শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সংগ্রামী জীবন

পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ২৬, ২০১৩ 

news-image

প্রতিটি আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।মানবতার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলার এই বাণী ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জান্নাত যাত্রার উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে বিদায়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) রাজনীতি ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে কেবল একজন অনন্য বিশ্বনেতাই ছিলেন না; বরং আইনবিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, সূফিতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসাবেও ইসলামী বিশ্বের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি এসব ক্ষেত্রে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং ইসলামী নীতির অনুশীলন ও ধর্মীয় ঐতিহ্য মেনে চলার ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

ইমাম খোমেইনীর জ্ঞান, ঈমান, দৃঢ়তা, অভ্যন্তরীণ চারিত্রিক সৌন্দর্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর ধারণা এতই গভীর ছিল যে, তা সংক্ষিপ্ত কোন নিবন্ধে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একটি বিখ্যাত কবিতায় যেমন বলা হয়েছে : সমুদ্র থেকে আমরা পানি তুলতে পারি না, কিন্তু তৃষ্ণা তো মেটাতে পারি নিশ্চয়ই।এই নিবন্ধ তেমনই এক প্রচেষ্টা মাত্র।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৩২০ হিজরির ২০ জমাদিউস সানী ইরানের খোমেইন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তারিখটি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর জন্মদিন। তিনি ৮৯ বছর বয়সে ১৪০৯ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৯ সালের ৩রা জুন ইন্তেকাল করেন।

তাঁর পিতা শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুস্তফা মুসাভী ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ মুসাভীর পুত্র।

ইমাম খোমেইনীর মাতা হাজেরা একটি ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী ও ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। মোহতারেমা হাজেরার পিতা ছিলেন মরহুম আয়াতুল্লাহ মির্জা আহমদ। তিনি তদানীন্তন সময়ের একজন বিশিষ্ট আলেম ছিলেন।

অত্যাচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়ে সাইয়্যেদ মুস্তফা মুসাভীর শাহাদাতের পর তাঁর বোন সাহিবা এই শিশুর অভিভাবক হন। মাত্র পাঁচ মাস বয়স থেকেই ইমাম খোমেইনী তাঁর প্রিয় ফুফু ও মায়ের কাছে লালিত-পালিত হন। এছাড়া খাভের নামে তাঁর একজন ধাত্রী ছিল। তাঁরা তাঁকে সার্বিকভাবে গড়ে তোলেন।

যুগস্রষ্টা মানুষেরা সর্বদাই দুঃখ-কষ্ট, মানসিক চাপ, একাকিত্ব, নির্বাসন ও বিদ্রোহের সম্মুখীন হন এবং এভাবেই তাঁরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হওয়ার ভাগ্য লাভ করেন। ইমাম খোমেইনী তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর ফুফু সাহিবা ইন্তেকাল করেন। এর কিছুদিন পর ১৩৩৬ হিজরিতে তাঁর মাতা হাজেরা ইন্তেকাল করেন। এসব দুঃখ ও শোক ইমাম খোমেইনীকে সহায়হীন ও পিছপা করার পরিবর্তে আরো অভিজ্ঞ ও মহৎ আত্মশক্তির অধিকারী করে তোলে। তিনি সকল পরিস্থিতি সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেন এবং আত্মবিশ্বাস ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রগতি, পরিশুদ্ধি, সুশিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করেন।

অত্যন্ত উন্নত প্রতিভার অধিকারী ইমাম খোমেইনী শিশুকালে মির্জা মাহমুদ নামের একজন শিক্ষকের কাছে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরে তিনি মক্তবে ভর্তি হন। মক্তবের প্রধান ছিলেন মোল্লা আবুল কাশেম। পরে তিনি নব প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। শেষ পর্যায়ে মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি ফারসি ভাষা শেখার কাজ শেষ করেন। এর পর তিনি তাঁর ভাই সাইয়্যেদ মুর্তাজার (আয়াতুল্লাহ পাছান্দিদের) কাছে যুক্তিশাস্ত্র, আরবি ভাষা ও ব্যাকরণসহ ইসলামী বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করেন। ইমাম খোমেইনী আরো অধ্যয়নের জন্য ইসফাহানের ধর্মতত্ত্ব স্কুলে গমন করেন। তিনি খোমেইন অবস্থান করেন ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৩৩৯ হিজরিতে তিনি আরাক যান। ঐ সময় সেখানে (মরহুম) হাজী শেখ আবদুল করীম হায়েরী বসবাস করতেন। সেখানে তিনি অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকম-লীর কাছে সাহিত্য শিক্ষা শুরু করেন। ১৩৪০ হিজরিতে আয়াতুল্লাহ হায়েরী আরাক থেকে কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসায় বদলী হলে ইমাম খোমেইনীও সেখানে যান এবং মুতাওয়াল-এর ওপর (আরবি শিক্ষা গ্রন্থ) অধ্যয়ন ও গবেষণা শুরু করেন।

