ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ইবাদাত
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৫

পৃথিবীর অন্যসব ধর্মে ইবাদাত-বন্দেগিকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিষয়াবলি থেকে বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলাম এরূপ কোন ধর্ম নয়। পবিত্র ইসলামে ধর্ম জীবনের সর্ববিধ বিষয়ের সাথে জড়িত এবং সম্পৃক্ত। অর্থাৎ ইসলামে ইবাদাতের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই যে, ধর্ম জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইসলাম ব্যতিরেকে অন্যান্য ধর্মমতে ইবাদাতের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা একান্তই সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ। এ কথাটাকে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, একজন হিন্দু যতক্ষণ পর্যন্ত মন্দিরে দেব-দেবীর পূজা-অর্চনায় লিপ্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্তই সে হিন্দু। আর অন্য সময়ে সে একজন সাধারণ মানুষ। এভাবে একজন খ্রিস্টান যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রুশের সম্মুখে অবস্থান করে তখন সে খ্রিস্টান আর অন্য সময় সে একজন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থাই চলছে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একজন মুসলমান শুধু মসজিদের চৌহদ্দির মধ্যেই মুসলমান নয়; বরং সে সর্ববস্থায়ই মুসলিম। চিন্তা-চেতনার দিক থেকেই হোক আর ধর্মীয় মূলনীতিগুলোর অনুসরণের দিক থেকেই হোক অথবা কর্মগত দিক থেকেই হোক- একজন মুসলমানের কর্ম ইসলামের আলোকেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।
আমাদের সমাজ জীবনে উত্তম বলে গণ্য প্রতিটি মানবীয় কর্ম এবং যেসব কর্মের প্রভাব সমাজ বিন্যাসে ও সমাজ গঠনে সহায়ক তার সবই ইবাদাত। মানব জীবনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বন্দেগি, ইসলামের মূল তাৎপর্যই হচ্ছে প্রকৃত ইবাদাত।
কোন কোন জ্ঞানী লোক ইবাদাতের অর্থ বোঝাতে গিয়ে একটি সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁরা নামায, রেযা, হজ, যাকাত- বিশেষ করে ধর্মের কতিপয় কাজকেই ইবাদাত বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে ইবাদাতের ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। আল্লাহ তাআলা বলেন :
و ما خلقت الجنّ و الانس الا ليعبدون
এ আয়াত দ্বারা এটা বোঝানো হয়েছে যে, জ্বীন ও ইনসানের সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগি করা। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানুষের সদিচ্ছাপ্রসূত এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রতিটি পুণ্যময় এবং উপকারী কাজই ইবাদাত। আর যখন এটা সাব্যস্ত হলো যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর মর্জি মোতাবেক যা কিছু সম্পাদন করা হয় তাই ইবাদাত, এমতাবস্থায় বিদ্যা-শিক্ষা, জ্ঞানার্জন, রুটি-রুজি অন্বেষণ, ধর্মীয় খেদমত, সামাজিক তৎপরতা, অসহায় ও নিঃস্বের সাহায্য, বাতিল শাসন ব্যবস্থা বিলোপ ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম- এ সবকিছুই ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা যায় তাহলে বলব যে, প্রতিটি ইবাদাতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে সমাজের পরিশুদ্ধি, পরিবেশ তৈরি, শিশুদের প্রতিপালন ও পরিচর্যা, সমাজ সংশোধন, ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা, আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি, বিধবা ও ইয়াতিমদের দেখাশোনা এবং ধৈর্য ও তাকওয়ার অনুশীলন।
যদিও ইসলামে এমন কিছু কিছু ইবাদাত-বন্দেগি রয়েছে যা শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদাত হিসাবেই গণ্য, যেমন নামায, হজ ইত্যাদি। আর এগুলো হচ্ছে এমন ইবাদাত যা জামায়াতবদ্ধভাবে আদায় করা হয়ে থাকে। এসব ইবাদাতের উপকারিতা এবং গুরুত্ব সূর্যালোকের মতোই উজ্জ্বল। তবে ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে নিষ্পন্ন ইবাদাতগুলোকেও এমনিভাবে নির্ধারণ করেছে যাতে ইবাদাত-বন্দেগির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপনের প্রয়োজনগুলোও পূরণ হয়ে থাকে। যেমন নামাযের কথা উল্লেখ করা যায় যা আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এ নামায যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবেও আদায় করে তাহলে সে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্তব্য এবং নৈতিক গুণাবলি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়ে থাকে। যথা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন, অন্যের অধিকার সংরক্ষণের অনুভূতি, সময়-জ্ঞান, দিক নির্ণয, চেতনা ও অনুভূতিগুলোর সুনিয়ন্ত্রণ, আল্লাহর সৎ ও খাঁটি বান্দাদের সঙ্গে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির ঘোষণা ইত্যাদি।
