ইবনে সিনা : মধ্যযুগের বিশ্বসেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১
আবদুস সবুর খান
সর্ববিদ্যায় পারদর্শী চিকিৎসাবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ, মৃত্তিকাবিজ্ঞানী, তর্কশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ, কবি এবং ইরান ও বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক ও প-িত আবু আলী হোসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান বিন আলী বিন সিনা ৩৭০ হিজরির সফর মাসে (৯৮০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস) তদানীন্তন পারস্যের বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রাচ্যে তিনি আবু আলী সিনা, ইবনে সিনা, পুর সিনা প্রভৃতি নামে সুপ্রসিদ্ধ। দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বিজ্ঞান ও দর্শনের জ্ঞানকোষ ‘কিতাবে শেফা’ এবং ‘দানেশ নামেয়ে এলমি’। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন ফিত তিব্ব’কে ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ইবনে সিনার পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন বালখের অধিবাসী। সামানিদের পতন ও সুলতান মাহমুদের উত্থান এই সন্ধিক্ষণে তিনি মাওয়ারাউন্ নাহর-এর সামানি শাসক আমির নূহ বিন মানসুর (শাসনকাল ৯৭৬৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ)-এর শাসনকালে জন্মভূমি বালখ ত্যাগ করে বোখারা চলে আসেন এবং এক উচ্চপদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর রাজস্ব বিভাগের একটি পদে নিযুক্ত করে তাঁকে খারামশীন-এ প্রেরণ করা হয়। এরই নিকটবর্তী আফশানে নামক গ্রামের সেতারে নাম্মী এক মেয়ের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখানেই তাঁদের প্রথম সন্তান ভুবনবিজয়ী প-িত ও চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ ইবনে সিনার জন্ম হয়।
ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। ছয় বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে বোখারায় চলে আসেন এবং এখানে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। দশ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। অতঃপর সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং বিভিন্ন শিক্ষকের নিকট ফিক্হ বা মুসলিম আইনশাস্ত্র ও কালাম বা অলংকারশাস্ত্র শিক্ষা করেন। এ সময় তাঁর পিতার নিকট ইসমাঈলিগণের যাতায়াত ছিল। ইসমাঈলিগণের সাথে মেলামেশার ফলে ইবনে সিনার বিভিন্ন বিদ্যার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে তিনি আত্মা ও বুদ্ধি সম্বন্ধে তাদের আলোচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
ইবনে সিনা আবদুল্লাহ নাতিলির নিকট নীতি-দর্শন, জ্যামিতি, জ্যোতিষ্ক বিজ্ঞান এবং মানতেক বা তর্কশাস্ত্রশিক্ষা করেন। নাতিলি ইবনে সিনার জ্ঞানান্বেষায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর পিতাকে স্বীয় পুত্রকে জ্ঞান শিক্ষা দান ছাড়া অন্য কোনো কাজে নিযুক্ত না করার পরামর্শ দেন এবং ইবনে সিনাকেও বিদ্যার্জন ছাড়া অন্য কোনো কাজে যুক্ত না হবার উপদেশ দেন। ইবনে সিনাও ওস্তাদের উপদেশ মতো জ্ঞান শিক্ষায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিযুক্ত করেন এবং মানতেক বা তর্কশাস্ত্রে ওস্তাদের চেয়েও অধিকতর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অল্প দিনেই তিনি, মাত্র ১৪ বছর বয়সে, শিক্ষককে ছাড়িয়ে যান। নাতিলি বোখারা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ইবনে সিনা ধর্মতত্ত্ব ও প্রকৃতিবিজ্ঞান অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। এর কিছুদিন পর তাঁর ভেতর চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ইতঃপূর্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানিগণ যা কিছু লিখেছিলেন তার সবই তিনি পড়ে শেষ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাঁর কাছে তেমন কোনো জটিল শাস্ত্র ছিল না, তাই দ্রুততম সময়েই তিনি এই বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং চিকিৎসাকার্যে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানের পরিপূর্ণতা সাধন করেন। যার ফলে তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই বিদ্যা আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট আগমন করেন। বলা হয়ে থাকে, ‘যখন চিকিৎসাবিদ্যার অস্তিত্ব ছিল না তখন হিপোক্রেটিস এর সৃষ্টি করেন; যখন এটি প্রায় মরে গিয়েছিল তখন গ্যালেন একে পুনরুজ্জীবিত করেন; যখন এটি বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তখন আর-রাজি একে সুসংবদ্ধ করেন; তবে এটি ছিল অসম্পূর্ণ, ইবনে সিনা একে পরিপূর্ণতা দান করেন।’ এসময় তিনি রুগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য শাস্ত্র যথা পদার্থবিদ্যা ও অধিবিদ্যা অধ্যয়ন করছিলেন। এ সময় তিনি খুব কম রাতই ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন এবং খুব কম দিনই কাটে যাতে তিনি অধ্যয়ন ব্যাতীত অন্য কোনো কাজ করেছেন। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত দিনরাত তিনি লেখাপড়ায়ই ব্যাপৃত থাকতেন। নিদ্রাকর্ষণ যাতে অধ্যয়নে ব্যাঘাত না ঘটায় সে জন্য তিনি নিদ্রা-প্রতিরোধক কিছু পান করতেন। নিদ্রিত অবস্থায়ও তাঁর মনে নানা প্রশ্নের উদয় হতো, এমনকি কোনো কোনো প্রশ্নের সমাধান নিদ্রার মাধ্যমেই হয়ে যেত।
এ সময় তিনি ধর্মতত্ত্ব, বিশেষ করে ¯্রষ্টার পরিচয় বিষয়ে অধ্যয়নে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং অ্যারিস্টোটলের ‘মা বাদাত্ তাবিয়ি’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। কিন্তু অ্যারিস্টোটলের ম্যাটাফিজিক্স-এর কিছুই তিনি বুঝতে পারেন না এবং এসব বক্তব্যের মাধ্যমে লেখক কী বলতে চাচ্ছেন তাও তাঁর নিকট সুস্পষ্ট হয় না। ফলে তিনি গ্রন্থটি আবার শুরু থেকে পাঠ করতে আরম্ভ করেন। এভাবে তিনি চল্লিশ বার গ্রন্থটি পাঠ করেন। যার ফলে গ্রন্থটি তাঁর মুখস্ত হয়ে যায়। তথাপি এর বক্তব্য তাঁর নিকট অস্পষ্টই থেকে যায়। অবশেষে একদিন বিকেলে তিনি বইয়ের বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় দেখেন ভ্রাম্যমাণ এক বই বিক্রেতা একটা বই হাতে করে ক্রেতা খুঁজছে। বিক্রেতা বইটি তাঁকে কেনার জন্য অনুরোধ করে। তিনিও বইটি কিনে নিয়ে আসেন। এটি ছিল আবু নাসর আল-ফারাবির ‘এগরাজে মা বাদাত্ তাবিয়ি’। বাড়ি পৌঁছেই তিনি বইটি নিয়ে পড়তে বসে পড়েন এবং এটি পড়তে পড়তেই অ্যারিস্টোটলের ‘মা বাদাত্ তাবিয়ি’র সব বক্তব্য তাঁর নিকট পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ, ‘মা বাদাত্ তাবিয়ি’র প্রতিটি শব্দই হুবহু তাঁর মুখস্ত ছিল। এই ঘটনায় তিনি এতটাই আনন্দিত হন যে, পরদিন তিনি বহু অভাবী লোকদের দান-সদকা করেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ৩৮৭ হিজরিতে। এসময় ইবনে সিনার বয়স ছিল ১৭ বছর।
ইবনে সিনার বয়স যখন ১৮ বছর তখন বোখারার শাসনকর্তা নূহ বিন মানসুর এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। বহু চিকিৎসক চিকিৎসা করে তাঁর রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ হলে ইবনে সিনার ডাক পড়ে। কারণ, এরই মধ্যে ইবনে সিনার চিকিৎসার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর চিকিৎসায় নূহ বিন মানসুর সুস্থ হয়ে ওঠেন। এতে খুশি হয়ে ইবনে সিনাকে তিনি তাঁর রাজকীয় গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ দেন। এটি ছিল খুব সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার এবং শুধু শাহজাদাগণেরই এ গ্রন্থাগারে প্রবেশের অনুমতি ছিল। ইবনে সিনা এই গ্রন্থাগারে এমনসব দুর্লভ গ্রন্থাদি অধ্যয়নের সুযোগ পান সাধারণ মানুষ যেগুলোর নামই জানত না এবং ইবনে সিনারও ইতঃপূর্বে এগুলো দেখার সুযোগ ঘটেনি। এসব গ্রন্থ অধ্যয়নে ইবনে সিনার জ্ঞান-সাধনার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
সময় ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ইবনে সিনার পিতার ইন্তেকাল ঘটে। এর কিছুদিন পর বোখারার শাসক নূহ বিন মানসুরেরও মৃত্যু হয়। বোখারায় রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হয়। ফলে তিনি খাওয়ারিজমের গোরগাঞ্জ-এর উদ্দেশে বোখারা ত্যাগ করেন। ১০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি খাওয়ারিজম পৌঁছেন। খাওয়ারিজমের শাসনকর্তা আলী ইবনে মামুন তাঁকে সসম্মানে রাজ দরবারে বরণ করেন। এখানে তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এখানে তাঁর আবু রায়হান আল বিরুনি, আবু নাসর আল ইরাকি, আবু সাঈদ আবুল খায়ের প্রমুখ প-িত ও সুফির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। আলী ইবনে মামুনের আনুকূল্যে খাওয়ারিজমে অবস্থানকালে তিনি বেশ ক’টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইতঃপূর্বে বোখারায় অবস্থানকালেও তিনি বেশ ক’টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এরই মধ্যে বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ফলে ইবনে সিনা ১০১৩ খ্রিস্টাব্দে জুরজানের উদ্দেশ্যে গোরগাঞ্জ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। উদ্দেশ্য ছিল বন্ধু কাবুস বিন ওয়াশামগিরের সাথে সাক্ষাৎ করা। তিনি খোরাসানের পথে যাত্রা করেছিলেন। বেশ কিছুদিন এ-শহর, ও-শহর ঘোরাঘুরির পর অবশেষে জুরজানে পৌঁছেন। তবে এরই মধ্যে কাবুস বিন ওয়াশামগিরের মৃত্যু ঘটে। জুরজানে তিনি তাঁর এক বন্ধুর আতিথেয়তায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। জুরজানে অবস্থানকালে তিনি বেশ ক’টি গ্রন্থ রচনা করেন। এসময় আবু ওবায়েদ জুরজানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত আবু ওবায়েদ জুরজানি তাঁর সহচর ছিলেন।
১০১৫ খ্রিস্টাব্দে ইবনে সিনা জুরজান থেকে রেই গমন করেন। এখানে তিনি দিলমি বংশীয় শাসনকর্তা মাজদুদ্দৌলার খেদমতে উপস্থিত হন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁকে বিষণœতার জটিল রোগ থেকে সারিয়ে তোলেন। ইবনে সিনা রেই-এ অবস্থানকালেই ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মাজদুদ্দৌলার ভাই আলে বুইয়ার শাসনকর্তা শামসুদ্দৌলা রেই আক্রমণ করে। এ সময় ইবনে সিনা কাজভিন গমন করেন এবং কাজভিন থেকে হামেদানে চলে যান। হামেদানে তিনি দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এখানে তিনি হামেদানের শাসনকর্তা শামসুদ্দৌলা দিলমির চিকিৎসা করেন এবং তাঁর অনুরোধে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। ১০২১ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দৌলার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে হবাল ছিলেন।এই সময়েই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন’ রচনা করেন এবং ‘শিফা’ গ্রন্থের রচনা শুরু করেন। ইবনে সিনার সুযোগ্য মন্ত্রিত্বের কারণে শামসুদ্দৌলার শাসনকাল ইতিহাসে প্রশংসিত স্থান লাভ করেছে।
শামসুদ্দৌলার মৃত্যুর পর স্বীয় পুত্র সামাউদ্দৌলা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি ইবনে সিনাকে তাঁর মন্ত্রিত্বের পদ অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেন। কিন্তু ইবনে সিনা রাজকার্যে পূর্ব থেকেই সন্তুষ্টি বোধ করছিলেন না, এই পদ থেকে মুক্তির বাহানা অনুসন্ধান করছিলেন। তাই তিনি গোপনে ইসফাহানের শাসনকর্তা আলাউদ্দৌলা আলে কাকুইয়ার সাথে পত্রযোগাযোগ করেন।
ইবনে সিনা সামাউদ্দৌলার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, ইসফাহানের শাসনকর্তার সাথে তাঁর পত্রযোগাযোগ রয়েছে এবং এই অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ৪ মাস তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় কাটান এবং এ সময় তিনি ৩টি গ্রন্থ রচনা করেন। কারামুক্তির পর ইবনে সিনা কিছুদিন হামেদানে অবস্থান করেন। অতঃপর একদল দরবেশের সাথে গোপনে হামেদান থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং ইসফাহান অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় তাঁর ভাই, শিষ্য ওবায়েদ জুরজানি এবং আরো দুজন ব্যক্তি তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। বহু বন্ধুর পথ পারি দিয়ে অবশেষে তাঁরা ইসফাহান গিয়ে পৌঁছেন। ইসফাহানের শাসনকর্তা আলাউদ্দৌলা তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে গ্রহণ করেন। আলাউদ্দৌলা ছিলেন মুক্ত চিন্তা ও জ্ঞানী প-িতদের পৃষ্ঠপোষক। যুদ্ধ কিংবা শান্তিকালে, সফর কিংবা রাজধানীতে অবস্থানকালে সর্বদাই তিনি ইবনে সিনাকে তাঁর সাথে রাখতেন। এই শহরে অবস্থানকালেই ইবনে সিনা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুশ্ শেফা’ রচনা সমাপ্ত করেন। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন আলাউদ্দৌলার সাথে হামেদান সফরে যান এসময় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৪২৮ হিজরির ৪ রমজান মোতাবেক ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুন এই শহরেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
যদিও অল্প বয়সেই ইবনে সিনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন তবে জুরজান, হামেদান এবং ইসফাহানের শাহী দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায়ই তাঁর রচনাশক্তি পূর্ণ পরিণতি পায়। রাজ-মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর যখন তাঁর কর্মব্যস্ত জীবন শুরু হয় তখনো তিনি ভ্রমণ ও প্রবাস অবস্থায়ও নিজের বৃহৎ গ্রন্থসমূহের সারসংক্ষেপ ও বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনায় নিবিষ্ট থাকতেন। ফলে তাঁর বিশাল এক রচনাসম্ভার তৈরি হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে রচিত তাঁর এসব গ্রন্ধের সংখ্যা ৪৫০-এরও অধিক। তবে এগুলোর বেশিরভাগই চিকিৎসা ও দর্শনবিষয়ক। জর্জ সার্টন তাঁর ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঝপরবহপব-গ্রন্থে ইবনে সিনাকে চিকিকৎসাশাস্ত্রের একজন প-িত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি তাঁকে তাঁর সমসাময়িককালের ইরানের শ্রেষ্ঠ প-িত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একই সাথে তাঁকে সর্বযুগের, সর্বস্থানের এবং সর্বজাতির শ্রেষ্ঠ প-িতদের একজন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইবনে সিনার সমকালে ইরানের প-িতদের বেশিরভাগই তাঁদের মাতৃভাষা ফারসি হওয়া সত্ত্বেও আরবি ভাষায়ই জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থ রচনা করতেন। ইবনে সিনাও তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থই আরবি ভাষায়ই রচনা করেছেন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ এগুলো ফারসি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করেছেন। দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র ও অধিবিদ্যাবিষয়ক তাঁর গ্রন্থ ‘আশ-শিফা’ অল্প বয়সের রচনা হলেও বেশ ব্যাপক। এটি কয়েকটি খ-ে মুদ্রিত হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘আল-কানুন ফিত্ তিব’ বা সংক্ষেপে ‘আল কানুন’। ‘কানুন’ চিকিৎসাবজ্ঞানের একটি বৃহৎ, ব্যাপক ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রচনা। আবদুর রহমান শারাফকান্দি ‘কানুন ফিত তিব্ব’ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এটি ইউরোপেরও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। এ গ্রন্থে ইবনে সিনা প্রাচীনকাল ও তাঁর সমসাময়িককালের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে লব্ধজ্ঞান অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে সুবিন্যস্ত আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ কারণেই এ গ্রন্থ প্রকাশের পর চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে গ্যালেন, রাজি ও আলী ইবনে আব্বাসের রচনাবলির ব্যবহার পরিত্যাক্ত হয়।
ইবনে সিনার সমকালেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁর খ্যাতি এশিয়া থেকে ইউরোপেও পৌঁছে গিয়েছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক ইবনে সিনার দুটি মৌলিক গ্রন্থ ‘শেফা’ এবং ‘কানুন’ দ্বাদশ শতকেই ইউরোপে চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক বিদ্যা হিসেবে অধীত হতো। দ্বাদশ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সর্বত্রই চিকিৎসাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অধ্যাপনার বিষয়গুলো মূলত ইবনে সিনার ‘শেফা’ এবং ‘কানুন’-এর ভিত্তিতেই পরিচালিত হতো। অবশ্য ইউরোপীয়রা আবুবকর মোহাম্মদ বিন যাকারিয়া রাজির চিকিৎসাবিষয়ক তত্ত্ব সম্পর্কেও অবহিত ছিল। তবে ইউরোপে তিনি চিকিৎসা-তাত্ত্বিকের চেয়ে চিকিৎসক হিসেবেই অধিকতর গণ্য হতেন। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে ইবনে সিনার ‘কানুন’ বিকল্পহীন গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো। যদিও গ্যালেনের মাধ্যমে প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির চরম উন্নতি হয়েছিল তবে ইবনে সিনা গ্যালেনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ‘কানুন’ গ্রন্থে খুঁটিনাটি বিষয়ের আলোচনায় ইবনে সিনা যে সূক্ষ্ম দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তার অনুমান এ থেকেই করা যায় যে, তিনি বেদনার পনেরোটি কারণ বর্ণনা করেছেন। চোখের আবরণের প্রদাহ বর্ণনায় তিনি মধ্যস্থিত এবং পার্শ্বস্থ আবরণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি বলেন, ক্ষয়রোগ একটি সংক্রামক ব্যাধি এবং এই রোগের বিস্তারে বাতাস ও পানির প্রভাব অনেক বেশি। চর্মরোগের যথাযথ বর্ণনা দেওয়া ছাড়াও তিনি ধাতুগত পীড়া ও ধাতুগত বিকৃতি, ¯œায়বিক উপসর্গ, এমনকি প্রেমজনিত পীড়া সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি মানসিক ও পীড়াগত তথ্যের নিদান নিরূপণ ও এর বিশ্লেষণও করেছেন। এখান থেকেই মনোবিশ্লেষণ (চংুপযড়-ধহধষুংরং) শুরু হয়। ভেষজ দ্রব্যগুণ বিষয়ে তিনি অষুধসমূহের যথার্থ তত্ত্ব ও ভেষজবিদ্যায় অনুসরণীয় পদ্ধতিসমূহের একটা নক্সাও প্রস্তুত করেছেন।
১১৫০ থেকে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জারারদ কারমুনায়ি ‘কানুন’-এর সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন। ইউরোপে এটি ঈধহহড়হ সবফরপরহধ নামে প্রসিদ্ধ। এ পর্যন্ত এটি প্রায় ৮৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব অনুবাদের বেশিরভাগই ল্যাটিন ভাষায়। তবে স্পেনিস, ইতালীয় এবং দক্ষিণ ফরাসি ভাষায়ও কিছু অনুবাদ হয়েছে। ইউরোপের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার মূল ভিত্তিই ছিল ইবনে সিনার ‘কানুন ফিত্ তিব’। এ পর্যন্ত ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে পুরোনো যে পাঠ্যক্রমের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেটি ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম পোপ কালমান্ট-এর মাধ্যমে মনোপলিয়ে চিকিৎসা বিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত হয়েছিলো, তাতে ইবনে সিনার ‘কানুন’ গ্রন্থের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সব পাঠ্যক্রমেই এ গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর দশ বছর পর অর্থাৎ ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ গ্যালেনাস-এর নাম ইবনে সিনার চেয়ে অধিক প্রাধান্য পায়। তবে সপ্তদশ শতক পর্যন্তই ইবনে সিনার ‘কানুন’ ইউরোপে পাঠ্যভুক্ত ছিল।
জর্জ সার্টন-এর মতে, ইবনে সিনা ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের একজন। তেনসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিশ্বকোষে ইবনে সিনাকে প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর দর্শনবিষয়ক বক্তব্যসমূহ পরবর্তী যুগের বিখ্যাত দার্শনিকবৃন্দ, যথা : মোল্লা সাদরা, টমাস অকুইয়ুনাস, ডেকার্ট প্রমুখের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। যদিও ইবনে সিনা অ্যারিস্টোটলীয় দর্শনের অনুসারী ছিলেন এবং এ দিক থেকে আল ফারাবি ছিলেন তাঁর এই চিন্তার গুরু। দর্শন বিষয়ে তাঁর আলোচনা-পর্যালোচনার বেশিরভাগই অ্যারিস্টোটলীয় ব্যাখ্যাকারদের মতামতের ভিত্তিতেই লক্ষ করা যায়। অ্যারিস্টোটলের ন্যায় তাঁর সমুদয় রচনার প্রারম্ভও হয়েছে ন্যায়শাস্ত্র হতেই। তবে যতই দিন গড়াতে থাকে তিনি অ্যারিস্টোটলীয় দর্শন-চিন্তা থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন এবং প্লেটনিক ও ইসলামের আধ্যাত্মিক দর্শন-চিন্তায় প্রভাবিত হতে থাকেন। তাঁর বিশাল আকারের গ্রন্থ ‘মান্তেকুল মাশরেক্বিন’-এর বক্তব্যসমূহ এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, যেটি তিনি জীবনের শেষ দিকে রচনা করেছিলেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে বর্তমানে এই গ্রন্থটির ভূমিকা অংশ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
ইবরাহিম মাকদুর মনে করেন, দর্শনে ইবনে সিনা অ্যারিস্টোটল অপেক্ষা অধিকতর অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর দর্শন এক হিসেবে নতুন ন্যায়ের অগ্রদূত। সে কারণেই মুসলিম বিশ্বে ‘সিনুভি দর্শনতত্ত্ব’ বা ‘ইবনে সিনার দর্শনতত্ত্ব’ নামে পৃথক দর্শনতত্ত্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রেও ইবনে সিনার দর্শনতত্ত্ব স্বীকৃতি পায়। খাজা নাসির উদ্দিন তুসির ‘বিমূর্তন বিশ্বাসতত্ত্ব’ মূলত ইবনে সিনার দর্শনতত্ত্ব থেকেই উদ্ভুত। ইবনে সিনার মতে, মানতিক বা ন্যায়শাস্ত্র হচ্ছে একটি চিন্তামূলক শিল্প। এর কাজ হচ্ছে দার্শনিককে সঠিক সীমা ও সঠিক ধারণা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। কারণ, যে কোনো প্রকারের জ্ঞানই হোক না কেন, হয় তা হবে ‘তাসাব্বুর’ বা নিছক ধারণা অথবা হবে ‘তাসদিক্ব’ বা সত্যতা প্রতিপাদন। ‘তাসদিক্ব’-এর মাধ্যম হলো ‘ক্বিয়াস’ বা অনুমান। এটি সঠিকও হতে পারে, আবার বেঠিকও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে শব্দসমূহের তাৎপর্য নির্ণয়। এ কারণে তিনি সম্বোধনমূলক, বিতর্কমূলক, বিভ্রান্তিমূলক ও কুতর্কমূলক প্রমাণ প্রয়োগ পদ্ধতিসমূহরে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শব্দসমূহকে ‘মুফরাদ’ বা মৌল এবং ‘মুরাক্কাব’ বা যৌগ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন।
সত্তা (ইবরহম) ও অস্তিত্ব (ঊীরংঃবহপব) প্রশ্নে ইবনে সিনার অনুরাগ বিশেষ প্রকট। তাঁর মতে সত্তার মৌলিক পরিচয় এর নিজ অস্তিত্ব হতেই প্রতিষ্ঠিত। সত্তার বর্ণনায় কেবল এইটুকু বলাই যথেষ্ট নয় যে, এর নিজ অস্তিত্ব থেকে এটি ভিন্ন নয় অথবা এর অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কহীন নয়। এই সম্পর্কহীনতা কল্পনাই করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান, এই কথাটি বাস্তবেও সত্য এবং কল্পনাতেও সত্য। সুতরাং ত্রিভুজ হতে এ কথাটিকে বিচ্ছিন্ন করা হলে ত্রিভুজ সম্পর্কে এটি বলা সম্ভব হবে যে, এটি সত্তাজ্ঞাপক ও অস্তিত্বজ্ঞাপক উভয়ই।
ইবনে সিনা বিজ্ঞান ও দর্শনচর্চার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করেছেন। আরবি ও ফারসি ভাষায় তাঁর বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে ৭২টি ফারসি শের (শ্লোক) ইবনে সিনার রচনা হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এসব কবিতায় সৃষ্টিজগতের নশ্বরতা ও মানব জাতির অক্ষমতা সম্পর্কে ইবনে সিনার তীর্যক ব্যঙ্গ লক্ষ করা যায়। নমুনা হিসেবে কয়েকটি পঙ্্ক্তির উদ্ধৃতি করা যায় :
بر سرِ خاک باد پیمودم روزکی چند در جهان بودم
جانِ پاکیزه را بیالودم ساعتی لطف و لحظهای در قهر
بیخرد را به طمع بستودم باخرد را به طبع، کردم هَجو
و آبِ دیده ازو بیالودم آتشی برافروختم از دل
[বাতাসের ধূলির মাথায় করেছি ভ্রমণ যতদিন ছিলাম এই ভুবন
পরিচ্ছন্ন জীবনকে করেছি দূষণ ক্রোধের ভেতর করুণার সময়-ক্ষণ
লিপ্সায় করেছি মূর্খের তোষণ জ্ঞানীকে করেছি দুর্নামে মুদ্রণ
আর তার অশ্রুজলে করেছি মিশ্রণ হৃদয়ে জ্বেলেছি অগ্নি-দহন]
ইবনে সিনা জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি আবু ওবায়েদ জুরজানি, আবুল হাসান বাহামানিয়ার, আবু মানসুর তাহের ইসফাহানি, আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ বিন আহমাদ আল মাসুমি প্রমুখের ন্যায় বেশ কিছু যোগ্য চৈন্তিক উত্তরসূরিও তৈরি করেছিলেন। যাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিজ্ঞ প-িত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে পা-িত্বের কারণে সমকালেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ইবনে সিনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে ইরানে ইবনে সিনার জন্মদিন ২৩ আগস্ট ‘চিকিৎসক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইবনে সিনার নামে নানা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের নামকরণ করা হয়েছে। ‘ইবনে সিনা মুখ’ নামে চাঁদের লুক্কায়িত দিকের একটি মুখের নামকরণ করা হয়েছে। তেহরান, শিরাজ, মাশহাদ, ইসফাহান, ইস্তাম্বুল, হারারে, ফ্রান্সের বুবিনি এবং বাংলাদেশের ঢাকায় ইবনে সিনার নামে হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। নিউইয়র্কে ইবনে সিনার নামে একটি অপারেশন থিয়েটারের নামকরণ করা হয়েছে। পূর্ব ব্রিটেনের সাসেক্সে ইবনে সিনার নামে একটি চাইনিজ মেডিক্যাল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। পাকিস্তানেও ইবনে সিনার নামে একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাঙ্গেরীতে ইবনে সিনার নামে একটি ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। তেহরানে ইবনে সিনার নামে আন্তর্জাতিক বায়োটেকনোলজি জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে। তেহরানে ইবনে সিনা নামে একটি গবেষণাকেন্দ্রও রয়েছে। এ ছাড়া ইবনে সিনা নামে বেশ কটি স্কুল এবং শিক্ষাকেন্দ্রও কাজ করছে।
জার্মানিতে ইবনে সিনার নামে একটি পুরস্কারও প্রবর্তিত হয়েছে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ড. ইয়াশার বিলগিন আরো কজন বিজ্ঞজনকে সাথে নিয়ে ফ্রাঙ্কফ্রুট শহরে ‘অভিসিনা প্রেইজ’ (আরপবহহধ-চৎবরং ব. ঠ) নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন প্রতিবছর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদানের জন্য মূল্যায়নের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে ‘ইবনে সিনা পুরস্কার’ প্রদান করে। এই পুরস্কারের মূল্যমান এক লক্ষ ইউরো।
২০০৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিজ্ঞানের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির নিদর্শনস্বরূপ ভিয়েনায় অবস্থিত জাতিসংঘের দপ্তরে হাখামানশি যুগের স্থাপত্যধারা এবং ইসলামি স্থাপত্যধারার মিশেলে প্রস্তুত একটি চমৎকার ভাস্কর্য উপহার দেন, যেটি এই দপ্তরের মূল প্রবেশদ্বারের ডানপাশে স্থাপন করা হয়েছে। চারদিক-সম্মুখবিশিষ্ট এই ভাস্কর্যে ইরানের বিখ্যাত চার দার্শনিক ওমর খাইয়াম, আবু রায়হান বিরুনি, যাকারিয়া রাজি এবং ইবনে সিনার প্রতিকৃতি বিদ্যমান।