আশুরা আমাদের কী আহ্বান জানায়
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮

রাশিদ রিয়াজ: ৬৮০ সালের ১০ মহররম খোদাদ্রোহী জালিম শাসক ইয়াজিদের শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র নাতি হযরত ইমাম হোসেন এবং তাঁর পরিবার ও সঙ্গীদের ওপর কারবালা প্রান্তরে অবরোধের পর চাপিয়ে দেয়া হয় এক অসম যুদ্ধ। ইমাম ও তার ৭২ জন সঙ্গী বীরত্বপূর্ণ এবং নীতি-নির্ধারণী ওই যুদ্ধে শহীদ হন।অন্যায় ও অবিচারের মোকাবেলায় তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ বা শাহাদাতের অমর আদর্শ রয়ে গেছে বিশ্বমানবতার কাছে। কারবালার ঘটনাকে শুধু বিয়োগান্তক একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে এবং তা কেবল স্মরণের মধ্যে রেখে আশুরা বা দশম মহররমকে একটি নিছক দিবস হিসেবে পালনের মধ্যে যদি আমরা সীমাবদ্ধ রাখি তাহলে এর তাৎপর্য অনেকটাই আমাদের প্রায়োগিক জীবনে অনুসরণের কোনো সুযোগ ঘটে না। মহররম কি শুধুই কারবালার শোক পালনের মধ্যে দিয়ে মন খারাপের একটি দিন বা মর্সিয়া গেয়ে চোখের পানি মুছে ছওয়াব অর্জনের ফজিলত কামনার অভিপ্রায়? আশুরার আরো নানা ধরনের তাৎপর্য ও এই দিনে আরো বিশেষ বিশেষ ঘটনার ভীড়ে অনেক সময় আমরা খেই হারিয়ে ফেলি কারবালার মহান সেই শিক্ষাকে যা মহাকবি ইকবাল বর্ণনা করেছেন তার কবিতায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হর কারবালা কি বাদ… অর্থাৎ কারবালার পূর্বাপর প্রেক্ষাপট ও পটভূমি এবং আজকের দিনে তার ভাবনা নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পথপরিক্রমা খুঁজে পেতে আমাদের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই।
শৈশব থেকেই জেনে এসেছি দশই মহররম পবিত্র আশুরা আর এর ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনা। নফল রোজা, দোয়া মাহফিল, এবাদত বন্দেগীর মধ্যে দিয়ে দিনটি উদযাপনের চিত্র ফিবছর দেখা যায়। দিবসের নানা ধরনের তাৎপর্যের ভীড়ে আসল মর্মবাণী যদি হারিয়ে যায় তাহলে তা নিছক দিবস পালনের মধ্যেই বাক্সবন্দি একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আসলে মহররম হচ্ছে অবিচারের বিরুদ্ধে সাম্যের জয়গান গেয়ে ওঠার মাস। এ ঘটনা এমন এক সময় ঘটে যখন ইমাম হোসেন মিথ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন আপোষহীনভাবে এবং এ ইতিহাস সৃষ্টি করতে যে সত্য সবসময় মিথ্যাচারের ওপর জয়লাভ করেছে। নষ্টাচার ও ভ্রষ্টাচারের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ইমাম হোসেনের আনুগত্য দাবি করে বসেন। ইসলামের মূল মর্মবাণী থেকে যোজন যোজন পথ সরে দাঁড়ানোর ফলে এমনিতে মুসলমানদের দুর্গতির আর সীমা পরিসীমা ছিল না। ঠিক সেই সময় ইসলামী আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ন্যায় বিচারের পক্ষে এবং অবিচারের বিরুদ্ধে ইমাম হোসেন যে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা এখনো প্রতিদিন আমাদের অবিচলিত হতে শিক্ষা দেয়। ইয়াজিদ ইমাম হোসেনের পরিবার ও অনুসারীদের হত্যার মাধ্যমে ইসলামকেই নিরুদ্দেশ করে দিতে চেয়েছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলাম জিন্দার বিষয়টি নিয়ে যদি চিন্তা করি তাহলে আমরা দেখতে পাই যেন বিশ্ববাজারে এক অচল মুদ্রা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। পশ্চিমা বিশ্বের ইসলামভীতি নিয়ে অপপ্রচার, জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেয়ার পিছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গোপন খরচ, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় ‘রেজিম চেঞ্জ’ চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা বা মধ্যপ্রাচ্যে নতজানু জবাবদিহিবিহীন একধরনের বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম সম্পর্কে বিরাট ভুল ধারণা স্থায়ী করে রাখা হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের অবশিষ্টটুকু বিনাশ বা শিয়া সুন্নী বিভেদের মত অসংখ্য অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও বিভক্ত সমাজ সৃষ্টি করে অবরোধের সংস্কৃতি চালু করে দিতে সক্ষম হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। এরফলে মুসলিম দেশগুলো অস্ত্র ক্রয়ের পিছনে যে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছে তার অংশ বিশেষ প্রকৃত জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পুঁজি কিংবা উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এরপর রোহিঙ্গা, ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন মজলুম মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর মত হাতে গোনা দু’একটি দেশ ছাড়া কেউ নেই। এসব বিবেচনা করলে ইসলাম নিয়ে আমাদের মনমানসে যে বিশাল সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সে সম্পর্কেও এক অনিবার্য আহবান জানিয়ে যায় আশুরা। কারণ, ইমাম হোসেন বলে গেছেন, ক্ষমতা দখল তার অভিপ্রায় ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ইসলামের ভেতরে রাজতন্ত্র, বিলাসবহুল জীবন যাপন, অবিচার, ব্যভিচার ইত্যাকার ধরনের অপসংস্কৃতির যে প্রবেশ ঘটেছে যা ইসলাম থেকে মুসলমানদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় সেগুলোর সংস্কার করতে। ইমাম হোসেন বলেন, যদি ইয়াজিদের মত দুর্ভাগা উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ইতি ঘটবে। যদি মুহাম্মাদ (সা)এর ধর্ম আমার নিহত হওয়া ছাড়া টিকে না থাকে তাহলে এসো হে তরবারি। নাও আমাকে। যে মৃত্যু সত্যের পথে হয়, মধুর চেয়েও সুমিষ্ঠ।
কারবালার পটভূমি নিয়ে ভাবতে অবাক লাগে নবীজীর (সা) ওফাতের মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে ইমাম হোসেনকে হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। হযরাত আম্মার ইবনে ইয়াসির ঠিকই বলেছিলেন, তারা মুসলমান হয়নি, ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র। আবু সুফিয়ান ২০ বছর রাসুলুল্লাহর (সা:) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষের ৫/৬ বছর ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ও ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করেন। মোয়াবিয়া তার পিতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই পথ অনুসরণ করেন যার চরম পরিণতি ঘটে ইয়াজিদের হাত ধরে।অথচ ইসলামী উম্মার নেতৃত্বের বিষয়টি এমন নয় যে, কারো খেয়াল খুশীমাফিক বা শাসকের পুত্র পরবর্তী শাসক হবে। সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনো অভিলাষ তাহলে আর অবশিষ্ট থাকত না যদি ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নেয়া হত।ইয়াজিদকে মেনে নিলে ইসলামকে বাতিল থেকে পৃথক করাই অসম্ভব হয়ে পড়ত । এই যে শতাব্দীর পর শতাব্দী সত্যের পথে সংগ্রামকারীদের জন্যে তিনি এক পথ অনুসরণের জন্যে রেখে গেছেন যা জাগরুক থাকবে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত এবং এটিই হচ্ছে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই পরিবর্তন আনার এক অনিবার্য প্রচেষ্টা।
কারবালার ঘটনা তাই আমাদের প্রতিবছর ডাক দিয়ে যায় সচেতন হয়ে ওঠার জন্যে। ব্যক্তিগত ইচ্ছা, লোভনীয় প্রস্তাব, অন্যায়ের কাছে একরকমের দাসত্ববরণ করে নেয়ার মাধ্যমে দু’দ- ভাল থাকার অভিপ্রায় কার্যত আমাদের ইসলাম থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। আর যা কিছু নিজেদের আয়ত্বের বাইরে অবশিষ্ট থেকে যায় তার জন্যে প্রকারান্তরে আল্লাহর ওপর খোড়া ভরসা করে তার ইচ্ছার ওপর দায় চাপিয়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মত সাহস ও চ্যালেঞ্জ না নেয়ার এক যুক্তি অবলম্বন করে বসি। ইমাম হোসেন এ স্থানেই সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে স্পষ্ট এক সীমারেখা টেনে নিয়ে গেছেন। এমনকি তিনি তার পরিবারের সদস্য ও অনুসারীদের পর্যন্ত শাহাদাৎ হওয়ার আগের দিন বলেছেন, তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে যাও। ইয়াজিদের আমাকেই প্রয়োজন কেবল। অন্যকিছু নয়। নিজেদের নিরাপদে ফিরে যেতে এবং তার সঙ্গে বিপদাপন্ন না হতেও অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি যে আদর্শে বলীয়ান হয়ে লড়েছেন সেই শাহাদাতের তামান্না তার অনুসারীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর হয়ে লড়তে এসেও হুর ইমামের পক্ষেই সত্যের তরবারী উঁচু করে ধরেছেন। মানবিক গুণাবলীর বিচারে দেখা যায় ইয়াজিদের সেনাবাহিনী এসে পড়ার পর তাদের ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়ানোর ও পানি মশক ভরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি তিনি ঘোর যুদ্ধের ময়দানে দিয়েছেন। অতঃপর ইমাম হোসেনের পরিবার ও তার অনুসারীদের পানির কষ্টে ফেলেছে ইয়াজিদের বাহিনী। উমাইয়াদের পার্থিব জীবন ধারার সঙ্গে এখানেই ইমাম হোসেনের জীবনাদর্শের পার্থক্য। ইসলামী জীবন বিধানের সঙ্গে উমাইয়াদের ক্ষমতার লোভ ও সিংহাসনে টিকে থাকার মধ্যে ফারাক এখানেই। এজন্যেই উমাইয়ারা হযরত আলী (রা:) ও ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেছিল। মোয়াবিয়া শাম বা সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর ইসলামের বিরুদ্ধে নিজেদের পছন্দ ও ইচ্ছা পরিপূরণে কুফার অধিবাসীদেরও বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। তারও আগে বনি হাশিমের বিরুদ্ধে বনি উমাইয়া তিন বংশ ধরে গোষ্ঠীগত বিদ্বেষে লিপ্ত ছিল। সেখানে উমাইয়াদের মনের ভিতর ইসলাম নিয়ে বিপরীত ধ্যান ও সুবিধাবাদী এবং বস্তুবাদী হওয়ার এক খায়েশ যুগ যুগ ধরেই গোপনে অক্ষয় ছিল। উমাইয়াদের স্বভাব ও মনমানস এহেন দুনিয়া নির্ভর নানাবিধ চর্চায় এতই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে তারা খোদায়ী বিধান থেকে উপকৃত হতে পারেনি। ঐশী শিক্ষাকে সেই অবনত মস্তকে গ্রহণ করার মত মর্যাদাবোধ, উন্নত আত্মা ও মহত্বের উপলব্ধি তারা হারিয়ে ফেলেছিল। ধনদৌলতের প্রাচুর্য, দরবারী আলেম সমাজ ইয়াজিদদের মনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে মিম্বারে ও খুৎবায় তারা হযরত আলী (রা:)কে অভিশাপ দেয়ার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন, তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের হত্যা করা হয়েছিল। তাই সত্যান্বেষষী মনোবাসনা না নিয়ে যদি দিবস উদযাপনের ঘেরাটপে ফেলে আশুরাকে আমরা বিবেচনা করি তাহলে ইমাম হোসেনের শাহাদাতের তাৎপর্য ও তার সংগ্রামের নির্যাস আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ ও খোদাভীরু, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পরও চার খলিফার মধ্যে তিনজনকেই হত্যার ঘটনার কারণএকজন মুসলমান হিসেবে জানা যেমন জরুরি তেমনি কারাবালার ঘটনা থেকে অনেক কেন’র মত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। একজন শিশুও নানা প্রশ্নের সন্ধান করতে থাকে। তার শিশুমন চারপাশ সম্পর্কে জানতে চায়। ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে ধরে নিয়ে এসব প্রশ্ন থেকে পাশকাটিয়ে থাকার কোনো ফুরসত বা সুযোগ নেই। ছিল না বলেই ইসলামী পুনর্জাগরণের সময় জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের উৎকর্ষতা ছিল চোখে পড়ার মত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কবিতার মত, ‘শুকনো রুটি সম্বল করে যে ঈমান আর যে প্রাণের জোরে, ফিরেছি জগৎ মন্থন করে…। কিন্তু মুসলমানরা যখন ভাগ্যের হাতে নিজেদের ভবিষ্যত সমর্পণ করে নিঃশেষ হতে শিখল তখনি তার ভেতর থেকে শিশুর মত কেন প্রশ্নের উত্তর জানার তীব্র ইচ্ছাও ফুরিয়ে গেল। এই অসহায়ত্ব থেকে ঘুরে দাঁড়াবারও ডাক দিয়ে যায় কারবালার ঘটনা। যখন বিজ্ঞানী নিউটনের মাথায় গাছ থেকে একটি আপেল এসে পড়ল, তখন নিউটন এর কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করলেন। গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়াই বিধি এ কথা ভেবে নিউটন বসে থাকেননি। তার মনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন আপেলটি উপরে উঠল না। বোকার মত মনে হলেও এই বিবিধ কেন প্রশ্নের উত্তর নিউটনকে মধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহায়তা করে। এটি খুবই প্রাসঙ্গিক যে মুসলমানরা আজকাল যখনি কোনো অবাক কা- বা বুঝতে পারেন না এমন কিছু প্রত্যক্ষ করেন তা নিয়ে নানাবিধ কেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বা চিন্তা শক্তি ব্যবহারের মত বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল অবলম্বন করতে চান না। সবই নিয়তি মনে করে এক ধরনের অসহায়ত্বে নিজেকে বলী দিয়ে বসেন। অনেক কেন এবং এই কেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার নিরন্তর প্রচেষ্টা যতদিন না কারবালার ঘটনা নিয়ে আমাদের মনের মাঝে দানা বেঁধে উঠবে না ততদিন আমরা এটিকে দিবস উদযাপনের মধ্যে শুধুই সীমাবদ্ধ করে কেবলি কি অসহায় হয়ে থাকব?