‘ইরানের ইসলামী বিপ্লব এ অঞ্চলে ফারসি চর্চাকে পুনরুজ্জীবীত করেছে’ ( ভিডিও)
পোস্ট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২১

ইরানের ইসলামী বিপ্লব এ অঞ্চলে ফারসি চর্চাকে পুনরুজ্জীবীত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইরান বিশেষজ্ঞরা। সোমবার ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী ও নারী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইরানোলজি ফাউন্ডেশন, সাদি ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তরা এ কথা বলেন।
‘‘বাংলাদেশে ইরান পরিচিতির অবস্থান পর্যালোচনা’’ ও ‘‘ইসলামী বিপ্লবের ৪২ তম বিজয় বার্ষিকী’’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘‘ বাংলাদেশে ইরান পরিচিতি বিষয়ক শিক্ষা ও যোগাযোগের ইতিহাস’’, ‘‘ বাংলাদেশে ইরান পরিচিতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান অবস্থা’’ ও ‘‘ বাংলাদেশে ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের অবস্থান’’ । ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, অনেক পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে ফারসি চর্চা হয়ে এসেছে। অনেক কবি-সাহিত্যিক ফারসি ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্যাপকভাবে ফারসি সাহিত্যের অনুবাদ করেছেন। তবে মাঝে কিছুকাল চর্চা কমে গেলেও ইরানের ইসলামি বিপ্লব ফারসি ভাষার প্রসারের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এ অঞ্চলে ফারসি চর্চার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারে ফারসি ভাষা শেখানো হচ্ছে। ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দীর্ঘদিন যাবৎ ফারসি ভাষা শিক্ষার জন্য জুনিয়র, সিনিয়র ও ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করে আসছে । আর গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত ইরানোলজির ক্লাস ইরান পরিচিতি ও ফারসি ভাষার প্রসারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্ত রাখেন বাংলাদেশে অবস্থিত ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচালার কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত। তিনি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে এই ওয়েবিনারের সহ আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী সকলকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের ৪২তম বার্ষিকী উপলক্ষে সকলকে মোবারকবাদ জানান এবং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে নারী দিবস উপলক্ষে সকলকে বিশেষকরে নারীদেরকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ইরানি সভ্যতা একটি প্রাচীন সভ্যতা। এই সভ্যতা বিভিন্ন অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছে। মহাকবি ফেরদৌসি, হাফিজ শিরাজি, মাওলানা রুমি, ওমর খৈয়্যাম, ফরিদুদ্দিন আত্তার প্রমুখ ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহক হিসেবে ইরানকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষজন ইরান-পরিচিতিকে নিজেদের পরিচিতি হিসেবেই পাঠ করেছে। মিলাদ মাহফিলে যে শেখ সাদীর ফারসি গযল ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি’ পাঠ করা হয় তাকে নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবেই মনে করে। তেমনি ফারসি ভাষাকে তারা একটি বিদেশি ভাষা হিসেবে নয়; বরং নিজেদের ভাষা হিসেবেই জানে। তাই ইরান-পরিচিতি আত্মপরিচয়ের সন্ধানেরই নামান্তর।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ইরানোলজি ফাউন্ডেশনের প্রধান আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ মোহাম্মদ খামেনেয়ী বলেন, ইরানোলোজির লক্ষ্য ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও গণমানুষের চিন্তাধারাকে বিশ্বের আগ্রহী ও কৌতুহলী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া ও তা বিকাশে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা। ইরান স্বীয় গৌরবময় সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে স্বকীয় মর্যাদায় আসীন। ইরান স্টাডিজ মূলত ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্বগাথা, উপাখ্যান, সংস্কৃতি, সভ্যতা, শিল্প-সাহিত্য, আইন, অর্থনীতি ও ফারসি ভাষার বিকাশ ও উৎকর্ষকে ঘিরে আবর্তিত। বিশ্বব্যাপী ইরান স্টাডিজের বিকাশ সাধনে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইরানের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ফারসি সাহিত্য ও ভাষা বিকাশে ইরানোলোজি ফাউন্ডেশন সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী বিজ্ঞ শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেজন্য তাঁদেরকে হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানাচ্ছি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ রেজা নাফার বলেন, কয়েকটি আনন্দ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে এই ওয়েবিনারের আয়োজন । উপলক্ষগুলো হলো হযরত ফাতিমা যাহরার জন্মদিবস অর্থাৎ নারী দিবস, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লব বিজয়ের ৪২তম বার্ষিকী যে বিপ্লব ‘যুগের বিপ্লব বা মুজিযা’ হিসেবে অভিহিত হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করতে চলেছে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি।
তিনি বাংলাদেশে ‘ফারসি ভাষার মা’ খ্যাত অধ্যাপক ড. কুলসুম আবুল বাশারের সুস্থতা কামনা করেন। বাংলাদেশে যাঁরা ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে কাজ করছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
মোহাম্মাদ রেযা নাফার বলেন, ইরানি সভ্যতা রোম ও মিশরীয় সভ্যতায় প্রভাব রেখেছিল। একইভাবে বাংলাদেশেও প্রভাব রেখেছে। ইরান ও বাংলাদেশের মুসলমান ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক অনেক প্রাচীন। এ সম্পর্ক একদিনে গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন অনেক মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই এ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
তিনি অরো বলেন, বর্তমানে ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বে গৌরবময় অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। বিপ্লবের পর নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইরান জ্ঞান-গবেষণায় বিশ্বের ১২তম স্থান ও মধ্যপ্রাচ্যে ১ম স্থানের অধিকারী হয়েছে। এটি ইরানি জাতির সক্ষমতাকে প্রমাণ করে।
অনুষ্ঠানে ইরানোলজি ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান ড. হামিদ ফুরুজান বলেন, ইরানে ইসলামের আগমনের পর ইরানি সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিশ্বে ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বে ইরান পর্যটন ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ দেশের একটি। প্রাকৃতিক দিক থেকে ৫টি দেশের অন্যতম। শিক্ষা সম্প্রসারণে বিশ্বের ৭টি দেশের একটি।
তিনি ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র এবং ইরান-পরিচিতির ছাত্ররা যাতে সশরীরের অথবা অনলাইনে আরো উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। যোগ্যরা যেন ইরানে মাস্টার ডিগ্রিতে ভর্তি হতে পারে এবং যাতে দু’দেশের মধ্যে শিক্ষক বিনিময় হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, ইরানোলজি ফাউন্ডেশনের ইন্টারন্যাশনাল সাইন্টিফিক কো-অপারেশন বিভাগের মহাপরিচালকের উপদেষ্টা ড. সাইয়্যেদ আব্দুল মাজিদ মিরদমদি, সাদী ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. এলহাম হাদ্দাদী, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হেকমাত উল্লাহ মোল্লা সলেহী, ইরানোলজির শিক্ষক ড. জুহরে জারশেনস,আঞ্জুমানে ফারসি বাংলাদেশের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. উসমান গনি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল করিম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহ জালাল।ওয়েবিনার সঞ্চালনায় ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক এবং ইরান স্টাডিস সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন।
ওয়েবিনারে নারী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে ইরানোলজি বিষয়ক দুই নারী বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. কুলসুম আবুল বাশার মজুমদার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফারসি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শামীম বানুকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়।