মঙ্গলবার, ৪ঠা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরান পরিচিতি: কারাজ

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৯, ২০১৬ 

-কামাল মাহমুদ
ইরানের আলবোর্য প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর কারাজ। যার পরিধি ৮৫৮ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্র উপকূল থেকে এর উচ্চতা ১৩১২ মিটার (৪৩০৪ ফুট)। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ১.৯৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইরানের ৪র্থ জনবহুল শহর। তেহরান, মাশহাদ এবং ইসফাহানের পরেই কারাজের অবস্থান। তেহরান থেকে এর দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল)। কারাজ স্কয়ারকে ঘিরেই মূলত কারাজ শহর অবস্থিত। এটি কারাজ সমুদ্র ও কারাজ ব্রীজ থেকে ১০০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত।
কারাজের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মতামত রয়েছে। কথিত আছে যে, কারাজ নামের একটি বিখ্যাত হ্রদের নাম অনুসারে কারাজের নামকরণ করা হয়েছে।
সাফাভী শাসনামলে এর উন্নতি ঘটতে থাকে এবং কাচার আমলে এর আরো অগ্রগতি হয়। সে সময় এ শহর মূলত গ্রীষ্মকালীন রিসোর্ট হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। বর্তমানকালে এটি শিল্প নগরী হিসেবে খ্যাত। যেখানে চিনি, টেক্সটাইল, ক্যাবল, কোমল পানীয় প্রভৃতি তৈরি হয়।
কারাজের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। ২০ শতক পর্যন্ত কারাজ স্টোন ব্রিজের জন্য বিখ্যাত ছিল। সাফাভী আমলে এটি নির্মিত হয়েছিল। এটি শহরের দক্ষিণ দিকে তাওহীদ স্কয়ারের কাছে অবস্থিত। ১৮১০ সালে কেরমান শাহের পুত্র শাহজাদা সোলায়মান (সোলায়মান মির্জা) এখানে গ্রীষ্মকালীন রিসোর্ট নির্মাণ করেন। বর্তমানে এ রিসোর্ট তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
আবহাওয়া : কারাজের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৬০ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট), গড় তাপমাত্রা ২১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭০.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট), গড় নি¤œ তাপমাত্রা ৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট), রেকর্ড নি¤œ তাপমাত্রা -১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এখানে আমীর কবিরদাম সহ বেশ কয়েকটি লেক রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য স্থান : কারাজের উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে রয়েছে মোরওয়ারিদ প্যালেস। পাহলভী আমলে রেযা শাহ পাহলভীর বড় বোন শামস পাহলভী এটি নির্মাণ করেন। এর ডিজাইন করেন ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট ফাউন্ডেশন। এখানকার অধিকাংশ স্থাপনা দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে বাসিজ অর্গানাইজেশন। মোরওয়ারিদ প্যালেসের কিছু অংশ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে যা পরিচালনা করছে কালচারাল হেরিটেজ অর্গানাইজেশন অব ইরান। অপরাপর দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে শাহজাদা সোলায়মান মিউজিয়াম, ইমামযাদে মিউজিয়াম, রহমান মিউজিয়াম, ইমাম যাদে জিয়াদ মিউজিয়াম প্রভৃতি। কারাজের বিখ্যাত এলাকার মধ্যে রয়েছে হেসারক, গোওহারদাস্ত, শাহরাক এ আজমীর, গারম দারে, গোলশার ভিলা, মেহেরসার, শাহরাক এ জাহান সার, যিবা দাস্ত, যোবে অহান, মেহের ভিলা, দেহকান ভিলা, মাহদাস্ত, শাহরাক এ বানাফশে, মোহামআদ শহর, ফারদীস, মেহদী আবাদ, মিয়ান যাদে, বাকেস্তান, এসলামাবাদ, হায়দারাবাদ, দৌলাতাবাদ প্রভৃতি। শহরের প্রবেশ পথ হচ্ছে আলবোর্য পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ এবং শেষ সীমানা কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত।
বিনোদন কেন্দ্রের মধ্যে পার্ক এ যানভাদে, টেনিস পার্ক, পার্কে মাদার, তালেকান গার্ডেন, কোরদান গার্ডেন, জাহানসার গার্ডেন, পারদেশ এ গোলহা, গাকসারের টিউলিপ গার্ডেন প্রভৃতি।
ভাষা : মোট জনসংখ্যার ৬১% ফারসি, ৩৪% আজারবাইজানি, ৭% কুর্দি, ৫% মাজেন্দারানি, ৪% লোর ও অন্যান্য ভাষাভাষি। তবে সবাই ফারসি ভাষায় কথা বলে।
যাতায়াত : তেহরান থেকে ৪০ কিলোমিটার ও কাজভীন থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কারাজে রয়েছে সড়ক, রেল ও আকাশ পথ। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় পাতাল রেলও রয়েছে। কারাজে ১৯৯০ সালে নগর রেল এর কাজ আরম্ভ হয় এবং ২০০১ সালে তা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এটি কারাজের দক্ষিণে এবং কাজভীন ফ্রি ওয়ের নিকটেই অবস্থিত। সড়ক পথে তেহরান-কারাজ হাইওয়ে, স্পেশাল রোড এবং তেহরানের প্রাচীন রাস্তা (ফাতেহ হাইওয়ে) প্রসিদ্ধ। বাকেরী এক্সপ্রেস ওয়ে কারাজের উত্তর থেকে দক্ষিণ হয়ে তেহরান পর্যন্ত একটি প্রসিদ্ধ সড়ক রুট। যা তেহরান ও কারাজকে যুক্ত করেছে। আকাশ পথে যাতায়াতের জন্য ১৯৯০ সালে নির্মিত পায়াম ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ১৯৯৭ সালে চালু হয় এবং এ পথে যাত্রী বহন ও মালামাল আমদানি-রপ্তানি করা হয়।
শিল্প : অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কারাজ তেহরানের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। তেহরান ও কাস্পিয়ান সাগরের রুট হিসেবেও কারাজ ব্যবহৃত হয়। কেমিক্যাল, সার, কৃষিপণ্য কারাজে তৈরি হয়। অধুনা তেহরান থেকে অনেক ব্যবসায়ী কারাজে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছেন ও আবাস গড়ে তুলেছেন। এখানকার ব্যবসায় পরিবেশ বেশ উন্নত, জীবন যাপন সহজ এবং শ্রমিকও সহজলভ্য। শাহরাক ও জাহানসার কারাজের মূল শিল্প এলাকা। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে এখানে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। ১৯৬০ সালের দিকে তা আরো বেগবান হয়। এখানে রয়েছে টেক্সটাইল মিল, তেল কারখানা, চা প্রক্রিয়াজাতকরণ মিল ও কোল্ড স্টোরেজ। ইরানের শিল্প খাতের জাতীয় আয়ের ২০% কারাজ থেকে আসে। এখানে ৩৬০০ হেক্টর জুড়ে রয়েছে ‘স্পেশাল ইকোনোমিক জোন’। যা পায়াম ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের নিকটেই অবস্থিত। এখানকার ‘স্পেশাল ইকোনোমিক জোন’ এ রয়েছে নিজস্ব এয়ার লাইন ও কার্গো বিমান ব্যবস্থা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কারাজ আযাদ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়, পায়ামে নূর বিশ্ববিদ্যালয় কারাজ, খারাজমি বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ফ্যাকাল্টি, তেহরান চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ও নগর পরিকল্পনা অনুষদ, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদ অনুষদ, সেন্টার ফর রিসার্চ এগ্রিকালচার অ্যান্ড নিউক্লিয়ার মেডিসিন, আলবোর্য হাইস্কুল ও কলেজ প্রভৃতি।
খেলাধুলা : কারাজের ফুটবল দলসমূহের খেলা ইরান জুড়ে বিখ্যাত। ক্লাবগুলোর মধ্যে সাইপা এফসি খুবই জনপ্রিয়। খেলাধুলার জন্য রয়েছে এনক্বেলাব স্টেডিয়াম যেখানে ১৫০০০ দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা উপভোগ করতে পারে। শাহরাক ও জাহানসারে রয়েছে টেনিস কোর্ট। স্কেটিং ও রাইডিং এর জন্য রয়েছে ডিজিন রিসোর্ট যা আলবোর্য পর্বতের কাছেই অবস্থিত। এখানে সাইক্লিং এর কয়েকটি দল রয়েছে। ব্যায়ামের জন্য রয়েছে অনেকগুলো জিমনেসিয়াম ।