ইরানের শান্তির শহর মাশহাদ সফরে পাবেন পবিত্র এক অনুভূতি
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ১২, ২০২৩
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2023/11/Mashad-1.jpg)
সিরাজুল ইসলাম : মাশহাদ শহরটিতে পা রাখলেই সারা দেহমনে একটা প্রশান্তির আভা ছড়িয়ে পড়বে। মনের মধ্যে আলাদা রকমের কিছু পবিত্র অনুভূতি খেলা করবে। আপনার দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করে যে কথাটি বার বার দোলা দেবে তাহলো- এখানে শুয়ে রয়েছেন নবী বংশের অষ্টম পুরুষ ইমাম রেজা। যদি আপনি শহরটি ঘুরে দেখতে যান তবে সেখানে পৌঁছানো মাত্রই আপনার মন উতালা হবে- কখন দেখবেন সেই মাজার যেখান শুয়ে আছেন মহান এই ইমাম! আপনি এই মহান ইমামের মাজার জিয়ারত না করে যেন সুস্থির হতেই পারবেন না।
হ্যা, বলছি ইরানের মাশহাদ শহরের কথা। শহরটিতে পা রাখলে মনে হবে এ যেন শান্তির শহর। সত্যি সত্যিই কেউ যদি নগর সভ্যতার মাঝেই দুদণ্ড শান্তি পেতে চান তবে তিনি নির্দ্বিধায় মাশহাদ শহর ঘুরে দেখতে পারেন। একথাও ঠিক যে, মাশহাদ শহরে গেলে শুধু আপনি মহান ইমামের মাজারের সঙ্গে পরিচিত হবেন না, বরং আরো বহু বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মস্থান ও মাজার দেখতে পাবেন। আপনার ঝুলিতে জমা হবে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা।
জনসংখ্যার দিক থেকে ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হচ্ছে মাশহাদ। এটি খোরাসান রাজাভী প্রদেশের রাজধানী। এর অবস্থান আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সীমান্ত এলাকায়। মাশহাদ শহরে গেলে আপনার মনে এই অনুভূতি আসা বিচিত্র নয় যে, আপনি আরো দুটি দেশের একদম সীমান্তে অবস্থান করছেন!
ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে মাশহাদ যাওয়ার জন্য বাস, ট্রেন ও বিমানের ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি ইচ্ছা করলে এর যেকোনো একটি ব্যবস্থা বেছে নিতে পারেন। তবে তেহরান থেকে মাশহাদের দূরত্ব যেহেতু প্রায় ১২০০ কিলোমিটার, সে কারণে ভ্রমণটিকে আরামদায়ক ও মধুময় করে তুলতে আপনি ট্রেনকেই বেছে নিতে পারেন। জানালার পাশে বসে আপনি উপভোগ করতে পারবেন নির্জন মরুভূমির রহস্যময় নীরবতা, বহুদূরে মিশে যাওয়া সীমান্তরেখা, কোথাও দু চারটি ফলের বাগান কিংবা হৃদয়কাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী সবুজ বুননের ফসলের ক্ষেত।
বাসে গেলে ক্লান্তি ভর করবে বড্ড বেশি। বাসযাত্রায় তেহরান থেকে মাশহাদ পৌঁছতে সময় লাগবে ১২/১৩ ঘণ্টা। আপনি যদি বড় বেশি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হন তবে বাসযাত্রাকেও বেছে নিতে পারেন। সুদীর্ঘ যাত্রাপথের বিরাট অংশ হবে অনেক বেশি জনমানবহীন, কোথাও কোথাও একেবারেই থাকবে না কোনো জনবসতি! শুধু কতিপয় বিদ্যুতের লাইন আপনাকে জানান দেবে মানব বসতির কথা।
তেহরান থেকে মাশহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে মনের মধ্যে আলাদা এক অনুভূতি জাগবে। বার বার আপনার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে চাইবে মাশহাদ শহর, ইমাম রেজার মাজার, নিশাবুরের ফিরোজা পাথর, ভুবন বিখ্যাত জাফরান, বিশ্বখ্যাত ফারসি কবি, দার্শনিক ও সুফিবাদের প্রবক্তা ফরিদ উদ্দনি আত্তার, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং কবি ওমর খৈয়ামের মাজার। মাশহাদ সফরে গিয়ে আপনি আরো পাবেন শেখ বাহায়ী, শেখ হুররে আমেলী, শেখ তাবারসী, নাদির শাহের মাযার। এখানকার কুহে সাদী পার্ক খুবই বিখ্যাত। পার্কে সাদী কমপ্লেক্সে রয়েছে চিড়িয়াখানা, রয়েছে নানারকম বন্য প্রাণী যা হতে পারে বাড়তি আকর্ষণ। মাশহাদ শহরের ৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে খাজা মুরাদ ও খাজা রাবীর মাজার। এছাড়া সাফাভি আমলের ক্যালিগ্রাফার রেযা আব্বাসী এবং খাজা আবসালাতের মাজারও রয়েছে যা মাশহাদ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২৪ কিলোমিটার দূরে তূসে রয়েছে ‘শাহনামা’র কবি ফেরদৌসীর মাযার। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শাহ পাবলিক গোসলখানা রয়েছে মাশহাদে যা অসাধারণ নির্মাণশৈলীতে পূর্ণ। অবশ্য, বর্তমানে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে প্রোমা হাইপার মার্কেট, কিয়ান সেন্টার, মাশহাদের মালেক হাউজ, সেন্ট মেসরোপ আর্মেনিয়ান চার্চ, নাদির শাহ মিউজিয়াম, তূস মিউজিয়াম, সানদিজ টুরিস্ট টাউন, ইমাম রেজা হাসপাতাল, হোমা হোটেল প্রভৃতি। এ শহরে কুর্দি ও তুর্কমেনিস্তান জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এখানে আছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরাক থেকে আসা অনেক অভিবাসীর বসবাস। ফলে আপনি সহজেই একটা ভিন্ন রকমের মিশ্র সংস্কৃতির সাক্ষাৎ পাবেন।
তেহরান থেকে দীর্ঘপথের যাত্রাটি রাতের বেলায়ই বেশি আরামদায়ক মনে হবে। এতে আপনি সকাল বেলায় মাশহাদ পৌঁছবেন। রওয়ানা হওয়ার পর শাহরে রেই বা রেই শহর পেরিয়ে মাশহাদ যাওয়ার মূল সড়কে ওঠার পর অল্প পথ পাড়ি দিলেই আপনাকে ঘিরে ধরবে পাহাড়। জোছনা রাতে যদি আপনি সফর করেন তবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখবেন দূর আকাশের চাঁদ আপনার সঙ্গী হয়েছে। চাঁদের জোছনা যেন চারদিকে ঠিকরে পড়বে। কোথাও কোথাও মনে হবে এই পাহাড়ের ওপরেই চাঁদ, যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে! এভাবে চাঁদকে সঙ্গী করে আপনার যাত্রা এগিয়ে যাবে মাশহাদ শহরের দিকে। রাতে কয়েকবার যাত্রাবিরতি পাবেন। পথে পথে থাকবে চা কিংবা হাল্কা খাবারের ব্যবস্থা।
রাতের শেষে ভোরের আলো ফুটলে পাবেন ভিন্ন চিত্র। যতদূর চোখ যাবে দেখবেন শুধু বিজাবন। ধু ধু মরুভূমি। দূরে যেখানে গিয়ে দৃষ্টি আটকে যায় সেখানে পাহাড়ের সারি। কোথাও কোথাও দৃষ্টিসীমা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু কোনোকিছুর দেখা মেলে না। এর মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেছে বিদ্যুতের লাইন। সেই বিজাবনের মাঝে বিদ্যুতের লাইনই যেন মানব সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। হঠাৎ করে কোথাও হয়ত কিছু গাছপালা দেখা যাবে তবে তা মুর্হূতেই চলে যাবে আপনার দৃষ্টির বাইরে।
এমনিভাবে পাহাড়, মরুভূমি আর নির্জন রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছানো যাবে মাশহাদ শহরে। শহরে পৌঁছে আপনার চাহিদা ও সামর্থ্যমতো হোটেল ভাড়া করতে পারবেন। এসবের জন্য সহজ ব্যবস্থা রয়েছে। যাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে নাস্তা সেরে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন অথবা ইমাম রেজার মাজারে ছুটে যেতে পারেন। মাজার নিয়ে আপনি যাই কল্পনা করুন না কেন, বাস্তবে দেখে বিস্মিত-অভিভূত হবেন নিশ্চয়। হয়ত আপনি ধারণাই করতে পারবেন না মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্স এত বড় হয়!
ইমাম রেজার মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্সের আয়তন পবিত্র কাবা শরীফ ও মসজিদে নববীর চেয়েও বড়। মোট আয়তন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫৬৭ বর্গমিটার। এর মধ্যে শুধু মাজার এলাকা রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৯ বর্গমিটার জুড়ে। এই বিশাল মাজার কমপ্লেক্সে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। এখানে বিদেশী পর্যটকদের জন্য রয়েছে ইংরেজিভাষী ইরানি গাইড। তাঁরা এ কমপ্লেক্স সংক্রান্ত নানারকম তথ্য দিয়ে পর্যটকদের সাহায্য করেন। জানলে অবাক হবেন যে, ২০১৮ সালে ইরানে বিদেশী পর্যটক এসেছেন ৬০ লাখ এবং তাঁদের কাছে মূল আকর্ষণ ছিল মাশহাদের ইমাম রেজার মাজার। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- আমাদের দেশে মাজারকেন্দ্রিক যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে তার কিছুই এখানে নেই। এখানে নেই কোনো গাঁজার আসর, নেই কোনো উটকো লোকের ঝামেলা। কেউ কুরআন তেলাওয়াত করছেন, কেউ হাদিসগ্রন্থ কিংবা ইসলামি বই পড়ছেন, কেউ নামায কিংবা দোয়ায় মশগুল। কেউবা নিজের খাবার খেয়ে নিচ্ছেন। কোথাও বিজ্ঞ আলেমের ইসলামি আলোচনা শুনছেন শত শত মানুষ।
ইরানের রাজধানী তেহরানের পরেই যেসব শহর গুরুত্বপূর্ণ মাশহাদ তার অন্যতম। দৃষ্টিনন্দন অতুলনীয় এ শহরের কোথাও নেই ময়লা-দুর্গন্ধ, কোথাও নেই ভিক্ষুক, নেই যানজট, গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন। অসম্ভব ছিমছাম শহর। রাস্তাগুলোর পাশ দিয়ে নানা রঙের ফুল যেন শহরের শোভা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেখানে সেখানে পার্ক, ফোয়ারা, গাছপালার সমারোহÑ যেন সবুজে ঘেরা শহর। ট্রাফিক সিস্টেম সচল রাখতে কোথাও কোথাও ফ্লাইওভার রয়েছে; সিগন্যাল বাতির দেখা খুব কম মিলবে। গাড়ি কিংবা হোটেল লবি থেকে তাকালেই চোখে পড়বে পাহাড় আর পাথুরে মাটি। আপনাকে ছুঁয়ে যাবে মাশহাদ শহরের ছিমছাম পরিবেশ। মিসরের বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৩ সালে এ শহর ভ্রমণ করেছিলেন। বিমুগ্ধচিত্তে তিনি মাশহাদকে ফুল-ফল-বৃক্ষ আর নানা রঙের টাইলসে সমৃদ্ধ মাজারের শহর হিসেবে আখ্যা দেন। মাশহাদ সফর করে আপনিও হতে পারেন তাঁরই মতো একজন পর্যটক!
ইরানের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের অনেকেই মাশহাদে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শায়খ তূসী, নাসিরুদ্দীন তূসী, বর্তমান রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী, নিজামুল মূল্ক (সালজুক যুগের প-িত), আল-হুর আল-আমিলী (প্রখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস), ইমাম গাজ্জালী (ইসলামি চিন্তাবিদ), তিমুর শাহ দুররানী, আলী আল-সিসতানী, মোহাম্মাদ কাজেম খোরাসানী, হোসাইন ভালীদ খোরাসানী, আবু মুসলিম খোরাসানী, তেহরানের দীর্ঘদিনের মেয়র মোহাম্মাদ বাকের কলিবাফ, হাদী খোমেইনী, সাইয়্যেদ জালিলী। লেখক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন অরিয়ান গোলমাকানী, ফেরদৌসী, আবু মানসুর দাকীকী, আবুল ফাজল বায়হাকী, আবু সাঈদ আবুল খায়ের, আনওয়ারী, মাহদী আখাবানে সালেস, মোহাম্মাদ তাকী বাহার, আবু জাফর আল কাজীন, জাবির ইবনে হাইহান।
মাশহাদ সফরে গিয়ে আপনি ইরানের আর দশটি শহরের মতোই ‘চেলো কাবাব’ ও ‘বাকেরি কাবাব’ কিংবা ‘জুজে কাবাব’ এর চমৎকার স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন। নানা রকম রুটি, বাটার, পনির, জ্যাম, মধু, দুধ হবে নাস্তার অনুষঙ্গ। ইরানের বিখ্যাত কোরমে সাবজি, জেরেশ্খ পোলু, সাবজি পোলু ব’ মহী (সবজি পোলাও ও মাছ ভাজি) ফেসেনজুন, কাশকে বদেনজুন, মির্জা কাসেমির মতো খাবার আপনি সহজেই পাবেন। ভাত, মাছ-গোশত পাওয়া যায়, তবে অন্য খাবারের তুলনায় দাম একটু বেশি হলেও মোটেই সাধ্যের বাইরে নয়। ভেড়া, দুম্বা, উট ও উট পাখির গোশত পাওয়া এখানে। আপনার মেন্যুতে এসব খাবার যোগ হতে পারে সহজেই। এখানকার আইসক্রিম বেশ জনপ্রিয় ও সুস্বাদু। মাশহাদ শহরের শরীয়তী স্কয়ারের আইসক্রিম খুবই বিখ্যাত। এখানকার আইসক্রিম, চকলেট আর সোহানের স্বাদের কথা ভ্রমণ শেষেও স্মরণে থাকবে বহুদিন।