শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরানের সমকালীন কবি পারভীন এ’তেসামী ও তাঁর কাব্যে মানবতা

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৩, ২০২০ 

অধ্যাপক ড. মো. নূরুল হুদা –

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরানে যে সকল কবি ও সাহিত্যিক ফারসি ভাষা ও সাহিত্যকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়েছেন তাঁদের অন্যতম মহিলা কবি ছিলেন পাভীন এ’তেসামী। তাঁর কবিতায় মানব জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে মানুষের জীবন যাত্রা ও সামাজিক ব্যবস্থার সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করে বঞ্চিত, অভাবী, মেহনতী ও দুঃখী মানুষের হৃদয়ের ব্যথাগুলোকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পারভীন এমন এক সমাজ চেয়েছিলেন যে সমাজে থাকবে না কোনো দারিদ্র, বঞ্চনা, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্য, মিথ্যা ও প্রতারণা। তিনি সমাজের নারী-পুরুষের মর্যাদা ও অধিকার নিয়েও কথা বলেছেন।
পারভীন এ’তেসামী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ ইরানের তাবরিয শহরে এক বিত্তবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইউসুফ এ’তেসামী সমসাময়িক কালের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত লোক ছিলেন। তিনি ‘বাহার’ নামক ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন এবং এক সময় ইরানের কালচারাল কমিশনের সদস্য ছিলেন। শৈশব কালেই মাতা বানু আখতার মৃত্যুবরণ করলে পিতা নিজ হাতে তাঁকে গড়ে তোলেন এবং জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের অলংকারে সজ্জিত করেন। মাত্র আট বছর বয়সে পারভীন কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন। আধুনিক শিক্ষা লাভের জন্য পারভীন তেহরানে অবস্থিত American Girl’s School and College -এ ভর্তি হন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে একই কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে পারভীন কলেজ জীবন সমাপ্ত করেন। 
পারভীন কলেজ জীবন থেকে বিদায় উপলক্ষে نهال آرزو” ” নামে একটি সুন্দর কবিতা লিখেন এবং বিদায় অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন, যা সকলের প্রশংসা কুড়ায়। কবিতাটির প্রথম পঙক্তি ছিল এরূপ-  
ای نهال آرزو خوش زی که بار آورده ای
غنچۀ بی باد صبا، گل بی بهار آورده ی .
ওহে আশার চারগাছ সুখী হও; কেননা, তুমি সুফল এনেছ বয়ে,
সমীরণ ছাড়াই কিশলয় আর বিনা বসন্তে এনেছ ফুলের সওগাত।
পারভীন গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভের পর American Girl’s School and College  – এ শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি যৌবন কাল থেকেই কবিতা লিখতেন এবং সাহিত্য আসরে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকের ধারণা ছিল যে, এসব কবিতা পারভীনের লেখা নয়। পত্র-পত্রিকায় যারা পারভীনের কবিতা পাঠ করতেন তাঁরাও পারভীনকে পুরুষ বলে ধারণা করতেন। পারভীন নিজেই এর প্রতিবাদ করে বলেছেন-
مرد پندارند پروین را ، چه برخی زاهل فضل
این معمّا گفته نیکوتر، که پروین مرد نیست .
জ্ঞানীদের একটি দল কি করে পারভীনকে পুরুষ ভাবে,
এ রহস্যের জট খোলাই উত্তম যে পারভীন পুরুষ নয়।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পারভীন আপন চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য জীবন তিন মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে পিতার কাছে তেহরানে ফিরে আসেন এবং কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। বিবাহ বিচ্ছেদের পর এক কবিতায় পারভীন লিখেছেন-
ای گل، تو ز جمعیت گلزار ، چه دیدی
جز سرزنش و بد سری خار، چه دیدی
رفتی به چمن، لیک قفس گشت نصیبت
غیر از قفس، ای مرغ گرفتار، چه دیدی .
হে ফুল তুমি ফুলের আসরে কি দেখেছ?
কাঁটার রুক্ষতা আর ভর্ৎসনা ছাড়া কি দেখেছ?
বাগানে গিয়েছিলে কিন্তু ভাগ্যে জুটেছে খাঁচা
ওহে বন্দিনী পাখি! ফুলবনে গিয়ে খাঁচা ছাড়া কি দেখেছ?
দিওয়ানে পারভীন
মানবতার কবি পারভীনের একমাত্র স্মৃতির স্মারক হিসেবে একটি ‘দিওয়ান’ কাব্য পাওয়া যায়। তাঁর এ দিওয়ান কব্যে কাছিদা, মাসনাবি, কেতয়া ও গজল কবিতা রয়েছে। পারভীনের দিওয়ান কাব্যে ৫০ হাজারের বেশি বয়েত বা দ্বিপদী শ্লোক রয়েছে। পারভীন আধুনিক কবি হওয়া সত্ত্বেও ইরানের পুরাতন কবিদের ন্যায় কবিতা রচনা করেছেন। তবে বিষয়বস্তু হিসেবে আধুনিক কবিদের অনুসরণ করেছেন। তাঁর কবিতার রচনা-পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে ঔধহ জুঢ়শধ বলেছেন- ঝযব পড়সঢ়ড়ংবফ ধপপড়ৎফরহম ঃড় ঃযব ৎঁষবং ড়ভ পষধংংরপধষ ঢ়ড়বঃৎু-ধষনবরঃ রহ ংরসঢ়ষব খধহমঁধমব ড়ভঃবহ পড়হংপরড়ঁংষু রসরঃধঃরহম ঃযব অৎঃ ড়ভ ঃযব অহপরবহঃং.’
পারভীনের কবিতায় মানব সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তাঁর কবিতায় রয়েছে নৈতিক শিক্ষার উপদেশ ও সৎকর্মের অনুপ্রেরণার সমাহার। তিনি মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা কাব্যাকারে ব্যক্ত করেছেন। সমাজে অভাবী, নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও বঞ্চিত মানুষের কথা চিন্তা করতেন এবং তাদের সহযোগিতার জন্য বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাতেন এ জন্য তাঁকে ‘মানবতার কবি’ বলা হয়।
সমাজের ইয়াতীম-দুঃখীর অবস্থা বর্ণনা
মানব সমাজে ইয়াতীম, বঞ্চিত ও গরীবদের যে দুরাবস্থা তা অত্যন্ত দরদের সাথে তুলে ধরেছেন। আমরা তাঁর কবিতায় এমন একটি ইয়াতীম শিশুর দুঃখের কাহিনী দেখতে পাই, যে শিশু দু’মুঠো খাবারের জন্য কাতর ছিল এবং তার পিতার দারিদ্রতার কারণে ঔষধ ও চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। অথচ সমাজের অভিজাত ও বিত্তবানরা তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি। পারভীন এমনি এক অবস্থা তুলে ধরে ‘ بی پدر বা পিতৃহীনতা কবিতা রচনা করেন। পারভীনের ভাষায়-
به سر خاک پدر ، دخترکی
صورت و سینه به ناخن میخست
که نه پیوند و نه مادر دارم
کاش روحم به پدر می پیوست
گریه ام بهرپدر نیست که او
مرد از رنج تهیدستی رست
زان کنم گریه که اندریم بخت
دام بر هر طرف انداخت گسست
شصت سال آفت این دریا دید
هیچ ماهیش نیفتاد به شست
پدرم مرد ز بی داروئی
اندرین کوی، سه داروگر هست
دل مسکینم از این غم بگداخت
که طبیبیش ببالین ننشست
سوی همسایه پی نان رفتم
تا مرا دید، در خانه بست
همه دیدند که افتاده ز پای
لیک روزی نگرفتندش دست
آب دادم بپدر چون نان خواست
دیشب از دیده من آتش جست
هم قبا داشت ثریا هم کفش
دل من بود که ایام شکست
این همه بخل چرا کرد، مگر
من چه می خواستم از گیتی پست ؟
سیم و زار بود ، خدائی گربود
آه از این آدمی دیو پرست.

পিতার কবরের পাশে এক ছোট্ট বালিকা
নখের আঁচড়ে বুক আর মুখ বিক্ষত করছিল।
নাই কোনো আত্মীয়, নাই আমার মা,
হায় আমার প্রাণ যদি বাবার কাছে উড়ে যেত!
আমার কান্না বাবার জন্য নয়, কারণ, তিনি তো
মরে বেঁচে গেছেন অভাবের যন্ত্রণা হতে।
কাঁদছি- কারণ, ভাগ্যের বিশাল সাগরে
যতদিন জাল ফেলেছি ছিঁড়ে গেছে বারে বারে।
তিনি (পিতা) ষাট বছর এই ভাগ্যের সাগরের দুর্বিপাক দেখেছেন,
এর (সাগরের) কোনো মাছই ধরা পড়েনি বড়শিতে।
বাবা আমার মারা গেছেন বিনা ঔষধে, বিনা চিকিৎসায়,
অথচ তিনজন চিকিৎসক আমাদের পাড়ায় ছিল বিদ্যমান,
জানেন কি? আমার হতভাগা হৃদয় কাঁদছে কেন?
অসুস্থ বাবার শিয়রে আসেনি ডাক্তার কোনো।
পড়শির কাছে গিয়েছিলাম আমি রুটির খোঁজে
আমাকে দেখে দুয়ার আটকে দিল অবজ্ঞা করে,
সবাই দেখেছে, তিনি পড়ে আছেন, অসহায় নিরুপায়,
আসেনি কেউ দু’হাত বাড়িয়ে, হয়নি তার সহায়।
রুটি চেয়েছিলেন বাবা, আমি দিয়েছিলাম পানি,
গত রাত ভর জ্বলেছে সেই দুঃখের অগ্নি।
সুরাইয়ার তো জামাও ছিল, তার পায়ে জুতাও ছিল
এই জগতে বঞ্চিত কেবল আমিই, আমার কপাল মন্দ ছিল।
এই সকল কার্পণ্য কেন করল? তবে
আমি হীন ধরণীর কাছে কি চেয়েছি?
খোদার কর্ম যদি করতোÑ স্বর্ণ-রৌপ্যের তো কমতি নাই,
হায়! যদি এই দৈত্য স্বভাবের মানুষ হতে রেহাই পেতাম।

পারভীন এ’তেসামী এমনি ভাবে সমাজের ইয়াতীম শিশুদের বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, কোনো এক ইয়াতীম শিশু তার মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে কেঁদে বলছে কেউ তার প্রতি মনোযোগ দেয় না, তাকে পাড়ার ছেলেরা খেলার সাথি করতে রাজি হয় না। তার ক্লাসের পড়া আর বাড়ির কাজ দেখে না স্কুলের শিক্ষক। কেবল তাকেই ‘রাজা’ বানায় যার গায়ে নতুন জামা থাকে। তার জামার সেলাই দেখে আত্মীয়রা ঠাট্টা করে। তার অশ্রুজল দেখার মত কেউ থাকে না। পারভীন এমনি এক শিশুর মর্মবেদনার করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন এ ভাবেÑ

دی کودکی به دامن مادر گریست زار
کز کودکان کوی، به من کس نظر نداشت
طفلی مرا ز پهلوی خود، بی گناه راند
آن تیر طعنه، زخم، کم از نیشتر نداشت
اطفال را به صحبت من، از چه میل نیست؟
کودک مگر نبود ، کسی کو پدر نداشت؟

গত রাতে এক ছেলে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে
কেঁদে কেঁদে নালিশ করল, মা!
পাড়ার ছেলেরা আমার দিকে তাকায়নি কেউ
আমাকে করেনি তাদের খেলার সাথি।
সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাকে একটি ছেলে তাড়িয়ে দিয়েছে তার পাশ থেকে।
তার ভর্ৎসনা তীর বর্ষার চেয়েও তীক্ষè বিষাক্ত ছিল।
ছেলেরা আমার সাথে কথা বলতে চায় না কেন মা?
তা হলে কি যার বাবা বেঁেচ নাই, ছেলে হিসেবে
গণ্য হওয়ার অধিকার তার নাই?

সমাজে নারীর ভূমিকা
মানব সমাজে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনকারী নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা সম্পর্কে পারভীন তাঁর কবিতার মধ্যে বিভিন্ন ভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি নারীদের মর্যাদা সম্পর্কে সর্র্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। তিনি ছিলেন ইরানে নারী জাগরণের অগ্রদূত। সমাজে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বহু কবিতা লিখেছেন। তবে তাঁর একটি সুন্দর ও মনোজ্ঞ কবিতার নাম হলো- فرشتۀ انس বা ‘মায়ার ফেরেশতা। এ কবিতায় পারভীন নারীকে এমন এক ফেরেশতা হিসেবে কল্পনা করেছেন, যাকে জড়িয়ে আছে সংসারের সকল মায়া-মমতা। যাদের কোলে লালিত পালিত হয়েছেন ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় সকল পয়গাম্বর, মনীষী, আলেম ও মহামানব। পারিবারিক জীবনে মায়ের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি নারীকে কল্পনা করেন এক জাহাজ রূপে, যার কাপ্তান পুরুষ। সংসার সমুদ্রে জাহাজ যখন মজবুত এবং কাপ্তান বিজ্ঞ হয় তখন কোনো ঝড়-ঝাপটা ও দুর্বিপাকের ভয় থাকে না। পারভীনের ভাষায়Ñ

در آن سرای که زن نیست، انس و شفقت نیست
در آن وجود که دل مرد، مرده است روان
به هیچ مبحث و دیباچه ای، قضا ننوشت
برای مرد کمال و برای زن نقصان
اگر فلاطون و سقراط، بوده اند بزرگ
بزرگ بوده پرستار خردی ایشان
به گاهواره ی مادر، به کودکی بس خفت
سپس به مکتب حکمت، حکیم شد لقمان
وظیفه ی زن و مرد ، ای حکیم، دانی چیست؟
یکیست کشتی و آن دیگریست کشتیبان
چو ناخداست خردمند و کشتیش محکم
دگر چه باک به ز امواج و ورطه و طوفان

যে ঘরে নারী নাই, সেখানে প্রেম-মায়ার চিহ্ন নাই ‎
যে দেহে মনের মৃত্যু হয়েছে, সে তো নিসাড় নিষ্প্রাণ।
কোথাও, কোনো ভূমিকায় ভাগ্যলিপি এমন কথা লিখেনি।
পুরুষের জন্য সকল পূর্ণতা আর নারীর ভাগে ত্রুটি ও অপূর্ণতা।
প্লেটো-সক্রেটিস যদি মহান ছিলেন, শৈশবে তাঁদের
লালন পালন করেছে যে সেইতো মহান নির্দ্ধিধায়।
মায়ের দোলনায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটি শিশু
জ্ঞান মনীষার পাঠশালায় পড়ে হয়েছেন লোকমান হেকীম।
ওহে জ্ঞানী! জান কি নারী পুরুষের দায়িত্ব কী?
একজন হলো জাহাজ আর একজন কাপ্তান।
কাপ্তান যদি বিজ্ঞ হয় আর জাহাজ মজবুত
তুফান, তরঙ্গের শংকা কিসের? তুমি নির্ভয়।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারী শিক্ষার গুরুত্ব আরোপ
পারভীনের সমসাময়িক কালে ইরানে নারীরা ছিল অবহেলিত। তাদের শিক্ষা-দীক্ষার কোনো উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজমান ছিল না। এমনকি সামাজিকভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি পর্যন্ত ছিল না। পারভীন সামাজিক ভাবে নারীদেরকে পুরুষের পাশাপাশি সম্মানজনক অংশগ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন। কেননা, সমাজের অর্ধেক জনশক্তি নারী জাতিকে উপেক্ষা করে সুশৃঙ্খল ও সুখী সমাজ তৈরি করা সম্ভব নয়। এ সত্যকে তিনি লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পারভীন তৎকালীন নারীদের অবস্থা তুলে ধরেন এ ভাবেÑ

زن در ایران، پیش از این گویی که ایرانی نبود
پیشه اش،جز تیره روزی و پریشانی نبود
زندگی ومرگش اندر کنج عزلت می گذشت
زن چه بود آن روزها، گر ز آنکه زندانی نبود

ইতঃপূর্বে ইরানের নারী ছিল না ইরানি
অন্ধকার জীবন আর পেরেশানি ছাড়া কিছুই ছিল না তাদের।
তাদের জীবন ও মৃত্যু জনবিচ্ছিন্ন নিবাসে অতিবাহিত হতো
বন্দিশালায় না থেকেও তারা স্বাধীন ছিল না।
পারভীন নারীদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তাঁর কবিতায় বিশেষ ভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নারীদেরকে শিক্ষার প্রতি উৎসাহিতও করেছেন। এ সম্পর্কে পারভীন বলেছেনÑ

پستی نسوان ایران، جمله از بی دانشی است
مرد یا زن ، برتری و رتبت از دانستان است
به که هر دختر بداند قدر علم آموختن
تا نگوید کس، پسر هشیار و دختر کودن است

ইরানের নারীদের হীনমন্যতা, সম্পূর্ণ জ্ঞানহীনতার কারণ
পুরুষ অথবা নারীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা জ্ঞানেরই অবদান
যদি প্রতিটি মেয়ে জ্ঞান শিক্ষার মর্যাদা জানত
তবে কেউ বলত না যে, পুরুষ বুদ্ধিমান ও নারী বোকা।

পারভীনের কবিতায় সত্যের আহ্বান
পারভীন ছিলেন একজন সত্য ও ন্যায়পরায়ণ কবি। সমাজে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর কবিতায় সত্যের আহ্বান এবং মিথ্যা পরিহারের উপদেশ বাণী রয়েছে। তিনি সত্য কথাই নির্ভয়ে তুলে ধরেছেন। কেননা, মহানবী (সা.) বলেছেন- قولوا الحق ولوکانا مرا অর্থাৎ তোমরা সত্য কথা বলে যাও, যদিও তা তিক্ত।’ পারভীনও মহানবির হাদিসের অনুসরণ করে বলেছেনÑ
حقیقت گوئی شو پروین چه ترسی
نشاید بهر باطل حق نهفتن
সত্যভাষী হও পারভীন, কিসের ভয়? মিথ্যার কারণে সত্য গোপন করা উচিত নয়।
পারভীনের ভাষায় সত্যবাদী মানুষকে সাহসী হতে হবে এবং সময় মতই কথা বলতে হবে। কেননা, কথার তরবারি কিছুতেই খাপবদ্ধ করতে নেই। পারভীনের ভাষায়Ñ
وقت سخن مترس و بگو آنچه گفتنی است
شمشیر روز معرکه زشت است در نیام

কথার সময় ভয় পেও না, যা বলার বলে যাও,
যুদ্ধের দিনে তরবারি খাপে আবদ্ধ থাকবে, এটাতো খুবই ঘৃণ্য।

পারভীনের কবিতায় নৈতিক শিক্ষা
পারভীন তাঁর কাব্য-চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে বিধবা, দরিদ্র, ইয়াতীম, শ্রমিক প্রভৃতি চরিত্র ছাড়াও বস্তুজগৎ ও জীবজগতের বিভিন্ন দৃশ্যেরও চিত্র অংকন করেছেন। কবিতার আঙ্গিকে যা তাঁর চিন্তাশক্তি ও প্রতিভার প্রখরতার পরিচয় বহন করে। এসব রূপকল্পের আদলেই তিনি মানব জীবনের জন্য অবশ্যকীয় নৈতিক ও সাহিত্যিক বিষয়াদি চয়ন করেছেন। পারভীন নেকড়ে ও কুকুরের সংলাপের মাধ্যমে যে দৃশ্যের চিত্রপট এঁেকছেন তাতে নেকড়ে মেষপালের রক্ষক কুকুরের কাছে একটি মেষ দানের ফরমায়েশ দেয়। কুকুর সে আদেশ তামিল করতে রাজি হয় না। কুকুরের ভাষ্য, আমি আমার মনিবের স্বার্থের হেফাজতকারী, রক্ষক ও জিম্মাদার। কুকুর কিছুৃতেই মনিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। পারভীনের ভাষায়-
پیام داد ساگ گله را، شب گرگی
که صبحم برّه بفرست، میهمان دارم
مرا بخشم میاور، که گرگ بدخشم است
درون تیره و دندان خون فشان دارم
جواب داد مرا باتو آشنایی نیست
که رهزنی تو و من نام پاسبان دارم

এক রাতে এক নেকড়ে ফরমায়েশ পাঠালো, মেষ পালের কুকুরের কাছে;
প্রত্যুষেই একটি ছাগ পাঠিয়ে দিবে আমার ঘরে, মেহমান আছে।
আমার রাগ জাগাবে না, জান যে, নেকড়ে ভীষণ রাগী।
কলিজাটা নিরেট কালো, রক্ত চোষা দ- নখরে দাগী
জবাব দিল (কুকুর), তোমার সাথে আমার কোনো পরিচয় নাই,
তুমিতো ডাকাত, আর আমার পরিচয় ‘রক্ষক’ তাই।

গরীব-দুঃখীদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন
পারভীন সমাজের গরীব, দুঃখী, অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। মোমবাতি নিজে দগ্ধ হয়ে অপরকে যেমন আলো দান করে, তেমনি গরীব-দুঃখীর উপকারের জন্য সমাজের সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। পারভীনের ভাষায়Ñ
سوختن بگداختن چون شمع و بزم افروختن
تن بیاد روی جانان اندر آذر داشتن

মোমবাতির ন্যায় দগ্ধ হয়ে গলে গিয়ে সভাকে আলোকিত কর
শরীর থেকে অন্তরের কষ্ট বের করে দাও।

অর্থ-সম্পদে দাম্ভিক ও সত্যবিমুখ লোকদের প্রতি হুঁশিয়ারি
সমকালীন কবি পারভীন এ’তেসামী পার্থিব ধন-সম্পদ ও ভোগবিলাসের প্রতি বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট ছিলেন না। এমনকি অর্থের মোহে কোনো রাজা-বাদশাহর প্রশংসায় কোনো কবিতা বা কাছিদা রচনা করেন নি। বরং তিনি সমাজের বিত্তবান ও সত্যবিমুখ লোকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, মুত্যুর পর কবরে পার্থিব ধন-সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। সেখানে সকলেই দরিদ্র-মিসকীন। পারভীনের রচিত একটি গজল কবিতা তাঁর কবরে খোদাই করে লিখে দেওয়া হয়েছে, তাতে অর্থ-সম্পদে দাম্ভিক ও সত্যবিমুখ লোকদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে নিজের জীবনের তিক্ততার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। পারভীন বলেছেনÑ
این که خاک سیهش بالین است
اختر چرخ ادب پروین است
گرچه جز تلخی از ایام ندید
هرچه خواهی سخنش شیرین است
صاحب آن همه گفتار امروز
سائل فاتحه و یاسین است

এই কালো মৃত্তিকা আজ যার বিছানা-ঠিকানা
সাহিত্যাকাশের নক্ষত্র, সে সপ্তর্ষি।
ভাগ্যে যদিও জোটেনি সংসারের তিক্ততা ছাড়া তার
যতই দেখবে তার কথায় পাবে মধু অপার।
এত সব কথার শিল্পী যিনি, তিনি তো আজ
সূরা ফাতেহা ও ইয়াসীনের বড় কাঙ্গাল।

জ্ঞান অর্জন এবং বিপদে শক্ত থাকার উপদেশ
আদর্শ মানুষ গঠনের জন্য পারভীন প্রথমেই জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং বিপদের সময় যেন মনোবল হারিয়ে না ফেলে সে সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে বলেছেনÑ
در دهّ ویران دل، اقلیم دانش ساختن
در ره سیل قضا ، بنیاد و بنیان داشتن

অন্তরের ধ্বংস পুরীতে, জ্ঞানের মহাদেশ তৈরি কর
অপ্রত্যাশিত বন্যার (বিপদের) পথে, ভিত্তি ও কাঠামোকে শক্ত রাখ।

অপর এক কবিতায় পারভীন বলেছেনÑ
روشنی دادن دل تاریک را با نور علم
در دل شب ، پرتو خورشید رخشان داشتن
অন্ধকার অন্তর জ্ঞানের আলো দ্বারা আলোকিত কর
অন্ধকার অন্তরকে সূর্যের কিরণ দ্বারা উজ্জ্বল রাখ।

মানুষের জীবন কর্মময় করার জন্য পিপীলিকা ও মাছির থেকে শিক্ষা নেওয়ার উপদেশ
পারভীন মানুষের জীবন কর্মময় করার জন্য সামান্য পিপীলিকা ও মাছির থেকে শিক্ষা নেওয়ার উপদেশ দিয়েছেন।
পিপীলিকা সর্বদা পরিশ্রম করে নিজের খাদ্য যোগাড় করে আর মাছি খাদ্যের খোঁজে মাথায় হাত রেখে সারা জীবন ঘুরে বেড়ায়। আর্থাৎ তারা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যায়, মানুষকেও অনুরূপ পরিশ্রমী ও কর্মময় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পারভীনের ভাষায়Ñ
همچو مور اندر ره همت همی پا کوفتن
چون مگس همواره دست شوق بر سر داشتن
যেমনটি পিপীলিকা প্রচেষ্টার পথে নিজের পাকে গুড়িয়ে দেয়
অনুরূপ মাছি সর্বদা বাসনার হাত মাথায় রেখে উড়ে বেড়ায়।

পার্থিব সমাজে সম্মান পেতে হলে নিজেকে ছোট ভাবার উপদেশ
সমাজে সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা লাভের জন্য পারভীন উপদেশ প্রদান করে বলেছেন, যদি সম্মান লাভ করতে হয় তবে নিজেকে ছোট হতে হবে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে’, কবি পারভীন একথারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেনÑ
سربلندی خواستن در عین پستی ، ذرّه وار
آرزوی صحبت خورشید رخشان داشتن

যদি হীন মন্য চোখে সম্মান চাও তবে ছোট হও
সূর্যের সাহচর্যের আশায় বা আকাক্সক্ষায় উজ্জ্বল থাক।

এই মানবতার কবি পারভীন এ’তেসামী মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। তাই তিনি আমাদের জন্য উপদেশ বাণী রেখে গেছেনÑ
از تکلّف دور گشتن، ساده و خوش زیستن
দুঃখ-কষ্টকে দূরে রাখ, সাধারণ ও খুশি মনে বেঁচে থাক।

সমকালীন দার্শনিক, নৈতিক ও মানবতার কবি পারভীন এ’তেসামীর এই অমূল্য বাণী আমাদের জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে। ইরানের এই মহান মহিলা কবি পারভীনসহ সা’দী, রুমী, হাফিজ, খৈয়াম ও আত্তারের কাব্যদর্শন, আধ্যাত্মিক দর্শন, জীবনদর্শন, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ যদি মানব সমাজে উপস্থাপন করা যায়, তবেই মানব সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। আর তাই ইরানের কবি আব্বাস ইয়ামীনী শরীফের সঙ্গে একাত্ম বলতে চাইÑ
دست در دست هم دهیم به مهر
باغ فارسی را کنیم آباد
یار و غمخوار یکدیگر باشیم
تا بمانیم در این جهان خرّم و شاد

আমরা যদি বন্ধুত্বের সাথে হাতে হাত রাখি,
আর যদি ফারসির এই বাগানকে (ফারসি সাহিত্যকে) আবাদ করি,
একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথি হই,
তবেই এই পৃথিবীতে শান্তিতে থাকতে পারব।

লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী শ্বিবিদ্যালয়।
তথ্য নির্দেশ