ইরান ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাফল্য অর্জন করেছে
পোস্ট হয়েছে: জুন ২২, ২০১৬
ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান সালেহী-
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান ড. আলী আকবার সালেহী বলেন, বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিচিত ৬টি দেশ ও ইরানের মধ্যে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে ইরান এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে।
জনাব সালেহী গত ২১শে জুলাই (২০১৫) মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট)-এর উন্মুক্ত অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
বার্তা সংস্থা এন্তেখাব্-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনাব সালেহী বলেন, আমরা শার‘ঈ দায়িত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিবেকের দৃষ্টিতে, সাধারণ প্রচলিত দৃষ্টিতে ও বিচারবুদ্ধির আলোকে তথা যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যকার সমঝোতার কৌশলগত দিকসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করি না কেন, আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, জনাব সালেহী পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও দীর্ঘ ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতার অধিকারী।
ড. আলী আকবার সালেহী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই শহীদ পরমাণু বিজ্ঞানীদেরকে তাঁদের নামোল্লেখসহ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এবং এরপর বলেন, মজলিসের এ অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জাওয়াদ যারীফ যে বক্তব্য পেশ করেছেন কার্যত তা এ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। তাই এ ক্ষেত্রে আমি কেবল আলোচনার কৌশলগত দিক সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা পেশ করব মাত্র। আশা করি এর ফলে এ সমঝোতা সম্পর্কে যে কোনো সংশয়ের অবসান ঘটবে।
জনাব সালেহী বলেন, আলোচনা কোনো সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে তা যদি হয় শয়তানকে চ্যালেঞ্জ করে। যারা সব সময়ই ধূর্ততা ও অপকৌশলের আশ্রয় নেয়ার অপচেষ্টা চালায় তাদের সাথে আলোচনা চালানো মোটেই সহজ ও স্বস্তিকর নয়। তবে ইসলামী বিপ্লবের কোলে লালিত ব্যক্তিবর্গÑইরানী প্রতিনিধি দলÑঅবিনশ্বর আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল করে স্বীয় চিন্তা-বিশ্বাসের আলোকে এবং শার‘ঈ দায়িত্ব হিসেবে ও রাহ্বারের পথনির্দেশের ভিত্তিতে যথাযথভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এর ফলে আমরা যা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি একজন ইরানী নাগরিক হিসেবে সে জন্য আমি গর্বিত।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান বলেন, আমাদের দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির ফাইল নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-তে ইরানের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এতদসংক্রান্ত সকল বিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছি। চ্যালেঞ্জপূর্ণ বিগত বারো বছরে ইরানী জাতি সব সময়ই দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের পরিচয় দিয়ে আসছে এবং এ ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। আর এর ফলেই আমরা সম্মান ও উন্নত শির অবস্থাসহ এ ব্যাপারে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি।
জনাব সালেহী বলেন, আমি রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নই। তবে তা সত্ত্বেও নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, এ সমঝোতার ফলে বৈশ্বিক রাজনৈতিক গতিধারায় এক সর্বাত্মক পরিবর্তন সাধিত হবেÑ যে পরিবর্তনের ঘণ্টা ভিয়েনায় বাজানো হয়েছে। কারণ, যেসব দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে পরিগণিত তাদের সামনে এই প্রথম বারের মতো একটি দেশ দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ইতিহাসে এটাই প্রথম যে, একটি উন্নয়নশীল দেশ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জপূর্ণ বিশ্বে আন্তর্জাতিক আন্তঃক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটি উন্নত দেশের অবস্থানে আসন গ্রহণ করে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে। ইসলামী বিপ্লবের বরকতে এবং জাতি ও তার দায়িত্বশীলগণের মনোবলের কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আজ এমন একটি অবস্থানের অধিকারী হতে পেরেছে। আসুন, আমরা এ অর্জনকে মোবারকবাদ জানাই, এর কদর করি এবং এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান জনাব সালেহী সমঝোতার কৌশলগত বিষয়াদি নিয়ে বিরাজমান দুশ্চিন্তা প্রসঙ্গে বলেন, ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যকার আলোচনা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছিল। ইতিপূর্বে যে মহান ভাইয়েরা এ আলোচনায় অংশগ্রহণের দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন ড. রুহানি, জনাব লারিজানী এবং এখন আছেন জনাব যারীফ; তাঁদের সকলেই অনেক পরিশ্রম করেছেনÑ যার ফলে এখন আমরা অধিকতর সমুন্নত একটি দিগন্ত প্রত্যক্ষ করছি। কারো পক্ষে এটা মনে করা উচিত হবে না যে, অতীতে যাঁরা পরিশ্রম করেছেন তা কোনো কাজে লাগে নি; বরং আমরা তাঁদের কাজের ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছি। প্রকৃত অবস্থা হলো এই যে, অতীতে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের প্রত্যেকেই একটি ইটের ওপর একটি করে ইট গেঁথেছেন এবং সর্বশেষ ইটটি এ ধারাবাহিকতায় সবশেষে অংশগ্রহণকারী মহান ভাইয়েরা গেঁথেছেন।
