শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরানে মসজিদের সংস্কৃতি : একটি শিক্ষণীয় বাস্তবতা

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১ 

সিরাজুল ইসলাম

মসজিদ হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতির প্রতীক এবং প্রার্থনাস্থল। এটি সমস্ত মুসলমানের জন্য আধ্যাত্মিক স্থান। মসজিদ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর সবচেয়ে নিকটতম স্থান হলো মসজিদ।’ মসজিদেই নামাজ আদায় করা হয় আর নামাজ হচ্ছে ইসলামের অন্যতম প্রধান রুকন বা স্তম্ভ, নামাজ হচ্ছে ‘ইসলামের নির্যাস’। ফলে শুধু সাধারণ লোকজনের জন্য মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া বা সংঘবদ্ধভাবে ইবাদত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় নি; বরং খ্যাতিমান ইসলামি প-িত ব্যক্তিরাও জামায়াতে নামাজ পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
মসজিদ হলো ইবাদাতের স্থান। কোরআন তেলাওয়াত করা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, নামাজ আদায় করা ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের ইবাদাতের স্থান হলো মসজিদ। এইসব কাজের সুবিধার্থে সময়ের পরিক্রমায় মসজিদকে ঘিরে গড়ে ওঠে গ্রন্থাগার, সরাইখানা, চিকিৎসাকেন্দ্র, মাদ্রাসা ও রান্নাঘর। মুসলমানরা তাদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক বিচিত্র চাহিদা মেটানোর জন্য মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করত। সাধারণত এই মসজিদ কমপ্লেক্স গড়ে উঠত শহরকে কেন্দ্র করে। সেজন্য এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
ইসলামের আবির্ভাব থেকে এখন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর কাছে মসজিদ সমানভাবে গুরুত্বপূর্র্ণ ও মর্যাদার অধিকারী। কেননা, মসজিদ হচ্ছে তাদের ইবাদাতের মূল কেন্দ্র। ইবাদাত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের স্থান মসজিদে এক সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি সামরিক অভিযান সম্পর্কেও পরামর্শ করা হতো। মসজিদ ছিল মুসলিম সমাজের সকল কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমলে মসজিদ বিচিত্র কাজে ব্যবহৃত হতো। যেমন নিঃস্বদের আবাসন, মুসাফিরদের যাত্রাবিরতি, সামাজিক কাজকর্মের কেন্দ্র এবং কোরআনসহ ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা। পরবর্তীকালে জ্ঞানের ‘আদর্শ নমুনা’ এই মসজিদ থেকেই শুরু হয়ে বিস্তৃতি ও বিকাশ লাভ করেছে। তবে ইতিহাসের সকল পর্যায়েই মসজিদ ছিল আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং তাঁর সাথে নিজেদের চাওয়া-পাওয়া-প্রয়োজনীয়তার কথা বলার পবিত্র স্থান। কিন্তু বর্তমানে নামাজ আদায় ও ওয়াজ মাহফিল ছাড়া মসজিদ তার অবশিষ্ট ভূমিকাগুলো খুব একটা পালন করতে পারছে না। প্রায় সারা বিশ্বেই একই অবস্থা। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া একান্তই জরুরি। তাতে দেশ, সমাজ ও সমাজের মানুষেরই উপকার হবে।
১৯৭৯ সালে ইরানে মহান ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে মসজিদকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ সময় ইরানের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে শহরের বড় বড় মসজিদগুলোকে বিশেষ শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করা হয়। মসজিদের ইমামদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইমামরা শুধু ‘নামাজ পড়ানো লোক’ হিসেবে বিবেচিত না হয়ে সমাজের নেতা হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেন। মসজিদ হয়ে ওঠে প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের মধ্যে যোগাযোগের বিরাট সেতুবন্ধন। বিপ্লবের পর মসজিদ আর শুধু নামাজের স্থান থাকল না; বরং এর নানামুখী ব্যবহার শুরু হলো। গড়ে উঠতে থাকল নতুন নতুন মসজিদ ও মসজিদ কমপ্লেক্স। এসব মসজিদ কমপ্লেক্সে রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকা- নির্বাচনের ভোট গ্রহণও করা হয়ে থাকে।
মসজিদ তথা ইবাদাত-কেন্দ্রের নানামুখী ব্যবহারের বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে রাজধানী তেহরানে নির্মিত ইমাম খোমেইনী মুসাল্লার কথা বলতে পারি। আগে ইরানের রাজধানী তেহরানের কেন্দ্রীয় জুমার নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হতো তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ১৯৮২ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুমার নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের জন্য তেহরানের আব্বাস আবাদ এলাকায় মুসাল্লা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আলোচনা-পর্যালোচনার পর ১৯৯০ সালে এর চূড়ান্ত নকশা গ্রহণ করা হয় যাতে ইরান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান এবং জর্জিয়ার ইসলামি নির্মাণশৈলী ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। তাজিকিস্তান, আজারবাইজান এবং জর্জিয়া প্রাচীনকালে ইরানের অংশ ছিল।
যাহোক, তেহরানে নির্মিত এই মুসাল্লার নাম দেওয়া হয়েছে ইমাম খোমেইনী মুসাল্লা। এখানে শুধু জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় না; বরং ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার নামাজের জামায়াতও অনুষ্ঠিত হয়। ইমাম খোমেইনী মুসাল্লায় গড়ে তোলা হয়েছে সুবিশাল কমপ্লেক্স। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ কমপ্লেক্স। এখানে ২৩০ মিটার উচ্চতার দুটি মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
ইমাম খোমেইনী মুসাল্লায় জুমা এবং ঈদের নামাজ অনুষ্ঠান ছাড়া আরো যেসব কার্যক্রমে এটি ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো। ইমাম খোমেইনী মুসাল্লায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যেমন-
১. আন্তর্জাতিক কোরআন প্রদর্শনী
২. তেহরান ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার
৩. ইরানের খনি এবং খনিজ শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী এবং
৪. আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প প্রদর্শনী।
এবার আমরা ইরানের মাশহাদ শহরে ইমাম রেযা আলাইহিস সালামের পবিত্র মাজার কমপ্লেক্সের দিকে নজর দিতে পারি।
মাশহাদ শহরটি তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী একটি শহর। পবিত্র এই শহরেই রয়েছে নবী-বংশের অষ্টম ইমাম হযরত ইমাম রেযা আলাইহিস সালামের মাজার। এই মাজার কমপ্লেক্সে যে মসজিদ রয়েছে সেটি আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এছাড়া, মসজিদ কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি জাদুঘর, একটি বিশাল লাইব্রেরি এবং চারটি মাদ্রাসা, একটি কবরস্থান, রাজাভি ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক সায়েন্সেস, পর্যটকদের জন্য নির্মিত একটি বিশাল ডাইনিং হল, সুবিশাল নামাজের স্থান এবং আরো কয়েকটি ভবন।
ইরানে ঐতিহাসিক ও আকর্ষণীয় যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে ইমাম রেযার মাজার কমপ্লেক্স তার অন্যতম প্রধান। কানাডার বিশিষ্ট লেখক বেনি রাল্ফ ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজার কমপ্লেক্সের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি ‘ইরান, ফিরোযা ব্রিজ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজারের বিস্তৃত শাবেস্তান আর কবরের পাশের কারুকার্র্যময় খোলা আঙ্গিনা দেখতে খুবই সুন্দর। সেখানে সবাই একধরনের প্রশান্তি ও নিরাপত্তা বোধ করেন। গম্বুজের ভেতরের রং-বেরঙের দেয়াল চমৎকার সব টাইলসের কারুকাজে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, অন্যরকম এক ভালো লাগার সাথে সেখানে বিরাজ করে এক ঐশী গুঞ্জরণ। মানুষ এখানে অলৌকিক মাহাত্ম্য অনুভব করেন এবং মানুষকে যেন বেহেশতের পথ দেখায়। মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করেন এবং মারেফাতের নূর তাঁর অন্তরে আলো বিকিরণ করে। এই মাজার দেখার যে অনুভূতি তা বর্ণনা করার মতো কোনো ভাষা নেই।’
২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী ইরান এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ইমাম রেযার মাজার জিয়ারত করে থাকেন।
এই মাজার কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশন যার নেতৃত্বে থাকেন ইরানের একজন প্রখ্যাত আলেম। ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইবরাহিম রায়িসি একসময় এই আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান ছিলেন।
ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজার কমপ্লেক্সের মোট আয়তন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৭ বর্গমিটার। এর মধ্যে শুধু মাজার এলাকার আয়তন ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯ বর্গমিটার।
ইমাম রেযার মূল কবরের বেষ্টনীর ভেতরে সোনা ও রূপার যে বিচিত্র কারুকাজ, তার পাশাপাশি কাচের শিল্পকর্মে সজ্জিত ক্যানভাসে মৃদু আলোর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যিনি একবার দেখেন, তিনি আর ফিরে আসতে চান না। বিখ্যাত ৭ জন ইরানি শিল্পী আড়াই বছর ধরে এসব কারুকাজ সম্পন্ন করেছেন। আধ্যাত্মিকতা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের গুণে একটি মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্স ইরানের মতো একটি দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, কেবল ইবাদাতের স্থান হয়ে থাকে নি।
শুধু ইসলামি বিপ্লবের পরে নয়, বরং বিপ্লব সফল হওয়ার আগেও মহান ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনী তাঁর আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র বানিয়েছিলেন মসজিদকে। ১৯৭৮ সালে যখন মোহাম্মদ রেযা শাহের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করল তখন ফ্রান্সের প্যারিস থেকে পাঠানো রেকর্ড একজন মসজিদের ইমাম রমজানের জুমার নামাজের খুতবা হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভে নামেন। তাঁদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালালে ৮৭ জন শহীদ এবং ২০৫ জন আহত হন। ইরানের ইতিহাসে এ ঘটনাকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। প্যারিস থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ) নতুন রেকর্ড পাঠিয়ে জনগণের প্রতি বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান এই কথা প্রচার করার জন্য যে, মসজিদ থেকেই ইসলামি বিপ্লবের শুরু। এর পরিণতিতে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তেহরানের রাজপথে কোটি মানুষের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়- ‘আয়াতুল্লাহ খোমেইনী দেশের নেতা এবং রাজতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করা হলো, পরিবর্তে দেশে ইসলামি সরকার গঠিত হবে।’ এই বিক্ষোভের পরে (১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯) মোহাম্মদ রেযা শাহ দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং ১১ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ইমাম খোমেইনী ইরানে ফিরে আসেন। এভাবে ইরানের বিপ্লব চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখে।
বলা যেতে পারে, ইরানের আলেমদের মসজিদভিত্তিক নেটওয়ার্ক বিপ্লব গড়ে তোলা ও মোহাম্মদ রেযা শাহের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। ইরানের শহর নগর ও গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার মসজিদ দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক এবং প্রাকৃতিক যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল।
ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার ব্যাপারে ইরানের মসজিদগুলো ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে বিরাটভাবে সাহায্য করেছিল। বিপ্লবের পর তিনি মসজিদগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে সেগুলোকে বিপ্লবের অর্জন সমাজে বাস্তবায়নের জন্য কাজে লাগাতে শুরু করলেন।
তিনি দেশে ফিরেই জুমার নামাজের বৃহৎ জামায়াত অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেন এবং ইরানের সমস্ত শহর-নগরের মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের ইমাম নিয়োগ করলেন। বিপ্লবের নেতার প্রতিনিধি হিসেবে এসমস্ত ইমামের ওপর জুমার নামাজের খুতবা ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে বক্তব্য রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইরানে যে তামাকবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল এবং ১৯০৫ সালে যে সাংবিধানিক বিপ্লব হয়েছিল মসজিদ তাতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য এই ঐক্য ও সংহতির কোনো বিকল্প নেই। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানের যেসব শহরে শিয়া ও সুন্নি মুসলমান বসবাস করেন সেসব শহরে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভূতপূর্ব উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় যাহেদান শহরের মুসলমানরা এক শুক্রবার একজন শিয়া আলেমের ইমামতিতে জুমার নামাজ আদায় করতেন এবং পরবর্তী শুক্রবার একজন সুন্নি আলেমের ইমামতিতে এই সাপ্তাহিক নামাজ আদায় করতেন। প্রথমদিকে এই নামাজের ইমামতি করেছেন মরহুম আয়াতুল্লাহ কাফআমি ও মরহুম মৌলভি আবদুল আজিজ। শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেটি ছিল একটি চমৎকার উদ্যোগ। পরস্পরের মসজিদে এবং ইমামতিতে নামাজ আদায় করার সময় তাঁরা ফিকাহ সংক্রান্ত মতপার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।
সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মসজিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তার আরেকটি উদাহরণ ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশের ‘খাশ’ মসজিদ। প্রদেশের খাশ শহরে অবস্থিত এই মসজিদ শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। শহরের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিরা বলেন, এখানে শুরু থেকেই দুই মাজহাবের মুসল্লিরা একত্রে নামাজ আদায় করতেন। খাশ শহরের জুমার নামাজের খতিব হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মাদ হোসেইন মিরি বলেছেন, মসজিদটিতে এখনো শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা একসঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন।
এতক্ষণ রাষ্ট্র ও সমাজে বিশেষ করে ইরানে মসজিদের নানামুখী গঠনমূলক কর্মকা- এবং সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মসজিদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হলো। নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা বলতে পারি- মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে মসজিদের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। মুসল্লিরা যখন জামায়াতে সারিবদ্ধভাবে নামাজ আদায় করেন তখন সমাজের এই মানুষগুলোর সামষ্টিক আচরণ প্রকাশ পায়। ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজে দাঁড়ালে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাশাপাশি অন্য সময়ে যখন মুসল্লিরা আলাদাভাবে মসজিদে উপস্থিত হন তখনও তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত আচরণ ও কথাবার্তা নিয়ন্ত্রণ করেন। মসজিদে কেউ কোনো অবস্থায় স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেন না এবং এখানকার এই প্রশিক্ষণটি মানুষের জন্য সমাজে চলার উত্তম পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায়কারী একজন মানুষ নিজেই তার স্বভাব-চরিত্রের খারাপ দিকগুলো বর্জন করে উন্নত গুণাবলি অর্জন করতে থাকেন। এটি একটি দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত মসজিদে যাতায়াতকারী ব্যক্তি সমাজের আদর্শস্থানীয় মানুষে পরিণত হয়ে যান। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের উপাসনালয়ের এরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
নিয়মিত মসজিদে যাতায়াতকারী একজন মানুষ প্রতিনিয়ত ঈমানদার, নামাজি, মুত্তাকি ও ধার্মিক ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ পান। এসব ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমান ও আমল সবার সামনে উন্মুক্ত। ধর্মভীরু এসব মানুষ সাধারণভাবে সমাজে সবার শ্রদ্ধাভাজন হন। পারিবারিক ও সামাজিক কাজেকর্মে এমনকি অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও এই মানুষগুলোর কথা ও দিক-নির্দেশনাকে সবাই সম্মান জানান। পক্ষান্তরে মসজিদের সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষেরা ইসলামি সমাজে কোনো অবস্থাতেই এরকম শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে না। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শুধু ইরান নয়- সব মুসলিম দেশেই মসজিদকে নানামুখী সমাজসেবামূলক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা দরকার। তাতে উন্নত চারিত্রিক মাধুর্যের মানুষে ভরে উঠবে প্রতিটি সমাজ, দেখা দেবে বৈষয়িক উন্নতি। সমাজে ছড়িয়ে পড়বে শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া।
লেখক : রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট