শনিবার, ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরান পরিচিতি : আহওয়াজ

পোস্ট হয়েছে: জুন ৮, ২০১৬ 

-এডভোকেট কামাল মাহমুদ
আহওয়াজ দক্ষিণ ইরানের একটি প্রাচীন শহর। এখানে প্রায় ২,৪৩২,৯৬৫ পরিবার বসবাস করে। এ শহর অতীতকাল থেকে বাণিজ্যিক শহর হিসেবে পরিচিত। একই কারণে এখানে বায়ু দূষণও রয়েছে। আহওয়াজ কারুন নদীর তীরে খুজেস্তান প্রদেশে অবস্থিত। এটি খুজেস্তানের সবচেয়ে জনবহুল শহর এবং এর রাজধানী শহরের মর্যাদায় অভিষিক্ত।
উৎপত্তি : اهواز ফারসি শব্দ; দেহ্খোদা অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে ‘সাওক আল-আহওয়াজ’ যার অর্থ আহওয়াজের বাজার বা খুজিস বাজার। এখানে সাওক বলতে বিশ্ববাজার বুঝানো হয়েছে। اهواز বহুবচন, এর একবচন হচ্ছে ‘হাওজ’। অনেক অভিধানে এর অর্থ হিসেবে ‘হুজির জনগণ’ বা ‘হুজিদের ভূমি’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রাচীন ফারসিতে একে বলা হতো ঝঁং (সুস) বা ঝঁংরহধ (সুসিনা) যা ইলামী ভাষায় তাদের ধর্মকে বুঝানো হতো। পরবর্তীকালে এর ঝঁং (সুস) এর আদ্যক্ষর ঝ কে ঐ এ রূপান্তর করে ঐঁং (হুজ) নামে ডাকা হতো এবং এ নামই পরবর্তীকালে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে । অন্যমতে আভাজ, আভাজা শব্দের অপভ্রংশ রূপ হচ্ছে আহওয়াজ। দারিয়ুশের সময়কালে এ অঞ্চলের নাম ছিল আভাজ। যা নাকশে রুস্তমে অংকিত আছে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন এটি ছিল প্রাচীন তারীয়ানা (ঞধৎুধহধ) শহর এর পার্শ্বে অবস্থিত যেটি ছিল হাখামানেশী সা¤্রাজ্যের একটি আদর্শ শহর। যেখানে গ্রীস সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছিল। অহুর মাজদা আরদেশীর খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ সালে এ শহরের গোড়াপত্তন করেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইরানিকা-আল মুকাদ্দেসী) আহুর মাজদা এ শহরের নামকরণ করেন যা হুমসার (ঐঁসংধৎ) নামে পরিচিত ছিল। সাসানি সময়কালে প্রচুর খাল-নদী-নালা খনন ও পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। যেমন- বান্দে বালা রুদ, বান্দে মিজান, বান্দে র্বোজ্ আয়ার, বান্দে খাক্ প্রভৃতি। হুমসারকে পরবর্তীকালে সুসা নামে ডাকা হতো যা সাসানি রাজধানী হিসেবে পরিগণিত ছিল, তারও পরে সুসা থেকে সুস্তার নামকরণ করা হয়। এখানকার কারুন নদীকে কেন্দ্র গড়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। কাজার সা¤্রাজ্যকালে নাসির উদ্দিন শাহ কাজার এ শহরের নামকরণ করেন নাসেরী।
উনিশ শতকে এ শহরের প্রসার ঘটতে থাকে। প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ পরিবার এখানে বসবাস করতে আরম্ভ করে। ১৮৮০ সালে কারুন নদীর তীর পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারিত হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি অধিকতর ত্বরান্বিত হয়। কারুন নদী ব্যবসায়ের লিংক হিসেবে কাজ করে। সুয়েজ খাল খননের পরে এটির পরিসর আরো বাড়তে থাকে। আহওয়াজের পাশে নদী বন্দর গড়ে ওঠে এবং নাসির উদ্দিন শাহ কাজারের সম্মানার্থে এর নামকরণ করা হয় বন্দরে নাসিরী। বিংশ শতকে আহওয়াজে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এর পর থেকে এ শহর নতুন রূপলাভ করে। ১৮৭৯-১৯২৫ পর্যন্ত এ শহরের শাসনকর্তা ছিলেন হাশমাতুদ দৌলা কাচার। তাঁর সময়ে শহরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। যিনি ছিলেন গভর্নর শারহাঙ্গ রেজা গোলী খান আরগুন এর সেনাপতি। পরবর্তীকালে কাজল খান বা শেখ কাজল, সরদার আসাদ বখতিয়ারী, আমীর মোজাহেদী বখতিয়ারী প্রমুখ এ অঞ্চল শাসন করেন।
পাহলভী শাসনকালে নেসারী থেকে এ শহর আবার তার পুরোনো নাম আহওয়াজ ফিরে পায়। ১৯২৯ সালে ট্রান্স ইন্ডিয়ান রেল লাইন কারুন নদীর তীর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীকালে এখানে আরবসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বণিকরা এসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাস করতে আরম্ভ করে এবং নগরীর পরিসর বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। ১৯৮০ সালে ইরাকের তৎকালীন স্বৈরাচারী সাদ্দাম সরকার আহওয়াজে আক্রমণ করে এবং ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮ইং) সংঘটিত হয়। ১৯৮৯ সালে ফুলাদ আহওয়াজ স্টীল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং বাণিজ্যের আরো সম্প্রসারণ ঘটে। এ কোম্পানি ইরানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খেলায় প্রধান স্পন্সর হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে।
অবস্থান : আহওয়াজ আবাদান থেকে ১০০ কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। আহওয়াজ দু’ভাগে বিভক্ত। নতুন আহওয়াজ হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম, ইন্ডাষ্ট্রি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। অন্যদিকে পুরাতন আহওয়াজ হচ্ছে মূলত: আবাসিক এলাকা।
আবহাওয়া : আহওয়াজের আবহাওয়া সাধারণত শুষ্ক। এখানকার আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে প্রচ- উষ্ণ যা বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ শহর হিসেবে পরিগণিত। বিশেষত জুলাই-আগস্ট মাসে এর তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। আর শীতকালে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। তবে ইরানের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে বরফ পড়তে দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালে এখানে প্রায়শই ধুলাঝড় হয়। এখানকার বার্ষিক বৃষ্টিপাত গড়ে ২৩০ মিমি।
যাতায়াত : আহওয়াজে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম রেলপথ ও সড়ক পথ। এখানকার রেলব্যবস্থা খুবই উন্নত ও কার্যকরী। এছাড়া মেট্রোরেল ও বিমান পথও রয়েছে। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। যেখান থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল করে। বিমানসমূহের মধ্যে রয়েছে ইরান এয়ার, কাস্পিয়ান এয়ারলাইন্স, মাহান এয়ার লাইন্স, এয়ার র্টুস ইরান, অসেমান এয়ারলাইন্স প্রভৃতি। দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য অনেক দেশের বিমান এখানে ওঠানামা করে থাকে। সড়ক পথে তেহরান থেকে ১০ ঘণ্টার দূরত্ব। এখানে অনেকগুলো বাসরুট রয়েছে। যেমন আহওয়াজ-তেহরান, আহওয়াজ-ইসফাহান, আহওয়াজ-শিরাজ, আহওয়াজ-মাশহাদ, আহওয়াজ-র্খোরামাবাদ প্রভৃতি। ৪টি প্রধান বাস টার্মিনাল রয়েছে আহওয়াজে। এছাড়া শহরে চলাচলের জন্য ২৪ ঘণ্টা ট্যাক্সি তো রয়েছেই।
খেলাধুলা : এখানে দুটি বিশাল সরকারি ক্রীড়া কমপ্লেক্স রয়েছে। একটির নাম তাকী স্টেডিয়াম অপরটির নাম গাদীর স্টেডিয়াম। এছাড়া একটি প্রাইভেট স্টেডিয়াম রয়েছে যার নাম ফুলাদ এফসি স্টেডিয়াম। যা ফুলাদ স্টীল কোম্পানির উদ্যোগে নির্মিত। এছাড়া খেলাধুলার জন্য ছোট ছোট ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম তো রয়েছেই। এখানকার প্রধান খেলা ফুটবল। বিখ্যাত ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুলাদ এফসি, ইস্তেকলাল এফসি, খুজেস্তান এফসি, এস্তেকলাল আহওয়াজ এফসি প্রভৃতি। ক্লাবগুলো ইরানের প্রিমিয়ার লীগ, প্রো-লীগ সহ নানা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থকে।
কেনাকাটা : কেনাকাটার জন্য এখানে প্রধান মার্কেট হচ্ছে তালেকানী স্ট্রীটের পুরাতন বাজার। এছাড়া চামরান এভিনিউ, যাইতুন এভিনিউ প্রভৃতি। এখানকার আইসক্রীম, কাবাব ও পিজা খুবই বিখ্যাত। এছাড়া কফিশপ, ফাস্টফুডের প্রচুর দোকান রয়েছে। থাকার জন্য নাদেরী হোটেলসহ অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে।
দর্শনীয় স্থান : এখানকার কারুন নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন পার্ক পর্যটকদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এছাড়া সুইডিস ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত প্রায় ৮০ বছরের পুরোনো সাদা ব্রীজ অন্যতম দর্শনীয় স্থান যে ব্রীজ কারুন নদীর এপার-ওপারকে এক করে দিয়েছে।
শিক্ষা : শিক্ষাক্ষেত্রে আহওয়াজের সুনাম রয়েছে। এখানে অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন-আহওয়াজ জুন্দিসাপুর ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, পেট্রোলিয়াম ইউনিভার্সিটি, শহীদ চামরান ইউনিভার্সিটি অব আহওয়াজ, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব আহওয়াজ প্রভৃতি।
বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ : আহওয়াজ প্রাচীনকাল থেকে অনেক ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গের জন্ম দিয়েছে। যেমন ইবনে হাশিম মাজুসী আহওয়াজী (বিজ্ঞানী), আলী ইবনে আব্বাস মাজুসী আহওয়াজী (প্রফেসর), আবু ইয়াকুব ইবনে ইসা (প্রফেসর), হেলাল আহওয়াজী, আবু নাওয়াজ ইবনে আহওয়াজী (কবি), কিয়ানুস আইয়ারী (চলচ্চিত্র নির্মাতা), আহমেদ মাহমুদ, আলী সামখানী, বাবাক রেজা যাদেহ, জালাল কামেলী মোফরাদ, আলী হাশেমী (ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রধান কমান্ডার), মারিয়াম হায়দারী (কবি), রেজা এস্কেন্দারী, মনুচেহর শাহরোখী, রেযা জোযাদেহ (চলচ্চিত্র নির্মাতা) প্রমুখ।
আহওয়াজ ইরানের প্রাচীন শহরসমূহের অন্যতম। আহওয়াজের বাণিজ্যিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ইরানের অন্যতম নদীবন্দর এখানে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আহওয়াজ নানা চড়াই-উৎরাই পার করে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। আহওয়াজে নানা দেশের ব্যবসায়ীদের সম্মিলন ঘটেছে সুপ্রাচীনকাল থেকেই। আধুনিক কালে তেলক্ষেত্র আর সাদা ব্রীজ আহওয়াজকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলেছে । বিজ্ঞান শিক্ষায় আহওয়াজ অন্যান্য অনেক শহর থেকে অগ্রগামী। অতীতের মতোই বর্তমানেও আহওয়াজ এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।