্তি থাকবে না।
এর ভিত্তিতে সাদ্দাম হোসেন ইরানে আগ্রাসন চালানোর বাহানা হিসেবে তিনটি দাবি তোলেন, তা হচ্ছে : (১) শাতিল্ ‘আরাব্ (র্আবান্দ রূদ) সংক্রান্ত আলজিয়ার্স চুক্তি সংশোধন করতে হবে অর্থাৎ পুরো র্আবান্দ রূদ ইরাককে দিতে হবে, (২) ইরানের কুর্দী, বেলুচ ও আরবদেরকে স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে এবং (৩) হরমূয প্রণালীস্থ ইরানি দ্বীপ তোম্বে বোযোর্গ, তোম্বে কুচাক ও আবূ মূসা থেকে ইরানি সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে হবে। বলা বহুল্য যে, তিনটি দাবিই ছিল অযৌক্তিক। কারণ, আল্জিয়ার্স চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং অপর দু’টি দাবি ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বৈ ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এ সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
এর ভিত্তিতে, আগ্রাসন শুরু করার পাঁচ দিন আগে সাদ্দাম হোসেন ইরাকি টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে আলজিয়ার্স চুক্তির ডকুমেন্ট ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর ২২শে সেপ্টেম্বর (১৯৮০) ইরাকি স্থল ও বিমান বাহিনী ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, সাদ্দাম হোসেন সদম্ভ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যে তেহরান দখল করে সেখানে গিয়ে চা খাবেন।
আগ্রাসনের প্রথম দিনেই ইরাকি বিমান বাহিনী ইরানের দশটি সামরিক ও বেসামরিক বিমান বন্দরে হামলা চালায় এবং সীমান্তে দুই দেশের স্থল বাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
যুদ্ধের শুরুতে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পরিচালিত আকস্মিক সর্বাত্মক হামলার মাধ্যমে ইরাক কয়েক দিনের মধ্যে ইরানের তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নেয়Ñ যার মধ্যে খুযেস্তানের খুররমশাহ্র ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসী অভিযান অব্যাহত থাকে এবং তারা ইরানের আবাদান বন্দর এবং দেযফুল্ ও আহ্ওয়ায্ সহ আরো অনেক শহর সহ মোট ১৩ হাজার ৬০০ বর্গ কিলোমিটার ইরানি এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অচিরেই ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্য থেকে গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ঈমানী ও জিহাদী চেতনায় দীপ্ত হয়ে ইসলামি হুকুমাতের পবিত্র প্রতিরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাদ্দামের আশাকে হতাশায় পরিণত করে দিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।
ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পরিচালনার আগে থেকেই ইরাকি সশস্ত্র বাহিনী ছিল প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রে সজ্জিত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী। আমেরিকার নির্দেশে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল আরব দেশ এ যুদ্ধে ইরাকের প্রতি আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে, কেবল সিরিয়া ও লিবিয়ার কূটনৈতিক সমর্থন ছিল ইরানের পক্ষে। যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে আরবদের অর্থে সাদ্দাম সরকার আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুগোশ্লাভিয়া সহ তেইশটি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় করে। এর বিপরীতে অস্ত্রশক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের ঈমানী অস্ত্রই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
যুদ্ধের চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে ইরাকি বাহিনী ইরানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ইরাকের সরকার-বিরোধী বেসামরিক কুর্দী জনগণের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ^ সম্প্রদায় আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতাধীন সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয় নি।
যুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে ইরানি জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী খুররমশাহ্র সহ ইরাক কর্তৃক দখলকৃত ইরানি এলাকার বেশির ভাগ (৮,৬০০ বর্গ কিলোমিটার) পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৮৪ সালে যুদ্ধ ইরানি ভূখ- থেকে ইরাকি ভূখ-ে স্থানান্তরিত হয়। এরপর ইরানি বাহিনী ১৯৮৬-র ফেব্রুয়ারি মাসে ইরাকের অন্যতম তেল রফতানি বন্দর ‘ফাও’ এবং আরো অনেক এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়।
ইতিমধ্যে দুই দেশের পক্ষ হতে পরস্পরের তেল-ট্যাঙ্কারে হামলা চালানো শুরু হয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তৃতীয় পক্ষের তেল-ট্যাঙ্কারও হামলার শিকার হতে থাকে। যেহেতু বিশে^র তেল মওজূদের বেশির ভাগই পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত সেহেতু তেল সরবরাহ বিঘিœত হওয়ার ফলে বিশে^র বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার বিশে^র বৃহৎ শক্তিবর্গের টনক নড়ে।
প্রথম দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য দায়সারা গোছের প্রস্তাব নিলেও এবার এ যুদ্ধের বিষয়টিকে অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার হৃত এলাকার বেশির ভাগ পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধকে ইরাকি এলাকায় নিয়ে যাবার পর ইরাক স্বভাবতঃই যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে আগ্রহ প্রদর্শন করে। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যুক্তিসঙ্গতভাবেই শর্ত আরোপ করে যে, আগে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে তদন্ত করে যুদ্ধের সূচনাকারী কে তা নির্ণয় করতে হবে। কিন্তু ইরাকের পৃষ্ঠপোষক বৃহৎ শক্তিবর্গের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় নি। এদিকে ইরানি বাহিনীর অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে এবং ইরানি বাহিনী ইরাকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর বসরার ১২ কিলোমিটার ব্যবধানে গিয়ে পৌঁছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মোট ৮টি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তবে ১৯৮৭ সালের ২০শে জুলাই গৃহীত ৫৯৮ নং প্রস্তাবে পূর্বেকার প্রস্তাবগুলো থেকে পার্থক্য ছিল এই যে, এতে যুদ্ধ বন্ধের পরে যুদ্ধের সূচনাকারী কে তা নির্ণয় করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়। ইরানের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা না হলেও প্রত্যাখ্যানও করা হয় নি।
যুদ্ধের শেষের দিকে ইরাক সরকার তার ক্রমবর্ধমান পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের বিভিন্ন শহরের ওপর ব্যাপকভাবে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় Ñ যার ফলে ইরানের বহু সরকাপর ও বেসরকারি স্থাপনা ধ্বংস হয় ও বহু বেসামরিক লোক নিহত হয়। ইরানের পক্ষ থেকে এর সীমিত মাত্রায় জবাব দেয়া হয়, তবে বেসামরিক জনগণের প্রাণহানি রোধ করার লক্ষ্যে প্রতিটি হামলার যথেষ্ট আগে তা ঘোষণা করে তাদেরকে সরে যেতে বলা হয়।
এদিকে যুদ্ধে ইরাকের ক্রমবর্ধমান বিপর্যস্ত অবস্থা লক্ষ্য করে আমেরিকা অঘোষিতভাবে ইরাকের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ তারিখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব না মানলে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। এরপর ১৯৮৮-র ৪ঠা এপ্রিল আমেরিকার যুদ্ধ জাহায থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে পারস্য উপসাগরের আকাশে উড্ডয়নরত ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়Ñ যার ফলে নারী ও শিশু সহ এর ২৯০ জন আরোহীর সকলেই নিহত হয়Ñ যার মাধ্যমে আমেরিকা এ বাণীই প্রদান করে যে, প্রয়োজন মনে করলে ইরানের বিরুদ্ধে যে কোনো পৈশাচিকতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করবে না। আর ১৯শে এপ্রিল আমেরিকান নৌবাহিনী ইরানের কয়েকটি তেল সরবরাহ জেটি ও কয়েকটি তেল-ট্যাঙ্কারের ওপর হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয় এবং ইরান ও আমেরিকান নৌবাহিনীর মধ্যে অঘোষিত সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সুযোগে ইরাক তার হারানো এলাকার অংশবিশেষ পুনরুদ্ধার করে এবং নতুন করে কিছু ইরানি এলাকাও দখল করে, তবে দখলকৃত ইরানি এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে না মনে করে সেখান থেকে পশ্চাদপসরণ করে; কেবল যুদ্ধের প্রথম দিকে দখলকৃত এলাকার অংশবিশেষ (২,৫০০ বর্গ কিলোমিটার) ইরাকের দখলে থেকে যায়।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায় যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব না মানলে আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাকের পক্ষে যুদ্ধ নামার ঘোষণা দেবে এবং প্রয়োজন মনে করলে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেÑ তখন পর্যন্ত যার মোকাবিলা করার সামর্থ্য ইরানের ছিল না।
এ যুদ্ধে পরাশক্তিবর্গ সহ বিশে^র প্রায় সকল সরকার ছিল ইরাকের পক্ষে, কেবল সিরিয়া, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়া ব্যতীত উল্লেখ করার মতো কোনো দেশই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষে ছিল না। অধিকন্তু ইরানকে আমেরিকার বয়কট মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। বস্তুত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ মূলত ঈমানের অস্ত্র ও শক্তির বদৌলতে দীর্ঘ প্রায় আট বছর তার পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এমতাবস্থায়ও যুদ্ধ আরো চালিয়ে যাওয়া ইরানের পক্ষে সম্ভব হলেও বিশেষ করে পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকারকতা বিবেচনা করে ইরানি জনগণের ওপর যে দুঃসহ দুঃখকষ্ট চেপে বসার আশঙ্কা ছিল তা বিবেচনা করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ১৯৮৮-র ১৮ই জুলাই নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ইরাকও তা মেনে নেয়। এভাবে প্রায় ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর উভয় পক্ষ পরস্পরের দখলকৃত এলাকা থেকে সরে যায় এবং যুদ্ধবন্দি বিনিময় ঘটে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে দশ লক্ষাধিক লোক হতাহত হয় এবং দুই পক্ষের মোট আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা হয় এক লক্ষ ১৯ হাজার কোটি ডলার। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষে শহীদের সংখ্যা মোটামুটি এক লাখ সত্তর হাজার হিসাব করা হয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদ : অব্যাহত প্রক্রিয়া
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদ কেবল ইরানের ওপর ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধের মোকাবিলা করার মধ্যেই সীমিত ছিলো না; বরং এটি একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বস্তুত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দাম সরকারের আগ্রাসন কেবল ঐ সরকারের আগ্রাসন ছিল না; বরং সেটি ছিল তৎকালীন সকল পরাশক্তি ও তাদের তাঁবেদারদের সম্মিলিত আগ্রাসন; সাদ্দাম সরকার তাদের পক্ষ হতে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়েছিলেন মাত্র। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও অন্য ইরানি নেতৃবৃন্দ আগ্রাসনের শুরু থেকেই এটা ভালোভাবেই জানতেন। তাই শুরু থেকেই তাঁরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে সকল ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সামর্থ্যরে ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগ্রসর হন। তাঁরা জানতেন যে, ইরানের জন্য বিদেশী অস্ত্র আমদানির সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাই তাঁরা দেশে মওজূদ সীমিত অস্ত্রের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্রের খুচরা অংশ উৎপাদন ও মানোন্নয়ন সহ অস্ত্র উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এভাবেই আট বছর যুদ্ধ চালানো হয় এবং যুদ্ধের পরে এ কার্যক্রম একইভাবে অব্যাহত থাকে।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলেও প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে, ইসলামি ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের চিন্তা করে নি। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা প্রতিপক্ষের সাধারণ জনগণকে হত্যা ও শহর ধ্বংস করা সম্ভবÑ যা ইসলামের দৃষ্টিতে অনুমোদিত নয়, কিন্তু তা যুদ্ধে জয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তাছাড়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কখনোই অন্য দেশের ভূখ- দখলের লক্ষ্য পোষণ করে নি। অন্যদিকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সবচেয়ে বড় দুশমন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সম্ভাব্য প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের মুখেও পারমাণবিক অস্ত্র তেমন কার্যকর হতে পারে না। কারণ, এ ধরনের অস্ত্র নির্মাণ করা সম্ভব হলেও আমেরিকার পামাণবিক অস্ত্রের বিশাল ভা-ারের সাথে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, বিশেষত সে অস্ত্র আমেরিকান ভূখ-ে পৌঁছানোর প্রশ্নও আছে। বরং পারমাণবিক প্রকল্পে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিনিয়োগের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করা।
অন্যদিকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পুরো সামরিক পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন সহ বাইরের যে কোনো সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে দেশকে নিরাপদ করা। এ কারণে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার তার সামরিক খাতে প্রতিরক্ষামূলক প্রচলিত সমরাস্ত্র উন্নয়ন ও উৎপাদন, এ কাজে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও অভিনব প্রতিরক্ষা স্ট্রাটেজি গ্রহণÑ এ তিনটি বিষয়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। এর ফলে বিগত বছরগুলোতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যে বিরাট সাফল্যের তথা স্বয়ংসম্পূর্ণতার অধিকারী হয়েছে তার প্রমাণ অতি সাম্প্রতিক কালে বিশ^বাসী দেখতে পেয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আশেপাশে বিভিন্ন দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং ইরানি উপকূলের অদূরে পারস্য উপসাগরে ও ভারত মহাসাগরে রয়েছে আমেরিকার যুদ্ধজাহায। এছাড়া আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের অবস্থানও ইরান থেকে বেশি দূরে নয়। এ পরিস্থিতি সামনে রেখে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশেষভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ও ব্যাপক উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয় যাতে মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হলে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া সম্ভব হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান নিকট পাল্লা, মধ্যম পাল্লা ও দূর পাল্লার বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ও ব্যাপক উৎপাদন করেছে ও করছে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইরানের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩০০ থেকে ২,০০০ কিলোমিটার এবং সাম্প্রতিক কালে যে সুমার ক্রুজ মিসাইলের উন্নয়ন করা হয়েছে তার পাল্লা ২,৫০০ কিলোমিটার। এর মানে হচ্ছে, ইরানের আশেপাশে অবস্থিত আমেরিকার সমস্ত সামরিক ঘাঁটি ও যুদ্ধজাহায এবং গোটা ইসরাঈল, এমনকি দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতাধীন। এছাড়া ইরান গুচ্ছ বোমা নিক্ষেপের জন্য তার শাহাব-৩ ক্ষেপণাস্ত্রে এমন ধরনের পরিবর্তন সাধন করেছে যার ফলে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এক বারে ১,৪০০ বোমা বহন করতে সক্ষম। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ভূগর্ভ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান পাইলটবিহীন ক্ষুদ্র বিমান (ড্রোন) নির্মাণের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। এসব ড্রোনের মধ্যে রয়েছে বিমানবিধ্বংসী কামানবাহী ড্রোন ও ছোট বোমা নিয়ে ৯৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উড্ডয়নে সক্ষম ড্রোন। এছাড়া ইরান সাবমেরিনে বহনক্ষম যুদ্ধজাহায বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানে বহনক্ষম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও নির্মাণ করেছে এবং সাম্প্রতিক কালে এগুলোর সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যে বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ ক্ষেত্রে ইলকট্রনিক প্রযুক্তির মোক্ষম ব্যবহার। ইরান ইতিমধ্যেই ১০০ কিলোমিটার পাল্লার ‘সিরাফ্’ ড্রোন্ নির্মাণ করেছে Ñ যা শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশে থাকা অবস্থায় জ্যামিং-এর মাধ্যমে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করে দিতে সক্ষম হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে পদানত করার লক্ষ্যে দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে গিয়ে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার আশ্রয় নিয়েও ইরানকে নত করতে ব্যর্থ হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চলানোর সম্ভাব্যতা জরীপের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২০শে জুন সমরাস্ত্রের ইতিহাসে অপরাজেয় হিসেবে পরিগণিত বিমান বিধ্বংসী কামানের পাল্লার ঊর্ধ্বে উড্ডয়নক্ষম সর্বাধুনিক ও বিশালায়তন পাইলটবিহীন গ্লোবাল হক বিমান (ড্রোন) প্রেরণ করে এবং এর পিছন পিছন প্রেরণ করে ৩৮ জন সৈন্যবাহী আরেকটি সামরিক বিমান। গ্লোবাল হক বিমানটি হরমূয প্রণালীর কাছে ইরানি আকাশ সীমায় প্রবেশের সাথে সাথে ইরানের একটি ছোট্ট ড্রোন সেটিকে আঘাত করে ভূপাতিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। সেই সাথে ইরানের পক্ষ থেকে আমেরিকার সৈন্যবাহী বিমানটিকে সতর্ক করে ফিরে যেতে বলা হয় এবং সেটি গ্লোবাল হকের পরিণতি লক্ষ্য করে ফিরে যায়।
আমেরিকা তার পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার জন্য প্রথমে গ্লোবাল হক ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা অস্বীকার করে। কিন্তু অচিরেই কার্যত তা স্বীকার করে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি)-র রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু অধিকতর লজ্জাজনক পরাজয় এড়ানোর জন্য তাঁর সামরিক উপদেষ্টাগণ এ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলে তিনি এ আদেশ প্রত্যাহার করেন এবং এর পরিবর্তে আইআরজিসি-র ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাইবার হামলা চালাবার আদেশ দেন, কিন্তু ইরানের সর্বাধুনিক সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এ হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
তবে ইসলামি প্রজতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে অভিনব দিকটি হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ব্যবস্থা। ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কেবল সামরিক ঘাঁটিসমূহে মোতায়েন করে নি। ইরান জানে যে, আমেরিকার মতো পৈশাচিক শক্তি প্রয়োজন মনে করলে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হামলা চালিয়ে ইরানের সকল বড় বড় শহর, সেনানিবাস ও সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাতেও দ্বিধা করবে না। এ কারণে ইরান বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই তার শহর, গ্রাম, পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, বনজঙ্গল ও যুদ্ধজাহাযে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেÑ যার ফলে আমেরিকার পক্ষে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েও ইরানের সকল ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রসংখ্যা কতো?
এ হচ্ছে এমন একটি তথ্য যা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় নি এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে কয়েক বছর আগে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি আলী শামখানী ঘোষণা করেছিলেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আক্রান্ত হলে প্রথম আধ ঘণ্টার মধ্যে আড়াই হাজার ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তার লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানবে। এ থেকেই আঁচ করা চলে যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ক্ষেপণাস্ত্রের দিক থেকে কতোখানি সমৃদ্ধ। তবে ইরানের হাতে যে লক্ষ লক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, যদিও অসমির্থত তথ্য অনুযায়ী এর সংখ্যা এগারো লক্ষের বেশি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ যারীফ্ ২০১৯ সালের পয়লা জুন বলেন, আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার অধিকার ইরানের রয়েছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে ইরান ‘যতো চায়’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে। এ থেকেও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা করা চলে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা বা যায়নবাদী ইসরাঈলের পারমাণবিক হামলার সম্ভাবনা ও তাতে সাফল্যের সম্ভাবনা কতোখানি?
গ্লোবাল হক ভূপাতিত করণ এবং আকাশপথে আগত শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিতকরণ ও তা ধ্বংসকরণে সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ইরানের সক্ষমতার যে পরিচয় আমেরিকা ও ইসরাঈল ইতিমধ্যেই পেয়েছে তাতে ইরানের আকাশ সীমায় শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রবেশ করে পারমাণবিক বা অপারমাণবিক অস্ত্রের হামলা চালাতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। অন্যদিকে ইরান তার যে জবাব দেবে তাতে ইরানের আশেপাশে আমেরিকার যতো সামরিক ঘাঁটি ও যুদ্ধজাহায আছে সেগুলোর এবং যায়নবাদী ইসরাঈলের নিশ্চিহ্ন হওয়া কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র। এটা জানা আছে বলেই পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে আমেরিকা ও ইসরাঈল ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালানো থেকে বিরত রয়েছে এবং তার পরিবর্তে আমেরিকা সর্বাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানি জনগণকে ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেÑ ইসলামি ইরানের লৌহকঠিন ঈমানদীপ্ত জনগণের বিরুদ্ধে যে অপচেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
এ হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদের কেবল একটি দিকের সংক্ষিপ্ত চিত্র মাত্র। এর অন্যান্য দিকের মধ্যে রয়েছে ইরানি জনগণের, বিশেষত যুবসমাজের মধ্যে ইসলামি হুকুমাতের প্রতিরক্ষার জন্য শাহাদাতের চেতনা; বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই বিপ্লবের দুশমন আমেরিকা ও ইসরাঈলের পক্ষ হতে এবং দেশের ভিতরে অবস্থিত মার্কিন এজেন্ট অন্তর্ঘাতকদের পক্ষ হতে রণাঙ্গনের ও সেনানিবাসের বাইরে ইরানের অনেক আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ, সরকারি নেতৃবৃন্দ, বিজ্ঞানী প্রমুখ বেসামরিক ব্যক্তিত্বকে ও সামরিক কর্মকর্তাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা সত্ত্বেও সকল অঙ্গনের মুজাহিদদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহকারে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখা; ইসলামের প্রথম ক্বিবলাহ্ বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে হিযবুল্লাহ্ ও হামাসকে সর্বাত্মক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান; হিযবুল্লাহ্ ও হামাসের কাছে সামরিক সাহায্য পৌঁছানোর একমাত্র রুট সিরিয়াকে আমেরিকার তৈরি করা তথাকথিত আইএস্ (দাা‘এশ্) থেকে মুক্তকরণ এবং আরো অনেক দিক।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদের সকল দিকের ওপর পরিপূর্ণ আলোকপাত করা একটি প্রবন্ধে কোনাভাবেই সম্ভব নয়; এটা করতে গেলে অবশ্যই তা একটি গ্রন্থের রূপ নেবে।