ইরানের মরুভূমিতে অলৌকিক তুষারস্রোত
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ১১, ২০১৬
আধুনিক ইরান, প্রাচীন পারস্য। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আর বহুমাত্রিক সংস্কৃতির ধারক এই দেশ। ইরানের প্রকৃতিও বৈচিত্র্যময়। নদী, সাগর, পাহাড়, মরুভূমি এবং হিমবাহ এই দেশটির প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এখানেই আছে মরুভূমিতে বরফশীতল পরশ।
জার্দ-কুহ মানে হলুদ পাহাড়। প্রায় সাড়ে বারো হাজার ফুট উঁচু এক পার্বত্য এলাকা। ইরানের বিস্তীর্ণ মরুভূমির পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে এ অঞ্চলের অবস্থান। এই মরুভূমিতেই লুকিয়ে আছে অনেক হিমবাহ।
ইরানে যত পর্যটক আসে, বিশেষ করে ইউরোপীয় পর্যটক তাদের দেখার জন্য আছে প্রচুর পাহাড়-পর্বত । আর এতো পাহাড় – পর্বতের ভিড়ে জার্দ -কুহতে পর্যটকদের খুব একটা যেতে দেখা যায় না। তবে এক ট্যুর অপারেটর বলেন, যারাই এ পর্যন্ত এই জার্দ কুহতে গেছেন তারাই বলেছেন, জার্দ কুহ পরিদর্শন তাদের ইরান সফরকে আলোকিত করেছে।
ইসফাহান পারস্যের প্রাচীন রাজধানী। শহরটি প্রাসাদ ও মসজিদে ভরা। আছে ময়দান ও উদ্যান। ১৭ শতকের পারস্যের প্রতিচ্ছবি এই শহর। যাকে বলা হয় নেসফ-এ-জাহান। অর্থাৎ অর্ধেক দুনিয়া। এই শহর থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরে জার্দ-কুহ। সেখানে বসবাস করে এক যাযাবর জাতি। মরুর বুকে বহমান হিমশৈলের পাশে তাদের তাঁবুর আবাস। এদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বখতিয়ারি জনগোষ্ঠী হিসেবে। ইসফাহান থেকে জার্দ-কুহের অর্ধেক পথ বালুময়। হাওয়া বেশ গরম। এর পর গায়ে লাগে হিমবাহ থেকে বয়ে আসা শীতল বায়ু। বদলে যেতে থাকে ভূমিরূপ। প্রাণহীন মরু-প্রান্তরে সবুজের সমারোহ দেখা দেয়।এই পথেই পড়ে শার-এ কোর্দ। ইরানের ছাদ বলে পরিচিত এ অঞ্চলটি সাগরতল থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচু।
অনেকেই জানেন না ইরানে রয়েছে বরফের পাহাড় আর বিশ্বমানের স্কি-ট্র্যাক। এর মধ্যে বিখ্যাত স্কি-ট্র্যাক হলো আলবোর্জ পর্বতে। তেহরানের উত্তরে, চেলগ্রে গ্রামে। এই গ্রামটি হিমবাহ শুরুর আগের শেষ জনপদ। দেখতে অনেকটা আলপাইন অঞ্চলের গ্রামের মতো। চেলগ্রে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পাথরের গায়ে লেখা দেখা যায়। এর একটিতে লেখা বাবা হাজি রেস্তোরাঁ, এখানে বাচ্চা ভেড়ার কাবাব পাওয়া যায়। আছে মুরগি কাবাব, রুটি, দুধ-দই, গরম পানি। হে প্রিয় পর্যটক আপনাকে স্বাগতম!
চেলগ্রে গ্রাম থেকে নয় কিলোমিটার দূরে শেখ খান ঝরনা। জার্দ-কুহ এলাকায় এমন অজস্র ঝরনা দেখা যায়। এই গ্রামটি সু-উচ্চ নয়। তারপরও মাটির রং শর্ষের মতো। ঝরনার জলে যখন এ মাটির রং প্রতিফলিত হয় তখন এই ছবিকে কোন পরাবাস্তব শিল্প বলে মনে হয়।
এই ঝরনা থেকে সামান্য দূরে যাযাবর বখতিয়ারি জনগোষ্ঠীর বসবাস শুরু। বখতিয়ারিরা ঐতিহাসিকভাবেই পশু পালক ও শিকারি। তারা বুনো ছাগল, নেকড়ে, শিয়াল, খেকশিয়াল, হায়েনা এবং চিতা শিকার করে। আর জার্দ-কুহ এসব প্রাণীর চারণভূমি।
আর এ কারণেই এ অঞ্চলে কমতে থাকে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা। ১৯৭৩ সালের দিকে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকলে এই এলাকাকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। জার্দ-কুহ’র আর একটা নাম আছে। তাং-এ-সাইয়াদ, অর্থাৎ শিকারিদের উপত্যকা।
বখতিয়ারিরা আট মাস কাটায় খুজেস্তান অঞ্চলে। এটি দক্ষিণ ইরানের একটি অঞ্চল। এপ্রিলের শেষ দিকে তারা জার্দ-কুহ অঞ্চলে চলে আসে। প্রচণ্ড গরম থেকে রক্ষা পেতেই তারা এ এলাকায় আসে। খুজেস্তান অঞ্চলে গরমকালে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। জার্দ-কুহ এলাকায় বখতিয়ারিরা থাকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এখানকার পুষ্টিকর সবুজ ঘাস পশুগুলোকে তাজা করতে সহায়তা করে।
বখতিয়ারিদের অভিযাত্রা মসৃণ পথে হয় না। তাদের পার হতে হয় মরুভূমি ও বরফগলা পথ। এখন অবশ্য কেউ কেউ ছোট ট্রাক ব্যবহার করে। তবে বেশিরভাগই ঐতিহ্যের পথে চলতে ভালোবাসে।
শেখ খান ঝরনা থেকে বিশ কিলোমিটার গেলেই পিচঢালা পথ শেষ। শুরু হয় খানা-খন্দকে ভরা ধুলিময় সড়ক। ইরানের গ্রীষ্মকালের বৈপরীত্য টের পাওয়া যায় এ পথে। ইরানের অন্য এলাকা যখন গরমে পড়ে, এখানকার বাতাস তখন চামড়ায় হিম-কামড় দেয়। এখানে আছে চারশ’ কিলোমিটার দীর্ঘ জায়ান্দেরুদ, জীবন্ত নদী। এই নদী উপত্যকাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে। ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘ জলপথ এটি। এই নদী দিয়ে বয়ে যায় হাজার হাজার কিউবিক লিটার বরফগলা পানি। আর প্রশান্ত করে ইসফাহান ও ইয়াজদ-এর মতো শুষ্ক শহরকে। এ জলপ্রবাহের শেষ বখতিয়ারি জনগোষ্ঠীর শীতকালীন বাস খুজেস্তানে।
কাবাব ও কার্পেট ইরানের ঐতিহ্য। নোমাড অর্থাৎ যাযাবর জনগোষ্ঠীর কাবাব ও গালিচা সর্বশ্রেষ্ঠ। এর সঙ্গে আছে যাযাবরদের পোশাক। সবই এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
হিমবাহ এবং বরফের গুহা জার্দ-কুহ’র সম্পত্তি নয়, সম্পদ। হিমশৈলের নিচে লুকানো গুহাগুলো বখতিয়ারি সম্প্রদায়ের প্রাকৃতিক সম্পদ, যাদের বলা হয় বরফের গুহা।