শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে দেশী-বিদেশী মেহমানদের প্রদত্ত সাক্ষাতে রাহবার

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৭, ২০২০ 

ইসরাঈলের বিলুপ্তিই ফিলিস্তিনের প্রকৃত মালিকদের সরকার প্রতিষ্ঠার উপায়
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে উদ্যাপিত ইসলামি ঐক্য সপ্তাহের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দেশী-বিদেশী মেহমানগণ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে প্রদত্ত এক সাক্ষাতে প্রদত্ত ভাষণে ফিলিস্তিনের মুক্তি ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য অধিকার পুনরুদ্ধারের ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ইসরাঈলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার মানেই হচ্ছে ফিলিস্তিনের প্রকৃত মালিকরা তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে সক্ষম হবে।
রাহ্বারের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হলো :
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম
সমস্ত প্রশংসা বিশ^জগতের রব আল্লাহ্র জন্য এবং দরূদ ও সালাম সাইয়্যেদেনা মুহাম্মাদের, তাঁর পবিত্র বংশধরদের, তাঁর নির্বাচিত সহচরদের ও যারা উত্তমভাবে তাঁদের অনুসরণ করেছেন তাঁদের প্রতিÑ শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত।
ইসলামের মহাসম্মানিত নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহ্) ও হযরত ইমাম জা‘ফর সাদিকের (সালামুল্লাহি ‘আলাইহি) মহান জন্মদিবস উপলক্ষে সকলের উদ্দেশে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। এ মহান দিবসের গুরুত্ব হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) যেদিন দুনিয়ায় আগমন করেন ঠিক সেই দিনটির গুরুত্বের সমান, সুতরাং এ দিবসটির এবং এ ধরনের অন্যান্য মহান দিবসের যথাযথ ক্বর্দ করা কর্তব্য।
বস্তুত হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) মহান রাব্বুল্ ‘আলামীনের সৃষ্টিকুলের মধ্যে শীর্ষতম ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠতম মানুষÑ যিনি ইতিহাসের সমস্ত নবী-রাসূলের (‘আ.) ও সমস্ত আউলীয়া’র তুলনায় শ্রেষ্ঠতর এবং সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ইসলামের মহানবী (সা.) শ্রেষ্ঠতম, সমুন্নততম ও মহানতম।
فاق النّبیّین فی خَلق و فی خُلُق
و لم یدانوه فی علم و لا کرم
و کلّهم من رسول الله ملتمس
غرفاً من البحر او رشفاً من الدّی
কবির এ কথা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। রাসূলুল্লাহ্র (সা.) পবিত্র অস্তিত্ব সমগ্র সৃষ্টিজগতের শীর্ষচূড়া এবং সম্ভব অস্তিত্বলোকের শ্রেষ্ঠতম অস্তিত্ব। কোরআন মজীদ নিজেকে ‘নূর’ হিসেবে উল্লেখ করেছে; কোরআন মজীদ স্বীয় যে সব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে তার অন্যতম হচ্ছে ‘নূর’; এরশাদ হয়েছে : قَد جٰاءَکُم مِنَ اللهِ نورٌ وَکِتٰبٌ مُبین
রাসূলুল্লাহ্র (সা.) সম্মানিতা বিবির নিকট থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, তাঁর নিকট রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন : کان خُلقه القرآن অর্থাৎ তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত প্রতীক তথা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)ও ছিলেন নূর।
‘নূর’ (আলো/জ্যোতি) হচ্ছে ঔজ্জ্বল্যের মাধ্যম এবং মানুষের জীবনের মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ছিলেন মানব সমাজের জন্য ঔজ্জ্বল্য ও জীবনের মাধ্যম। এগুলো হচ্ছে এমন বিষয় মানুষ যেগুলোতে ধীরে ধীরে উপনীত হচ্ছে।
‘নূর’ শব্দটির প্রকৃত অর্থেই রাসূলুল্লাহ্র (সা.) পবিত্র অস্তিত্ব নূর। বস্তুত আরব কবি যথার্থই বলেছেন :
ولد الهدیٰ فالکائنات ضیاء
তেমনি তিনি এ-ও যথার্থই বলেছেন :
و فم الزّمان تبسّم و ثناء
আল্লাহ্ করুন, ইসলামি জাহান এমনটিই হোক; রাসূলুল্লাহ্র (সা.) জন্মদিনে ইসলামি জাহানের সকলের ঠোঁটে আনন্দের হাসি ফুটে উঠুক; কারো মধ্যে দুঃখ ও মনঃকষ্ট না থাকুক। কারণ, এ দিনটি আমাদের দিন।
আমি দু’তিনটি বিষয় নোট করেছি; এবার তা পেশ করছি।
একটি বিষয় হচ্ছে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ। আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে এ সপ্তাহটি অর্থাৎ বারোই রাবী‘উল্ আউয়াল্ থেকে যে সপ্তাহ্ তাকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ নামকরণ করেছি। এটি স্রেফ্ একটি নামকরণ নয় এবং একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত আন্দোলনও নয়, বরং এটি অন্তঃকরণ থেকে উৎসারিত একটি ‘আক্বায়েদী ও ঈমানী আন্দোলন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এ নামটির প্রকৃত তাৎপর্যে অর্থাৎ ইসলামি উম্মাহ্র ঐক্যের অপরিহার্যতায় বিশ^াসী। অতীত অভিজ্ঞতায়ও এর প্রমাণ রয়েছে অর্থাৎ এটি বিশেষভাবে কেবল আমাদের যুগের ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ইতিপূর্বে আমাদের যৌবন কালের মহান র্মাজা‘ মরহূম আয়াতুল্লাহ্ বোরুর্জেদীÑতৎকালে যিনি ছিলেন সমগ্র শিয়া দুনিয়ার সর্বজনীন র্মাজা‘Ñইসলামি ঐক্যের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তিনি ইসলামি মাযহাবসমূহের ঘনিষ্ঠতার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন এবং আহ্লে সুন্নাতের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ সহ সারা বিশে^র শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ও তাঁদের সাথে তিনি মত বিনিময় করতেন। বস্তুত এ হচ্ছে একটি ‘আক্বীদাÑ অন্তঃকরণের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত একটি ‘আক্বীদা।
অনেকে ধারণা করেন বা এমনটি ভান করেন যে, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল। না, মোটেই এ রকম নয়। এটি একটি ঈমানী ও অন্তঃকরণ থেকে উৎসারিত আন্দোলন।
অবশ্য ঐক্যের বিভিন্ন স্তর আছে; ইসলামি জাহানের ঐক্যের বিভিন্ন স্তর আছে। এর নিম্নতম স্তর হচ্ছে এই যে, ইসলামি সমাজসমূহ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহ, মুসলিম সরকারগুলো, মুসলিম জাতি-গোষ্ঠীসমূহ ও ইসলামি মাযহাবসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণ করবে না, পরস্পরের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করবে না, পরস্পরকে আঘাত করবে না; এটি হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। তবে এর চেয়ে উচ্চতর স্তর হচ্ছে, ইসলামি জাহান কেবল যে পরস্পরের ওপর আঘাত হানবে না শুধু তা-ই নয়, বরং অভিন্ন দুশমনের বিরুদ্ধে পরস্পর হাত মিলাবে; প্রকৃত ও যথেষ্ট মাত্রায় ঐক্যের পরিচয় দেবে, পরস্পরের প্রতিরক্ষা করবে। এ-ও হচ্ছে এক ধাপ উচ্চতর ঐক্য। তবে এর চেয়েও উচ্চতর ধাপ আছে, তা হচ্ছে, মুসলিম জাতিসমূহ পরস্পরের উন্নয়ন ও বিকাশে সহায্য করবে।
মুসলিম দেশসমূহ জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধনসম্পদ, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে এক পর্যায়ের নয়; এ সব ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে, পরস্পরের সমৃদ্ধিসাধন করতে পারে। যে দেশই এ সব ক্ষেত্রের মধ্যে যে ক্ষেত্রে উচ্চতর স্তরে রয়েছে সে দেশই যে সব দেশ সে ক্ষেত্রে নিচের স্তরে রয়েছে সে দেশকে সাহায্য করতে পারে।
এ-ও হচ্ছে ঐক্যের একটি পর্যায়। এর চেয়ে উচ্চতর পর্যায় হচ্ছে এই যে, একটি নতুন ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইসলামি জাহানের সকলেই ঐক্যবদ্ধ হবে। আর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এটাকেই স্বীয় চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। নতুন ইসলামি সভ্যতার মানে হচ্ছে, মুসলিম জাতিসমূহ বর্তমান যুগের উপযোগী একটি নতুন ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণ করবে।
এগুলোই হচ্ছে ইসলামি ঐক্যের বিভিন্ন স্তর।
হ্যা, এবার আপনারা লক্ষ্য করুন, এ ঐক্যের নিম্নতম স্তর কী? তা হচ্ছে, মুসলিম দেশসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন ও হামলা করবে না এবং অভিন্ন দুশমনের বিরুদ্ধে পরস্পরের পাশে দাঁড়াবে। আজকের দিনে আমরা যদি এটি মেনে চলতাম তাহলে ইসলামি জাহানে এতো সব বিপদ-মুসিবতের অস্তিত্ব থাকত না।
ফিলিস্তিন সমস্যা হচ্ছে ইসলামি জাহানের সবচেয়ে বড় বিপদ, কারণ, এখানে একটি জাতিকে তাদের বাড়িঘর ও স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তাদের জায়গায় অন্য লোকদেরকে নিয়ে এসে বসতি করিয়ে দিয়েছে ও শাসকে পরিণত করেছে এবং আসল মালিকদেরকে চাপের মধ্যে রেখেছে। লক্ষ্য করুন, গাযা’র এই পরিস্থিতি ও যায়নবাদীদের পৈশাচিক অপরাধসমূহ, অন্যদিকে সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ-ের ও পশ্চিম তীরের অবস্থা; এটি ইসলামি জাহানের জন্য ন্যূনতম এ নিম্নতম স্তরের ঐক্যের ও তার আন্তরিক অনুসরণের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেÑ যা থাকলে এ অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটত না। এ ঐক্য থাকলে দুশমন কখনোই এ কাজ করতে সাহসী হতো না।
আপনারা লক্ষ্য করে দেখুন, ইসলামি জাহানে কী সব অবাঞ্ছিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে; ইয়েমেনের ঘটনা, পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের ঘটনাবলিÑ এ সব কিছুই কেবল এ কারণে সংঘটিত হয়েছে ও হচ্ছে যে, ইসলাম আমাদের নিজেদের মধ্যে যে ন্যূনতম মাত্রার ঐক্য দাবি করছে আমরা তার প্রতি দৃষ্টি দেই নি।
এটি আমাদের একটি গুরু দায়িত্ব। আমরা শীর্ষস্থানীয় সমুজ্জ্বল চিন্তাশক্তির অধিকারীদের সামনে বিষয়টি পেশ করছি। আল্লাহ্ তা‘আলার শুকরিয়া যে, বর্তমানে ইসলামি জাহানে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যাঁরা চিন্তাশীল, তাঁরা দৃঢ়তার সাথে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার চেষ্টা করছেন। মুসিলম জাতিসমূহ, বিশেষত যুব সমাজ এ বিষয়ে খুবই আগ্রহী। কিন্তু এর পাশাপাশি অনৈক্য সৃষ্টিকারী লোকও রয়েছেÑ যাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
আজকের ইসলামি জাহানে উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত মুসলমানরা চাপের মধ্যে রয়েছে; ইসলামি জাহানের পূর্বাংশে ও পশ্চিমাংশে মুসলমানরা চাপের মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে আমি কয়েকটি কথা আরয করতে চাই।
ফিলিস্তিনের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান একটি মূলনীতিগত অবস্থানÑ একটি অকাট্য ও সুদৃঢ় নীতিগত অবস্থান। ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের অনেক আগেইÑ বৈপ্লবিক আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের মহান ইমাম যায়নবাদের প্রভাব, যায়নবাদের হস্তক্ষেপ ও যায়নবাদের যুলুম সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বক্তব্য রাখেন; ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর শুরু থেকেই আমরা এ অবস্থান গ্রহণ করেছি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বপ্রথম যে কাজটি করে তা ছিল, পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর শাসনামলে তেহরানে যায়নবাদীদের যে কেন্দ্র ছিল তা তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়, তাদেরকে বের করে দেয় এবং সেটি ফিলিস্তিনীদেরকে প্রদান করে; এটি ছিল একটি বাস্তব ও দৃষ্টিগ্রাহ্য মৌলিক পদক্ষেপ এবং আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের এ অবস্থানের ওপর অটল আছি।
আমরা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছি ও ফিলিস্তিনীদেরকে সাহায্য করে আসছি; আমরা তাদেরকে আরো সাহায্য করে যাব; এ ব্যাপারে আমরা অন্য কোনো বিষয়ই বিবেচনা করব না এবং কখনোই আমরা এ থেকে সরে দাঁড়াব না। সমগ্র ইসলামি জাহানেরও উচিত ফিলিস্তিনকে সাহায্য করা।
মরহূম হযরত ইমাম (রেয্ওয়ানুল্লাহে তা‘আলা ‘আলাইহি)-এর বক্তব্য-বিবৃতিসমূহে ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্য-বিবৃতিসমূহে বার বার ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিলুপ্তির ওপরে জোর দেয়া হয়েছে। দুশমনরা এর কদর্থ করেছে। কিন্তু ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি মানে ইয়াহূদীদের নিশ্চিহ্নকরণ নয়; তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনোই কথা নেই। আমরা চাই ঐ সরকারের বিলুপ্তিÑ যায়নবাদী সরকারের বিলুপ্তি। ‘ইসরাইলের বিলুপ্তি’ মানে ফিলিস্তিনী জনগণÑযারা ঐ ভূখ-ের প্রকৃত মালিক, তা তারা মুসলমানই হোক, বা খৃস্টানই হোক, বা ইয়াহূদীই হোকÑঐ ভূখ-ের প্রকৃত মালিকরা তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করবে এবং নেতানিয়াহু ও তার মতো অন্যান্য বিজাতীয় ও হীন-নীচ লোকদেরকেÑযারা প্রকৃতই হীন-নীচÑনিজেদের মধ্য থেকে উচ্ছেদ করবে, বের করে দেবে, আর নিজেদের দেশকে নিজেরাই পরিচালনা করবে; এটাই ‘ইসরাঈলের বিলুপ্তি’র তাৎপর্য এবং এটি অবশ্যই ঘটবে।
কেউ কেউ এটি অসম্ভব মনে করেন যে, কীভাবে সত্তর বছর পর ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। কিন্তু বলকান রাষ্ট্রগুলো ও আরো কতক দেশ অন্যদের দখলে যাবার ষাট বছর ও সত্তর বছর পর স্বাধীন হয়েছে এবং স্ব স্ব জাতির কাছে ফিরে এসেছে। এটি মোটেই দূরে নয়। وَ ما ذٰلِکَ عَلَی اللهِ بِعَزیز এ ঘটনা সংঘটিত হবেই।
আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের সমর্থক, আমরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সমর্থক, আমরা ফিলিস্তিনের মুক্তির সমর্থক। আমরা ইয়াহূদী বিতাড়ক নই; আমাদের নিজেদের দেশেও বহু ইয়াহূদী আছেনÑ যাঁরা পরিপূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে এখানে জীবনযাপন করছেন।
এই হলো একটি বিষয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে, আমরা ঐক্য চাই এবং ঐক্যের জন্য আন্তরিকভাবে আগ্রহী। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ চিন্তা, এ কামনা ও এ লক্ষ্যের বিরোধী পৈশাচিক ঘাতক দুশমন গোষ্ঠীও রয়েছে; বর্তমান যুগে এখন এ দুশমনদের শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও যায়নবাদী কৃত্রিম সরকার। এরা ইসলামি ঐক্যের দুশমন।
আমেরিকা কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দুশমন নয়। কতক লোক মনে করে যে, কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও আমেরিকার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ চলছে; হ্যা, যেহেতু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সক্রিয় রয়েছে সেহেতু তার বিরুদ্ধেই বেশি শত্রুতা করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে তারা ইসলামি জাহানের এবং মুসলিম দেশসমূহের দুশমন, তারা ফিলিস্তিনের দুশমন, পশ্চিম এশিয়ার জাতিসমূহের দুশমন, উত্তর আফ্রিকার জাতিসমূহের দুশমন, তারা সমস্ত মুসলমানের দুশমন। আর এর কারণ হচ্ছে ইসলামের প্রকৃতি। যেহেতু ইসলাম যুলুমের বিরোধী, আধিপত্যবাদের বিরোধী, বলদর্পিতার বিরোধী, সেহেতু আধিপত্যবাদী শক্তিবলয়Ñবর্তমানে যার শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা এবং এক সময় যার শীর্ষে ছিল ব্রিটেন বা অন্যরাÑইসলামের যুক্তির, ইসলামের প্রকৃতির ও ইসলামের তাৎপর্যের বিরোধী। অবশ্য তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বেশি বিরোধী। এরা সউদীদেরও বিরোধী। কেউ কেউ মনে করে যে, আমেরিকানরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দুশমন এবং সউদীদের বন্ধু; না, আমেরিকা তাদেরও দুশমন। তারা যে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে, সউদীদের অর্থ ছাড়া আর কিছুই নেইÑ এটা কি দুশমনী নয়? এ কথার অর্থ কী? এর মানে হচ্ছে এই : ‘যেহেতু তাদের অর্থ আছে সেহেতু যাব, তাদের অর্থ লুটে নেব।’ একটি দেশের বিরুদ্ধে, একটি জাতির বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় দুশমনী আর কিছু হতে পারে কি?
বেশ, তাঁরা বুঝুন; তাঁরা দুশমনীটা বুঝুন; তাঁরা বুঝুন এ দুশমনীর মোকাবিলায় একজন আত্মমর্যাদার অধিকারী মানুষের দায়িত্ব কী; এ ধরনের অবমাননার মোকাবিলায় ইসলামি আত্মমর্যাদা, ইসলামি ইজ্জত, আরব ইজ্জত্ কী দাবি করে? তাঁরা তাঁদের নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য বুঝুন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আসলে আমেরিকানরা সকলেরই দুশমন।
এতদঞ্চলে আমেরিকার উপস্থিতি দুর্বৃত্তপনা করা ও দুর্নীতি-পাপাচার বিস্তার করা ব্যতীত অন্য কোনো ধরনের প্রভাবই বিস্তার করে নি। তারা এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং তাদের নিজেদের সাথে করে দুর্বৃত্তপনা, দুর্নীতি ও পাপাচার নিয়ে এসেছে। তারা যেখানেই পা রাখে সেখানেই নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয় বা গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায় অথবা তারা দা‘এশ্ (আইএসআইএস) ও এ ধরনের কিছু তৈরি করে।
আমরা চাই যে, আমেরিকার প্রকৃত চেহারা দেখা যাক; মুসলিম জাতিসমূহ বুঝুক আমেরিকার প্রকৃত চেহারা কী এবং তারা কারা, তারা যে বাহ্যত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সমর্থক হবার দাবি করে এবং এ ধরনের আরো অনেক মিথ্যা ও মুনাফেক্বী কথা বলে, তার অন্তরালে কী রয়েছেÑ লোকদের এ সম্পর্কে জানা উচিত।
আমাদের দৃষ্টিতে এ অঞ্চলে আমেরিকার আসল অস্ত্রÑআমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে যে অস্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক আছিÑতা হচ্ছে অনুপ্রবেশÑ সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেন্দ্রসমূহে অনুপ্রবেশÑ এবং এর মাধ্যমে জাতিসমূহের জাতীয় দৃঢ়তাকে নড়বড়ে করে দেয়া। তারা জাতিসমূহের পরস্পরের মধ্যে এবং জাতিসমূহের ও তাদের সরকারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের হিসাব-নিকাশের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে এবং ভান করে যে, তারাই সকল সমস্যার সমাধানকারী, সুতরাং আমেরিকার পতাকাতলে আশ্রয় নাও, আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ কর এবং আমেরিকার কথা মেনে নাও, আমেরিকা যা-ই বলে তা-ই শোনোÑ মেনে নাও, কার্যকরী কর। তারা মুসলিম জাতিসমূহের ও মুসলিম দেশসমূহের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মন-মগযে এগুলো প্রবেশ করাতে চায়। এগুলো হচ্ছে তাদের অস্ত্রÑ যা শক্ত অস্ত্র ও সমরাস্ত্রের তুলনায় অধিকতর বিপজ্জনক।
বাস্তবিকই লোকেরা তাদের কাজের মধ্যে যা দেখতে পায় তা হচ্ছে সেই নেফাক্বÑ কোরআন মজীদে যে সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
كَيْفَ وَإِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلا وَلا ذِمَّةً يُرْضُونَكُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ
এদের অবস্থা এমনইÑ আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের বৈশিষ্ট্য যেরূপ বর্ণনা করেছেন।
এরপর যা আরয করতে চাই তা হচ্ছে, এ দুশমনীর চিকিৎসা মাত্র একটিই, তার চেয়ে বেশি নয়। তা হচ্ছে : فَاستَقِم کـَما اُمِرتَ ; রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্যাবলির মোকাবিলায় তাঁর রাসূলকে (সা.) এরশাদ করেন : فَاستَقِم کـَما اُمِرتَ وَ مَن تابَ مَعَک অর্থাৎ দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে।
অবশ্য রুখে দাঁড়ানো খুবই কষ্টের ও কঠিন কাজ; এমন নয় যে, এটি খুবই সহজ কাজ। কিন্তু আত্মসমর্পণের পরিণামে তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট, কঠিনতা ও দুর্দশা অপেক্ষা করে। এ দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য এই যে, আপনারা দৃঢ়তা, রুখে দাঁড়ানো ও প্রতিরোধের পথে যে কোনো কষ্ট ও কঠিনতার শিকার হোন না কেন, তার বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাদেরকে পুরষ্কার দেবেন; এরশাদ হয়েছে :
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلا نَصَبٌ وَلا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلا إِلا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ
বস্তুত এ পথে আপনাদের ওপর যে কোনো কষ্ট ও কঠিনতাই আপতিত হোক না কেন, তা-ই একেকটি নেক আমল। অথচ আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে আপনাদের ওপর যে কোনো কষ্ট ও কঠিনতাই আপতিত হোক তার বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট কোনোই পুরষ্কার নেই, বরং যুলুমের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে; কোরআন মজীদ এমনই বলেছে যে, না যুলুম করবেন, না যুলুম সহ্য করবেন।
সবশেষে যে বিষয়টি আরয করতে চাই তা হচ্ছে আমলে সালেহ্ বা নেক আমল সম্পর্কে, যেমনটি আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন : كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ
আমি আরয করতে চাই যে, আজকের বিশে^ দেশসমূহের ও জাতিসমূহের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সপক্ষে যে কোনো আন্দোলনই করা হোক, যে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হোক, যে কোনো কথাই বলা হোক, তা দেশসমূহের ও জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে হওয়া উচিত, দেশসমূহের ও জাতিসমূহের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও বিকাশের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ঐক্যের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ইসলামি উম্মাহ্র শক্তিমত্তা অর্জনের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ইসলামি জাহানে বিজ্ঞানের প্রচলনের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ইসলামি জাহানের যুব শক্তির বিকাশের লক্ষ্যে হওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে যে কোনো তৎপরতাই চালানো হোক না কেন তা-ই নেক আমল, তাই উত্তম কাজ।
আপনারা যদি বিজ্ঞানের অঙ্গনে কাজ করেন, গবেষণার ক্ষেত্রে কাজ করেন, পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে কাজ করেন তো তার সবই নেক আমল।
পারমাণবিক শক্তি জাতিসমূহের প্রয়োজনীয় বিষয়। কারণ, এ বিশে^র ভবিষ্যতের জন্যÑ সকল জাতির ভবিষ্যতের জন্য শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অপরিহার্য প্রয়োজন। কিন্তু পাশ্চাত্যের একচেটিয়াবাদীরা চায় যে, এটি কেবল তাদের নিজেদের হাতে রেখে দেবে এবং অন্যান্য জাতিকে তারা সে সব জাতির মর্যাদার বিনিময়ে, তাদের স্বাধীনতার বিনিময়ে তা এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে দান করবে। তারা যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক তৎপরতার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করছে তা কেবল এ কারণেই, নচেৎ তারা নিজেরাও জানে যে, আমরা আমাদের মৌলিক নীতিগত, দ্বীনী ও ‘আক্বায়েদী কারণে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিরোধী এবং এ অস্ত্রের বিরোধী। তারা চায় যে, জাতিসমূহ পারমাণবিক বিজ্ঞানের, এ শিল্পের, এ সক্ষমতার অধিকারী না হোক; আমাদের বেলায়ও এমনটিই, অন্যদের বেলায়ও এমনটিই। তারা বলে : আমাদের কাছ থেকে কিনে নাও; তোমরা নিজেরা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করো না।
কিন্তু এ শক্তি অর্জনের লক্ষ্যে যে কোনো তৎপরতা চালানো হোক তা নেক আমল, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তৎপরতা চালানো হোক তা-ও নেক আমল; জনগণকে সাহায্য করার লক্ষ্যে, দুর্বল করে রাখা লোকদেরকে সাহায্য করার লক্ষ্যে, দরিদ্রদেরকে সাহায্য করার লক্ষ্যে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক তা-ও নেক আমল। সত্য ও প্রকৃত বিষয়াদি ও ঘটনাবলি প্রচারের লক্ষ্যে এবং কল্পিত ও মিথ্যা ধারণা-কল্পনাসমূহের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে যে কোনো তৎপরতা চালানো হোক তা-ও নেক আমল।
আপনারা ইসলামি জাহানের সমুজ্জ্বল চিন্তার অধিকারী বুদ্ধিজীবিগণ এবং ইসলামি জাহানের ওলামায়ে কেরামÑ আল্লাহ্ তা‘আলার শুকরিয়া যে, আপনাদের মধ্যকার কিছু সংখ্যক ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ উপলক্ষে মেহমান হিসেবে এখানে সমুপস্থিত আছেন এবং ইসলামি জাহানের আরো অনেকে এখানে সমুপস্থিত আছেন; আপনাদের মধ্যে অনেকে আছেন সমুজ্জ্বল চিন্তার অধিকারী, আপনাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা দ্বীনী আলেমÑ আপনার দেখতে পাচ্ছেন যে, আজ আপনাদের সামনে নেক আমলের জন্য কতো বড় একটি ক্ষেত্র! আপনারা চাইলে কতো নেক আমল আঞ্জাম দিতে পারেন! আপনার কলম চালান, সত্যের প্রতিরক্ষা করুন, নিজেদের বক্ষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করুন, দুশমনদেরকে ভয় পাবেন না। কারণ,
الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلا اللَّهَ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا
বস্তুত এ কাজের হিসাব-নিকাশ আল্লাহ্র হাতে; আল্লাহ্ই এর হিসাব-নিকাশ করবেন, তিনিই আপনাদেরকে পুরস্কার প্রদান করবেন।
আমি আপনাদের খেদমতে আরয করতে চাই যে, আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে ইসলামি জাহান একদিনÑযেদিন খুব বেশি দূরেও নয়Ñআল্লাহ্ তা‘আলারই অনুগ্রহ ও শক্তির বদৌলতে এ আশা-আকাক্সক্ষাসমূহের বাস্তব রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করবে।
ওয়াস্-সালামু ‘আলাইকুম্ ওয়া রাহ্মাতুল্লাহ্ িওয়া বারাকাতুহ্।
ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী