শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরানের আরদেবিল, গ্রীষ্মের তাপদাহেও প্রশান্তির খোঁজ মেলে যেখানে

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ১৭, ২০১৮ 

news-image

মারইয়াম কারেজওযলো: চার ঋতুর দেশ ইরান। ঋতুগুলো হচ্ছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। ইরানের প্রকৃতিতে এখন চলছে গ্রীষ্মকাল। জুন, জুলাই ও আগস্ট- এই তিন মাস নিয়ে গ্রীষ্মকাল। এর মধ্যে জুলাই মাসে দেশটিতে বিরাজ করে সর্বোচ্চ তামাত্রা। ইরানে এখন কিছু দিন মেঘহীন আকাশে তীব্র তাপদাহ ছড়াচ্ছে টগবগে জ্বলন্ত সূর্য। ফলে দুঃসহ গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা দেশটির মানুষের। গ্রীষ্মের এমন তাপদাহ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন কোনো শীতল তাপমাত্রার জায়গা। যেখানে প্রশান্তি খুঁজে নেবেন ভ্রমণপিপাসুরা। তেমনই একটি জায়গার নাম আরদেবিল। ইরানের সর্বত্র গরমের প্রচণ্ড তাপদাহ বিরাজ করলেও এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আবহাওয়া। প্রশান্তির শীতল পরিবেশ যেন মন জুড়িয়ে দেয় পর্যটকদের।

আরদেবিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি প্রদেশ। যেখানে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপেও পেতে পারেন প্রশান্তি। পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর সেরা পর্যটন গন্তব্য এটি। যার শীতলতায় আকৃষ্ট হয়ে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছেন বিপুল সংখ্যাক পর্যটক। তাই কিছু দিনের জন্য উষ্ণ আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে ঘুরে আসতে পারেন আপনিও।

সড়ক পথ ধরে হেইরান রুট দিয়ে তেহরান থেকে আরদেবিল ভ্রমণ করা যায়। মনোরম দৃশ্যের জন্য রুটটি অতি সুপরিচিত। এটি উত্তরাঞ্চলীয় গিলান প্রদেশের আস্তারাকে আরদেবিলের সাথে সংযুক্ত করেছে। যাইহোক আস্তারা পৌঁছতে হলে আপনাকে গিলান প্রদেশ পাড়ি দিতে হবে। তাই হেইরান রুট ধরে যাওয়ার সময় গিলানের দৃষ্টিনন্দন গ্রামগুলোতে এক রাত কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এখানে রয়েছে সিয়াহ দারান ফরেস্ট পার্ক নামের একটি পার্ক। যদি কোনো কারণে গিলানে এক রাত কাটাতে না চান, তাহলে গিসুম ফরেস্ট পার্কে কিছু সময় যাত্রা বিরতি করতে পারেন। জঙ্গলে পরিপূর্ণ পার্কটি কাসপিয়ান সাগরে গিয়ে মিলেছে। সেখানকার ছোট ছোট হোটেল ও সমুদ্রের পাশে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যাবে দারুণ স্বাদের মাছের কাবাব।

হেইরান রুট ধরতে পরের দিন সকালে আমরা আস্তারা অভিমুখে রওয়ানা করলাম। সড়ক ধরে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে ইরান ও আযারবাইজানের মধ্যকার বেড়া দেওয়া সীমান্ত। সুন্দর গাছপালা আচ্ছাদিত সড়কটির দুপাশে শোভা পাচ্ছে সবুজ ধান ক্ষেত। অবশেষে আমরা হেইরান রুটে গিয়ে পৌঁছলাম। নানারকম ফুলে ফলে সুশোভিত বিস্তীর্ণ আলবোর্জ পর্বতমালার সুন্দর ভূদৃশ্য হয়ে ১৫শ’ মিটার পথ ভ্রমণ শেষে আমরা একটি কুঁড়েঘর পেলাম। যাত্রা পথে কিছু জায়গায় ঘনকুয়াশার কারণে কোনো কিছুই চোখে পড়ল না। অতঃপর পরের স্টেশনে পৌঁছলাম।

সেখানে পৌঁছতেই ঠাণ্ডা বাতাস আর চেহারায় এসে পড়া পানির ছোট ছোট ফোটা প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিলো। সেখানকার পাহাড় ও সমতল ভূমিতে ছোট পরিসরে হাঁটাচলা করতে পারেন। সমতল এলাকা সুন্দর বনফুলে আচ্ছাদিত। চিরস্থায়ী কুয়াশা এনে দেবে মহা আবহ। এখানে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, কফি হাউজ ও চা দোকান। যেখানে ওই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার ও ড্রিংক পাওয়া যাবে।

শোরাবিল লেক

অবশেষে আমরা হেইরানকে গুডবাই জানালাম। পৌঁছে গেলাম প্রধান গন্তব্য আরদেবিলে। সেখানে পৌঁছতেই শোরাবিল লেক ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। লেকটি শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। ঝলমলে ও শান্তিময় পরিবেশ। লেক ভ্রমণ করলে আর অন্য কিছুরই প্রয়োজন হবে না। লেকের পাশে বসে অবলোকন করা যাবে মনোরম দৃশ্য। মন খুলে নেওয়া যাবে নির্মল বাতাস।

দর্শনার্থীদের অবসরযাপন, বিনোদন ও আরাম-আয়েসের জন্য লেকের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। ১৬ একর এলাকা জুড়ে থাকা লেক ঘিরে রয়েছে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও কফি শপ, ইনডোর ও আউটডোর চিত্তবিনোদন পার্ক,একজোড়া আন্তর্জাতিক হোটেল ও একটি চিড়িয়াখান। চারপাশে আরও রয়েছে দৌড়ানো ও বাইক চালানোর রাস্তা। তাই এখানে দৌড়ানো, সাইকেল চালানো ও ছোট ছোট বোটে করে ঘোরাঘুরির সুযোগ রয়েছে। ইরানের এক শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা লেকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় লেক এটি।

ফান্দোকলো বন, যেন পৃথিবীর বুকে থাকা একখণ্ড স্বর্গ

আরদেবিল শহরে কয়েক ডজন হোটেল রয়েছে। এখানে থাকার জন্য উপযুক্ত জায়গা হিসেবে ফান্দোকলো বনকে বেছে নিতে পারেন। প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর বিস্তীর্ণ জমির ওপর গড়ে উঠেছে বনটি। দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাশ্চর্জজনক দৃশ্যের জন্য এটি সুপরিচিত। ফান্দোকলোর আক্ষরিক অর্থ হলো লালচে গাছপালাপূর্ণ এলাকা। এই এলাকায় ডগ রোজ, জার্মান কামোমাইল, বন্য প্যান্সি, এবং বন্য স্ট্রবেরি গাছ দেখতে পাওয়া যায়।

ফান্দোকলো আরদেবিল থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই শহর থেকে স্বল্প সময়ে বনটিতে পৌঁছা যায়। আপনি বনের ভেতর ক্যাম্প তৈরি করে থাকতে পারেন। আবার কোনো কারণে তাঁবুতে ঘুমাতে পছন্দ না করলে কটেজ ভাড়া করেও থাকতে পারেন। তবে তাঁবুতে রাত্রি যাপন করলে লাখ লাখ তারকাসজ্জিত সুন্দর আকাশ উপভোগ করতে পারবেন। এখানকার আবহাওয়া প্রশান্তিজনক শীতল।

আলোর শহর ‘সারেন’

আরদেবিলের দক্ষিণ-পশ্চিমে সারেন শহর অবস্থিত। আমার কাছে এটি একটি আলোর শহর। অসাধারণ সব কাবাব ঘর, খাবার হোটেল ও চা দোকান দিয়ে সাজানো রাস্তাগুলো। সারেন গরম ঝরনার কারণে পর্যটকদের কাছে সুপরিচিত। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে শত শত দর্শনার্থী এখানে ভীড় জমান ঝরনাটি দেখার জন্য। শুধু গরম ঝরনা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে তা নয়। গোধূলি বেলায় রাস্তায় হাঁটার সময় প্রশান্তির শীতল হাওয়া বয়ে যায়। আনন্দে ভরে দেয় মন। হয়তো আপনি মনের অজান্তেই বলে ফেলবেন- ভ্রমণের খরচ বুঝি উসুল হলো।

বিশাল আয়তনের ঝুলন্ত সেতু

পর্যটকদের জন্য আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হলো মেশগিন শাহর সিটির বিশাল আয়তনের ঝুলন্ত সেতু। ২০১৫ সালে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৩৪৫ মিটার,চওড়া ৩ মিটার এবং উচ্চতা ৮০ মিটার। বলা হয়ে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যে এই ধরনের সেতুর মধ্যে এটি সর্বাপেক্ষা বড়। তবে শীতল আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও ভর দুপুরে সেতু পরিদর্শনে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এসময় সূর্য থাকে অত্যন্ত জ্বলন্ত।

সূত্র: তেহরান টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন মমিনুল হক।