ইরানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আল-রাজি ও আজকের বাস্তবতা
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১
রাশিদ রিয়াজ
ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আল-রাজি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে (২৫১ হিজরি) পারস্যের ‘রেই’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আলবোর্জ পর্বতমালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশে এই নগরীটি অবস্থিত। বর্তমানে এটি বৃহত্তর তেহরানের অংশ। আল-রাজি ইউরোপে ‘রাজেশ’ নামে পরিচিত।
রাজি ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। জীবনের শুরুতে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করতেন। বিভিন্ন আসর, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি ইত্যাদি অনর্থক কাজে সময় কাটিয়ে দিতেন। (সও আজিম মুসলিম সাইন্সদা : ১৪৭)। পরবর্তী সময়ে রসায়নবিদ্যার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ‘কিমিয়াগিরির’ (লোহা ও পিতল ইত্যাদিকে স্বর্ণে রূপান্তর করার একটি কৌশল) পেছনে সময় ও মেধা ব্যয় করতে থাকেন। কিমিয়াগিরির জন্য বাড়িতে আগুনের চুল্লি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর বাড়ি সর্বদা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ থাকত। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে চোখ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার ৫০০ আশরাফি মুদ্রার বিনিময়ে চোখের চিকিৎসা করেন। বিদায়কালে বলেন, রসায়নবিদ্যার আকর্ষণে তুমি যে কিমিয়াগিরি করছ সেটি আসল কিমিয়াগিরি নয়, আসল কিমিয়া হলো আমি যেটা করছি সেটা! (তারিখুল হুকামা : ৬)
চক্ষু ডাক্তারের ওই মন্তব্য মুহাম্মাদ রাজির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী হতে তিনি স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বাগদাদের পথে যাত্রা করেন। বাগদাদের তৎকালীন শীর্ষ চিকিৎসক আলী ইবনে সাহলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইবনে সাহলের তত্ত্বাবধানে কঠিন অধ্যবসায় ও অধ্যয়নের ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হন। দীর্ঘকাল চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠদান ও রোগীদের সেবা করার ফলে তাঁর নাম চিকিৎসাশাস্ত্রের ইমাম ও নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনকারীদের শীর্ষ তালিকায় উচ্চারিত হতে থাকে। বিখ্যাত মনীষী ইবনে খাল্লিকান বলেন, মুহাম্মাদ আল-রাজি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প-িত ছিলেন। তাঁর যুগে তাঁকেই সেরা বলা হতো। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের অসংখ্য মৌল তত্ত্বের আবিষ্কারক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চিকিৎসাশাস্ত্রের দীক্ষা নিতে তাঁর কাছে আগমন করত। (হুকামায়ে ইসলাম : ১/২০১)
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুহাম্মাদ রাজির অবদান স¤পর্কে ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘চিকিৎসাাস্ত্রের মৃত্যু ঘটেছিল, হাকিম জালিনুস আবার প্রাণ দান করেছেন। এ শাস্ত্রের নীতিমালা বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল ছিল, ইমাম রাজি সেসব নীতিকে পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও সুবিন্যস্ত করে কিতাবের আকৃতি দান করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র অস¤পূর্ণ ছিল, ইবনে সিনা তার পূর্ণতা দান করেছেন।’ (ইবনে খাল্লিকান : ২/৭৮)
ইমাম রাজি একজন প্রাজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। রেই শহরের প্রধান হাসপাতালের প্রধান পরিচালকের পদে তাঁকে আসীন করা হয়। এ সময়েই তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার সুখ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। খলিফা মুকতাফির (১৭তম আব্বাসি খলিফা) রাজত্বকালে ইমাম রাজিকে বাগদাদে বদলি করা হয়। ৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রেইয়ের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাকের অনুরোধে তিনি আবার রেইয়ের সরকারি হাসপাতালে আগের পদে যোগদান করেন।
ইমাম রাজিই সর্বপ্রথম ‘ফার্স্ট এইড’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতির নীতিমালাও তিনি প্রণয়ন করেন। ‘মিজানে তিববি’ নামক ওষুধের ওজন পরিমাপক যন্ত্র তাঁর হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়। এ নিক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের সঠিক পরিমাপ জানা যায়। অ্যালকোহল আবিষ্কারকের নাম হিসেবেও মুহাম্মাদ রাজির নাম উচ্চারিত হয়। ‘বংশপরা¤পরায় রোগের সৃষ্টি’ তত্ত্বের ধারণা তিনিই সর্বপ্রথম প্রদান করেন। ‘নশতার’ নামক এক ধরনের অস্ত্রোপচার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। (সও আজিম মুসলিম সাইন্সদা : ১৪৭)
শল্যচিকিৎসার প্রাণপুরুষ আল-রাজিই প্রথম চিকিৎসক যিনি হাম ও গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি সালফিউরিক এসিড, ইথানল উৎপাদন ও পরিশোধন এবং চিকিৎসায় এর ব্যবহার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
আল-রাজি কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ ও রসায়নবিদ ছিলেন। ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে একটি সফল জীবন শেষ করে জন্মশহর রেইতে ইন্তেকাল করেন এ জগদ্বিখ্যাত মনীষী। তাঁর নামে ইরানে রাজি ইন্সটিটিউট ও ইরানের কেরমানশাহ শহরে রাজি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। ইরানে প্রতি বছর ২৭ আগস্ট আল-রাজিকে স্মরণ করে রাজি দিবস পালন করা হয়।
মুহাম্মাদ রাজির রচনাবলি
আল-রাজি রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ২০০টির অধিক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আল হাভি’ এবং ‘রসায়নশাস্ত্রের রহস্যাবলির রহস্য’ শীর্ষক গ্রন্থ। দিনরাত পড়াশুনা ও গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান। এরপর তিনি বলতেন আর তাঁর ছাত্ররা তা লিখে রাখতেন। যখন তিনি মারা গেলেন তখন তাঁর ছাত্ররাই ‘আল হাভি’র কাজ সমাপ্ত করেছিলেন। নিচে তাঁর কয়েকটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো :
ক. আল-হাভি : ‘আল-হাভি’ হলো চিকিৎসাশাস্ত্রে লিখিত তাঁর জগদ্বিখ্যাত কিতাব। এটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরবি ভাষার এনসাইক্লোপিডিয়া বলা হয়। এ বইতে চিকিৎসাশাস্ত্রের সূক্ষ¥ সূক্ষ্ম সমস্যার সমাধান ও আরব বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। ইউনান, হিন্দুস্তান ও ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সারনির্যাসকে নীতিমালার আলোকে একত্রিত করেছেন। শতাব্দীকাল ধরে এ বই পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে একজন ইহুদি চিকিৎসক এ বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ করেন। বইটির গ্রহণযোগ্যতা বোঝাতে এতটুকুই যথেষ্ট যে, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম অনুবাদ প্রকাশের পর ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পনেরোর অধিক সংস্করণ ছাপা হয়!
খ. কিতাবুল মানসুরি : ইমাম রাজির বিখ্যাত রচনা। দশ খ-ে লিখিত বইটি শাসক মানসুরের নামে নামকরণ করেন। ইতালির মিলান শহরে পনেরো শতাব্দীর শেষের দিকে এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অধুনা এর কিছু অংশ ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
গ. কিতাবুল জাদারি ওয়াল হাসাবা : আরেকটি জনপ্রিয় কিতাব। ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই কিতাবে বসন্ত, জলবসন্ত ও হাম রোগের চিকিৎসা স¤পর্কে বিস্তারিত সমাধান দেওয়া হয়। রাজির আগে অন্য কেউ এ বিষয়ে কলম ধরেনি। বসন্তের ধরন নির্ণয়ের ভিত্তিতে তিনি প্রতিষেধক উদ্ভাবন করেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় কিতাবটির অনুবাদ হয়। এ বইটিই ইমাম রাজিকে মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজি অনুবাদ হয় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। ফ্রেঞ্চ, ইউনান ও জার্মান ভাষায়ও এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমে কিতাবটি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঘ. আল-ফুসুল ফিত-তিব : রাজির বিখ্যাত কিতাব। সর্বপ্রথম ইবরানি ভাষায় তরজমা প্রকাশিত হয়। লন্ডনে এর অনুবাদ বিদ্যমান আছে। ল্যাটিন ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
ঙ. কিতাবুত তিববিল মুলুকি : আরেকটি প্রসিদ্ধ কিতাব। তবারিস্তানের (ইরানের বিখ্যাত নগরী) শাসক আলি ইবনে উমসুজানের নামে বইটির নামকরণ করেন। এটির হাতেলেখা পা-ুলিপি লন্ডন লাইব্রেরিতে বিদ্যমান আছে। (ইসলামি এনসাইক্লোপিডিয়া : ৮১৯, উলুম ওয়া ফুনুন আহদে আব্বাসি : ১২৬)
চ. কিতাবুল আসরার : গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত কিতাব। প্রসূতিবিদ্যা, চক্ষুরোগ ও মহিলা রোগের চিকিৎসা বিষয়ে এ কিতাবের গ্রহণযোগ্যতার কথা পশ্চিমা বিশ্ব নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছে। (আরবু কে ইলমি কারনামে : ৭০)।
লেখালেখিতে ইমাম রাজির স্বভাবজাত আগ্রহ ও যোগ্যতা ছিল। সর্বদা লেখার কাজে নিমগ্ন থাকতেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও আকিদা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, মহাকাশ ইত্যাদি বিষয়ে লেখা তাঁর রচনাবলি বিশেষ মর্যাদায় আসীন। পশ্চিমা বিশ্বের চিকিৎসা, দর্শন ইত্যাদির ওপর ইমাম রাজির রচনাবলির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন কংগ্রেস আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ইমাম রাজির জীবন ও অবদানের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনসূচক বাক্যে ইমামকে উল্লেখ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম রাজির মৃত্যুর হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিদের সবাই তাঁকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
ইরানের বর্তমান চিকিৎসাব্যবস্থা
আজকের দিনে ইরান যখন নিজেদের ওষুধ চাহিদার ৯৮ শতাংশ নিজেরাই তৈরি করে তখন বোঝা যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে আল-রাজির মতো বিদগ্ধ প-িতরা দেশটির এ শাখায় প্রাচীনকালেই ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ১০০ ভাগ ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান। গত বছর ৯৭০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে, এর মধ্যে ৮০টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এমন সব ওষুধ তৈরির জন্য যা দেশে এই প্রথমবারের মতো তৈরি হচ্ছে।
একটি দেশের বিরুদ্ধে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে যখন অন্যায়ভাবে অবরোধ ও ওষুধ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে আসছে তখনো ইরান করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এমনভাবে লড়ছে যেখানে জাতীয় জাগরণের আভাস পাওয়া যায়। ইরানই একমাত্র মুসলিম দেশ যারা অন্তত তিনটি দেশের সঙ্গে করোনাভাইরাসের টিকা যৌথভাবে ও নিজেদের উদ্ভাবিত তিনটি টিকা উৎপাদনে যাচ্ছে। এর বাইরে আরো কয়েকটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। ইতিমধ্যে ইরান জার্মানি ও তুরস্কসহ কয়েকেটি দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট রপ্তানি শুরু করার পর দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইরানের কিটের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের নিজস্ব টিকা ‘কোভিড বারাকাত’ গ্রহণ করেছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে নির্বাচিত হওয়ার পর ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ড. রায়িসি ইরানের তৈরি করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন। তাঁর নেওয়া ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ নামের ওই ভ্যাকসিন ইরানের তরুণ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। সকল প্রকার ট্রায়াল শেষে এই ভ্যাকসিন প্রদানের অনুমতি মিলেছে। প্রেসিডেন্ট রায়িসি এ টিকা নিয়ে ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ তৈরির ক্ষেত্রে নিয়োজিত তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের শ্রম ও মেধাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও তাঁদেরকে সম্মানিত করেছেন। ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ ভ্যাকসিন ব্যবহারের লাইসেন্স পাবার মধ্য দিয়ে ইরান করোনার টিকা প্রস্তুতকারী বিশ্বের ছয়টি দেশের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। আগামী বছরে মুখে নেওয়ার মতো কোভিড ওরাল ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ইরান। ইরানের মোট ৯টি স্থানীয় ফার্ম করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে কাজ করছে। দুটি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল লাইসেন্স লাভের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
এসব গবেষণা নিরন্তর চলার পেছনে উৎসাহ যুগিয়েছে তাদের উত্তরসূরি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতো আরো অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর অশেষ পরিশ্রম ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় আজকে ইরানে ৬শ’র বেশি কো¤পানি মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরি করে যা ইরানের মোট চাহিদার শতকরা ৩৫ ভাগ। বিভিন্ন দেশে যখন কোভিড মহামারিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন উপকরণের সংকট চলছে তখন ইরান এসব উপকরণ অনেক দেশে রফতানি করছে।
পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদকে পরিণত হবে ইরান এমন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। আর এধরনের লক্ষ্যমাত্র নিয়ে আগানো সম্ভব হচ্ছে ইরানের বিজ্ঞানীদের উচ্চ বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা ও সামর্থ্য এবং ওষুধ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান নিজেরাই তৈরি করতে পেরেছে বলে।
এমনিতে বিশ্বখ্যাত ৩৫ জন স্টেম সেল প্রতিস্থাপন ডাক্তারের তালিকায় রয়েছেন ইরানি চিকিৎসক আমির আলি হামিদিয়ে। ‘দেড় মিলিয়ন হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তিনি সেরা ৩৫ জনের মধ্যে স্থান পান। তাঁর মতো অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাঁদের উত্তরসূরির গবেষণার ভিত্তিকেই অনুসরণ করে নিত্যনতুন আবিষ্কার করছেন।
এরই মধ্যে ইরান ইন্দোনেশিয়ায় আধুনিক টেলিসার্জারি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোবটের সাহায্যে দূরবর্তী স্থানে অস্ত্রোপচারের জন্য ইন্দোনেশিয়ায় দুটি আধুনিক টেলিসার্জারি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে ইরান। এছাড়া পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম আয়ন থেরাপি কেন্দ্র চালু করেছে ইরান। আগামী বছরে থেকে কেন্দ্রটিতে সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে। বিশ্বে এই ধরনের প্রযুক্তি মাত্র ছয়টি দেশের হাতে আছে।
একই সঙ্গে ইরানে নিয়মিত আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তেহরানে পঞ্চম ইন্টারন্যাশনাল হেলথ কংগ্রেস শুরু হওয়ার পর আশা করা হচ্ছে এ আয়োজন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পর্যটন উন্নয়ন ও সহযোগিতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে, একই সঙ্গে মেডিকেল টুরিজ্যম, ¯েপার্টস টুরিজ্যম, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকর খাবার ও ল্যাবরেটরি ইকুয়েপমেন্ট নিয়েও এ কংগ্রেসে আলোচনায় উপকৃত হয়েছে দেশগুলো।
সম্প্রতি রাশিয়া, জার্মানি এবং ইকুয়েডরে ‘ব্রেন সার্জারি নেভিগেশন সিস্টেম’ রফতানি শুরু করছে ইরান। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের এসব জটিল উপকরণ বর্তমানে ইরানের ৮০টি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকরণগুলো কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারে এধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এধরনের ডিভাইস সার্জনকে অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম। টিউমার, সাইনাস ও মাথার খুলি, এমনকি ¯পাইনাল কর্ড বা মেরুদ- অপারেশনে এসব ডিভাইস খুবই উপযোগী। ফলে চিকিৎসকরা এধরনের অস্ত্রোপচারের সময় বাড়তি সাহস পেয়ে থাকেন। সঠিক সময়ের মধ্যে অস্ত্রোপচারে আস্থাও পান। তুরস্কে এধরনের ডিভাইস রপ্তানির কথা চলছে। ইরানের দেড়শ চিকিৎসক অন্তত ৬ হাজার রোগীর মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে এসব ডিভাইস ব্যবহার করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আহমেদ আল-মানদারি বলেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ইরান হচ্ছে রোল মডেল। ইরান জুড়ে ৬৯৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া এক বার্তায় তিনি এই মন্তব্য করেন। মানদারি বলেন, বিগত চার দশক ধরে ইরানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক জনগণের সময়মতো সাশ্রয়ী মূল্যে, গ্রহণযোগ্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিতের লক্ষে কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব নতুন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আওতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রায় সব ইরানিই রাষ্ট্র সমর্থিত স্বাস্থ্যবিমা পরিষেবা পান।