ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম টেলিভিশন বিতর্ক, যা বললেন প্রার্থীরা
পোস্ট হয়েছে: জুন ৮, ২০২১
ইরানের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম টেলিভিশন-বিতর্কে প্রার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ যেসব কথা বলেছেন সেসবের প্রধান কিছু অংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হল:
শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত ইরানের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রথম টেলিভিশন-বিতর্কে অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিচার বিভাগের সাবেক প্রধান ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট দেশের জনগণের সবার ও সব শ্রেণীর জন্য প্রেসিডেন্ট। তাই তাকে সবার সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্যাগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। আমি বিচারবিভাগের জন্য পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলাম ও তা সবার কাছে দেয়া হয়েছে এবং জনগণ তা জানেন। এখন দুই বছর পর জনগণ অনুভব করছে যে একটা কিছু ঘটেছে এবং ভিন্ন ধরনের অবস্থা দেখা দিয়েছে। ১২টি গবেষণা বিভাগ পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে আমাদের সহযোগিতা করছে। জনগণের সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। তিনি ইন্টারনেট সেবার উন্নয়ন এবং গৃহিণীসহ নারী সমাজের অধিকারের উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে আরও বলেছেন, আমরা ‘আমরা পারব’-এই নীতির সহযোগী। রক্ষণশীল হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার ঘোষণা দেয়া (জনমত জরিপ অনুযায়ী জনপ্রিয়তার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা) এই প্রার্থী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নিজের সাফল্যের দিকে ইঙ্গিত করে এ ব্যবস্থার আরও উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি
এর আগে বিচার বিভাগের সাবেক প্রধান জনাব রায়িসি গত রোববার বলেছেন, উৎপাদন, বিয়ে ও গৃহায়ন খাতে ব্যাংকিং বিভাগের নানা সুবিধা যথাযথভাবে বণ্টন করা উচিত। দরিদ্র শ্রেণীর জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা রাখা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। গৃহিণীসহ নানা শ্রেণীর জনগণ যাতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে আয় করতে পারেন তার সরকার সেই ব্যবস্থা করবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।
রায়িসি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেও তার পেছনে রক্ষণশীল বা প্রিন্সিপালিস্ট শিবিরের সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হয়। রায়িসি ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েও ডক্টর হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
একই বিতর্কে আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইরানের সাবেক প্রধান পরমাণু আলোচক ড. সাঈদ জালিলি বলেছেন, আট বছর আগে যেসব ওয়াদা দেয়া হয়েছিল সেসব বাস্তবায়ন হয়নি বরং ওয়াদার উল্টোটাই ঘটেছে। যেমন, বৈদেশিক মুদ্রার দাম কয়েক গুণ বেড়েছে ও নিষেধাজ্ঞাও দ্বিগুণ বেড়েছে। শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট হওয়া মানে কঠোর কথা বলার যোগ্যতা থাকা নয়, সময়মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। রক্ষণশীল এই প্রার্থী শহীদ সুলাইমানির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: জমিনে পানি ছেড়ে দিলেই তা গাছে পৌঁছে না, সেই পানি গাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হয়।
একই বিতর্কে আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাবেক প্রধান ডক্টর মোহসেন রেজায়ি বলেছেন, তিনি যুব-বয়সীদের নিয়ে এক বিপ্লবী সরকার গঠন করতে চান। তিনি ভর্তুকি গ্রহীতাদের জন্য ভর্তুকির অঙ্ক বাড়িয়ে সাড়ে চার লাখ তুমান করবেন ও গৃহিণীদের পেশাজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন ( প্রশিক্ষণ ও বেতন দিবেন) এবং শেয়ার বাজারে অর্থ হারানো ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের চেষ্টা করবেন। এ ছাড়াও তিনি কৃষকদের জন্য বীমা ও সবার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। রক্ষণশীল প্রার্থী রেজায়ি জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য ইসলামী বিপ্লব-পরবর্তী কয়েকটি সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
ইরানের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রথম টেলিভিশন-বিতর্কে অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মাশহাদ ও কালাত এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইয়্যেদ আমির হোসেন কাজিজাদে হাশেমি প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স্ক। আর এদিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, আমাদের যুব সমাজের রয়েছে উচ্চতর আদর্শবাদী লক্ষ্য এবং আমরা সমাজে গভীর পরিবর্তন চাই। তিনি জনগণের প্রতি সরকারগুলোর জবাবদিহিতার রীতি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়ে বলেন, সরকার যেখানে ভুল করে সেখানে জনগণেরও উচিত হুঁশিয়ারি দেয়া। রক্ষণশীল এই প্রার্থী অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে আর্থিক তারল্যের নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, তারল্য এখন শত্তুর হাজার শতাংশ বেড়েছে।
মোহসেন মেহের আলীজাদেহ
একই বিতর্কে আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইরানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইস্ফাহানের সাবেক গভর্নর মোহসেন মেহের আলীজাদে বলেছেন: প্রেসিডেন্ট খাতামির আমলে ইরানে মুদ্রাস্ফীতির হার পঞ্চাশ শতাংশ থেকে কমে দশ শতাংশেরও নীচে নেমে এসেছিল। তিনি সে সময়কার ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও ফলদায়ক বলে প্রশংসা করেন। তিনি তার ভাষায় গত ১৬ বছর ধরে ইরানের লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতিসহ জনগণের অর্থনৈতিক নানা সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য শিক্ষিত ব্যক্তিদের কাজে না লাগানোকে দায়ী করেছেন। সংস্কারবাদী এই প্রার্থী অর্থনীতি ও জনকল্যাণ এবং যৌক্তিক পরিচালনা-ভিত্তিক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত ইরানের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রথম টেলিভিশন-বিতর্কে অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান আব্দুন নাসের হেম্মাতি দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের নানা বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করার পাশাপাশি তার বিষয়ে কয়েকজন প্রার্থীর তীব্র আক্রমণাত্মক সমালোচনার জবাবে বলেছেন, আমি গর্বিত যে ইরানের অর্থনীতিকে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতির মত হতে দেইনি। আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে প্রস্তুত যাতে ইরানের অর্থনীতি উত্তর কোরিয়ার মত না হয়। তিনি আরও বলেছেন, শহীদ সুলাইমানির প্রচেষ্টায় ইরান এ অঞ্চলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও আমাদের প্রথম অবস্থানে থাকা উচিত যা এখনও সম্ভব হয়নি। সঠিক ব্যক্তিকে (তাঁকে) নির্বাচনের মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রথম অবস্থান অর্জনের পথ ধরার আহ্বান জানিয়ে ভোটারদের উদ্দেশে সংস্কারপন্থী প্রার্থী হেম্মাতি বলেন, আপনারা ভোট না দিয়ে নয় বরং ভোট দেয়ার মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানান।
আব্দুন নাসের হেম্মাতি
এর আগে হেম্মাতি ইরানের ওপর বিদেশি নিষেধাজ্ঞাগুলোকে তার দেশের অর্থনীতির জন্য ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা’ বলে উল্লেখ করে গত রোববার বলেছেন, দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হচ্ছে এইসব নিষেধাজ্ঞা যা হঠাৎ করে দেশের বৈদেশিক আয়কে আগের অবস্থা থেকে এক ষষ্ঠাংশ কমিয়ে দিয়েছে। তাই এটা স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর হচ্ছে। যারা একে অস্বীকার করছেন তারা ভুল করছেন।
হেম্মাতি অর্থনৈতিক কোনো কোনো খাতে সরকারের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে বলেন এ ধরনের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা উচিত এবং সরকারের উচিত অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা। অর্থনৈতিক বিষয়ে জনাব হেম্মাতির প্রশিক্ষণ রয়েছে।
কোম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সংসদের গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান আলী রেজা যাকানি অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে গতকাল শনিবারের প্রায় তিন ঘণ্টার ওই বিতর্কে বলেছেন, অতীতের ভুল পথ অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। আমাদের সবাইকে পরিবর্তনের ময়দানে কাজ করতে হবে ও নিজেদের সংশোধন করতে হবে। ওয়াদা না দিয়ে আমাদের বলা উচিত কিভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা যায়। আমাদের রয়েছে এমন সার্বিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি যে আমার সরকারের প্রথম বছরের শেষে জনগণ পরিবর্তন ও চার বছর পর ব্যাপক বা আমূল পরিবর্তন দেখতে পাবে।
রক্ষণশীল এই প্রার্থী বলেন, দুর্নীতি, দারিদ্র ও বৈষম্যর বিরুদ্ধে আমার সংগ্রামই আমার একমাত্র অপরাধ বলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে!
ইরানের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রথম টেলিভিশন-বিতর্ক শুরু হয় শনিবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা থেকে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের এক নম্বর চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ওই বিতর্ক। তিন ঘণ্টার এই বিতর্কে মূলত অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে বক্তব্য ও মতামত রাখেন প্রার্থীরা। প্রার্থীদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে যথাক্রমে আগামী আট ও বারো জুন। ৩ ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠেয় ওই বিতর্কগুলোও একই চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।আগামী ১৮ জুন শুক্রবার দেশটিতে ১৩ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে । পার্সটুডে