সার্বিক বিবেচনায় ইবাদাত হচ্ছে আল্লাহ তাআলা নৈকট্যলাভের একটি উপায় যা মানুষের জন্য মেরাজ তুল্য। ইবাদাতের মাধ্যমেই আত্মা সমুন্নত হয়। ইবাদাত হচ্ছে একটি জিনিস যাকে প্রকৃত উপাস্যের নৈকট্য লাভের কেন্দ্রাভিমুখে রূহের উড্ডয়ন, আধ্যাত্মিক দক্ষতা লাভের প্রশিক্ষণ এবং খোদায়ী শক্তি-সামর্থ্য অর্জনের প্রয়াস বলা যেতে পারে। ইবাদাতের মাধ্যমেই শরীরের ওপর রুহ বা আত্মার বিজয় সূচিত হয়ে থাকে। মোট কথা, ইবাদাত হচ্ছে এই বিশ্বলোকের সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বড় উপায়।
ইবাদাতের মাপকাঠি
ইবাদাত-বন্দেগি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হওয়া উচিত। ইবাদাতে বিন্দু পরিমাণ প্রদর্শনের (রিয়া) ইচ্ছাও গ্রহণযোগ্য নয়; বরং এটি বান্দাসুলভ বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। হযরত আলী (আ.) বলেন :
ان قوماً عبدو الله رغبةً فتلك عبادة التّجار، و ان قوماً عبدو الله رهبةً فتلك عبادة العبيد، و ان قوماً عبدو الله شكراً فتلك عبادة الاحرار
‘কোন জাতি যখন বেহেশত লাভের আকাঙ্ক্ষায় আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগি করে, তখন তার ইবাদাত হবে ব্যবসায়ীসুলভ আর যে জাতি জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহর ইবাদাত করে তার ইবাদাত হচ্ছে দাসসুলভ আর যে জাতি আল্লাহর করুণা ও নেয়ামতের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ইবাদাত করে তার ইবাদাত হচ্ছে স্বাধীন ব্যক্তির ইবাদাতের মতো।’ তিনি অন্যত্র বলেছেন :
الهي ما عبدتك خوفاً من نارك و لا طمعاً في جنتك بل وجدتك مستحقاً للعبادة فعبدتك
অর্থাৎ ‘হে আমার প্রভু! আমি জাহান্নামের ভয়ে তোমার ইবাদাত করছি না, জান্নাত লাভের আশায়ও করছি না; বরং আমি তোমাকে উপাস্য হওয়ার উপযুক্ত বিবেচনায়ই তোমার ইবাদাত করছি।’
ইসলামের মহান আলেমদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইবাদাত
নবী করিম (সা.) বলেছেন : ‘কোন কোন আলেমের এক ঘণ্টা চিন্তা-ভাবনা একজন আবেদের সত্তর বছরের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম।’ এ হাদীসের ভাবধারা সুস্পষ্ট, আর তা হলো এই যে, একজন সাধারণ ইবাদাতকারীর ইবাদাতের সম্পর্ক হচ্ছে শুধু তার ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে। অন্যদিকে একজন আলেমের এক ঘণ্টার চিন্তা-ভাবনা সমাজের পরিশুদ্ধি, ধর্ম ও শরীয়তের সংরক্ষণ এবং সমাজের অসহায় ও দুর্বলদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্য কথায় একজন (সাধারণ) আবেদ স্বীয় ইবাদাত-বন্দেগিতে ইল্ম বা জ্ঞানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, কিন্তু একজন আলেম তা হয় না। আলোচ্য হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত যে, আলেমের চিন্তা-ভাবনাও ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। এভাবে নবী করিম (সা.)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে :
مداد العلماء افضل من دماء الشهداء
‘আলেমের কলমের কালি শহীদদের রক্তের চেয়ে উত্তম।’ এরূপ কেন হলো? অথচ আমরা জানি যে, শাহাদাত হচ্ছে একটি বড় ইবাদাত। এমনকি অন্যান্য ইবাদাত মানুষের জীবন রক্ষা করে সম্ভব, কিন্তু শাহাদাত এমন একটি ইবাদাত যা মানুষের জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। শাহাদাত যখন এরূপ একটি বড় ইবাদাত তখন আলেমদের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে উত্তম কেন? প্রকৃত কথা হচ্ছে এই যে, শহীদের রক্ত হচ্ছে একটি বার্তা বা বাণী সমতুল্য; আর আলেমদের কলমের কালি হচ্ছে বার্তাবহ বা বাণীবহ। আর বাণীবহ ছাড়া কোন বার্তা এবং বাণী মরু সাহারায় ধ্বনি তোলার মতো। এ কারণেই গ্রন্থ রচনা ও সংকলনও ইবাদাত। এ ইবাদাত শহীদদের রক্তের সংরক্ষণকারী হিসাবে গণ্য হবে।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ধর্মীয় জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে ইবাদাত
একটি প্রশ্ন মানুষের মনে স্বভাবতই সৃষ্টি হয়ে থাকে যে, ইমাম তো পর্দার আড়ালে রয়েছেন এবং তাঁর নিকট পৌঁছাও সম্ভব নয়, তাহলে এমতাবস্থায় শরীয়ত সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাগুলো এবং সকল প্রকার ধর্মীয় ব্যাপারে কিভাবে অবহিত হওয়া যাবে? এ প্রসঙ্গে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন :
من كان من الفقهاء حافظاً لدينه صائناً لنفسه مخالفا لهواه و مطيعاً لامر مولاه فللعوام ان يقلدوه
‘ফকীহদের মধ্যে যে ফকীহ ধর্মের হেফাজতকারী, নিজের নাফ্সকে সংরক্ষণ করে, প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, স্বীয় প্রভুর প্রতিটি নির্দেশকে মান্য করে- এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তাঁর অনুসরণ করা।’ এখানে ‘সাধারণ মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার (উক্ত ফকীহর) অনুসরণ করা’- ইমামের এ বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যে ফকীহ নয় তথা ফিকাহ শাস্ত্রবিদ নয় সে সাধারণ মানুষের মধ্যে গণ্য- ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার কিছুটা দখল থাকলেও।
বিবেকের বিচারেও ফকীহদের বিদ্যমানতা আবশ্যক। তা হলেই সাধারণ মানুষ তাঁদের মাধ্যমে শরীয়ত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
ফকীহগণ যে একটি হুজ্জাত (প্রমাণ) এই ব্যাপারে ইমাম মাহদী (আ.) বর্ণিত একটি হাদীস নিম্নরূপ : ‘তারা (ফকীহগণ) হচ্ছে তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে দলিল, আর আমি তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দলিল, তাদের নির্দেশ প্রত্যাখ্যানকারী মূলত আমার নির্দেশকে প্রত্যাখ্যানকারীর সমতুল্য, আর আমার নির্দেশ প্রত্যাখ্যানকারী আল্লাহ তাআলার নির্দেশ প্রত্যাখ্যানকারী তুল্য।’ (ওয়াসায়েলুস শিয়া)
ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানলাভ তথা ইজতিহাদ বা গবেষণা সমস্ত ইবাদাত-বন্দেগির মধ্যে আরেকটি ইবাদাত। একজন ফকীহ কুরআন, সুন্নাত, আকল ও ইজমার আলোকে অনুসন্ধান করে যে ফল দাঁড় করান শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই ফতোয়া বলে। তবে ইজতিহাদে ভুলেরও সম্ভাবনা থাকে। কেননা, পবিত্রতা (عصمت) তথা সকল প্রকার ভুলত্রুটি ও পাপ থেকে মুক্ত থাকা মূলত আল্লাহ তাআলার বিশেষ করুণা বলতে হবে- যা তিনি নবী এবং ইমামদের জন্যই নির্ধারিত করে দিয়েছেন। অতএব, যদি কোন ফকীহ বা মুজতাহিদ কোন বিষেয়ে গবেষণা (ইজতিহাদ) করেন এবং তা যদি সঠিক হয়, তা হলে তিনি দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী হবেন- প্রথমত তাঁর পরিশ্রম ও সাধনার জন্য আর দ্বিতীয়ত তাঁর গবেষণালব্ধ বিষয়ের বিশুদ্ধতার জন্য। কেননা, ফকীহ হচ্ছেন ইমামের প্রতিনিধি।
ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুধু যে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ছিলেন তাই নয়; তিনি উঁচু স্তরের একজন মুজতাহিদ এবং ফকীহও ছিলেন। তিনি জীবনভর দীনী-জ্ঞান অর্জন বিষয়ক ইবাদাতটি পালন করে গেছেন। ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো যখন মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর একের পর এক আঘাত হানে, ইসলামের দুশমনদের ইঙ্গিতে সালমান রুশদীর মতো একজন কুখ্যাত লেখক মুসলিম উম্মাহর মাতৃতুল্য নবীর স্ত্রীগণ এবং স্বয়ং নবী করিম (সা.)-এর বিরুদ্ধে স্যাটানিক ভার্সেসের মতো অশোভন পুস্তক রচনা করে মুসলিম উম্মাহকে আহত করে তখন ইমাম খোমেইনী (রহ.) সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে ইসলামের শত্রুদের একথা বুঝতে বাধ্য করেছিলেন যে, ইসলামের আকীদা-বিশ্বাসের ওপর হামলা এবং তা নিয়ে খেলতামাসা করার অধিকার কারো নেই। সুতরাং ইমামের এই ফতোয়া ঘোষণার পর থেকে ব্রিটিশ সরকার সালমান রুশদীর নিরাপত্তার জন্য প্রতি মাসে হাজার হাজার ডলার খরচ করছে। এই ফতোয়া ঘোষিত হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ সরকার অদ্যাবধি অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে ইমাম (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর সালমান রুশদী এবং তার অনুসারীরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, সংকটের নিরসন হয়ে গেছে। কিন্তু রাহবার আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী উক্ত ফতোয়ার সপক্ষে নতুন করে ঘোষণা দিয়ে সালমান রুশদীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলেন। আর তার জন্য নিয়োজিত নিরাপত্তা ব্যূহ সত্ত্বেও সে আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মনে হচ্ছে যেন সে কিস্তিতে নিহত হচ্ছে। ইমামের এই ফতোয়ার আলোকে সালমান রুশদীকে হত্যা করা একটি বড় ইবাদাত। ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার ফলশ্রুতিতে সম্পাদিত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ইবাদাতের মাধ্যমে একজন দুর্বিনীত এবং অশিষ্ট লোককে যেভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে তাতে এটা তো সাব্যস্ত হলো যে, ইসলামের কোন দুশমন নবী (সা.)-এর স্ত্রীগণ এবং স্বয়ং পয়গাম্বর (সা.)-এর ব্যাপারে এ ধরনের অশালীন আচরণ করতে সাহস পাবে না। সালমান রুশদীর মৃত্যুদ- ঘোষণা দেয়ার পর অনেকেই ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল; কিন্তু ইমাম তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি তো ইবাদাত হিসাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ ফতোয়া জারি করেছিলেন- আর কোন মুফতিই তাঁর ফতোয়া প্রত্যাহার করে নেন না।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ঐক্যের সংগ্রাম
ইবাদাতসমূহের মধ্যে আরেকটি বড় ইবাদাত হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা। সমকালীন বিশ্বে ইমাম খোমেইনী (রহ.) মুসলিম ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই ইবাদাতের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ঐক্য হচ্ছে একটি নেয়ামত। মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য আল্লাহ তাআলা এভাবে নির্দেশ দিয়েছেন :
واعتصموا بحبل الله جميعا و لا تفرقوا
‘আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’
আরো বলা হয়েছে : ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই।’
ইমাম পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন, শিয়া-সুন্নি বিরোধ সৃষ্টিকারীরা সুন্নিও নয়, শিয়াও নয়; বরং তারা ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর চর। প্রকৃতপ্রস্তাবে শিয়া এবং সুন্নির উদাহরণ হচ্ছে কাঁচির দুটি ফলার মতো। যতক্ষণ পর্যন্ত এ দুটি বিচ্ছিন্ন থাকবে ততক্ষণ কুফ্র ও শির্ক বেড়েই চলবে, আর যখন এ দুটি মিলিত তথা অবিচ্ছিন্ন থাকবে তখন কুফ্র ও শিরকের প্রাধান্যও হ্রাস পেতে থাকবে। মুমিনদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মতদ্বৈধতা সৃষ্টি বড় অপরাধ- যা আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।
আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘এবং যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফ্রী ও মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে…’ সূরা তাওবা : ১০৭
এ হচ্ছে মসজিদে কুবার বিপরীতে নির্মিত মসজিদ যা ‘মসজিদে জিরার’ নামে অভিহিত। আর এটি নির্মাণের উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের ক্ষতিসাধন, কুফ্রীর বিস্তার এবং মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এই মসজিদে দাঁড়াবারও অনুমতি দেননি। বরং আল্লাহ তাআলা বলেছেন : لا تقم فيه ابدا ‘হে নবী! তুমি কখনও এতে দাঁড়াবে না।’ অতএব, আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মসজিদটি নিশ্চিহ্ন করে দেন যাতে এই মসজিদের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে যে অনৈক্য সূচনা করার চেষ্টা হয়েছিল তা নিঃশেষ হয়ে যায় আর মুমিনদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে ঐক্য একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয়। মুসলমানরা যদি পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে বৃহৎ শক্তিগুলো পদানত হতে বাধ্য। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তব্য হচ্ছে এই যে, যদি মুসলমানগণ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয় এবং প্রত্যেক মুসলমান যদি এক বালতি করে পানি ইসরাইলী ভূখণ্ডে ঢেলে দেয় তাহলে এই লুটেরা ও আগ্রাসী ইসরাইল প্লাবনের তোড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আহ্বানেই ‘ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ’ (১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত) পালিত হচ্ছে। তাঁর এ পদক্ষেপ থেকেই উপলব্ধি করা যায় যে, ঐক্য তাঁর নিকট কতখানি প্রিয় ছিল! তিনি জানতেন ঐক্যের মধ্যে কী পরিমাণ শক্তি নিহিত রয়েছে! প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শক্তি ও মুসলমানদের ক্ষমতা লাভের উৎস এ ঐক্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এ ঐক্যের বদৌলতেই মুসলমানরা তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে।
ঐক্য প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন :
لا فخر لعرب على عجم و لا بيض على الاسود
অর্থাৎ ‘একজন অনারবের ওপর কোন আরবের এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর কোন শ্বেতাঙ্গের কোনই গৌরব নেই।’ মোট কথা, ঐক্য হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত- যে ব্যাপারে প্রতিটি মুসলমানেরই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। মুসলিম মিল্লাতের দরদি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর অসিয়তনামায় বলেন :
‘মুসলিম জাতিগুলোর প্রতি আমার অসিয়ত তারা যেন নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে তথা ইসলাম ও ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়নে উপায় হিসাবে কখনো বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা না করেন। এই জীবন সঞ্জীবনী কাজে আপনাদের নিজেদেরকেই জেগে ওঠা উচিত, যা আপনাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে।’
‘সুতরাং মুসলিম দেশসমূহের ওলামা ও ওয়ায়েজগণের কর্তব্য তাঁদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো তারা যেন বৈদেশিক শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং দেশের জনগণের সাথে ঐক্যে উপনীত হয়। এর মধ্যেই তাদের জন্য সাফল্য নিহিত রয়েছে। ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইসলামবিরোধী বর্ণপ্রথার বিলোপ সাধনের জন্য ওলামা ও ওয়ায়েজগণ তাঁদের জাতিকে আহ্বান করুন। তাঁরা যেন বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসী ভাইয়ের সাথে হাত মেলান। কারণ, ইসলামের জন্য তারা সব সময়েই ভাই। যখন ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা একবার সকল মুসলিম সরকার ও জনগণের মাঝে বাস্তবে রূপ লাভ করবে তখন আপনারা দেখবেন মুসলমানরাই দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইনশা আল্লাহ, একদিন আমরা মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে এই ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্য স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করব, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে সামাজিক ইবাদাত
ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসলামের সামগ্রিক ইবাদাত-বন্দেগির ওপরই জোর দিয়েছেন। তবে তিনি সেসব ইবাদাতের ওপরই বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন যেগুলোর সম্পর্ক রয়েছে ঐক্য-সংহতি, সমাবেশ, ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতির সাথে। যেমন জুমআর নামায ও হজের মহাসম্মিলন। জামায়াতবদ্ধভাবে নামায আদায় যা দিনে কয়েকবারই সম্পন্ন হয়ে থাকে তা দ্বারা একটি ইসলামী সমাজে ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কয়েকবার দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে থাকে। জামায়াতবদ্ধভাবে নামায হচ্ছে এরূপ একটি ইবাদাত যার জন্য ইমাম খোমেইনী (রহ.) বাস্তবভাবে ইরানে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর তা হচ্ছে যে, এখানে শিয়াদের জামায়াতে সুন্নিরা শরীক হয়ে থাকেন আর সুন্নিদের জামায়াতে শিয়ারা শরীক হয়ে থাকেন। আর এভাবেই ইসলামী ঐক্যের একটি সুন্দর দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
জুমআর নামায
দৈনিক পাঁচবার যে নামায আদায় করা হয় তার মাধ্যমে আশেপাশের লোকজন উপকৃত হয়ে থাকে। কিন্তু জুমআর নামাযের যে সমাবেশ হয় তাতে আরো ব্যাপক উপকার পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী লোকদের ব্যাপারে তথ্য লাভ করার মতো সুযোগও এতে হয়ে থাকে। জুমআর নামায প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী গণসংযোগকে দৃঢ় করা, মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা এবং পরস্পরের হাল অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া। ইমাম খোমেইনী (রহ.) জুমআর নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিয়েছেন। এটা এজন্য যে, এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজ অধিক হারে মৌলিক উপকারগুলো অর্জন করতে সক্ষম হবে। সুতরাং জুমআর নামাযের খুতবা দানের মাধ্যমে ইমামগণ ইরানী জাতির অন্তর জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এভাবেই এ সমাবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে হজের ইবাদাত
হজ হচ্ছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত যার অসংখ্য উপকারিতার মধ্যে একটি বড় উপকারিতা হচ্ছে এই যে, এটি আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে ইসলামী ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বকে সুসংহত করার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই ইবাদাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানগণ বছরে একবার কাবা ঘরে সমবেত হয়ে নিজেদের ধর্মীয় বিষয়াবলি, অর্থনীতি, রুটি-রুজি সংক্রান্ত বিষয় এবং সমাজ সংশোধনের ব্যাপারে মতবিনিময় করবে এবং তারা এ মর্মে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে যে, তাদের সংকটসমূহ নিরসনের উপায় কী? ইমাম খোমেইনী (রহ.) হজের এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত প্রসঙ্গে বলেন : ‘হজ হচ্ছে এমন মহান অনুষ্ঠান যা মানবতাকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে সজাগ করে তোলে।’ হজ এমন একটি মহৎ অনুষ্ঠান যা দ্বারা মানুষ উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদা, আরব-আজম সবাই একই সারিতে সমবেত হয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম খোমেইনী আরো বলেন : ‘এটা অনস্বীকার্য সত্য যে, দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রশক্তি অথবা কোন নেতা এ ধরনের একটি মহান অনুষ্ঠান আয়োজনের যোগ্যতা রাখেন না। শুধু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অনুগ্রহেই এ বিশাল সমাবেশের ব্যবস্থা হয়ে থাকে।’ ইমাম খোমেইনী (রহ.) পবিত্র কুরআনের সূরা বারাআতের আলোকে হজকে মুশরিকদের সঙ্গে বারাআত বা সম্পর্কচ্ছেদের একটি উত্তম উপায় বলে গণ্য করেন। আর এ কারণেই ইরানী হাজিগণ মক্কায় পৌঁছে ‘আমেরিকা মুর্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আর এ সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রেক্ষিতেই ইমাম বলেছিলেন, মক্কা-মদিনা কারো মালিকানাধীন নয়; বরং এ হচ্ছে বিশ্বের সকল মুসলমানের সম্পত্তি। আর এ কারণেই মক্কা-মদীনার প্রশাসনিক ব্যবস্থা মুসলিম দেশগুলোর ওপরই ন্যস্ত হওয়া প্রয়োজন।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে জিহাদ সংক্রান্ত ইবাদাত
শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম যামান তথা ইমাম মাহদী (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে জিহাদ ফরজ হওয়ার বিষয়টি পরিত্যক্ত বা স্থগিত হয়ে থাকে। এটা এজন্য যে, জিহাদ হয় কোন মাসুম ইমামের উপস্থিতিতে সংঘটিত হয়ে থাকে অথবা কোন মাসুম ইমামের নির্দেশে হয়ে থাকে। আর বর্তমান যুগে এ উভয় পদ্ধতিই অসম্ভব। হ্যাঁ, যদি কোন শত্রু আক্রমণ করে তাহলে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে সে আক্রমণের জবাব দেয়া প্রয়োজন- যাকে বলা হয় ‘প্রতিরক্ষা’। সুতরাং আক্রমণকারী আগ্রাসী ইরাককে প্রতিহত করার লক্ষ্যে যে সব জবাবী হামলা করা হয়েছিল সেগুলোকে ইমাম ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
সূরা হজে আল্লাহ বলেন : … ‘এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত।’ সূরা হজ : ৭৮
মহানবী (সা.) বলেছেন যে, বেহেশত হচ্ছে তলোয়ারের নিচে। জিহাদের গুরুত্বকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না, এ ইবাদাতকে এজন্যই ফরয বা অবশ্য কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে যাতে কাফের এবং মুশরিকরা ইসলামের অগ্রগতির পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। যদি জিহাদ না হতো তাহলে কাফের-মুশরিকদের ইসলামবিরোধী তৎপরতার কারণে ইসলামের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো। আর প্রতিরক্ষাও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই হওয়া প্রয়োজন। এই ইবাদাতের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তির স্বীয় প্রবৃত্তি শামিল হয়ে যায় তাহলে পুণ্য তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। অর্থাৎ সওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা ইসলামের ইতিহাসের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, পরিখার যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে আমর ইবনে আবদে উদ পরাভূত হয়। অহংকারী আমরকে ধরাশায়ী করে তিনি তার বুকের ওপর চড়ে বসলেন। দেহ থেকে তার শির বিচ্ছিন্ন করে দেবেন- ঠিক এই মুহূর্তেই আমর তাঁর সঙ্গে একটি অশোভন আচরণ করে। সে হযরত আলীর মুখমণ্ডলে থুথু নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি তার বুকের ওপর থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং যখন তার রাগ প্রশমিত হলো তখনই তিনি তাকে হত্যা করলেন। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল : ‘আপনার এরূপ করার কারণ কী?’ তিনি বলেন : ‘যদি সে অবস্থায় আমি তাকে হত্যা করতাম তাহলে আমি আমার নাফ্স বা প্রবৃত্তির ইচ্ছার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তাম।’ হযরত আলী (আ.) একই মুহূর্তে দুটি জিহাদই সম্পন্ন করেছেন- আমরের বুকের ওপর থেকে উঠে আসা যা বড় জিহাদ হিসাবে গণ্য এবং তাকে হত্যা করা- যা ছোট জিহাদ হিসাবে গণ্য। এটা এজন্য যে, মাসুম ইমামদের বর্ণনা অনুসারে প্রবৃত্তির ইচ্ছা ও অভিলাষের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিহাদ। ইমাম খোমেইনীও এই বড় জিহাদের ওপর গুরুত্ব আরো করেছেন এবং কলম চালিয়েছেন। সুতরাং তিনি তাঁর একটি গ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘জিহাদে আকবার’। এই গ্রন্থে তিনি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
পরিখার যুদ্ধে যখন হযরত আলী (আ.) আমর ইবনে আবদে উদকে হত্যা করেন তখন নবী করিম (সা.) বলেন : অর্থৎ পরিখার যুদ্ধের দিন আলীর আক্রমণ সাকালাইনের জিন-ইনসানের ইবাদাতের চেয়ে উত্তম। এ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা ইবাদাতের ক্ষেত্রে বান্দার আমলের পরিমাণ দেখেন না; বরং আমলের ওজন বা গুরুত্বকেই দেখে থাকেন। পরিখার যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)-এর উক্ত ইবাদাত ছিল একটি মুহূর্তের বিষয়; কিন্তু ওজনের দিক দিয়ে তা ছিল সাকালাইনের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানী জনগণকে জিহাদে (প্রতিরক্ষা) উদ্বুদ্ধ করে অনেক বক্তব্য প্রদান করেন। এর প্রভাবে ইরানী জাতি তাদের যুবকদেরকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করাকে নিজেদের জন্য সৌভাগ্যের কারণ বলে মনে করে। জিহাদের ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা সমাজে চালু আছে। আর তা হচ্ছে যে, জিহাদ মানে যুদ্ধ। অথচ আরবি ভাষায় যুদ্ধ বলতে ‘হারব’ جرب শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। নিজের আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক হামলার অধীন শত্রুকে নিধন করা জুলুম নয়; বরং ন্যায়সঙ্গত। কারণ, ইসলামী জিহাদ হচ্ছে ঈমানী তৎপরতা বা কর্মকাণ্ডেরই একটি বহিঃপ্রকাশ। যেভাবে কোন অভিজ্ঞ ডাক্তার জীবন রক্ষার তাগিদে রুগীর দেহে অস্ত্রোপচার করে তার শরীর থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত কোন অংশ কেটে ফেলেন যাতে ঐ দূষিত অংশের কারণে শরীরের বাকি অংশে কোন রোগ সংক্রমিত হতে না পারে তেমনিভাবে সেসব দুষ্ট লোককেও সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি যারা মানব সমাজ ও শান্তির ধর্মের জন্য ক্যান্সারস্বরূপ।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা
সমুদয় ইবাদাত-বন্দেগির মধ্যে সৎকাজের আদশে দান ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখাও একটি উল্লেখযোগ্য ইবাদাত। কিন্তু এই ইবাদাতটি সম্পন্ন করা যে কোন লোকের পক্ষে সম্ভব নয়; কারণ, এর জন্য কতিপয় সাধারণ শর্তও রয়েছে। প্রথমত শর্ত হচ্ছে এই যে, ব্যক্তির নিজেরই এসব মন্দ আচরণ ও স্বভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে যে ব্যাপারে সে অন্যদের কাছে প্রচার করবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তোমরা কি লোকদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দাও আর নিজেদেরকে বিস্মৃত হও?’ (সূরা বাকারা : ৪৪)
এটা একান্তই প্রয়োজন যে, যখন কোন মানুষ কোন বিষয়ে অন্যের নিকট প্রচার করবে, তখন তাকে সে ব্যাপারে যতটুকু সম্ভব সচেতন ও যত্নশীল এবং বাস্তব নমুনা হতে হবে।
কুরআন মজিদে আরো বলা হয়েছে : …‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল হোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; এরাই সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)
আরো বলা হয়েছে : …‘তোমরা একটি উত্তম জাতি, বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্যই তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করো এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো… ।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)
কুরআনের উপরোল্লিখিত বক্তব্যের আলোকে সৎকাজের আদেশ দান এবং অসৎকাজে নিষেধ একটি বড় ইবাদাত। ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইবাদাতটি যথাযথ আদায় করার জন্য নিজে যেমন চেষ্টায় থাকতেন, তেমনি অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি লোকদেরকে ইসলামের অধ্যয়ন ও অনুশীলনের জন্য আহ্বান জানাতেন। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ইমাম খোমেইনী (রহ.) তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট মি. মিখাইল গর্বাচেভের উদ্দেশে যে ঐতিহাসিক বাণী প্রেরণ করেন তাতেও তিনি এই ইবাদাতের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা ইমাম খোমেইনীর উক্ত বাণী থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা প্রয়োজন বোধ করছি। ইমাম বলেন :
‘জনাব গর্বাচেভ! সবাইকে সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা উচিত। ব্যক্তিমালিকানা, অর্থনৈতিক (সমস্যা) ও স্বাধীনতা (হীনতা) আপনাদের প্রধান সমস্যা নয়। এটি হচ্ছে সত্যিকারের খোদা বিশ্বাসের অনুপস্থিতি। সেটাতো এমন এক সমস্যা যেটা পাশ্চাত্যকে নোংরামি ও অচলাবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে সে অবস্থাই বিরাজ করবে। সকল সত্তা ও সৃষ্টির উৎস যে খোদা তাঁর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ও অর্থহীন সংগ্রামই আপনাদের প্রধান সমস্যা।’
‘জনাব গর্বাচেভ! যখন আপনাদের কোন কোন প্রজাতন্ত্রের মসজিদের মিনারগুলো থেকে আল্লাহু আকবার ও শেষ নবী (সা.)-এর নবুওয়াতের সাক্ষ্যের ধ্বনি শ্রুত হয় তখন এটি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে আনন্দাশ্রু বয়ে আনে।’
ইমামের প্রেরিত এই বাণী গর্বাচেভের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। যার ফলশ্রতিতে গর্বাচেভ প্রতিনিধিদলের নিকট বলেছিলেন, ‘আমার জন্য এটা বড়ই গৌরবের ব্যাপার যে, আমি পৃথিবীর প্রথম নেতা যার নিকট হযরত ইমাম একটি বাণী প্রেরণ করেছেন।’ অতঃপর সোভিয়েত নেতা ইমামের প্রতিনিধি দলের নিকট ব্যক্ত করেন : ‘আপনারা ইমামের নিকট এ সংবাদ পৌঁছে দিবেন যে, আমরা শীঘ্রই সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্মীয় স্বাধীনতা বহাল করতে যাচ্ছি।’ ইমামের প্রেরিত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতেই রাশিয়ার মতো একটি খোদাবিমুখ দেশে তেলাওয়াতে কুরআন, নামাযের আযান এবং রোযা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি স্বাধীনভাবে পালনের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর এ কর্মপদ্ধতির মধ্যে মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিতের বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে। যেভাবে নবী করিম (সা.) তাঁর সমসাময়িক যুগের রাজা-বাদশাদের নিকট ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন তেমনিভাবে তিনিও নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করতে গিয়ে সত্যের পথে আহ্বান করে এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত এবং শরীয়তের এমন একটি আবশ্যিক বিষয় পালন করেছেন যার দৃষ্টান্ত বর্তমান যুগে একান্তই বিরল।