ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ইরাকে নির্বাসিত জীবন
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ২২, ২০১৪
১৯৬৫ সালের অক্টোবরে ইমাম খোমেইনীকে তুরস্ক থেকে ইরাকের নাজাফে পাঠানো হয়। নাজাফ শুধু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই নয়, নির্বাসিত ইরানী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের আশ্রয়স্থল হিসেবেও খ্যাত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলনের সমর্থক আলেমরা কিংবা তামাক আন্দোলনের সময় অথবা তারও আগে তাঁরা ইরাকের শহরগুলোতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। এবার কিন্তু ইমাম খোমেইনীর জন্য নাজাফ কোনক্রমেই বিপদমুক্ত ছিল না। পাশ্চাত্য প্রচারমাধ্যমগুলোর অপপ্রচারের জবাবে একথা উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ইরাকের বাথ সরকারের সাথে সামান্যতম বন্ধুত্ব বা বোঝাপড়ার ফলে ইমাম সেখানে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করেননি; বরং বিভিন্ন প্রকার কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ জারি করে বারবার বিভিন্নভাবে তাঁকে অনর্থক হয়রানি করা হতো।
নাজাফে ইমাম জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান বিতরণ ও গ্রন্থ রচনার কাজে আত্মনিয়োগ করার সাথে সাথে ইরানী জনগণের আন্দোলনের পথনির্দেশনা প্রদানের কাজও অব্যাহত রাখেন। সেখান থেকে সময় সময় ইরানী জনগণের উদ্দেশে ও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলি সম্পর্কিত বাণী রেকর্ড করে পাঠাতেন। ইমামের এসব বাণীর হাজার হাজার কপি অল্প সময়ের মধ্যেই গোপনে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত।
নাজাফে অবস্থানকালেই ইমাম খোমেইনী তাঁর ‘বেলায়াতে ফকীহ’ সংক্রান্ত চিন্তাধারা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন। এ গ্রন্থই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করে। কারণ, বেলায়াতে ফকীহ বা ফকীহর শাসনের অপরিহার্যতা মানেই হচ্ছে ফকীহ নয় এমন ব্যক্তির শাসন অবৈধ এবং অগ্রহণযোগ্য- তা রাজতন্ত্রই হোক কিংবা অন্য কোন ধরনের সরকারই হোক। ইমামের অনুসারী আলেমগণ দ্বীনী অনুষ্ঠানাদিতে বেলায়াতে ফকীহ বা ইসলামী হুকুমত সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকেন।
এদিকে কোমের ধর্মতত্ত্ববিদ ও ধর্মীয় শিক্ষকবৃন্দ ইমামকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিলেন এবং সর্বত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্লাস মূলতবী ঘোষণা করলেন। কিন্তু তাঁদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। সরকার ইমামকে ফিরিয়ে আনতে রাজি হলো না।
ইরাকে নির্বাসিত জীবনে ইমাম সবসময়ই চিন্তা করতেন কিভাবে ইরানী জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যায়। ইমাম এ সময় প্রদত্ত তাঁর এক ভাষণে বলেন : ‘যারা ইসলাম ও তার পবিত্র নীতি-আদর্শের মর্যাদা বৃদ্ধি ও মুসলিম জনগণকে বিদেশী শক্তির আধিপত্যের কবল থেকে রক্ষার ব্যাপারে নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ (সৎকাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের নিষেধ করা)-এর দায়িত্ব পালন করছেন এবং তা করতে গিয়ে জেল-জীবন অতিবাহিত করছেন বা শহীদ হচ্ছেন তাঁদের পরিবার-পরিজন জীবনের আসল অবলম্বন হারিয়ে ফেলছেন। এদের সাহায্য-সমর্থনে আপনাদের এখলাসের সাথে এগিয়ে আসা উচিত, কিন্তু তাঁদের আত্মসম্মান বা মর্যাদাবোধে যাতে ঘা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইসলামী ছাত্র সমিতির সদস্যদের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে তিনি বলেন : ‘ইসলামী প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার রূপ কী, মুসলিম জনগণের সাথে শাসকদের সম্পর্ক কেমন হবে এবং জনগণের সম্পদ থেকে তারা কিভাবে অর্থ গ্রহণ করবে, এ সম্পর্কিত নীতিমালা আপনারাই মানবসমাজে পরিচিত করবেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইরানী স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে কখনো ইতস্তত করবেন না। ইরানে যে পৈশাচিকতা, গণহত্যা এবং বেআইনি কার্যকলাপ চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন।’
রাজতন্ত্রী সরকারের দুর্নীতির আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইরানে রাজতন্ত্রের ২৫০০তম বার্ষিকী উপলক্ষে পালিত উৎসব। অবশ্য এ অনুষ্ঠানকে পাহলভী রাজবংশের ৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপন বা গদীচ্যুত শাহের রাজ্যাভিষেক উৎসবও বলা যেতে পারে। সে অনুষ্ঠানে অন্তঃসারহীন জাঁকজমকের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছিল তা ছিল জাতির জন্য বিরাট বোঝাস্বরূপ। ইমাম এ প্রসঙ্গে প্রেরিত এক বাণীতে বলেন : ‘যালিম শাসকগোষ্ঠী মনে করে যে, আমি আমার এ জীবন নিয়ে সুখী। মযলুম জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দেখার জন্য বাঁচার চেয়ে আমার বরং মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়। আমি মনে করি, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো আমার কর্তব্য।
আমাদেরকে বার বার বলা হয়েছে, আমরা যেন রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম বা বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ না করি। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে কোন আন্দোলন বা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহর মহান নবী-রাসূল ও ধর্মীয় নেতারাই সবসময় স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন।
দেশে আলেমদের সংখ্যা ১৫০০০০ ছাড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে খ্যাতনামা ধর্মতত্ত্ববিদ ও মহান মুজাহিদও রয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর যুলুম-অত্যাচারের কথা তাঁদের জানা আছে। সে সম্পর্কে তাঁরা যদি লিখেন এবং বলেন, তাহলে জয় তাঁদেরই হবে নিঃসন্দেহে।
বঞ্চিত জনগণ উপোস করছে, অথচ শাহী শান-শওকত ও উৎসবের জন্য শুধু তেহরানেই ৮০ কোটি রিয়াল বরাদ্দ করা হয়েছে। তোমরা (সরকার) মৃতদের জন্য উৎসব কর, কিন্তু জীবিতদের অবজ্ঞা কর। শাসকগোষ্ঠী জনগণের তহবিল লুটপাট করছে এবং জাতীয় সম্পদের উৎস বিদেশীদের ভোগ-ব্যবহার করার পূর্ণ সুযোগ দিচ্ছে।’
শাহ বুঝতে পারল তার ক্ষমতার মসনদ নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। কাজেই সে এমন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার চিন্তা করল যা হবে সকল রাজনৈতিক দলের একটি একক দল এবং রাজতন্ত্রী আদর্শের প্রচারক। কিন্তু এ শয়তানি পরিকল্পনা চরমভাবে ব্যর্থ হলো।
শাহের নবগঠিত রাজনৈতিক দল রাস্তখিজ পার্টি সম্পর্কে ইমাম জনগণের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে বলেন : ‘ইরানের বঞ্চিত জনগণকে জোর-জবরদস্তি করে রাজতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ এটি একটি বাজে ও ক্ষয়িষ্ণু পদ্ধতি, এমন এক পদ্ধতি যা ইসলাম স্বীকার করে না, বরং নিন্দা করে। এ শাসকগোষ্ঠী আল-কুরআনকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। শাহ নিয়মতান্ত্রিকতার কথা বলে, শাসনতান্ত্রিক আইনের কথা বলে, অথচ সে নিজেই এসব কিছু মুছে ফেলতে চেয়েছে। যেহেতু রাস্তখিজ পার্টি ইসলাম ও ইরানী মুসলিম জনগণের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছে, সেহেতু এ দলে কারো যোগ দেয়া উচিত নয়। অন্যথায় যোগদানকারী ব্যক্তি যালিমের সাহায্যকারী এবং মযলুমের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলে বিবেচিত হবে।’
১৯৬৭ সালের এপ্রিলে ইমাম খোমেইনী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিকট একটি খোলাচিঠি পাঠান। এসময় ইরানের প্রধানমন্ত্রী ছিল আমীর আব্বাস হোবায়াদা। ইমাম তাঁর চিঠিতে হোবায়দা এবং শাহকে বারবার ইসলাম ও সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি তাঁর চিঠিতে সকল সরকারি নীতির সমালোচনা করেন এবং হোবায়দাকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, একদিন তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে তিনি যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন তা কার্যকর হতে দেখা যায় ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবী আদালত কর্তৃক হোবায়দাকে মৃত্যুদ- প্রদানের মাধ্যমে।
নির্বাসিত জীবনে ইমাম খোমেইনীর ঘোষণার আরো একটি উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭০ সালের মে মাসে ইরানী অর্থনীতিতে আমেরিকা অধিকতর অনুপ্রবেশ ও শোষণকে আরো পাকাপোক্ত করে তোলার জন্য বিনিয়োগকারী কনসোর্টিয়াম তেহরানে এক আলোচনায় বসে। ইমাম খোমেইনী এ সময় পর পর অনেকগুলো ঘোষণা জারি করেন। এ উপলক্ষে ইমাম খোমেইনীর অন্যতম অনুসারী আয়াতুল্লাহ সাঈদী তেহরানের এক মসজিদে ঐ আলোচনা সভাকে নিন্দা করে খুতবা দেন এবং শাহের গুপ্ত পুলিশ সাভাকের হাতে নির্যাতিত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম তখন পাহলভী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জনগণকে নতুন করে শপথ নেয়ার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ইমাম খোমেইনী নির্বাসিত জীবনে দুইবার- একবার ১৯৭১ সালে এবং আরেকবার ১৯৭৯ সালে বিপ্লব চলাকালে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে বাণী পাঠান এবং তা হজের সময় বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিলি করা হয়। ঐ আবেদনে তিনি মুসলিম উম্মাহর সংহতি এবং পারস্পরিক সমস্যা মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।
(নিউজলেটার, অক্টোবর ১৯৯১)