কোম নগরীতে মুতাওয়াল-এর ওপর ব্যাপক অধ্যয়ন, গবেষণা ও নিরলস সাধনার ফলে ইমাম খোমেইনী ১৩৪৫ হিজরিতে অধিক সাফল্যের সাথে তাতে কৃতকার্য হন।

মরহুম হাজী শেখ আবদুল করীম হায়েরীর ক্লাসসমূহে যোগদানের মধ্য দিয়ে তিনি বিজ্ঞান ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভিত্তি রচনায় প্রভূত অগ্রগতি অর্জন ও ইজতিহাদের যোগ্যতা লাভ করেন। ১৩৫৫ হিজরিতে আয়াতুল্লাহ হায়েরী ইন্তেকাল করলে ইমাম খোমেইনী একজন মুজতাহিদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসায় তিনি বিশেষজ্ঞ শিক্ষক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

আইন শাস্ত্রের ওপর উচ্চতর জ্ঞানের পর্যায় অর্জন করা ছাড়াও ইমাম খোমেইনী (রহ.) জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ও সূফিতত্ত্বেও ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন।

আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের জন্য ইমাম খোমেইনী ছেলেবেলা থেকেই ইসলামী শিক্ষাচর্চার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালান। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি উচ্চতর আধ্যাত্মিক পর্যায় অর্জন করেন এবং সে সময়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যে একজন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জনের পর থেকে তিনি ইমাম হিসাবে নেতৃত্বে সমাসীন হন। তিনি কখনই নিজের মর্যাদার ভাব প্রকাশ করেননি এবং কখনই জনসাধারণের দানের অর্থ নিজের জন্য ব্যয় করেননি। সত্যিকার অর্থে তিনি পদমর্যাদাকে অপছন্দ করতেন এবং সর্বদা এ ধরনের বিষয় থেকে দূরে থাকতেন। এটা এই কারণে যে, তিনি মনে করতেন, ইসলাম, ইসলামী সমাজ বিপদাপন্ন। একে রক্ষা করতে হবে এবং এ উদ্দেশ্যে বিক্ষিপ্ত জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

সকল দিক ও বিষয়ে ইমাম খোমেইনীর জীবন ছিল খুব সুশৃঙ্খল। এমনকি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির তুলনায়ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে তিনি ছিলেন অনন্য। সমকালীন যুগে এমন ব্যক্তির কথা না শোনা গেছে, না দেখা  গেছে। তিনি শৃঙ্খলার সাথে তাঁর সকল কাজ সম্পাদন করতেন। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ইত্যাদি সকল কাজের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। তাঁর জীবন এতই সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী ছিল যে, তাঁর পরিবারের সদস্যরা অনায়াসে বলতে পারত তাঁর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে।

এটা বিস্ময়কর যে, ইমাম খোমেইনী তাঁর চলাফেরা বা নড়াচড়ার ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি যখন উঠে দাঁড়াতে চাইতেন তখন বাম হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেন। যখন বাড়ি, স্কুল বা মসজিদে প্রবেশ করতেন তখন ডান পা আগে দিয়ে প্রবেশ করতেন। রাস্তায় তিনি সব সময় ডান পাশ দিয়ে হাঁটতেন। তিনি হাঁটার সময় সৈনিকের মতো মাথা ও ঘাড় সোজা করে অগ্রসর হতেন।

ইমাম খোমেইনী ১৩৪৮ হিজরি পর্যন্ত একাকী জীবন যাপন করেন। ঐ বছরই তাঁর বিবাহের ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং তিনি আয়াতুল্লাহ হাজী মির্জা মুহাম্মাদ সাকাফী তেহরানীর কন্যা খাদিজাকে বিবাহ করেন।

ইমাম খোমেইনীর পরিবারে দুই পুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করে। তাঁর প্রথম পুত্র হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন হাজী সাইয়্যেদ মোস্তফা এবং দ্বিতীয় পুত্র হুজ্জাতুল ইসলাম হাজী সাইয়্যেদ আহমদ। তাঁর তিন কন্যা হলেন : সিদ্দিকা, ফরিদা ও ফাতিমা। এদের মধ্যে ড. যাহরা মুস্তফাভী (ফরিদা) তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপিকা এবং ইরানের মহিলা সমিতির প্রধান (১৯৯১ সাল)।

দর্শনশাস্ত্র ও সূফিতত্ত্বের ওপর গবেষণার ক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনীর অসাধারণ দক্ষতা তাঁকে কোমের ধর্মতত্ত্ব শিক্ষাকেন্দ্রে একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকে পরিণত করে। এই কারণে বিপুলসংখ্যক আলেম ও ছাত্র তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চা করতে আসেন। এক কথায় বলা  চলে যে, কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষকই তাঁর ছাত্র ছিলেন।

ইমাম খোমেইনী তাঁর ছাত্রদেরকে আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। এ কারণে তিনি দর্শন ও সূফিতত্ত্বের শিক্ষাদান ছাড়াও ছাত্রদের জন্য হেদায়াতের ক্লাস চালু করেন।

ঐ ক্লাসগুলো এতই আকর্ষণীয় ও গভীর জ্ঞানপূর্ণ ছিল যে, অল্পদিনের মধ্যেই শত শত ধর্মীয় আলেম ও কোমবাসী তাতে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং তাঁর ক্লাসসমূহে যোগদানকারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ইরানের তদানীন্তন শাসক শাহ রেজা খান পাহলবী ও তাঁর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভীত করে তোলে। সে কারণে তারা তাঁকে বাধা দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে। কিন্তু তারা সম্মুখীন হয় ইমাম খোমেইনী দৃঢ়তা এবং নজিরবিহীন প্রতিরোধ আন্দোলনের।

ইমাম খোমেইনী কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রগতি বিষয়েও এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নির্বাসন ইরানে ইসলামী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর ছিল আঘাতস্বরূপ। শত শত আলেম তাঁর নির্বাসনের ফলে জ্ঞান আহরণ ও বিজ্ঞানচর্চা থেকে বঞ্চিত হন।

নাজাফের আলেমগণও ইমাম খোমেইনীর বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আলো গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর ক্লাসসমূহে যোগদানের সুযোগ গ্রহণ করেছেন। নাজাফের ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যালয়ের আলেমদের এমন কথা বলতে শোনা যায় : আয়াতুল্লাহ খোমেইনী নাজাফে আসার আগে আমরা বুঝতে পারিনি যে, ইসলামী বিজ্ঞানের জগতে নতুন তথ্য রয়েছে। কিন্তু তিনি যখন নাজাফে আগমন করলেন এবং ক্লাস নেয়া শুরু করলেন, তখন আমরা মূল্যবান বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি সম্পর্কে জানতে পারলাম যা আগে কখনও শুনিনি।

বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনন্য মর্যাদা ও পর্যায় অর্জন করা ছাড়াও তিনি আইন, দর্শন ও সূফিতত্ত্বেও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। কবিতা রচনায়ও তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি নীতিশাস্ত্র, তত্ত্ববিদ্যা ও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে বেশকিছু গ্রন্থ সংকলন করেছেন। ২৭ বছর বয়সে ইমাম খোমেইনী তাঁর মিসবাহুল হিদায়াতগ্রন্থটি সংকলিত করেন। এ গ্রন্থটি খোদায়ী শিক্ষার এক অনন্য উদাহরণ। ২৯ বছর বয়সে তিনি রমযান মাসের ফজরের নামাযশীর্ষক একটি পুস্তক রচনা করেন। এই পুস্তকে ইমাম খোমেইনীর বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতার প্রমাণ মেলে। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের ৭টি হাদীস ও নীতিনৈতিকতা বিষয়ক ৩৩টি হাদিসের ব্যাখ্যা সম্বলিত আরবায়ীন হাদিসনামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইমাম খোমেইনী সংকলিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ইসলামী সরকার বা বেলায়েতে ফকীহএবং নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ বা জিহাদে আকবর

ইমাম খোমেইনীর জনপ্রিয়তায় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) এবং ইহুদিবাদী ও ইসলামবিরোধী শাহের সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা যখন দেখতে পেল যে, তাদের লুণ্ঠন ও ঔপনিবেশিক স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ছে তখন তারা ইমামের নেতৃত্ব থেকে ইসলামী জাতিকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁর কাছ থেকে জনগণকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করে। ইরানে কেউ যদি ইমামের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কথা বলে তাহলে তাকে গ্রেফতার, অত্যাচার, কারাগারে প্রেরণ বা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কেউ তাঁকে অনুসরণ (তাকলিদ) করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তাঁর রিসালাহ্ (ধর্মীয় আইনশাস্ত্রের বই) বাজার থেকে তুলে নেয়া হয় এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শাহের ভাড়াটেরা ইসলামী ও আরব দেশসমূহে ইমাম খোমেইনী সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা জোরদার করে। এসব দেশের জনগণ ইরানের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।

ইমাম খোমেইনী ইরানী সমাজের সকল ক্ষেত্রে গবেষণা চালানোর ফলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইরানের মুসলিম জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা থেকে উদ্ধার ও মুক্ত করার একমাত্র পথ হচ্ছে গণঅভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব আর এটা পরিচালনা করতে হবে মারজায়ে তাকলিদের মাধ্যমে (মারজা হচ্ছেন কোন অনুসরণযোগ্য মুজতাহিদ ব্যক্তিত্ব)। তিনি যখন জানলেন কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে সংগ্রাম ও বিপ্লব সৃষ্টি করা এবং তার মধ্যে কাজ করছে একটি বিপ্লবী চেতনা, তখন বিপ্লবের কাজ শুরু করলেন। তিনি বিপ্লবী পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাঁর আন্দোলন শুরু করলেন এবং কী হতে যাচ্ছে তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানত না।

এই বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল প্রয়োগ এবং বিপ্লবের সাথে তাঁর গোপন সংশ্লিষ্টতা ছিল এক অসাধারণ কর্মপ্রচেষ্টা, যা ইমাম খোমেইনীর মতো একজন মানুষের পক্ষেই চালানো সম্ভব হয়েছে। শাহের সরকার ও তাঁর দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এসব কর্মকাণ্ড দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এতসবের মধ্যেও ইমাম খোমেইনী জনসাধারণ ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানতে না দিয়ে তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনসুরের পুতুল সরকার ইরানী পার্লামেন্টে ক্যাপিটিউলেশন বিলনামে এক কুখ্যাত আইন পাশ করে। উক্ত আইনে ইরানে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকদের এমন কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, যা পৃথিবীর কোন দেশে কোন বিদেশী নাগরিক পেতে পারে না। এ আইন পাশের খবর ইমামের কানে পৌঁছলে তিনি এর বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। তেহরানে ইমাম খোমেইনীর সমর্থকবৃন্দ দশ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ৪০ হাজার ঘোষণাপত্র বিলি করেন। ঘোষণাপত্রটি কুখ্যাত ক্যাপিটিউলেশন আইন সম্পর্কে ইমামের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল। ঘোষণাপত্রের সারসংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপ : আমাদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট তুলে ধরা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব। এহেন অপমানের প্রতিবাদ করার ভার এখন ইসলামী মুবাল্লিগ ও বক্তাদের ওপরই ন্যস্ত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে দেশের স্বাধীনতার জন্য কলম ধরতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের উচিত পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্তের পিছনে কী রহস্য নিহিত রয়েছে সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। এ  সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বসম্মত নীতি গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ইসলাম ও কুরআনের গৌরব বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া এবং একই মুসলমানদের সমর্থনে কাজ করা উচিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শাহী সরকারের নতজানু মনোভাব সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে ইমাম বলেন : আমেরিকার কোন সৈনিকের কুকুর যদি শাহকে কামড়ায় তাহলেও শাহের প্রতিকার চাওয়ার মতো কোন আইনগত ভিত্তি নেই।

এছাড়াও এসময় সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করার উদ্দেশ্যে শাহ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দুশ’ মিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি করে। ইমাম খোমেইনী সুস্পষ্টভাবে বলেন : শাহের এ চুক্তি অনুমোদন করে মজলিসে যে ভোট প্রদান করা হয়েছে তা অবৈধ ও সুস্পষ্টভাবে কুরআনের নীতিবিরোধী।তিনি ইরানী সেনাবাহিনীর প্রতি এক আবেদনে তাদেরকে জেগে উঠতে বলেন এবং শাহের শাসন উৎখাত করার আহ্বান জানান। তিনি একইভাবে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তারা যেন এ স্বৈরতন্ত্রকে অদৌ বরদাশত না করে, যা ইরানকে পুরোপুরি দাসত্বের শৃঙ্খখলে আবদ্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শাহ বুঝতে পারলেন, এ হচ্ছে তাঁর ক্ষমতার প্রতি সারাসরি হুমকি। তিনি চিন্তাভাবনা করে দেখলেন, যতদিন ইমাম খোমেইনী দেশে আছেন ততদিন জনগণের স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা যাবে না। ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি জনগণের সমর্থন তাঁর সরকারের কাছে ছিল অসহনীয়। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটলে তারা বিপ্লবের মাধ্যমে উপনিবেশবাদকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে। লক্ষ মানুষের আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য শাহ তাই ইমামকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা ভাবলেন।

ইসলামী কর্তব্য পালনের তাগিদে ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানী জাতির বিরুদ্ধে রেযা খানের কৃত অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা প্রকাশ করেন। তিনি ইরানের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রেযা খানের অমার্জনীয় অপরাধ ও ষড়যন্ত্রের কথা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করেন।

সেসময় ইরানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ইমাম খোমেইনীর পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতা সকলের মনন ও চিন্তাশক্তিকে আলোড়িত করে এবং সকলে পূর্ণভাবে সজাগ হয়।

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)