জনাব সালেহী বলেন, ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যকার আলোচনা বছরের পর বছর ধরে চলেছিল, কিন্তু কাক্সিক্ষত উপসংহারে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। এমতাবস্থায় ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বারের খেদমতে একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়, আর তিনি স্বীয় দূরদর্শিতার আলোকে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং আরেকটি পথ উন্মুক্ত করতে বলেন। এ দ্বিতীয় পথটি ছিল সরাসরি আমেরিকার সাথে আলোচনা। অবশ্য তিনি একই সাথে সমন্বিতভাবে উভয় পথে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখার জন্য আদেশ দেন।
জনাব সালেহী বলেন, সৌভাগ্যবশত এ সুচিন্তিত কর্মধারা বর্তমান সরকারের আমলে অত্যন্ত চমৎকারভাবে অনুসৃত হয়। আর এ ক্ষেত্রে উভয় পথে অগ্রসর হবার দায়িত্ব এমন এক ব্যক্তির ওপর অর্পিত হয় যিনি সুপ্রশিক্ষিত ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞত্বের অধিকারীÑ যাঁর অভিজ্ঞতা খুবই কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আর এর চূড়ান্ত ফলাফলও অত্যন্ত বরকতময় হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান আলোচনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ফ্রান্সের লুসানে অনুষ্ঠিত আলোচনায় আমরা আলোচ্য বিষয়ের টেকনিক্যাল অক্ষসমূহের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় উপনীত হই। এরপর গত সপ্তাহে ভিয়েনায় সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে মধ্যবর্তী কয়েক মাসের আলোচনায় আমরা লুসানের সমঝোতাকে কাজে লাগাই। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে লেগে থাকতে হয় এবং লুসানে যে পথ রচনা করা হয় তাকে ধীরে ধীরে আরো বেশি মসৃণ করা হয়। এর ফলে এমন এক উপসংহারে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় ইতিপূর্বে যা চিন্তাও করা যায় নি; ইতিপূর্বে যা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল তা-ও অর্জন করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, এ কথা বলা কি আদৌ সম্ভব যে, আমেরিকা তার এতো সব উপায়-উপকরণসহ সহসাই হতভম্ব হয়ে পড়বে? কিন্তু হ্যাঁ, এটাই হয়েছিল। কারণ, এ ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আমেরিকার তুলনায় মোটেই পিছিয়ে ছিল না। কারণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশেষ করে আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল করে ও আহ্লে বাইতের মাসুম ইমামগণকে (আ.) উসিলা করে স্বীয় পথকে এগিয়ে নেয় এবং এরই বরকতের বদৌলতে নিজেদেরকে যথাযথভাবে ও শক্তিমত্তা সহকারে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। ফলে প্রতিপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও আমাদেরকে টলাতে পারে নি।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আলোচক প্রতিনিধিদল লুসানে যে ভূমিকা পালন করেন সে তুলনায় তাঁরা ভিয়েনার আলোচনায় অধিকতর সমুন্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রতিপক্ষ বলছিল যে, তারা ইরান কর্তৃক পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের পথ বন্ধ করে দেবে। কিন্তু আমরা কি পারমাণবিক অস্ত্র হস্তগত করার জন্য চেষ্টা করছিলাম? আমরা কি এমন কোনো পথে চলছিলাম যে, তারা ঐ পথ বন্ধ করে দেবে? তারা এ পথে যে কোনো বাধাই সৃষ্টি করুক না কেন তাতে আমাদের কিছুই আসে-যায় না। কারণ, ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বারের ফত্ওয়া অনুযায়ী পারমাণবিক অস্ত্রসহ যে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহার পুরোপুরি হারাম। সুতরাং গণবিধ্বংসী অস্ত্র হস্তগত করার জন্য যদি কোনো পথ থেকে থাকে, তাহলে তারা তাদের সাধ্য মতো সে পথ বন্ধ করে দিক। কারণ, আমরা আসলেই সে পথে চলার অভিলাষী নই, যদিও তারা মনে করে যে, তারা আমাদের জন্য এ পথে চলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পেরেছে এবং বিশ্বজনমতের কাছেও এটা আমাদের জন্য সীমাবদ্ধতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
ড. সালেহী তাঁর বক্তব্যের সমাপ্তিতে বলেন, সমঝোতায় যে সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, বাহ্যত হয়তো তা সীমাবদ্ধতা হিসেবে পরিগণিত হবে, কিন্তু তা এমন কোনো সীমাবদ্ধতা নয় যা আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল ভিত্তি, অগ্রগতি ও কর্মতৎপরতাকে স্থবির, শ্লথ বা খোদা না করুন, স্থগিত করে দিতে সক্ষম হবে।
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী