ইরানে অবরোধ বনাম স্বাধীন ও প্রতিরোধবান্ধব অর্থনীতি
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২০, ২০১৬
রাশিদুল ইসলাম
আপনি যদি ইরানের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন পশ্চিমা দেশগুলো উদগ্রীব হয়ে আছে দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য। কিন্তু এক দশক আগেও দেশটির অবস্থা এমন ছিল না। পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিন খবর প্রকাশিত হত এই আমেরিকা বা ইসরাইল ইরানে আক্রমণ করে বসল আরকি! ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলছে এমন অপপ্রচার ছিল দুনিয়াশুদ্ধ। যদিও ইরানের ধর্মীয় নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন ইরান কখনোই পারমাণবিক বোমা বানাবে না বা এধরনের বোমা বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে এধরনের বোমা মানুষ ছাড়াও প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে যা যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়াতে হয়। শান্তিপূর্ণভাবে ইরান পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে সস্তায় জ্বালানি উৎপাদন ও চিকিৎসাসহ মানব কল্যাণে। এতেই মাথা ঘুরে যায় পশ্চিমা দেশগুলোর। কারণ, জ্বালানি একটি অতাবশ্যকীয় কৌশলগত পণ্য হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো এ নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসাই শুধু করে না, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে তামাম দুনিয়ার দেশগুলোর জ্বালানি সম্পদ বিনিয়োগের নামে কুক্ষিগত করে রাখে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে নিজেরা রফতানি সক্ষমতায় এগিয়ে থাকে। আর নিজেদের সেরা প্রযুক্তি হাতে রেখে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অন্যদেশগুলোকে সেই সব পুরোনো প্রযুক্তি হস্তান্তর করে। এছাড়া উচ্চ সুদ আর অতিরিক্ত মূল্যের জ্বালানিসহ নানা জটিলতায় বিনিয়োগের নামে যাতে কোনো দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে না পারে এমন সংকট থেকেই যায়। একমাত্র সস্তা শ্রম বা শ্রমিককে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে কিছুটা লাভের মুখ দেখে থাকে দেশগুলো যা অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দেয় এবং আদতে অর্থনীতির কোনো টেকসই উন্নয়ন হয় না। এধরনের ছলচাতুরি ইরান খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। ইরান যে শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ হচ্ছে দেশটি প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে হাসপাতাল নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
লক্ষ্য করুন, বিপ্লবের পর ইরান মাথা গরম করে সাদ্দাম হোসেনের মতো কুয়েতে আগ্রাসন চালায়নি। বরং পশ্চিমা দেশগুলোর মদদে যে সাদ্দাম হোসেন দেশটির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল তার পরিণতি এখন সবার জানা। এখন আইএস জঙ্গিরা দেশটির তেল-সম্পদ চুরি করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেই বিক্রি করছে। অন্যদিকে ইরাক পুনর্গঠনে সাহায্য করে যাচ্ছে ইরান।
পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ওপর যে অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছিল তা বছরের পর বছর ধরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দরকষাকষির মধ্য দিয়ে এমন একটি ফয়সালার দিকে এগিয়েছে যে, পশ্চিমা দেশগুলো এখন বলতে শুরু করেছে, সিরিয়া সমস্যা নিরসনে ইরানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
ইরান যখন তার উপর আরোপিত অবরোধকে আশীর্বাদে পরিণত করেছে এবং এই অবরোধ যখন বাস্তবেই কার্যকারিতা হারিয়েছে তখন তা অবশিষ্ট রেখে লাভ কি? ফল দাঁড়িয়েছে, ইরানের ওপর অবরোধ থাকলে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি তা বুমেরাং হয়ে আঘাত হানছে। কেমন করে? কারণ, ইরান অবরোধের মধ্যে চীন, রাশিয়া, ভারত, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপসহ এমন সব দেশের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তাতে পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন ইসরাইল কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না। বরং কে কার আগে ইরানে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করবে রীতিমত তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে । ভারত ও চীন অবরোধ উপেক্ষা করে ইরানের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধায় তেল এনেছে। তাহলে পাকিস্তান কেন ইরান থেকে গ্যাস আনবে না? আর সেই গ্যাস কেন ভারতে যাবে না? হ্যাঁ, ভারত থেকে সে গ্যাস বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাপারেও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে কীভাবে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় তা দেখিয়েছে ইরান।
লক্ষ্য করুন, ইরান গত বছরের তুলনায় পারস্য উপসাগরে বাঙ্কারিং অর্থাৎ জাহাজ থেকে তেল খালাস কিংবা মজুত বাড়িয়েছে ৩০ ভাগ। এটা বেড়েছে হরমুজ প্রণালি দিয়ে অন্তত ১৭০টি জাহাজে প্রায় ১১ লাখ টন অতিরিক্ত তেল সরবরাহের ফলে। অবরোধ কাগজপত্রে যেটুকু টিকে আছে তা উবে গেলে কয়েক সপ্তাহে ইরান দিনে আরো অতিরিক্ত ৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে। আর তা হলে ইরান সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে তেল খালাস ও মজুতে। ইতিমধ্যে ইরানের জাতীয় তেল উৎপাদন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসের সাজ্জাদি বলেছেন, বাঙ্কারিং করে এখাতে আয় গত ৬ মাসে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবরোধ উঠে গেলে ওমান সাগর দিয়ে অন্য দেশে ইরানের তেল সরবরাহ বাড়বে। গত দুই বছরে বাঙ্কারিং থেকে ইরান আয় করেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তার মানে ইরানের কাছ থেকে তেল না কেনার যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা কাজে আসেনি।
ইরানের কাস্টমস বলছে, গত সাত মাসে তেল ছাড়া অন্যান্য বাণিজ্যে আয় হয়েছে ৪৮ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূলত অবরোধকে পাশ কাটিয়ে চীন, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত ও আফগানিস্তান ইরান থেকে শীর্ষ ৫ পণ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান করছে। এর আগে চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও ভারত ইরানে শীর্ষ ৫ পণ্য রফতানিকারক দেশ ছিল। ইরানের খনিজ ও বাণিজ্য উপমন্ত্রী মোজতাবা খোসরোতাজ বলেছেন, তাঁর দেশ আগামী সাত মাসে তেল ছাড়া সাড়ে ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে।
দিন কয়েক আগে মালয়েশিয়ার জাতীয় তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠান পেট্রোনাসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক ইখলাস আবদুল রহমান বলেছেন, অবরোধ উঠে গেলে তাঁর দেশ ইরান থেকে পুনরায় দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি শুরু করবে। তেহরানে পেট্রোনাসের অফিস অবরোধ উঠে গেলে পুনরায় সচল হয়ে উঠবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এর আগে ইতালির এনি এস পিএ ও ফ্রান্সের টোটাল এস এ একই ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ইতালি ও ফ্রান্স তেল প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করার জন্য অপেক্ষা করছে।
এর পাশাপাশি ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ বাখের নওবখ্ত গত সপ্তাহে জানান, ইউরোপের একটি প্রতিষ্ঠান দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়াও অতিরিক্ত একটি বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে দেশটি। গত অক্টোবরে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, অবরোধ উঠে গেলে ইরানে বিনিয়োগের ঢেউ আসবে। প্রযুক্তি ও বিনিয়োগে ইরান সবসময় উদার বলে তিনি জানান।
আমেরিকায় ইরানের কার্পেট ও চিংড়ি মাছ রফতানি হয়েছে, যদিও তা পরিমাণে কয়েক লাখ টন মাত্র। আসবাবপত্র, ফুল ও জাফরানও রফতানি হচ্ছে দেশটিতে। আর একই সময়ে আমেরিকা ইরানে রফতানি করছে ৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এরই মধ্যে ইতালির দানিয়েলি ও ফাতা কোম্পানি ইরানে স্টিল খাতে চার বিলিয়ন ইউরোর এক বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। ভারী ইস্পাত ছাড়াও স্পঞ্জ আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম খাতে এ বিনিয়োগ হবে ২৫ বছরের।
ইরানে এধরনের বিনিয়োগ কিংবা বিনিয়োগের প্রস্তাবের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। বরং নজর দেয়া যাক, কীভাবে ইরান এধরনের পথ পরিক্রমা তৈরি করল সেদিকে। একদিকে মাথার ওপর অবরোধ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে একঘরে করে দেয়ার পশ্চিমা নীতি আর ইসরাইলের ইন্ধনে ইরানে আক্রমণের হুমকি কেন পরোয়া করল না দেশটি? কিভাবে সে শক্তি পেল এসব ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোরÑ যা অন্যান্য দেশের জন্য অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠছে?
এজন্য চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে দেশটির রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও চিন্তাবিদদের। এক দশকের বেশি সময় ধরে আলোচনায় তাঁরা জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে ইরান পারমাণবিক বোমা নয়, বরং এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে শান্তিপূর্ণ কাজে এবং অন্য যে কোনো দেশের মত ইরানের সে অধিকার আছে। এ তো গেল আলোচনার টেবিল। এর বাইরে ইরান বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজেছে। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। এসব বিষয় ইরানকে সমঝোতা ও দরকষাকষিতে শক্তি যুগিয়েছে। এধরনের লড়াই ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত নিজেদের তেল-সম্পদ ও মেধা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কখনো বন্ধক রাখতে চায়নি ইরান। রাজা-বাদশাহদের মত বংশ পরিক্রমায় যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে না ধরে একটা মেধা ও মননের শাসনব্যবস্থা ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ তৈরিতে অনেক দূর এগিয়েছে ইরান।
লক্ষ্য করুন, এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কীভাবে ইরান নিজেকে উপস্থাপন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ জুলাই ভিয়েনায় সফলতা পেয়েছে দেশটি। ইরাকের কূটনীতিকরা বাড়ি ফিরেছেন বিজয়ীর বেশে। নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকা ও ইসরাইল ইরানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বলে যে প্রচারণা শুরু করে তা বিফল করে দিয়েছেন ইরানের কূটনীতিকরা। টানা ১৫ বছর ধরে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করেছেন পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিদের। প্রেসিডেন্ট বুশ ইরানকে সন্ত্রাসীর তকমা দিয়ে ‘এক্সিস অব ইভিল’ বলেছিলেন, এখন ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া পরিস্থিতিতে প্রমাণ হয়ে গেছে কারা আসল সন্ত্রাসী। প্রেসিডেন্ট বুশের পিতা সিনিয়র বুশ তাঁর ভিয়েনা আলোচনায় ইরানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার আগে যে ১৫৯ পাতার শর্ত রচিত হয়েছে তা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে পর্যালোচনা করবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। এরই মধ্যে এডওয়ার্ড ¯েœাডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন আর তার মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, আমেরিকা মিডিয়া, অর্থনীতি ও জাতিসংঘকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বকে খেয়াল খুশি মত পরিচালনা করে থাকে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যে সব দলিল ফাঁস করে দিয়েছেন তাতে এসব বিষয় আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জীবনে অনেকে কত উপন্যাসই পড়ে থাকেন। কিন্তু ইরান যে ১৫ বছর ধরে দরকষাকষি করল তার ব্যাখ্যা বা বিবৃতি কিংবা ধরন, এ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো উপন্যাস, চলচ্চিত্র বের হলে তা হবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিক থেকে খুবই চিত্তাকর্ষক। আর তা রচনা করেছেন ইরানের কূটনীতিকরা। তবে এজন্যে যদি পশ্চিমা মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেন তাহলে কিছুই টের পাবেন না।
বরং ইরানের কূটনীতিকরা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূ-রাজনৈতিক যুগের সূচনা করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ও ধারাবাহিক সংলাপের মধ্য দিয়ে এ যুগের সূচনা হয়েছে। যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে, আগামী বছর শুরু হবার আগেই ইরানে পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগ ¯্রােত একটা ঘূর্ণায়মান পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। কারণ, এতদিন এ বিনিয়োগের ¯্রােতকে আটকে রাখা হয়েছিল বাঁধে পানি আটকানোর মত করে। কারণ, অবরোধের পর দীর্ঘদিন ধরে এধরনের বিনিয়োগ ইরানে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। মনে রাখতে হবে অবরোধ চাপিয়ে দেয়ার আগে ইরান ৪০ ভাগ তেল রফতানি করত ইউরোপে। তেলনির্ভর শিল্পগুলো চালাতে বিকল্প পথে জ্বালানি সংগ্রহ করতে হয়েছে, কখনো তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে শিল্পব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপে যে মন্দা রয়েছে তাতে এ অবরোধ কিন্তু একটা ভূমিকা রেখেছে। এ কারণেই ইরানের সঙ্গে ফের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে তামাম বিশ্ব। ইরান বর্তমানে পূর্ব এশিয়ায় দশ লাখ টন তেল রফতানির বাজারকে সুসংহত করে নজর দিতে শুরু করবে অবরোধে তার হারিয়ে যাওয়া বাজারের দিকে।
পারমাণবিক গবেষণা বা অবরোধ নিয়ে ইরান যে আলোচনার পথ তৈরি করেছে তা যে কোনো আন্তর্জাতিক সংকট নিরসনে একটি বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি ইসরাইল গুপ্তচর পাঠিয়ে ইরানে পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করার পরও ইরান আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ায়নি।
আলোচনার চেয়ে সামরিক আগ্রাসন কখনো বিশ্বশান্তি আনতে পারে না তা প্রমাণ হয়েছে কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। এজন্য ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে লাল টেলিফোনের ভূমিকা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বরং আমেরিকা এ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
তবে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে ইরানের সঙ্গে বছরের পর বছর যে দরকষাকষি হয়েছে তাতে ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের মত দেশ ও ইউরোপিও ইউনিয়ন গঠনমূলক যুক্তিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ভিয়েনা চুক্তির ফলে এসব দেশ ইরানে বিনিয়োগ থেকে এখন লাভবান হবে। এজন্য ইরানে বিনিয়োগে দেশগুলো এত আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভারশীলতা কমিয়ে ইরান থেকে জ্বালানি সংগ্রহে সহজে মনোযোগী হতে চায় ইউরোপ। তাই বিপি, টোটালের মত দেশগুলো বিনিয়োগ প্রস্তাব দিতে শুরু করেছে ইরানকে।
তবে ইরানের এ দীর্ঘ আলোচনায় আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মত সক্রিয় ছিল না রাশিয়া। ইরানের মত রাশিয়াও এখন অপেক্ষা করছে কখন অবরোধ পুরোপুরি উঠে যাবে। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়া ইরানের সামরিক খাতে সহায়তা দিতে চুক্তি করেছে। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয় ভূকৌশলগত স্বার্থে সিরিয়ার ব্যাপারে ইরান ও রাশিয়া একই অবস্থান নিয়েছে। তাই অবরোধ প্রত্যাহার হলে সামরিক ও অর্থনৈতিক বিশেষ করে জ্বালানি খাতে বিশাল বিনিয়োগ করার জন্যই রাশিয়া উন্মুখ হয়ে আছে। বরং বলা যায় ইউরোপের তেলগ্যাস কোম্পানির সঙ্গে রাশিয়ার রসনেফট ও গ্যাজপ্রম পাল্লা দিয়ে ইরানে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে।
ইরানের ধীরে চল নীতি ও আঘাত না আসা পর্যন্ত দ্রুত শত্রুকে মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলেই দেশটিকে ইরাক, লিবিয়া বা সিরিয়ার মত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।
আজকাল মিশেল ফুকোর মত অনেক বুদ্ধিজীবী বলছেন, জ্ঞানই আসল শক্তি। কিন্তু তারও আগে অন্তত আটটি সভ্যতার সংমিশ্রণের দেশ ইরানের অনেক বুদ্ধিজীবী বলেছেন, জ্ঞানই আসল শক্তি। সেই শক্তির আরাধনা করছে ইরান। ইরানের ধর্মীয় নেতা আগেই বলেছেন, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ধ্বংসযজ্ঞের পথে তাঁর দেশ ইসলামের কারণেই কখনো যেতে পারে না, যাবে না।
ইরানের সঙ্গে ভিয়েনা চুক্তিকে কম সফলতা হিসেবে বর্ণনা করেননি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। কৌশলগতভাবে ভিয়েনা চুক্তির লাভ ইরান ছাড়াও এ প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত সবগুলো দেশ নিতে চাইবে। ওয়াশিংটন উল্লসিত এ চুক্তি নিয়ে আর তেহরান নাছোর বান্দার মত ভিয়েনা চুক্তি করেই ছেড়েছে। এজন্য উভয়পক্ষকে অনেক ছাড় দিতে হয়েছে, শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। আর পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যে একটা বিরাট ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে এই ভিয়েনা চুক্তি। এর ফলে ইরাক দখল করার পর ওই অঞ্চলে যে একতরফা সামরিক আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল তা এখন সংকুচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইরানের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশ ভালই ওয়াকিবহাল যে, ইসরাইল তাদের দোসরদের নিয়ে সুযোগ পেলে ইরানের ওপর হামলা করতে বা সহায়তা দিতে কোনোভাবেই পিছপা হবে না। তবে ইরানি নেতৃবৃন্দ সে ধরনের সুযোগ না দেয়ার প্রজ্ঞা রাখেন। চিন্তা, মতানৈক্য কিংবা মতভেদ কিভাবে আলোচনার টেবিলে ঘুরপাক খায় এবং সেখান থেকে কিভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থে দরকষাকষি করে নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা ইতিমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছেন ইরানিরা।
*লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক