ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ও তাঁর ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা
পোস্ট হয়েছে: জুন ১, ২০২০
মো. আশিফুর রহমান –
ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) সম্পর্কে একটি কথা খুবই প্রসিদ্ধ যে, ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায় বিচারের প্রতি অতিশয় গুরুত্ব দেয়ার কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন। এটি খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, যে ধর্মের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং এ ধর্মের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য ছিল ন্যায়পরায়ণ হওয়া, সেখানে কেবল ন্যায়নীতিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই ইমাম আলী (আ.)-কে শহীদ হতে হয়েছিল! মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায় বিচার সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।
যেসব মূল্যবোধ আমাদের সমাজের সুতাগুলোকে একত্রে গেঁথে রাখে এবং আমাদের সামাজিক অস্তিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলো অনেক এবং এগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টিও স্পষ্ট। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধগুলোর মধ্যে কোন্্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। তারপর তাঁরা যে বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ন্যায় বিচার।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কোরআন মজীদের ঘোষণা
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের মূলোৎপাটন করার জন্য নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
ক্সক্স
‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মানদ- অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।’ (সূরা হাদীদ : ২৫)
কোরআন মজীদের অন্যত্র বলা হয়েছে :
‘(হে রাসূল) বল, আমার প্রতিপালক ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সূরা আরাফ : ২৯)
আরো বলা হয়েছে :
ক্স
নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়দের অধিকার প্রদানের আদেশ করেন এবং অশ্লীলতা, অসমীচীন (ও অপছন্দনীয়) কর্ম ও সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেন; তিনি তোমাদের উপদেশ দান করেন যাতে তোমরা উপদেশ (ও শিক্ষা) গ্রহণ কর।-সূরা নাহল : ৯০
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সূরা নিসার ১৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
ক্স
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সর্বদাই ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেক এবং নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সত্যের সাক্ষী হিসেবে পেশ করো যদি এই কাজটি তোমার নিজের পিতা-মাতার কিংবা নিজের আত্মীয়-স্বজনের ওপরেও আসে। সে ব্যক্তি ধনী হোক বা গরিব হোক এটা কখনও দেখবে না। কেননা, তাদের উভয়ের চেয়ে আল্লাহর অধিকার অনেক বেশি। অতএব, তুমি কখনও ন্যায় বিচার করতে খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’
ন্যায়বিচারকের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা
মহান আল্লাহ বলেন :
ক্স
‘আর যদি তাদের মধ্যে বিচার-নিষ্পত্তি কর, তবে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার-নিষ্পত্তি কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন।’Ñ সূরা মায়েদা : ৪২
কিয়ামতে ন্যায়বিচারকারীদের অবস্থা
ন্যায়পরায়ণ খলিফা আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই প্রিয়। পক্ষান্তরে অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই ঘৃণিত। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন : ‘ন্যায়পরায়ণ খলিফা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে। আর অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ও সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। অধিকন্তু সে আল্লাহর দরবার থেকেও বহু দূরে অবস্থান করবে।’ অন্য একটি হাদিসে রয়েছে যে, ন্যায়পরায়ণ লোকদেরকে আল্লাহ তাআলা তাঁর পাশে স্থান দেবেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : কঠিন হাশরের দিনে যখন মহান আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোথাও কোনো ছায়া থাকবে না তখন মাত্র সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহ তাআলার আরশের নিচে ছায়া পাবে, তাদের প্রথম হচ্ছে ন্যায়পরায়ণ শাসক বাদশা বা বিচারক। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার
ন্যায়বিচার সম্পর্কে ইমাম আলী (আ.) থেকে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ঐশী বিধি ও নির্দেশমালা হলো শরীরের মতো যার আত্মা হলো ন্যায়বিচার। এজন্যই তিনি বলেন : ‘আইনের আত্মা হলো ন্যায়বিচার।’Ñ ফেহেরেস্তে গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ২৩৬
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সম্প্রীতির সাথে জীবন যাপনের লক্ষ্যে ব্যক্তি এবং সমাজের একটি সমন্বিত নীতির প্রয়োজন রয়েছে। আর তা ন্যায়বিচার ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তাই তিনি বলেন : ‘ন্যায়বিচার হলো শাসনকার্য পরিচালনার পদ্ধতি।’Ñ ফেহেরেস্তে গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ২৩৬
ইমাম আলী আরো বলেন : ‘ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা হলো মানব জাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মানদ- যাতে সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য কর এবং এই ঐশী মানদ- অনুযায়ী কর্ম কর। একে অমান্য করো না।’Ñ মিযানুল হিকমা, মুহাম্মদ রেইশাহরী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৭৮
ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ন্যায়নীতি হলো এমন বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা নীতি, কর্ম এবং মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে বিচার করা হয়। এ বিষয়টি ‘নাহজুল বালাগা’য় ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করে : ‘কোন্টি উত্তমÑ ন্যায় বিচার নাকি উদারতা? উত্তরে তিনি (আ.) বললেন : ন্যায়বিচার প্রত্যেক জিনিসকে তার যথাস্থানে রাখে। আর উদারতা সেটাকে তার স্থান হতে বের করে নিয়ে যায়। ন্যায়বিচার সর্জজনীন রক্ষক। আর উদারতা বিশেষ এক শ্রেণির জন্য উপকার বয়ে আনে। সুতরাং ন্যায় বিচারই শ্রেয়তর।’Ñ নাহজুল বালাগা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ৪৩৭
ইমাম আলীর আরেকটি বক্তব্যেও বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে : ‘সকল গুণের মধ্যে মূল্যবান হলো ক্ষমা ও মহানুভবতা এবং সবচেয়ে কার্যকরী বৈশিষ্ট্য হলো ন্যায়বিচার।Ñ গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ১৫৬
সামাজিক ন্যায়বিচার অন্যান্য মূল্যবোধকেও ধারণ করে। আর তাই তা অর্জনের মধ্য দিয়ে অন্য সকল মূল্যবোধও অর্জিত হয়। এই কারণে ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ন্যায়বিচারের মধ্যেই এর সার নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন : ‘ন্যায়বিচারের মধ্যে অনেক সুযোগ রয়েছে, আর যে ন্যায়বিচারকে সহ্য করতে পারে না সে অবিচারকে আরো কঠিন হিসেবে দেখতে পাবে।Ñ নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১৫
ন্যায়বিচার ও ইমাম আলী (আ.)
ইমাম আলী (আ.)-এর বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেখানে তিনি বলেন : ‘আলী মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী।’
আলী (আ.) ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক। ৩৫ হিজরিতে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি পূর্ববর্তী তিন খলিফার সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদেরকে বিচার কার্যে সাহায্য করেছেন। যখনই তাঁর কাছে বিচারকার্য ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে তখনই তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। এ ব্যাপারে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের উক্তি প্রসিদ্ধ যে, ‘আবুল হাসান (ইমাম আলী) না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।’ (ইবনে যাওযী প্রণীত তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃ. ৫৭; ইস্তিয়াব, পৃ. ১৫-২০; এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত আশারা মোবাশ্শারা, পৃ. ১৯৩)
আমরা জানি যে, একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভর করে আইনের শাসনের ওপর। আর যদি আইনের শাসন না থাকে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পরে তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের সময়ে ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্নর ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের কারণে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর একটি পর্যায়ে হযরত উসমান নিহত হন। এরপর জনগণ ইমাম আলী (আ.)-কে তাদের খলিফা নির্বাচন করে। ৩৫ হিজরিতে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইমাম আলী রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আলী (আ.) খেলাফতের দ্বিতীয় দিনে মিম্বারে আরোহণ করেন এবং জনগণকে সম্বোধন করে বলেন : ‘… হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর সুস্পষ্ট পথে ফিরে আসতে বাধ্য করব এবং নিজের আদেশ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করব। আমি যা কিছু বলব তার ওপর আমল করো, আর যে ব্যাপারে নিষেধ করব তা থেকে দূরে থেক।’
আলী (আ.) তাঁর খেলাফত গ্রহণের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘আমার বাইয়াত গ্রহণের জন্য তোমরা আমার হাত তোমাদের দিকে টেনে নিয়েছিলে, কিন্তু আমি হাত ফিরিয়ে নিয়েছি। আবার তোমরা আমার হাত টেনে ধরে রেখেছিলে, কিন্তু আমি জোর করেছিলাম। তৎপর তৃষ্ণার্ত উট যেভাবে জলাধারে ভিড় করে তোমরাও সেভাবে আমার চারদিকে ভিড় করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলে যে, আমার জুতা ছিঁড়ে গিয়েছিল, কাঁধের কাপড় পড়ে গিয়েছিল এবং দুর্বলরা পদদলিত হয়েছিল। আমার বাইয়াত গ্রহণ করে মানুষ এত বেশি উল্লসিত হয়েছিল যে, শিশু-কিশোররা নাচতে শুরু করেছিল। বৃদ্ধরা কাঁপতে কাঁপতে (বার্ধ্যেকের কারণে) আমার কাছে চলে এসেছিল, রুগ্নরা এলোপাথারিভাবে, আর কিশোরীরা মাথায় ঘোমটা ফেলে আমার দিকে ছুটে এসেছিল।’- নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ২২৭
কিন্তু কিছুদিন না যেতেই অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। কেউ কেউ তাঁর আনুগত্যকে অস্বীকার করে। অনেকে আলী (আ.)-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো দল আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরিশেষে ইমাম আলী (আ.) কুফার মসজিদে মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাতে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
প্রশ্ন হলো ইমাম আলীর নেতৃত্বের প্রতি এত উচ্ছ্বাস, এত স্বতঃস্ফূর্ততা কিছুদিন পরেই কেন মিলিয়ে গিয়েছিল? শুধু তা-ই নয়, কেনই বা মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশ তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল?
এ সম্পর্কে গবেষকগণ এই কথাই বলেছেন যে, এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল ন্যায়বিচারের প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর অধিক গুরুত্ব আরোপ। আমরা আলী (আ.)-এর ন্যায়ানুগ শাসন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন
ইমাম আলী (আ.)-এর সরকার ও প্রশাসনের ভিত্তি ছিল ন্যায়পরায়ণতা। সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা তাঁকে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন করে। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যিনি ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টিকোণ থেকেই সকল রাজনৈতিক কার্যকে এবং দলগুলোকে দেখতেন এবং তাঁর শত্রুদের সাথেও একইভাবে ন্যায়নীতি অনুসরণ করেন এবং ন্যায়নীতিকে বিন্দু পরিমাণ লঙ্ঘন করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি জানতেন যে, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি পুনঃমূল্যায়ন ও মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন। তিনি তাঁর খেলাফত গ্রহণের সময়ই এ বিষয়টি উল্লেখ করেন যে, তিনি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে কারো তোয়াক্কা করবেন না। তিনি রাসূলের সুন্নাতকে ফিরিয়ে আনবেন। একটি খুতবায় তিনি বলেন : ‘জেনে রাখ, আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম বান্দা হচ্ছে ন্যায়বান নেতা, যে পথপ্রদর্শিত হয় ও পথপ্রদর্শন করে।’ নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১৬৩
যখন তিনি মালিক আশতারকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন তখন তাঁর উদ্দেশে যে পত্র তিনি লেখেন সেখানে বলেন : ‘আল্লাহর জন্য ন্যায়বিচার কর এবং জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার কর… যদি তুমি তা না কর তাহলে তুমি অত্যাচারী হবে এবং যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে অত্যাচার করে তখন তাঁর সৃষ্টির পরিবর্তে আল্লাহ নিজেই তার বিরুদ্ধ পক্ষ হয়ে দাঁড়ান…।’Ñ নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৫৩
ইমাম আলীর কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, প্রতিটি জায়গায় মানুষের মধ্যে দুর্বলতা ও ত্রুটি রয়েছে; আর গভর্নরদের দায়িত্ব হলো তাদের ছোটখাটো ত্রুটিগুলোকে উপেক্ষা করা এবং তাদেরকে পথপ্রদর্শন করা। গভর্নরদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল যাতে তাঁরা সকলের সাথে কোনোরকম বৈষম্য ছাড়া স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়পরায়ণতার সাথে আচরণ করেন।
পরিকল্পনা প্রণয়নে ন্যায়নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়া
একটি দেশের যথাযথ ও দক্ষ প্রশাসনের জন্য এবং এর সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য পরিকল্পনা আবশ্যক। যদি ন্যায় বিচারকে পরিকল্পনা প্রণয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইমাম আলী (আ.) মিশরের গভর্নর মালিক আশতারের কাছে লেখা পত্রে এ বিষয়ে বলেন : ‘কর্মকা- বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এমন নীতি অবলম্বন করবে যেন তা ন্যায় পরায়ণতাকে ছাড়িয়ে না যায় আবার ন্যায় বিচারের চেয়ে কম না হয়। তোমাকে এমন নীতি অবলম্বন করতে হবে যা ন্যায় বিচারকে এগিয়ে নেয় এবং তোমার প্রজাদের জন্য সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক হয়।’Ñ নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৫৩
যদি ইসলামি রাষ্ট্রের শাসক ও কর্মকর্তারা এই নীতি অনুসরণ করেন তাহলে তাঁরা পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। আর এমনটিই হওয়া প্রয়োজন। আলী (আ.) বলেছেন : ‘সত্যই গভর্নরদের জন্য সবচেয়ে খুশির কথা হলো দেশে ন্যায়নীতির প্রচলন ঘটা এবং জনগণের কাছে প্রিয় হওয়া।’Ñ নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৫৩
পদ বণ্টনে ন্যায়নীতি অনুসরণ
আলীর সরকারে মন্ত্রীত্বের পদ ধন-সম্পদ, আত্মীয়তার সম্পর্ক, গোত্রীয় প্রীতি বা সমাজের প্রভাবশালী হওয়ার কারণে বণ্টিত হয় নি। তাদেরকে যোগ্যতা ও প্রতিভার কারণে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রীরা হবে খোদাভীরু এবং নীতিবান। সরকারি দায়িত্বশীলরা কখনই দ্বিমুখি নীতির অধিকারী হতে পারবে না।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর গভর্নরদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁরা সেসকল লোককে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ না দেন যারা গীবতকারী, গুজব রটনাকারী, কৃপণ এবং ভীরু। তাঁদের আরো বলা হয়েছিল যেন তারা লোভী ও উচ্চাভিলাষী লোকদেরকে উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ না করে কারণ, তারা অন্যদেরকে ব্যবহার করবে এবং তাদের সম্পদকে ছিনিয়ে নেবে।
দুর্নীতির মূলোৎপাটন
আলী (আ.) খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য গভর্নরদেরকে পদ থেকে অপসারণ করে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেন। এ বিষয়টিতে একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর শুভকাক্সক্ষীরা তাঁকে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন : ‘আল্লাহর শপথ, আমি আমার দ্বীনে প্রতারণা করব না এবং আমার দেশের শাসনকার্য ঘৃণ্য লোকদের নিকট ন্যস্ত করব না।’Ñ তারীখে তাবারী, ৫ম খ-, পৃ. ১৬০
ইমাম আলী (আ.) তাঁর গভর্নরদেরকেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনের উপদেশ দিতেন।
সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ
ইমাম আলী (আ.)-এর নীতি তাঁর উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা, বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা এবং জমিনের বুকে আল্লাহর নীতি কায়েমের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতাকে প্রকাশ করে। যে কেউ এই নীতি দ্বারা কর্ম পরিচালনা না করে তবে সে কোরআন ঘোষিত অবিশ্বাসী, ন্যায়হীন এবং অপকর্মকারী হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামের অন্যতম নীতি হলো আরব-অনারবের মধ্যে পার্থক্যের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা এবং মুমিনদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা।
ইসলামী ন্যায়নীতির ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.)-এর অবদান ছিল বংশ গৌরবের মূলোৎপাটন এবং দরিদ্র, অবহেলিত ও অত্যাচারিত শ্রেণিকে সম্মান দেয়া যা তারা সমাজে দাবি করে। তিনি এ ব্যাপারে সমাজের প্রভাবশালীদের কারো প্রতি কোনোরূপ তোয়াক্কা করেন নি। বাইতুল মাল বণ্টনে ইমাম আলী তাঁর সচিব আবদুল্লাহ বিন আবি রাফেকে আনসার ও মুহাজিরদের প্রত্যেককে তিন দীনার করে দেয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় সাহ্ল্ ইবনে হুনাইফ আনসারী বিরোধিতা করে বলেন : ‘এই যে কৃষ্ণাঙ্গ গতকাল পর্যন্তও আমার গোলাম ছিল আমি তার সমান হবÑ এটা কি সমীচীন হবে?’ ইমাম জবাবে বলেন : ‘আমি আল্লাহ্র কিতাবে ইসমাঈলের পুত্র (আরব) ও ইসহাকের পুত্রের (অনারব) মধ্যে কোন পার্থক্য দেখি না।’Ñ বেলায়াতের দ্যুতি, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী, পৃ. ৩৫৭
কর্ম মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা
একটি সমাজে অন্যতম যে পথে সম্প্রীতি ও ভারসাম্য আসে এবং যে পথ রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে গতিশীল, সৃষ্টিশীল, উৎপাদনমুখী এবং প্রত্যয়দীপ্ত করে তা হলো নাগরিকদের কাজকে ন্যায় বিচার ও স্বচ্ছ মানদ-ের ভিত্তিতে যাচাই করা। সমাজের সকল লোকের কর্মকে একই রকম মনে করা সঠিক নয়। যারা যত বেশি নিষ্ঠা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে কাজ সম্পাদন করবে তাদেরকে অযোগ্যদের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। ইমাম আলী (আ.)-এর প্রশাসনের নীতিও ছিল এটিই। তিনি মালিক আল আশতারকে বলেন : ‘ভালো আর মন্দ যেন তোমার কাছে একরকম স্থান না পায়। কারণ, তা ভালো মানুষকে ভালো কাজ থেকে নিরুৎসাহিত আর দুষ্কৃতিকারীদেরকে মন্দকাজে উৎসাহিত করবে। সুতরাং যে যে রকম কাজ করে তার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করবে।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৫৩
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের অতীতের ভালো কর্মকা-ের জন্য প্রশংসিত হবে ও পুরস্কার পাবেÑ তাদের বন্ধুত্ব অথবা আত্মীয়তার কারণে নয়। আমীরুল মুমিনীন (আ.) এই বিষয়টিকে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এর গুরুত্ব তুলে ধরছেন : ‘আর কারো কর্তব্যনিষ্ঠাকে অন্যের নামে চালিয়ে দেবে না এবং এর অবমূল্যায়ন করবে না। প্রত্যেককে তার সেবা অনুযায়ী প্রতিদান দেবে এবং তোমার ধন্যবাদ তারই জন্য নির্ধারিত জানবে। কোনো ব্যক্তির পারিবারিক মর্যাদা যেন তোমাকে একাজে প্রবৃত্ত না করে যে, তার সামান্য কাজকে তুমি অনেক বড় করে দেখবে। আবার কোনো ব্যক্তির হীন পারিবারিক অবস্থানের কারণে যেন তুমি তার বড় কাজকে তুচ্ছ মনে কর না।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৫৩
সম্পদের সুষম বণ্টন
রাষ্ট্রের সকল সদস্যের সামগ্রিক উন্নতির জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করার কোনো অবকাশ নেই। আলী (আ.) এক বক্তব্যে বলেন : ‘…যারা মনে করে যে, মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের ফলে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখে তাদের জানা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদ- অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তারই জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায়, সকলেই অধিকারের দিক থেকে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা, আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র ধনসম্পদÑ যা তোমাদের মধ্যে সমহারে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং আরব ও অনারব এতে এক সমান।’Ñ শারহে নাহজুল বালাগাহ, ইবনে আবিল হাদীদ, ৭ম খ-, পৃ. ৩৭
‘আল-কাফি’ গ্রন্থে আবু মিখনাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আলী (আ.)-এর একদল অনুসারী তাঁর কাছে আসল এবং বলল : ‘হে আমীরুল মুমিনীন! যদি আপনি এসব সম্পদ গণমান্য ব্যক্তি ও নেতাদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং তাদেরকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দেন তাহলে এই বিষয়টির ফয়সালা হতে পারে। তারপর আপনি আল্লাহ আপনাকে যে গুণে ভূষিত করেছেন সেখানে ফিরে যেতে পারেন। আর তা হলো সমবণ্টন এবং জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার চর্চা।’
আমীরুল মুমিনীন (আ.) বললেন : তোমাদের জন্য দুর্ভোগ! তোমরা আমাকে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় ও বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে সমর্থন নিতে বলছÑ যাদের ওপর আমি অভিভাবক মনোনীত হয়েছি? আল্লাহর শপথ, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তা করব না যতক্ষণ এ পৃথিবী বিদ্যমান এবং যতক্ষণ আমি আকাশে তারকারাজি দেখতে পাই। যদি তা আমার নিজের সম্পদও হতো তাহলেও আমি তা সমভাবে বণ্টন করতাম; আর যেখানে এটি তাদেরই সম্পদ সেখানে কীরূপ অবস্থা হবে?’Ñ সাওয়াবুল আমাল, ৩১০/১; বিহারুল আনওয়ার : ৭২/৩৪৫/৪২
নিজ ভাই আকীল তাঁর কাছে বাইতুল মাল থেকে অতিরিক্ত সাহায্য দাবি করলে আলী (আ.) তাঁকে তা দিতে অস্বীকার করেন। আলী (আ.) নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘আল্লাহর কসম! আমি [ভাই] আকীলকে অনটনে দেখেছি, সে [বাইতুল মালে] তোমাদের গম হতে এক সা আমার কাছে চেয়েছিল। আমি তার শিশুদেরকে দারিদ্র্যের তাড়নায় উস্কখুস্ক চুলে ও ধূলি-ধূসরিত চেহারায় দেখেছি। যেন তাদের মুখম-লসমূহ নীল দ্বারা কালো করা হয়েছিল। আকীল তার আবেদনে জোরাজুরি করছিল এবং আমার কাছে তার কথা বারবার বলছিল। আমি তার দিকে কর্ণপাত করছিলাম। সে মনে করছিল আমি আমার দ্বীনকে তার কাছে বিক্রি করে দেব এবং আমার নিজের পথ পরিত্যাগ করে তার পথ অনুসরণ করব। ইত্যবসরে আমি এক টুকরা লোহা উত্তপ্ত করলাম এবং তার শরীরের নিকটে নিয়ে গেলাম, যাতে এর দ্বারা সে শিক্ষা নেয়। তখন সে এর যন্ত্রণায় একজন রোগীর আর্তনাদের ন্যায় আর্তনাদ করে উঠলো এবং এর উত্তাপে তার পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন আমি তাকে বললাম : বেদনাহত মায়েরা তোমার শোকে রোদন করুক হে আকীল! তুমি কি এক টুকরা লোহার উত্তাপে চিৎকার করছ যা একজন মানুষ ক্রীড়া [কৌতুক] বশত উত্তপ্ত করেছে? অথচ তুমি আমাকে এমন এক আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাও যা তার [শক্তিমান] মনিব স্বীয় ক্রোধের জন্য প্রজ্বলিত করেছেন? এই সামান্য যন্ত্রণায় তুমি কাঁদছ। তবে কি আমি [জাহান্নামের] লেলিহান আগুনে কাঁদব না?’
যিয়াদ ইবনে আবিহর কাছে লিখিত এক পত্রে তিনি বলেন : ‘আমি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর নামে কসম করছি যে, আমার কাছে যদি খবর আসে যে, তুমি মুসলমানদের বাইতুল মালে কিঞ্চিৎ কিংবা বৃহৎ কোন খেয়ানত করেছ, তাহলে আমি তোমার ব্যাপারে এমন কঠোর হব যে, তুমি সর্বস্বহারা, বোঝার ভারে ন্যুব্জ এবং দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ২০
শত্রুদের ক্ষেত্রেও সম্পদ বণ্টন
রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মীয়তা, পক্ষপাতিত্ব অথবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর ভিত্তি করে বণ্টন হওয়া কখনই কাম্য নয়। আবদুল্লাহ বিন কাওয়া ছিল ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রু, যে কুফায় বসবাস করত, সে প্রকাশ্যে আলী (আ.)- কে গালমন্দ করত, যেটা আলী (আ.) জানতেন। কিন্তু তিনি সর্বদাই বায়তুল মালে তার অংশ কোনরকম কাটছাট করা ছাড়াই তার বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতেন।
সম্পদ ফিরিয়ে আনা
যখন আলী (আ.) ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কোরআন মজীদ ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী শাসন করা শুরু করেন তখন যেসব লোক অবৈধ কর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারা আলীর পক্ষ থেকে বিপদ অনুভব করে। বিশেষ করে মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে যেসব সম্পদ অন্যায়ভাবে বণ্টন করা হয়েছিল সেগুলো ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ইমাম আলী (আ.) কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘আল্লাহর কসম! যদি আমি সে সম্পত্তি পাই তাহলে অবশ্যই ফিরিয়ে নেব, [এমনকি] যদি দেখি তা নারীদের মোহরানাভুক্ত হয়েছে কিম্বা তা দ্বারা ক্রীতদাসী খরিদ করা হয়েছে। কারণ, ন্যায়পরায়ণতার মধ্যেই প্রসারতা রয়েছে। যার উপর ন্যায়পরায়ণতা কঠিন হয়, অন্যায় তার উপর আরো কঠিন।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ১৫
এছাড়াও যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অন্যান্য অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছিল তারাও আলী (আ.)-এর পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এতে অনেক ক্ষমতাশীল ও প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর থেকে দূরে সরে যায়। ইমাম আলী (আ.) তাঁর একটি ভাষণে জনগণের শপথ ভঙ্গের এই বিষয়টিকে এভাবে ব্যক্ত করেন : যখন আমি শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলাম তখন একটি দল শপথ ভঙ্গ করল এবং আরেক দল অবাধ্য হয়ে গেল, আর অবশিষ্টরা অন্যায় আচরণ শুরু করল যেন তারা আল্লাহর এই বাণী শোনে নি :
এ পরকালের গৃহ, যা আমরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছি যারা পৃথিবীতে না উদ্ধত হতে চায়, আর না বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায়; এবং সাবধানীদের জন্যই তো শুভ পরিণাম।Ñ সূরা কাসাস : ৮৩
এক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, যদিও জনগণ একজন ভালো ও পুণ্যবান শাসক চায়, কিন্তু তারা প্রকৃত ন্যায়পরায়ণ শাসককে চায় নাÑ যে শাসক প্রশাসনিক ন্যায়বিচার ও সততার ক্ষেত্রে কোনো রকম বংশগত বা পরিচয়গত সম্পর্ককে বিবেচনা করে না।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর কর্মকর্তা, প্রশাসক এবং প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে ন্যায়নীতি অনুসরণের জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দান করেন। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত ও ন্যায়নীতিহীন প্রশাসক ও গভর্নরদেরকে শাস্তি দেন এবং তাদেরকে পদচ্যুত করেন।
ঘুষ ও উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ করা
ইমাম আলী (আ.) কঠোরভাবে তাঁর গভর্নর ও কর্মকর্তাদেরকে ঘুষ ও উপহার নেয়াকে নিষেধ করে বলেন : ‘যে শাসক জনগণের প্রয়োজন থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহও নিজেকে সেই ব্যক্তি ও তার প্রয়োজন থেকে লুকিয়ে রাখবেন; যদি সে উপহার গ্রহণ করে তবে সে একজন দেশদ্রোহী; আর যদি সে ঘুষ নেয় তবে সে একজন মুশরিক।’Ñ সাওয়াবুল আমাল, ৩১০/১; বিহারুল আনওয়ার : ৭২/৩৪৫/৪২
আলী (আ.) নিজেও উপঢৌকনের ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। একটি ঘটনা তিনি নিজেই বর্ণনা করেনÑ “…এটি অপেক্ষা আরো আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা হলো ঐ ব্যক্তির কথা, যে রাতের আঁধারে মুখঢাকা পাত্রে কিছু উপঢৌকন এবং মা’জুন (এক প্রকার খাবার) নিয়ে আমার নিকটে এসেছিল, যে মা’জুন আমার পছন্দের ছিল না, যেন মনে হচ্ছিল এ মা’জুন সাপের লালা অথবা তার বমি দ্বারা মাখানো হয়েছে। আমি তাকে বললাম : ‘এটি কি আত্মীয়ের উপহার, নাকি যাকাত নাকি দান? আমরা (অর্থাৎ) আহলে বাইতের জন্য তো এসব নিষিদ্ধ।’ সে বলল : ‘এটিও নয়, ঐটিও নয়। বরং এটি একটি উপঢৌকন।’ ‘আমি বললাম : সন্তানহারা মা তোমার শোকে ক্রন্দন করুক! আল্লাহর দ্বীনের মাধ্যমে আমাকে প্রতারিত করতে এসেছ? নাকি তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, নাকি তুমি একজন পাগল, নাকি তুমি আবোল-তাবোল বকছ? আল্লাহর কসম! আমাকে যদি সাত আকাশ এবং তার নিচে যা কিছু রয়েছে সবই প্রদান করা হয় যেন আমি পিঁপড়ার মুখ হতে যবের বীজের একটি খোসাও [অন্যায়ভাবে] ছিনিয়ে নিয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করি, [কস্মিনকালেও] আমি তা করব না! নিশ্চয় তোমাদের দুনিয়া আমার কাছে পঙ্গপালের মুখের ঐ পাতার চেয়েও তুচ্ছ যা সে চিবাচ্ছে। যে নেয়ামত নস্যাৎ হয়ে যাবে এবং যে মজা স্থায়ী হবে না তার সাথে আলীর কি! বুদ্ধির তন্দ্রাভাব ও বিচ্যুতির মন্দত্ব হতে আমরা আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি’।”Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ২১৫
বন্ধুত্ব ও শত্রুতার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি অনুসরণ
যখন কারো হৃদয় আবেগ ও ভালোবাসা দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায় যে ভালোবাসা তাকে সৎ ও নিরপেক্ষতার আলোকে ম্লান করে দেয় তখন তার পক্ষে ন্যায়বান হিসেবে বহাল থাকাটা সহজ নয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘পরসংবাদ, যদি শাসনকর্তার কর্মকা- আবেগজড়িত হয় তাহলে তা অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৫৯
একইভাবে, চারিত্রিকভাবে দৃঢ় ও মহান না হলে কারো পক্ষে ন্যায়ের গ-িতে আবদ্ধ থাকা সম্ভব নয় যখন সে তার শত্রু ও বিরোধীদের সাথে কাজ করে। আলী (আ.) কথা ও কর্মে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার প্রতিমূর্তি। যিনি পবিত্র কোরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষায় গড়ে উঠেছিলেন তিনি নিচের এই আয়াতকে তাঁর পথের আলো হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন:
ক্স ক্স
হে বিশ্বাসিগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণকারী এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে সাক্ষ্যদানকারী হও এবং (সাবধান!) কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরিতা যেন তোমাদের কখনও এ ব্যাপারে উদ্যোগী না করে যে, তোমরা সুবিচার করবে না; বরং সুবিচার কর, এটাই আত্মসংযমের নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, কেননা, আল্ল¬াহ তোমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।Ñ সূরা মায়েদা : ৮
একই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি তাঁর এক সন্তানকে উপদেশ দেন : তুমি অবশ্যই তোমার বন্ধু ও শত্রুর সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ করবে।’Ñ গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ২৩৮
খোদাভীরু ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নীতির উল্লেখ করে বলেন : ‘(একজন মুত্তাকী ব্যক্তি হলো সে) যে তার শত্রুর সাথে কেবল শত্রুতার কারণে অন্যায় আচরণ করে না এবং কেবল তার বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কারণে পাপে পতিত হয় না।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ১৯৩
এটি নিশ্চিতভাবেই প্রকাশিত যে, যদিও আলী (আ.)-এর শত্রুরা তাঁকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ভীষণ কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল এবং তাঁকে মানসিকভাবে প্রচ- চাপের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল, তবু তিনি এসব ঝড়-ঝঞ্ঝায় ভীত হন নি, তাঁকে ন্যায় ও সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি।
এর সপক্ষে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো খারেজীদের বিষয়টি। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা রাষ্ট্রের জন্য সুস্পষ্টভাবে হুমকি সৃষ্টি করে নি ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করেন, যদিও তারা তাঁকে প্রকাশ্যে অভিশাপ দিত এবং তাঁকে অপমান করত। তিনি এই দলের প্রতি এভাবে সম্বোধন করেন : ‘তোমাদের তিনটি অধিকার রয়েছে যেগুলোকে আমি সম্মান করব: প্রথমত, এই মসজিদে নামায পড়তে নিষেধ করব না। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আমাদের সাথে রয়েছ এবং নীতিগতভাবে এই রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার কর ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তোমাদের অংশ প্রদান করব। তৃতীয়ত, আমি তোমাদের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হব না যতক্ষণ না তোমরা প্রথমে তা শুরু কর।’Ñ আল উমাম ওয়াল মুল্্ক, মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৪
তবুও খারেজীরা ইমাম আলী (আ.)-এর সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব ছড়াতে থাকে এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালাতে থাকে। ইমাম আলী (আ.)-এর সত্যিকার ও সত্যপন্থী অনুসারীরা খারেজীদেরকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না এবং সে মুহূর্তে একটি প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ার বিপদ দেখা দেয়। ইমাম আলী (আ.) উত্তেজনা প্রশমন, বিবাদ বন্ধ এবং সামাজিক অস্থিরতা দূর করার জন্য তাঁর অনুসারীদেরকে সবসময় নি¤েœর উপদেশ দিতে থাকেন : ‘আনন্দ ও ক্রোধে ন্যায়বান হও।’Ñ মিযানুল হিকমা, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৮৮
বিধর্মীদের প্রতি ন্যায় আচরণ
ইমাম আলীর দৃষ্টিতে কোরআনের সংস্কৃতি থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি বের হয়ে আসে তা হলো একটি ভূমির সকল জনগণ স্রষ্টার সৃষ্টি। তারা হয় তাদের শাসকের ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী অথবা তার মতোই একজন মানুষ। যে কোনো ক্ষেত্রেই তাদের মানবাধিকার রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে এ দিকে পরিচালিত করে যে, সকল অধিবাসীর প্রতি মানবিক ও ইসলামি আচরণ করতে হবে এবং শাসককে সর্বাবস্থায় ন্যায়ানুগ, সৎ ও নিরপেক্ষ আচরণ করতে হবে।
খারাজ আদায়ে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন
আমীরুল মুমিনীন (আ.) যখন যিয়াদ ইবনে আবিহিকে ফার্স ও তদসংলগ্ন এলাকার শাসক নিযুক্ত করেন তখন তাকে অগ্রিম খারাজ আদায় করতে নিষেধ করেন, আর বলেন : ন্যায় বিচারকে কাজে লাগাবে। আর কঠোরতা অবলম্বন ও অত্যাচার করা হতে বিরত থাকবে। কারণ, কঠোরতা জনগণের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ হয়। আর অত্যাচার [তাদেরকে] অস্ত্রের [যুদ্ধের] দিকে আহ্বান করে।Ñ নাহজুল বালাগাহ, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ৪৭৬
বিচারালয় ও বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা
আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে বিচারালয়ের ন্যায়বিচার হলো অন্য সকল মূল্যবোধের মাপকাঠি, ন্যায়বিচার সেগুলোকে সমুন্নত করে এবং জনগণকে ইসলামি সরকার ও এর কর্মকর্তাদের ওপর আস্থাবান করে তোলে।
আর বিচারালয়ের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার হলো ন্যায়নীতি বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। প্রকৃতপক্ষে এটিই হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের অস্তিত্বের নির্দেশক। যে সমাজে ন্যায়, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতির ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়া হয় সেই সমাজে শত্রুতা, দ্বন্দ্ব এবং উদ্বিগ্নতা কম পরিদৃষ্ট হয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, বিচারালয়ে ন্যায়বিচার হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি। একারণেই কুরআন শাসক ও বিচারকদেরকে এর ওপর দৃঢ় থাকার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিয়েছে :
ক্স ক্সক্স ক্স ক্স
(হে বিশ্বাসিগণ!) আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে, আমানতসমূহকে তার অধিকারীর নিকট পৌঁছে দাও এবং যখন মানুষের মধ্যে কোন বিচার করবে তখন ন্যায়ের ভিত্তিতে তা করবে; আল্লাহ তোমাদের সর্বোত্তম উপদেশ দান করছেন; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।Ñ সূরা নিসা : ৫৮
আলী (আ.) তাঁর কর্মকর্তাদেরকে সবসময় যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিতেন তা হলো : ‘যখন তোমাকে কোন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত করা হয় তখন ন্যায় বিচার করবে।’Ñ তুহাফুল উকুল, আবুল হাসান হাররানি, পৃ. ১০২
উপরন্তু এই সাধারণ উপদেশের বাইরেও আলী (আ.) বিচারালয়ের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে মুহাম্মাদ বিন আবু বকরের প্রতি লেখা পত্রে নির্দেশনা দিয়ে বলেন : ‘তাদের প্রতি বিনয়শীল হবে, তাদের সাথে কোমল আচরণ করবে এবং উদারতা প্রদর্শন করবে। চোখের কোণ থেকে তাকানো এবং চোখের সামনে দিয়ে তাকানোর ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে (অর্থাৎ সকলকে সমান চোখে দেখবে)। যাতে ধনীরা তোমার থেকে কামনা না করে যে, (তুমি দুর্বলদের প্রতি) অবিচার করবে আর দুর্বলরা যেন তোমার ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা থেকে নিরাশ না হয়। কারণ, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাসকল, (অর্থাৎ) তোমাদের সমস্ত কৃতকর্মের কৈফিয়ত চাইবেন, তা ছোটই হোক আর বড় হোক, প্রকাশ্যই হোক আর গোপন হোক। অতঃপর যদি তিনি শাস্তি দেন, সেটা তোমাদের অন্যায়ের কারণে। আর যদি ক্ষমা করেন, তাহলে সেটা তাঁর মহানুভবতার কারণে।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ২৭
যদি বিচারক ও বিচারিক কর্মকা-ের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অহমিকা ও যুক্তি-বুদ্ধির পরিপন্থী বিষয়গুলো নিজেদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে তবে সে বিচারকার্যের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং জনসাধারণকে দুষ্কৃতিকারীদের থেকে রক্ষা করতে পারে। এই বিষয়টিই আলী (আ.) এভাবে বলেছেন : ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে তাদের পদক্ষেপ হওয়া উচিত নিজেদের স্বার্থচিন্তাকে দূরে ঠেলে দেয়া।Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ৮৭
তিনি তাঁর এক গভর্নরকে একটি পত্রে সতর্ক করে লেখেন : যাতে অভিজাত লোকেরা আকাক্সক্ষা না দেখায় যে, তোমাকে দিয়ে অন্যায় করাবে আর দুর্বলেরা তোমার ন্যায়বিচার থেকে নিরাশ না হয়।Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৪৬
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘বিশ্বাসভাজন লোকের প্রতি অনুমানের ভিত্তিতে রায় দেওয়া ন্যায়বিচার নয়।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ২২০
আলী (আ.) ন্যায়নীতির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন। এখানে এমনই একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আলী (আ.) একদিন বাজারে গিয়ে দেখেন, একজন খ্রিস্টান একটি লোহার বর্ম বিক্রি করছে। আলী (আ.) তৎক্ষণাৎ বর্মটি চিনে ফেলেন এবং বলেন : ‘এ বর্ম তো আমার। চল, আদালতে তোমার ও আমার মধ্যে ফায়সালা হবে।’ সেসময় ঐ আদালতের বিচারক ছিলেন কাযী শুরাইহ। তিনি যখন আমীরুল মুমিনীনকে আসতে দেখলেন, তখন তাঁর বসার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং ইমামকে নিজ স্থানে বসিয়ে তিনি তাঁর পাশে বসলেন। আলী (আ.) বিচারপতি শুরাইহকে বললেন : ‘এই ব্যক্তির সাথে আমার বিরোধ মিটিয়ে দিন।’ শুরাইহ বললেন : ‘আমীরুল মুমিনীন! আপনার বক্তব্য কী?’ আলী বললেন : ‘এই বর্মটি আমার। অনেক দিন হলো এটি হারিয়ে গেছে। আমি তা বিক্রি করিনি, দানও করিনি।’ শুরাইহ বললেন : ‘ওহে! আমীরুল মুমিনীন যা বলছেন, সে ব্যাপারে তুমি কী বলতে চাও?’ সে বলল : ‘আমি আমীরুল মুমিনীনকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করছি না, তবে বর্মটি আমারই।’ শুরাইহ হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বললেন : ‘বর্মটিতো এই ব্যক্তির দখলে রয়েছে। কোনো প্রমাণ ছাড়া তার কাছ থেকে সেটা নেয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কি?’ আলী (আ.) হেসে ফেললেন এবং বললেন : ‘শুরাইহ ঠিকই বলেছেন। আমার নিকট তো কোনো প্রমাণ নেই।’ নিরুপায় শুরাইহ খ্রিস্টানের পক্ষেই রায় দিলেন এবং সে বর্মটি গ্রহণ করে রওয়ানা হলো। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে সে আবার ফিরে এল এবং বলল : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এটাই নবীদের বিধান ও শিক্ষা। আমীরুল মুমিনীন নিজের দাবি বিচারকের সামনে পেশ করেছেন, আর বিচারক তাঁর বিপক্ষে রায় দিচ্ছেন। আল্লাহ্র কসম, হে আমীরুল মুমিনীন! এটা আপনারই বর্ম। আমি এটি আপনার কাছে বিক্রি করেছিলাম। পরে তা আপনার মেটে রঙের উটটির উপর থেকে ছিটকে পড়ে গেলে আমি ওটা তুলে নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।’ আলী (আ.) বললেন : ‘তুমি যখন মুসলমান হয়ে গেলে, তখন এ বর্ম এখন থেকে তোমার।’ অতঃপর আলী তাকে ভালো দেখে একটি ঘোড়াও উপহার দিলেন এবং তাতে চড়িয়ে তাকে বিদায় দিলেন।Ñ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৮/৫
শুধু নিজ খেলাফতকালেই নয়; বরং পূর্ববর্তী খলিফাগণের সময়েও তাঁকে সূক্ষ্মভাবে ন্যায় বিচারের নীতির প্রতি অতিশয় গুরুত্ব প্রদানকারী হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের সময় এক ব্যক্তি আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। বিচারের দিন আলী (আ.) ও ওই ব্যক্তি উপস্থিত হন। উমর তাঁর বিচারকের আসনে বসেন এবং ওই ব্যক্তিকে নাম ধরে সম্বোধন করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াতে বলেন। আর ইমাম আলীকে সম্বোধন করে বলেন : ‘হে আবুল হাসান! আপনি ওই ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান।’ এতে ইমাম আলীর চেহারার মধ্যে অনুশোচনার একটি ভাব পরিলক্ষিত হয়। খলিফা বলেন : আপনি কি অভিযোগকারীর ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছুক নন?’ আলী বলেন : আমি একারণে হতাশ নই যে, তার পাশে আমাকে দাঁড়াতে হবে। বরং আমি একারণে হতাশ যে, আপনি ন্যায় বিচারের নীতির প্রতি যথাযথভাবে অনুগত ও নিরপেক্ষ থাকেননি, কারণ, আপনি আমাকে সম্মানজনক পদবি সহকারে সম্বোধন করেছেন যেখানে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ব্যক্তিকে তার নাম ধরে সম্বোধন করেছেন।’
উপসংহার
ইমাম আলী (আ.) শাসনকর্তৃত্ব লাভ করার পর কোনোরকম বৈষম্য ছাড়া এবং এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের ওপর অগ্রাধিকার প্রদান ছাড়া মহানবী (সা.)-এর স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন।
যারা পূর্বে ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ছিল তাদের অনেকেই তাঁকে পরিত্যাগ করে এবং তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষে নানা পদে যোগদান করে শুধু এই কারণে যে, তারা তাঁর ন্যায়পরায়ণতাকে সহ্য করতে পারে নি। যখন ইমাম আলী (আ.) তাদেরকে তাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য শাস্তি দিয়েছেন অথবা যখন তারা বুঝতে পারে যে, তারা অন্যায় ও অবৈধভাবে যা কিছু অর্জন করেছে তা আলী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণ শাসনের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হবে তখন তারা তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয় এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের দলে যোগ দেয়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ষড়যন্ত্রের মধ্যেও তিনি মুমিনদেরকে কোরআন মজীদ ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের দিকে আহ্বান জানাতে থাকেন।
বস্তুত, মহান আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত গ্রন্থ কোরআন মজীদকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার পার্থক্যকারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। এর বাণী সকলের জন্য ন্যায়পরায়ণতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর আলী (আ.) এক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছেন। যেখানেই এবং যখনই মিথ্যাকে সত্যের সাথে মিশ্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অন্যায়কে ন্যায়ের ওপর স্থান দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে সেখানেই ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর সন্তান ও উত্তরাধীকারীদের রক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা নস্যাতের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে।