ইমাম হুসাইন (আ.) ও আশুরা বিপ্লব সম্পর্কে কিছু অম্লান উক্তি-২
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১১, ২০১৬
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2016/10/4bhi21b03c020b17l6_800C450.jpg)
বিভিন্ন যুগে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত মনীষী, নেতা এবং নানা ধর্ম ও মতের অনুসারী খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়ক ইমাম হুসাইন (আ.) ও আশুরা বিপ্লব সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ মতামত ব্যক্ত করেছেন। এইসব বক্তব্য ও মন্তব্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু উক্তি বা মন্তব্য এবং আশুরা সংক্রান্ত কিছু ইসলামী বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হল:
**মিশরের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা মরহুম মুহাম্মাদ জগলুল পাশা:
ইমাম হুসাইন (আ.) এ কাজের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ফরজ পালন করেছেন। এ ধরনের শোক মজলিসগুলো মানুষের মধ্যে শাহাদতের মন মানসিকতা গড়ে তোলে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে তাদের অভিপ্রায়কে বলীয়ান করে।
** বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম:
“খাতুনে জান্নাত মা আমার হাসান হোসেন চোখের জল””
আঁজলা ভরে আনলো কি প্রাণ কারবালাতে বীর শহীদান?”
“হাসানের মত পিব পিয়ালা সে জহরের
হোসেনের মত নিব বুকে ছুরি কহরের
আসগর সম দেব বাচ্চাদের কুরবান
জালিমের দাদ নেব দেব আজ গোরজান
সখিনার শ্বেত বাস দেব মাতা কন্যায়
কাশিমের মত দেব জান রুধি অন্যায়
মহরম কারবালা কাঁদো হায় হোসেনা
দেখ মরু সূর্য এ খুন যেন শোষে না”
(মহররম)…….
(যদি) হাসান হোসেন হেসে হেসে নাচত আমার বক্ষে এসে
চোখে আমার বইত নদী পেয়ে সে নেয়ামত…. (ইসলামী গান)
বহিছে সাহারায় শোকের লু হাওয়া
দুলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে
নুহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন
ঘোর অশ্রু শ্রাবণ-ধারা ঝরে সঘনে..
কাঁদে গিরিদরী মরু বনস্থালী
কাঁদে পশুপাখী তরুলতার সনে…
বিশ্ব যাবে মুছে মুছিবে না আঁসু
চিরকাল ঝরিবে কালের নয়নে….
আসমান ও জমিন রহিবে যতদিন
সবে কাঁদিবে এমনি আকুল কাঁদনে
(কাওয়ালি: শোকের লু হাওয়া)
**কবি ফররুখ আহমদ :
জীবন দিয়ে যে রাখলো বাঁচায়ে দ্বীনি ইজ্জত বীর জাতির
দিন শেষে হায় কাটলো শত্রু সীমার সে মৃত বাঘের শির
তীব্র ব্যথায় ঢেকে ফেলে মুখ দিনের সূর্য অস্তাচলে,
ডোবে ইসলাম-রবি এজিদের আঘাতে অতল তিমির তলে,
কলিজা কাঁপায়ে কারবালা মাঠে ওঠে ক্রন্দন লোহু সফেন
ওঠে আসমান জমিনে মাতম; কাঁদে মানবতা:
হায় হোসেন হায় হোসেন।
(কবি ফররুখ আহমদের ‘শহীদে কারবালা ‘থেকে)
**ইরানি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর আলি শরিয়তি:
আমি সেইসব মানুষের ব্যাপারে বিস্মিত যারা নানা রকম জুলুম সয়ে নিচ্ছেন অথচ স্বাধীন জীবন যাপনকারী হুসাইনের জন্য কাঁদছেন?
**মহাকবি ডক্টর ইকবাল :
(কারবালা ও আশুরা সম্পর্কিত বহু চমতকার মন্তব্য দেখা যায় ইকবালের নানা কবিতায়। তার কবিতা হতে এখানে দুটি মন্তব্য তুলে ধরা হল:)
হুসাইনের তরবারি ছিল ‘লা’ বা না যার অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আর এই তরবারি দিয়ে তিনি কুফুরিকে বা ঈমানহীনতাকে ধ্বংস করেছেন। কারবালায় তিনি তাওহিদের চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। এটা আমাদের মুক্তির শ্লোগান। আমরা আসলে হুসাইনের কাছ থেকে তাওহিদের শিক্ষা পেয়েছি। ….
রাজ-রাজড়াদের যুদ্ধের মাধ্যমে যে শান-শওকত অর্জিত হয় তা কখনও স্থায়ী হয় না। সিরিয়া ও বাগদাদের সিংহাসনগুলোর অহংকার বা গরিমা আজ আর নেই। কেউই এখন আর (স্পেনের রাজাদের রাজধানী) গ্রানাডার শান-শওকতের কথা স্মরণ করে না। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) লা ইলাহা ইল্লাহ’র যে সুমহান আহ্বান জানিয়ে গেছেন কারবালায় তা আজও আমাদের কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এবং আমাদের হৃদয়গুলোকে শিহরিত করছে।
**মিশরীয় পণ্ডিত আল্লামা তানতাভি:
হুসাইনি কাহিনী স্বাধীনচেতাদেরকে আল্লাহর রাহে আত্ম-কুরবানি করতে মানুষকে প্রেরণা যোগায়। আর মৃত্যুকে সর্বোত্তম কামনায় পরিণত করে। তখন শাহাদতের জন্য একে-অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে।
**মরহুম মুফতি শফি (র.):
পবিত্র আহলে বাইতের মুহাব্বাত ঈমানের অংশ বিশেষ। ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ওপর নিপীড়নমূলক ঘটনা এবং হৃদয়বিদারক শাহাদত যার অন্তরে শোক ও বেদনা সৃষ্টি করে না, সে মুসলমান তো নয়ই, মানুষ নামেরও অযোগ্য।
**মাওলানা মোহাম্মাদ আলী জওহার:
‘কাতলে হুসাইন আসল মে মারগে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ।’অর্থাত হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা আসলে ইয়াজিদেরই মৃত্যু, ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়।
**শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারি (র.):
ইমাম হুসাইন (আ.) নিজের বাণীকে (রাজা-বাদশাহদের মত) না পাথরের ওপর রং-কালি দিয়ে লিখেছেন, না খোদাই করে রেখে গেছেন। তিনি যা কিছু বলেছেন তা (আজো) বাতাসে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মানুষের কানে ঝংকৃত হয়। তা লোকদের হৃদয়-পটে এমনভাবে লিপিবদ্ধ হয় যে তা কখনও হৃদয়-পট থেকে মুছে যায়নি। তিনি এ সত্যের ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তিনি তাঁর সামনে থাকা ভবিষ্যতকে সঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন। আর তা হল, এরপর আর কেউই হুসাইনকে হত্যা করতে পারবে না এবং তিনি আর কখনও নিহত হবেন না।
ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর মহান সঙ্গীদের মধ্যে সমন্বিত হয়েছিল প্রেমিক ও সংস্কারকদের যুক্তি। একজন সংস্কারক ও একজন আধ্যাত্মিক রহস্যবাদী প্রেমিকের ব্যক্তিত্ব যখন একদেহে লীন হয়ে যায় তখন সেখানে জন্ম নেয় একজন শহীদ। ইমামের শহীদ সঙ্গীরা ছিলেন এই প্রক্রিয়ারই ফসল। ইমাম হুসাইন (আ.) তো তাদেরকে রাতের আঁধারে আত্মীয়দের হাত ধরে একে-একে পালিয়ে যাওয়ারও অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ইমামের সঙ্গে থেকেই শহীদ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে চেয়েছেন। ইমাম অবশ্য এটাও বলেননি, অসম জিহাদের জন্য কারবালায় তাঁর সঙ্গে থেকে লড়তে আগ্রহী সঙ্গীদের অবস্থান করা হবে বোকামি, হারাম বা আত্মঘাতী ততপরতা মাত্র। তাঁদের কেউ কেউ ইমামের জন্য ৭০ বার কেউ কেউ হাজার বার শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা বলে গেছেন।
**ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.):
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যা কিছু অর্জন করেছি, তার সবই পবিত্র আশুরা ও শাহাদাতে কারবালা থেকে’-অর্থাত্ আমরা যা যা ভাল জিনিস পেয়েছি, নতুন সমাজ গড়েছি, বিশ্বের বুকে নতুন করে মহানবী (সাঃ) আনীত প্রকৃত ইসলামকে পেয়েছি-তার সবই শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আঃ) এর শাহাদাত থেকেই পেয়েছি ৷
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইমাম খোমেনী (র.) বলেছেন: আমাদের যা কিছু অর্জন তার সবই মহররম ও সফর মাসের অর্জন।
ইমামদের ও বিশেষ করে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ও মজলুমদের নেতা আবা আবদিল্লাহ হুসাইন (আ.)’র শোক অনুষ্ঠানের প্রতি সম্মান দেখাবেন। (মহান আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, নূরনবী এবং সকল সালেহ বান্দার পূর্ণ দরুদ ও সালাম তাঁর পবিত্র ও নির্ভীক রুহের ওপর বর্ষিত হোক।) কারবালার প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক মহাঘটনার স্মৃতিচারণের জন্য ইমামদের নির্দেশনাবলী জনগণের স্মরণ রাখা উচিত। নবী(সা.)’র আহলে বাইতের দুশমনদের ওপর যেসব ধিক্কার ও অভিশাপ আপতিত হয়েছে সেসব আসলে যুগ যুগ ধরে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগুলোর বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ। আপনাদের জানা উচিত উমাইয়্যাদের (তাদের ওপর আল্লাহর লা’নত) অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধিক্কার, নিন্দাবাদ ও অভিশাপের কথা। যদিও তারা এখন পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, তবুও এই ফরিয়াদ ইঙ্গিত বহন করে বর্তমান দুনিয়ার জালিমদের বিরুদ্ধে মজলুম জনতার আর্ত চিতকার। এ জুলুম বিধ্বংসী ফরিয়াদকে সংরক্ষণ করা জরুরি। ইমামদের (আ.) স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে প্রতিটি যুগের জালিমদের হাতে সংঘটিত অত্যাচার ও দুঃখজনক ঘটনাগুলো জোরালোভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। আর বর্তমান যুগ হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া ও তাদের দোসরদের, বিশেষ করে আল্লাহ পাকের পবিত্র হারামের প্রতি বিশ্বাসঘাতক সৌদি রাজবংশের (তাদের ওপর আল্লাহ ও তার ফেরেশতা ও রাসূলগণের লা’নত বর্ষিত হোক) হাতে মুসলিম বিশ্বের নির্যাতিত হওয়ার যুগ। আহলে বাইতের স্মরণে রচিত শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে বর্তমানকালের এ সকল অত্যাচারীর অত্যাচার ও দুঃখজনক ঘটনাগুলোও জোরালোভাবে স্মরণ করা এবং তাদের প্রতি অভিশাপ ও ধিক্কার দেয়া উচিত। (হযরত ইমাম খোমেনী-র.’র ওসিয়তনামা ‘অন্তিম বাণী’)
প্রথম দিন থেকেই ইমাম হুসাইন (আ.)’র উত্থানের বা জিহাদের লক্ষ্য ছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, ভালো কিছুর বাস্তবায়ন সহজে হয় না, কিন্তু মন্দের চর্চা হয় সহজেই। নিষিদ্ধ বিষয়ের চর্চাই সমাজের সব অনিষ্টের কারণ। তাই সমাজের সব খারাপ ও শয়তানি কাজের মূলোতপাটন ও জালিমের শাসন উতখাত করা ছিল ইমাম হুসাইন (আ.)’র লক্ষ্য।…
শহীদদের নেতা দেখলেন যে আদর্শ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে ইমাম হাসান ও আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আ.)’র জিহাদ এবং পৌত্তলিক ও জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে নবীগণের সংগ্রাম কোনো দেশ বা ভূখণ্ড দখলের সংগ্রাম ছিল না। কারণ, তাঁদের কাছে সারা দুনিয়ারও কোনো মূল্য ছিল না।… কুফা ও কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র জিহাদ ছিল জুলুম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদর্শের সংগ্রাম। …মুসলিম জাতিকে পুনর্গঠিত করতে ও ইয়াজিদের পতাকা ভূলুণ্ঠিত করতে শহীদদের নেতা জেগে ওঠাকে দায়িত্ব মনে করলেন। নিজের ও নিজ সন্তানের রক্ত দিলেন এবং ইসলামের জন্য নিজের সব কিছুই দিলেন। …নবী-রাসূলদের মত তিনিও জানতেন সমাজের সংস্কারের জন্য ব্যক্তি স্বার্থ কুরবানি দিতে হয়, তা সেই স্বার্থ যত বড়ই হোক না কেন।
**ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী:
আশুরার পুণ্য-স্মৃতি নিছক একটি স্মৃতির বর্ণনা ও রোমন্থন নয়, বরং তা হচ্ছে এমন এক ঘটনার বর্ণনা যার রয়েছে অগণিত দিক ও মাত্রা। এইসব বিষয়ের আলোচনা অপরিসীম আধ্যাত্মিক আশীষ ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আর এ জন্যই ইমামদের যুগে ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্য কাঁদা ও কাঁদানোর এক বিশেষ স্থান বা মর্যাদা ছিল। কেউ যেন না ভাবেন যে, চিন্তা ও যুক্তি-প্রমাণ থাকতে আবার কান্নাকাটি ও পুরনো সব আলোচনার দরকার কী? না, এটা ভুল। এসব কিছুরই নিজ নিজ গুরুত্ব রয়েছে। এমন অনেক বিষয় আছে যা ভক্তি ও ভালবাসা দিয়ে সমাধান করতে হয়। সেখানে যুক্তি ও প্রমাণই যথেষ্ট নয়। .. .. ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ও প্রবাসী অবস্থায় জিহাদ করতে হয়েছিল। নিজের চোখের সামনে কুরবানি করতে হয়েছে সন্তান, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় এবং তিনি জানতেন শাহাদতের পরও ঘটবে কতসব বর্বরতা! …সর্বপ্রথম শোকগাথা ও ফরিয়াদ জানালেন বোন জয়নাব (সা.):
‘হে রাসূলুল্লাহ (সা.)! আকাশের ফেরেশতারা আপনার ওপর দরুদ পাঠায়, এ হলো আপনার হুসাইন, রক্ত-রঞ্জিত- কর্তিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, লুণ্ঠিত পাগড়ী (রাসূলের প্রদত্ত) ও বস্ত্র’-এভাবেই ঘটনা সবার কাছে প্রচার করা হয়। তিনি ঘটনা তুলে ধরেন কুফায়, সিরিয়ায় ও মদীনায়। অথচ ইয়াজিদি গোষ্ঠী এ ঘটনাকে গোপন রাখতে চেয়েছিল।.. শোকানুষ্ঠান এক মহানেয়ামত। এ নেয়ামত ইতিহাসে এমন কাজ করেছে যে যুগে যুগে জালিম শাসকরা আশুরা ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র মাজারকে ভয় পেয়ে এসেছে। সেই উমাইয়া যুগ থেকে এ ভয় আজো অব্যাহত রয়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবই এর প্রমাণ।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন ইতিহাসের এক অনন্য অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং নবীপ্রেম ও খোদাপ্রেমের পরিপূর্ণ আদর্শ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, হযরত হুসাইন বিন আলী (আ.) আরওয়াহুনা ফাদা (তাঁর জন্য আমাদের আত্মাগুলো উতসর্গ হোক) বিশ্বের পবিত্র তথা নিষ্পাপ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সূর্যের মতই অনন্য, প্রোজ্জ্বল। নবী-রাসূল, আউলিয়া, ইমাম, শহীদ ও সালেহীনদের (উচ্চ পর্যায়ের সতকর্মশীল) কথাই ধরুন। তাঁরা যদি আকাশের চাঁদ ও তারকা হয়ে থাকেন তবে এই মহামানবের অনন্যতা সেখানে সূর্যের মতই জ্বলজ্বল।… হুসাইন বিন আলী (আলাইহি সাল্লাত ওয়া সাল্লাম) এক পরিপূর্ণ আদর্শ। কারণ, তাঁর মধ্যে আত্মকেন্দ্রীকতা, আমিত্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, গোত্রগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থান্ধতাও দেখা যায় না।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির মতে, লক্ষ পূরণের জন্য ‘উপযুক্ত সুযোগ বা সময় চিহ্নিত করা’ ছিল হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র অসংখ্য মহতী গুণের মধ্যে অন্যতম প্রদীপ্ত গুণ। ইমাম লক্ষ্য পূরণের জন্য উপযুক্ত সুযোগ বা সময় চিহ্নিত করতে ভুল করেননি। উপযুক্ত সুযোগ বা পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া মাত্রই তা বুঝতে পেরেছেন তিনি এবং (ধর্মকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য চরম আত্মত্যাগের) সেই মহিমান্বিত লক্ষ্য পূরণ করেছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বিশ্বাস করেন, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র অসংখ্য মহতী গুণের মধ্যে তিনটি বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যই এক মহান বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য ছিল অতি জরুরি। এ তিনটি গুণ হল, আন্তরিকতা, মহান আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস ও আস্থা এবং সুযোগ চিহ্নিত করা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র আরো কিছু অত্যুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন: তাঁর ব্যক্তিত্বের আরেকটি দিক হল জিহাদ, শাহাদত ও সেই প্রবল ঝড় যা তিনি সৃষ্টি করেছেন ইতিহাসে। সেই ঝড় মুসলমানদেরকে ও মানবতাকে দিয়ে গেছে কত মহাকল্যাণ ও বরকত যা চিরকাল টিকে থাকবে। হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র ব্যক্তিত্বের আরেকটি দিক হল আধ্যাত্মিক ও এরফানি দিক যা আমরা লক্ষ করি আশুরা ও কারবালার মহাবিপ্লবের ঘটনায়। … সেই প্রথম মুহূর্ত থেকে এ মহান ইমাম যখন কারবালার তপ্ত মরুতে পা রাখেন তখন থেকে সেই শেষ সময় পর্যন্ত তিনি বলেছিলেন: হে খোদা! আমি তোমার মাধ্যমে নির্ধারিত আমার তকদিরে বা ভাগ্যে যা ঘটছে তাতে সন্তুষ্ট এবং আমি তোমার নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করছি। তিনি সব সময়ই আল্লাহকে স্মরণ করেছেন, আল্লাহর প্রতি চরম বিনম্র থেকেছেন এবং কেবল আল্লাহর ওপরই ভরসা করেছেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র ধৈর্য প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন: ধৈর্য মানে কেবল এটা নয় যে, মানুষকে নির্যাতন করা হলে বা তার সন্তানদেরকে নিজের সামনেই নির্যাতন বা হত্যা করা হলে সে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, অবশ্য এটাগুলো প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব, তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এমন সব কুমন্ত্রণা ও পরামর্শ উপেক্ষা করা যা বাহ্যিক দিক থেকে কারো কারো কাছে যৌক্তিক মনে হলেও আসলে তা সেই সংগ্রামের তথা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের পথ অব্যাহত রাখতে মানুষকে বাধা দেয়। ইমাম (আ.)-কেও অনেকেই বলেছিল: জনাব! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? নিজেকেও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন এবং পরিবারকেও! অনেকেই ইমামের (আ.) সঙ্গে দেখা করে তাঁকে প্রতিরোধের নীতির জন্য সমালোচনাও করেছেন। এই পরামর্শদাতা ও তিরস্কারকারীরা অসত বা সাধারণ মানুষও ছিলেন না। তাদের কেউ কেউ ছিলেন ইসলামের গণ্যমান্য ব্যক্ত্বিত্ব। কিন্তু তারা ভুল বুঝেছিলেন। মানবীয় ভুল তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাই তারা চেয়েছিল হুসাইন বিন আলী (আ.)-কেও সেই দুর্বলতার শিকার করতে। কিন্তু ইমাম ধৈর্য ধরেছিলেন এবং সেইসব ভুল পরামর্শ বা কুমন্ত্রণার কাছে নতি স্বীকার করেননি। যারাই ইমামের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন তারা সবাই এই আধ্যাত্মিক ও আত্মিক সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছিলেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে সে সময় যারা উচ্চতর গুণ ও হীনতম নিচু স্বভাবের মধ্যে আধ্যাত্মিক সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে বিবেক বা বুদ্ধিমত্তাকে অজ্ঞতার ওপর প্রাধান্য দিতে পেরেছিলেন-এমন ব্যক্তির সংখ্যা ছিল খুবই কম বা মুষ্টিমেয়। কিন্তু এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিরা সেই মর্যাদার লড়াইয়ে অবিচল থাকার ব্যাপারে চরম ধৈর্যের পরিচয় দেয়ায় শত শত ও হাজার বছর পরও তাঁরা হয়ে আছেন মানুষের জন্য আদর্শ। মানব জাতি তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে ও তাঁদেরই পথ অনুসরণ করছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, সেই মহামানবরা যদি ওইসব উচ্চতর গুণকে নিজেদের মধ্যে নীচ স্বভাবের মোকাবেলায় বিজয়ী করতে না পারতেন তাহলে ইতিহাসে উচ্চতর বা মহতী গুণের বৃক্ষ শুকিয়ে মরে যেত। সূত্র: পার্সটুডে