শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৯, ২০২০ 

মো. আশিফুর রহমান –
ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.) মহানবী (সা.)-এর বংশধারার অস্টম ইমাম। ইমাম রেযা (আ.) ১৪৮ হিজরিতে ১১ যিলকদে পবিত্র মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর জন্মের সন ও মাস সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম মূসা কাযিম (আ.)। তাঁর মায়ের নাম ছিল নাজমা। এ মহান ইমামের নাম ‘আলী’ এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে তিনি মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতবর্গের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি, যার নাম ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এর পরে ‘আলী’ রাখা হয়।
ইমাম রেযা (আ.) ৩৫ বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব লাভ করেন। ইমাম কাযেম (আ.) তাঁর ইমামতের ব্যাপারে তাঁর শিষ্যদেরকে জানিয়ে যান। তাঁর জীবনকালে আব্বাসি খলিফারা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তিনি এসময় কঠিন দুর্ভোগের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। মার্ভে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইমাম রেযা (আ.) মদিনাতেই বসবাস করতেন। তিনি সেখানে মানুষকে হেদায়াত করা ও ইসলামি শিক্ষা প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। মদিনার লোকজন ইমামকে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। পুরো ইসলামি বিশে^ই তাঁর অনেক অনুসারী ছিল।

কুনিয়াত ও পদবি
ইমাম রেযা (আ.)-এর নাম ছিল আলী, কুনিয়াত ছিল আবুল হাসান। তাঁর বিখ্যাত সম্মানসূচক উপাধি ছিল রেযা যার অর্থ সন্তুষ্টি। তাঁর সন্তান ইমাম মুহাম্মাদ আত-তাকী (আ.) বলেন, মহিমান্বিত ও সর্বশক্তিমান প্রভু তাঁর নাম রাখেন রেযা। কারণ, আল্লাহ তাঁর প্রতি বেহেশতে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহর নবী (সা.), পবিত্র ইমামগণ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট এবং তাঁর নেতৃত্বের প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁর বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজন এমনকি তাঁর শত্রুরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট তাঁর উন্নত নৈতিক চরিত্রের কারণে।
তাঁর অন্যতম প্রধান উপাধি ছিল ‘আলিমে আলে মুহাম্মাদ’ অর্থাৎ মুহাম্মাদের বংশের জ্ঞানী ব্যক্তি। এই উপাধি দেখায় যে, তাঁর জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিষয়টি প্রকাশ করে। সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের সাথে তাঁর বিতর্ক, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের প-িতদের সাথে বির্তক এই বিষয়ের সত্যতাকে প্রকাশ করে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি
ইমাম রেযা (আ.)-এর ইমামতকাল ছিল ২০ বছর যেটিকে তিনটি শাসনকালে বিভক্ত করা যায় :
১. হারুনুর রশিদের খেলাফতকালের দশ বছর
২. আমিনের খেলাফতকালের পাঁচ বছর
৩. মামুনের খেলাফতকালের পাঁচ বছর
প্রথম দশ বছরের শুরুর দিকে ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-কে শহীদ করা হয় এবং ইমাম আলী (আ.)-এর বংশধররা নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। হারুনুর রশিদ রেযা (আ.)-কে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই সুযোগ করে উঠতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে আমিন খলিফা হন। এই সময়ে হারুনের মৃত্যুর কারণে সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমিন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ায় তিনি বা তাঁর গভর্নররা ইমামের দিকে লক্ষ্য দিতে পারেন নি। তাই এ সময়টি ইমাম ও ইমামের অনুসারীরা মোটামুটি নির্বিঘেœ দিন কাটান।
অবশেষে মামুন তাঁর ভাই আমিনকে হত্যা করে খলিফা হন। তিনি তাঁর বিদ্রোহীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে ইসলামি ভূখ-ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর একজন প্রতিনিধিকে ইরাকের দায়িত্ব দিয়ে নিজে মারভে স্থিত হন। তিনি ফযল ইবনে সাহল নামের একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে তাঁর মন্ত্রী ও উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। আলী বংশীয়রা মামুনের রাজত্বের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ ছিল। অনেক দিন নির্যাতন ভোগের পর তারা শাসনক্ষমতার মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর সুযোগ পায়। যে কোনো প্রকাশ্য বা গোপন সুযোগ আসলেই তারা মামুনের বিরোধিতা করত এবং আব্বাসী খেলাফতের পতন ঘটানোর চেষ্টা করত। উপরন্তু তারা সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং মুসলমানদের সমর্থন লাভ করে। তাই যখনই আলাভীরা আব্বাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত তখন সমাজের প্রতিটি শ্রেণি থেকে লোকদের সমর্থন পেত, বিশেষ করে আহলে বাইতের অনুসারীদের নিকট থেকেÑ যারা আব্বাসী খেলাফতের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আব্বাসী ও উমাইয়্যারা সবসময় ইমামদেরকে তাদের খেলাফতের জন্য হুমকি মনে করত যাঁরা জনসাধারণের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সত্যিকার উত্তরসূরি বলে পরিচিত ছিলেন। তাই ইমামগণ সবসময়ই ক্ষমতাশীন খলিফাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন।
মামুন তাদের সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যে, প্রথমে তিনি তাঁর শাসনক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে এবং সমাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে। মামুন কঠিন অবস্থা মোকাবেলার জন্য একটি নতুন সমাধান বের করেন যা তাঁর পূর্বসূরিরা করতে সক্ষম হননি। মামুন তাঁর মন্ত্রী ফাযলের সাথে পরামর্শ করে একটি ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলেন। তিনি ইমাম রেযা (আ.)-কে খলিফা হবার প্রস্তাব দেয়ার এবং নিজে খেলাফতের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর চিন্তা করলেন। কারণ, তিনি জানতেন যে ইমাম সেই প্রস্তাব গ্রহণ করুন বা না করুন এটি মামুনের জন্য একটি বিজয় হিসেবে দেখা হবে। যদি ইমাম সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে খলিফা হন তাহলে মামুন হবেন যুবরাজ এবং এটি ইমামের পরবর্তীকালে মামুনের জন্য শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথে উন্মুক্ত করে দেবে। সে যদি এমন কাজ করতে পারে তাহলে গোপনে ইমাম রেযা (আ.)-কে সরিয়ে সে আইনগতভাবেই খলিফা হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। এক্ষেত্রে আহলে বাইতের অনুসারীরা তাঁর শাসনব্যবস্থায় খুশি হবে এবং তাঁকে ইমামের পর বৈধভাবে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নেবে। অন্যদিকে জনগণ যখন তাঁর খেলাফতকে ইমাম কর্তৃক বলে মেনে নেবে তখন তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন বৈধতা হারিয়ে ফেলবে।
আর যদি ইমাম খলিফা হওয়ার প্রস্তাব মেনে না নেন তাহলে তাঁর খেলাফতকে বৈধতা দিতে তিনি ইমামকে যুবরাজ হওয়ার ব্যাপারে বাধ্য করবেন। এর মাধ্যমে তিনি আহলে বাইতের অনুসারী বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ করার ভিত্তিকে দুর্বল করতে সক্ষম হবেন এবং সেই বিদ্রোহ জনগণকেও যেমন সন্তুষ্ট করবে না, অপরদিকে ইমামের অনুসারীদেরকেও সন্তুষ্ট করবে না। অন্যদিকে তিনি ইমামকে তাঁর নিকটে অবস্থান করতে বাধ্য করে আন্দোলনকে দমন করতে সক্ষম হবেন। উপরন্তু ইমামের অনুসারীরা ইমামকে খেলাফতের পদ গ্রহণ না করার কারণে সমালোচনা করবে এবং তিনি জনগণের মাঝে তাঁর যে সম্মান ছিল তা হারিয়ে ফেলবেন।
মামুন তাঁর অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানোর জন্য তাঁর কিছু বিশেষ প্রতিনিধিকে মদিনায় ইমামের নিকট প্রেরণ করেন যাতে তারা ইমামকে খোরাসানে আসতে বাধ্য করতে পারে। তিনি আরো নির্দেশ দেন যে, ইমামকে এমন পথ দিয়ে নিয়ে আসতে হবে যে পথে তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা নিতান্তই কম হবে। সেই সময়ে প্রধান সড়কগুলো ছিল কুফা, জাবাল, কেরমানশাহ এবং কোমÑ যে নগরীগুলো প্রধানত আহলে বাইতের অনুসারীদের বাসস্থান ও তাদের শক্তির কেন্দ্র ছিল। মামুন ভেবেছিলেন যে, যদি এই রাস্তা দিয়ে ইমামকে নিয়ে আসা হয় তাহলে হয়তো তাঁর অনুসারীরা তাঁকে খোরাসানে আসতে বাধা দেবে আর তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতে পারে যা তাঁর শাসনক্ষমতার জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে বসরা, আহওয়াজ এবং ফার্সের পথ ধরে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তাঁর প্রতিনিধিরা সর্বক্ষণ ইমামের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল এবং সবসময় তাঁর কর্মকা-ের প্রতিবেদন মামুনের নিকট পাঠাচ্ছিল।
যখন ইমাম রেযা (আ.) মার্ভে প্রবেশ করলেন তখন মামুন তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান এবং জনসাধারণের উদ্দেশে একটি বক্তব্য রাখেন যেখানে তিনি বলেন : ‘সবার জানান উচিত যে, আমি বনু আব্বাস অথবা বনু আলীর মধ্যে আলী ইবনে মূসা আর-রেযার চেয়ে খেলাফতের যোগ্য আর কাউকে চিনি না।’ এরপর তিনি ইমামের দিকে মুখ ফিরান এবং বলেন : ‘আমি খেলাফতের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আপনাকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করছি।’ ইমাম রেযা (আ.) বলেন : ‘যদি আল্লাহ তোমার জন্য খেলাফতকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করে থাকেন তাহলে অন্য কাউকে সেটি দেয়ার অনুমতি নেই আর যদি এটি তোমার জন্য না হয়ে থাকে তবে অন্য কাউকে তা দিয়ে দেয়ার অধিকারও তোমার নেই।’ মামুন তাঁকে পীড়াপীড়ি ও যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন যেন তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু ইমাম বলেন : ‘আমি কখনই তা গ্রহণ করব না।’ মামুন হতাশ হয়ে ইমামকে বলেন : ‘তাহলে আমার উত্তরাধিকারী ও আমার মৃত্যুর পর খলিফা হওয়াকে মেনে নিন।’ এমন অবস্থা দুই মাস যাবত চলতে থাকে। ইমাম রেযা (আ.) মামুনকে এক পর্যায়ে বলেন : ‘আমি আমার পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি যে, আমি তোমার আগে মারা যাব এবং আমাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হবে আর পৃথিবী ও বেহেশতের ফেরেশতারা আমার জন্য ক্রন্দন করবে এবং আমি বিদেশ বিভূঁইয়ে হারুন অর রশিদের কবরের পাশে সমাহিত হব।’
আবাসাল্ত হারাভী বলেন : খেলাফত ও যুবরাজ পদের প্রস্তাবের পর এবং ইমাম কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যান ও মামুনের পক্ষ থেকে অনেক পীড়াপীড়ির পর অবশেষে মামুন ইমামকে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘খোদার কসম! হয় আপনি যুবরাজ পদ গ্রহণ করবেন নতুবা আপনাকে তা গ্রহণে বাধ্য করব। সেক্ষেত্রে আপনি যদি তা মেনে নেন (তাহলে তো মেনেই নিলেন) অন্যথায় আপনার শিরñেদ করব।’ এরপর ইমাম বলেন : ‘যেহেতু আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে, তাই আমি তা গ্রহণ করছি তবে আমি কাউকে পদে অধিষ্ঠিত করব না বা কাউকে ক্ষমতাচ্যুতও করব না এবং কোনো রীতি-নীতিকে পরিবর্তন করব না এবং শাসনকার্যে জড়িত হব না।’ মামুনও এ প্রস্তাব গ্রহণ করে নেন।
এরপর ইমাম রেযা (আ.) তাঁর দুই হাত তুলে মোনাজাতে বলেন, ‘হে আমার প্রভু! তুমি জান যে, তারা আমাকে বন্দি করেছে এবং আমি বাধ্য হয়ে এটি (যুবরাজের পদ) গ্রহণ করেছি। তাই দয়া করে আমাকে তিরস্কার করো না তোমার দুই নবী, ইউসুফ ও দানিয়েলের মতো, যখন তাঁরা তাঁদের সময়ের রাজাদের কর্তৃক (বাধ্য হয়ে) তাঁদেরকে দেয়া পদ গ্রহণ করেছিলেন। হে আমার প্রভু! তোমার প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনো প্রতিশ্রুতি নেই এবং তোমার প্রভুত্ব ছাড়া কোনো প্রভুত্ব নেই। সুতরাং আমাকে তোমার ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং তোমার নবীর সুন্নাতকে অনুসরণ করতে সাহায্য কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বোত্তম প্রভু এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী।’

যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত করার কারণ
যখন ইমাম রেযা (আ.) যুবরাজ পদে আসীন হন, তখন ইমামের চারপাশের সহচররা আনন্দিত হন। তাদের মধ্যে একজন বলেন : ‘আমি বড়ই আনন্দ ও উৎসাহের মধ্যে ছিলাম।’ এমন সময় ইমাম (আ.) আমাকে বললেন : ‘তোমার অন্তরকে বাইরের এ ভালো দেখে উদ্বেলিত করো না এবং আনন্দিত হয়ো না। কারণ, একাজের একটা পরিণতি রয়েছে।’
কয়েকটি কারণে মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজের পদ গ্রহণে আহ্বান জানায় বলে মনে করা হয়। যেমন-
১. যদি ইমাম রেযা (আ.) উপযুক্ত হয়ে থাকেন তবে তাঁর মর্যাদাকে ব্যবহার করা।
২. আর যদি তিনি উপুক্ত না হয়ে থাকেন তবে তাঁকে জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিলাষ।
৩. আমিনের সমর্থক বনি আব্বাসের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
৪. ইমাম আলী (আ.)-এর বংশধরদের বিদ্রোহকে প্রতিহত করা এবং
৫. রাষ্ট্রের অবস্থা স্থিতিশীল করা।
তবে মামুন নিজেই বনি আব্বাসের চাপের কারণে নিজ অভিসন্ধির কথা প্রকাশ করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন : ‘এ লোকটি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে ছিল, লোকদেরকে নিজের দিকে আহবান জানাতো। তাই আমি চেয়েছি তাকে নিজের যুবরাজ পদে বসাতে। যাতে যদি সে লোকজনকে আহবান জানায়, সেটা যেন হয় আমাদের দিকে। আর তার বিরোধিতাকারীকে চিনতে পারি এবং রাজত্বও থাকে আমাদের অধিকারে, তাঁর নয়। আমার ভয় হচ্ছিল তাকে ঐ অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে রাখতে। এখন আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটা করেছি। এটা আমার ভুল হয়েছে। ভুলটা হলো এই যে তাকে বিখ্যাত ও শ্রদ্ধাবান করে নিজের ধ্বংসই কাছে ডেকে এনেছি। সুতরাং এখন আর তাঁর ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। তবে আমাদের উচিত হবে তাঁকে তিলে তিলে ভেঙ্গে ফেলা এবং হেয় করা । যাতে জনগণের কাছে তাঁকে এমনভাবে তুলে ধরবো যে, সে এ খেলাফত ও যুবরাজ পদের যোগ্য নয়। তারপর পরিকল্পনা করে তাঁকে শেষ করে দিব।’
এথেকে বোঝা যায় যে, মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজ করার বাহানায় নিজ আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন যাতে তিনি ইমামের প্রতিটি গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে পারেন। আর খেলাফত প্রদানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তিনি এর মাধ্যমে এটাও চেয়েছিলেন যে, আলী বংশীয়রা যাতে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে।
মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজ ঘোষণার পরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উৎসব পালন করে। দিরহাম ও দিনারে ইমামের নাম মুদ্রণ করে। তার মেয়ের সাথে ইমাম রেযা (আ.)-এর বিয়ে দেয়।
ইমাম রেযা (আ.) কিছু ঘটনার মাধ্যমে মামুনের মুখোশ উন্মোচন করে দেন। মামুন ভাবতেন যে, ইমাম ভুল করতে পারেন। আর তাই তিনি চেয়েছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত করার মাধ্যমে ইমামের ভুল-ভ্রান্তি জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু ইমাম এ অবকাশটুকুও মামুনকে দেননি। অন্যদিকে ইমাম রেযা (আ.) বিভিন্ন বিতর্কে অন্যান্য প-িতকে পরাজিত করে প্রমাণ করেন যে, তিনিই ইমাম। এর ফলে ইমামের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিপরীতে এতে মামুন ভয় পেয়ে যান।
জনগণের পক্ষ থেকে ইমামকে নজিরবিহীন সম্বর্ধনা প্রদান মামুনকে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণে বাধ্য করে। এর ফলে মামুনের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে ইমাম (আ.) জনগণকে বুঝিয়ে দিলেন যে, মামুন ইমাম রেযা (আ.) ও আহলে বাইত এবং আলাভীদের বিরোধী। আর তাঁর অন্যান্য কাজ, যেমন সবুজ রংকে সেøাগানে পরিণত করা, ইমাম রেযা (আ.)-এর নামে মুদ্রা বের করা… সবই তাঁর কূটকৌশল মাত্র।

প-িতদের সাথে বিতর্ক
যখন মামুন ইমামের প্রতি জনগণের ব্যাপক আকর্ষণ ও উদ্দীপনার বিষয়টি লক্ষ্য করলেন তখন তিনি ইমামের পবিত্র ও সম্মানজনক অবস্থানকে খাটো করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। ইমামকে হেয় করার একটি পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের সাথে ইমামের বিতর্কের আয়োজন করা। তিনি আশা করছিলেন যে, প-িতরা হয়তো এই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করবে এবং ইমামের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে পরাজিত করতে সক্ষম হবেন।
মামুন ফাযলকে নির্দেশ দিলেন বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদেরকে দাওয়াত দেয়ার। ফযল খ্রিস্টান বিশপ, ইহুদি প-িত, সাবেয়ী, যরাথ্রুস্টদের ধর্মযাজক এবং অন্য ধর্মতাত্ত্বিকদেরকে দাওয়াত দিলেন। মামুন তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং পরবর্তী দিনে ইমাম রেযা (আ.)-এর সাথে বিতর্কের আয়োজন করেন। সকালে মামুন এক লোককে ইমাম রেযা (আ.)-এর কাছে প্রেরণ করেন। ইমাম রেযা (আ.) তাকে বলেন : ‘তুমি কি জান কখন মামুন তার এ সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করবে?’ লোকটি বলল : ‘কখন, হে জনাব?’ ইমাম বললেন : ‘যখন মানুষ আমাকে ইহুদিদেরকে তাওরাত থেকে, খ্রিস্টানদেরকে বাইবেল থেকে, দাউদের অনুসারীদেরকে দাউদের সহীফা থেকে, সাবেয়ীনদেরকে তাদের নিজেদের ভাষায় অগ্নিপূজকদেরকে ফারসিতে এবং রোমানদেরকে তাদের ভাষায় তাদের যুক্তিকে খ-ন করতে দেখবে এবং যখন তারা তাদের বিশ^াসকে একপাশে রেখে আমার কথায় বিশ^াস করতে দেখবে। সেই সময়ে মামুন বুঝতে পারবে যে, সে যা করতে চায় তা করতে সক্ষম নয় এবং পরিতাপ করবে। আর আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই, তিনি সুউচ্চ ও সুমহান।’ তারপর ইমাম মামুনের সভায় যোগ দিলেন। তিনি প্রবেশ করলে মামুন তাঁকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন : ‘আমি চাই আপনারা তাঁর সাথে বিতর্ক করুন।’ ইমাম রেযা (আ.) তাঁদের সাথে তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থ থেকেই তাঁদের বিশ^াস ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলেন। তারপর তিনি বললেন : আপনাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকেন যিনি ইসলামের বিরোধী তাহলে তিনি নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’ উমরান সায়েবী, যিনি অন্যতম ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন, তিনি ইমামকে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন এবং ইমাম একে একে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবং তাঁকে অভিভূত করে ফেললেন। ইমামের নিকট থেকে তাঁর প্রশ্নসমূহের জবাব শুনে তিনি কলেমা শাহাদাত পড়লেন এবং মুসলমান হয়ে গেলেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইমামের বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে শেষ হলো এবং জনগণ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। এরপর থেকে ইমাম উমরান সায়েবীর সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে সম্মান জানাতেন। তারপর তেকে তিনি ইসলামের একজন প্রচারকে পরিণত হন।
রাযা বিন যাহাক, যে মামুনের নির্দেশে ইমামকে মদিনা থেকে মার্ভে নিয়ে এসেছিল সে বলে : ‘ যে শহরেই ইমাম প্রবেশ করছিলেন সেখানেই জনগণ সব জায়গা থেকে এসে ভিড় করছিল এবং তারা তাদের ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করছিল। এর বিপরীতে ইমাম তাদের প্রশ্নগুলোর জবাব দিচ্ছিলেন এবং মহানবী (সা.) ও ইমাম আলী (আ.) থেকে অনেক হাদিস বর্ণনা করছিলেন। যখন আমি এই সফর থেকে ফিরে আসলাম তখন আমি মামুনের কাছে গেলাম। মামুন সফরের সময় ইমামের আচরণ কেমন ছিল তা জিজ্ঞাসা করলে আমি সফরকালে যা হয়েছিল তার বর্ণনা দিলাম। মামুন বললেন : ‘হ্যাঁ, যাহাকের পুত্র! তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে জ্ঞানী এবং দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি।’
ঈদের নামায পড়ানো
রমযান মাসের শেষে মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে ঈদুল ফিতরের নামায পড়ানোর জন্য আহ্বান জানান। ইমাম রেযা (আ.) এই শর্তে নামায পড়ানোর জন্য রাজি হন যে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতো করে এই দিনে নামাযের আয়োজন করবেন।
ঈদের দিনে ইমাম সাধারণ কাপড় পরিধান করে এবং খালি পায়ে নামাযের জন্য বের হলেন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিতে থাকলেন। নগরীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল যেহেতু তারা সবাই ইমামের সাথে স্লোগান দিচ্ছিলেন। মামুন এ অবস্থা দেখে ভড়কে যান এবং ইমামকে নামায পড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানান।

ইমামের নৈতিক চরিত্র ও আচরণ
তাঁর নৈতিক গুণাবলি ও ধার্মিকতা তাঁর বন্ধুদেরকে যেমন তেমনি তাঁর শত্রুদেরকেও আকৃষ্ট করত। তিনি মানুষকে সৌজন্যতা, সম্মান ও দয়ালু আচরণ করতেন যতটা সম্ভব এবং তিনি কখনই সাধারাণ জনগণ থেকে পৃথক হননি।
তাঁর একজন সাথি বলেন, আমি কখনই তাঁকে মন্দ কথা বলতে শুনিনি কিংবা কারো কথার মধ্যে বিঘœ সৃষ্টি করতে দেখি নি। যদি তিনি দরিদ্রকে দেয়ার সামর্থ্য রাখতেন তখন তিনি দরিদ্রকে প্রত্যাখ্যান করেন নি এবং তিনি কখনই তাঁর পা অন্যদের সামনে বিছিয়ে দেন নি। আমি কখনও তাঁর দাসদের প্রতি কটু কথা বলতে শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। তিনি সবসময় উচ্চ শব্দে হাসার পরিবর্তে মৃদু হাস্য করতেন।তিনি যখন খেতে বসতেন তখন বাড়ির সকলকে নিয়ে একসাথে খেতে বসতেন। তিনি রাত্রিকালে অল্প ঘুমাতেন আর বেশিরভাগ সময় জেগে থাকতেন ও নামায পড়তেন। তিনি প্রচুর রোযা রাখতেন। তিনি প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখতেন। তিনি প্রচুর দান-খয়রাত করতেন এবং রাতের অন্ধকারে গোপনে দরিদ্রদেরকে সাহায্য করতেন।’
তাঁর আরেক জন সাথি বলেন, ‘গ্রীষ্মকালে তাঁর বিছানা ছিল একটি ম্যাট আর শীতকালে ছিল একটি কাপড়ের চট। তিনি বাড়িতে মোটা কাপড় পরিধান করতেন, কিন্তু জনসাধারণের সমাবেশে তিনি নিজেকে উত্তম কাপড়ে সজ্জিত করতেন।

ইমামের সমাধিক্ষেত্র
ইমাম রেযা (আ.) আব্বাসীয় খলীফা মামুনের আমলে তুস নগরীর নওকন এলাকার অন্তর্গত ‘সানাবাদ’ নামক গ্রামে পঞ্চান্ন বছর বয়সে ২০৩ হিজরির ২৩ যিলকদ শাহাদাতবরণ করেন এবং মামুনের নির্দেশে হারুনের কবরের পাশে সমাধিস্থ হন। ইমাম রেযা (আ.)-এর সন্তান ইমাম জাওয়াদ (আ.) তাঁর পিতার দাফন, কাফন ও জানাযা পড়ান।
যেহেতু তিনি প্রাচীন শহর তূসে শহীদ হয়েছিলেন সেজন্য জায়গাটি প্রথমে মাশহাদুর রেযা নামে এবং পরবর্তীকালে শুধুই মাশহাদ নামে পরিচিত হয়। আরবি ‘মাশহাদ’ শব্দের অর্থ শহীদ হওয়ার স্থান।
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় বিভিন্ন অধ্যায়ে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘আমি বিষ প্রয়োগে নিহত ও বিদেশের মাটিতে সমাহিত হব’ এবং খলীফা মামুনকেই তাঁর হত্যাকারী বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
ইমাম রেযা (আ.)-এর বংশধর
ইমাম রেযা (আ.) পাঁচ পুত্রের জনক ছিলেন। তাঁরা হলেন : ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ তাকী, হাসান, আলী, হোসাইন, মূসা এবং এক কন্যা ছিল ফাতেমা নাম্মী। ইমাম রেযা (আ.) এর সন্তান ইমাম মুহাম্মাদ তাকী আল জাওয়াদ (আ.)-এর মাধ্যমেই তাঁর বংশধারা অব্যাহত থাকে।