মঙ্গলবার, ৪ঠা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

আর্গ-ই বাম: ইট ও কাদা দিয়ে তৈরি বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুর্গ

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ১২, ২০১৬ 

news-image

প্রাচীন ইরানের রাজা-বাদশাদের প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোকে শহরের ভেতর ‘আর্গ’€Œ নামে ডাকা হতো এবং শহরের বাইরে ডাকা হতো ‘কেল্লা’ বা ‘দূর্গ’ বলে। কেল্লাগুলোতে অনেক সময় বহু দল কিংবা বেসরকারি লোকজন এমনকি সাধারণ মানুষও বসবাস করতো। আর্গ ছিল শহুরে প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং ইরানের প্রাচীন শহরগুলোতে প্রাচীন আর্গগুলোর বহু নিদর্শন এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।

4bk71b00b3fa1aa444_800C450

তেহরান থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে খুরমা বীথিকাময় রোদে পোড়া ইটের শহর বাম অবস্থিত। এই শহরেরই একটি টিলার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে একটি আর্গ যার নাম ‘আর্গ-ই বাম’। বেশ সুন্দর দেখতে এটি। রোদে পোড়া ইট আর কাদা দিয়ে তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্গ€এটি। পাথুরে টিলার ওপরে তৈরি করা হয়েছে এই আর্গটি। বাম শহরটি কেরমানের কাছাকাছি অবস্থিত। বাম আর্গ€টি ঐতিহাসিক একটি বিশাল কমপ্লেক্সের অংশ বিশেষ। প্রাচীন শহর দর্যিনে ঐতিহাসিক একটি নিদর্শন রয়েছে যা তিন হাজার বছর আগের বলে পুরাতাত্ত্বিকগণ মনে করেন। বর্তমান বাম শহরের উত্তরাঞ্চলে এই নিদর্শনটি রয়েছে।

4bk54a0c2b69c07xgj_800C450

ইতিহাসে এসেছে, বাম আর্গটির সন্ধান পেয়েছিলেন হাখামানেশীয় রাজবংশের নামকরা বাদশাহ এসফান্দিয়ারের ছেলে বাহমান। পুরাতত্ত্ববিদদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী এই আর্গটি খুবই প্রাচীন। বহুবার এটির সংস্কার করা হয়েছে বা পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। তবে এটির নির্মাণ তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এখানে মানুষ বসবাস করেছে।

বাম আর্গের আয়তন দুই লাখ বর্গমিটার। দুটি অংশে বিভক্ত এটি। একটি জনগণ অধ্যুষিত আর অপরটি শাসকদের জন্যে সংরক্ষিত। আর্গের উত্তরাংশে বিশাল একটি গম্বুজ সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই গম্বুজটির নিচে রয়েছে গ্রীষ্মের খরতাপে তৃষিত মানুষের জন্যে ঠাণ্ডা পানি আর বরফ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা।

4bk75910c5aabca44y_800C450

বাম আর্গের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু স্থাপনা যেমন-বোর্যে আসলি, চহর ফাসল্, খনেয়ে হাকেম, চহে অব, হাম্মাম, সারবযখনে এবং দারভযে সাসানী। শাসকগণ যে অংশে বাস করতেন সে অংশটি পাথরের প্রাচীর ঘেরা এবং বেশ মজবুত। দেয়ালের উচ্চতা সাত মিটার। পুরো দেয়ালটাই মাটি আর খড়ের আস্তরে ঢাকা।

4bk7e093b1b467a45y_800C450

আর্গ€ ঘিরে ছোটো-বড়ো ৩৮ টি টাওয়ার বানানো হয়েছে মজবুত ও দৃঢ় প্রাচীরসহ। দীর্ঘ প্রাচীরের মাঝে কিন্তু কোনো প্রবেশপথ রাখা হয় নি। পুরো কমপ্লেক্সের একমাত্র প্রবেশদ্বার হলো দক্ষিণ দিককার প্রাচীর আর জনগণের বসবাস করার মধ্যবর্তী স্থানে। এই অংশে দরোযা, বাজারের রাস্তা, জামে মসজিদ, জিমনেশিয়াম বা শরীর চর্চাকেন্দ্র, গোরস্তান, হাম্মাম, মাদ্রাসা এবং ঘোড়া রাখার আস্তাবল ইত্যাদি স্থাপনা রয়েছে। বাম আর্গের আবাসিক অংশে আনুমানিক চারশ’ ঘর রয়েছে। আঁকাবাঁকা বহু অলিগলি একটি ঘর আরেকটি ঘরকে সংযুক্ত করেছে।

4bk70602ecb05ba44p_800C450

উঁচু একটি দেয়ালের মাধ্যমে আর্গের দক্ষিণাংশটি উত্তরাংশ থেকে পৃথক হয়েছে। জনগণের বসবাসের জন্যে এভাবে আলাদা করা হয়েছে। তবে দুই অংশের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হলো একটি দরোজা। আবাসিক এলাকাটি সমতল ভূমির ওপর নির্মিত হয়েছে। নগর নির্মাণ এবং নাগরিক জীবনের দৃষ্টিতে এটা একটা পরিপূর্ণ কমপ্লেক্স। এখানকার অনেক বাসা বেশ প্রশস্ত এবং কয়েকটি আঙিনা বিশিষ্ট, ভেন্টিলেশন পদ্ধতিযুক্ত। বারান্দাসহ গ্রীষ্ম এবং শীতকালের উপযোগী ভিন্ন ভিন্ন কক্ষ আর আঙ্গিনার মাঝে পানির হাউজও রয়েছে এগুলোতে। সকল ঘরেরই রয়েছে অপর ঘরের সাথে যোগাযোগের রাস্তা। কোনো কোনোটিতে বিশেষ হাম্মামও বানানো হয়েছে। রুটি তৈরির বেকারী, তেল তৈরির ঘানি এবং কাপড় তৈরির তাঁতও রয়েছে আর্গে বামে।

ইতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে,পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমমুখী মহাসড়কে আর্গে বামের অবস্থানের কারণে এর বিশেষ গুরুত্ব সবসময়ই ছিল। লুৎফে আলী খান যান্দ্‌-এর গ্রেফতারী ছিল এখানকার সর্বশেষ ঐতিহাসিক বিপর্যয়। কেল্লার গভর্নর মুহাম্মাদ আলী খান যাবোলির মাধ্যমে এই গ্রেফতারির ঘটনাটি ঘটে। বহু বছর আগে আর্গে বাম ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়। দেশের এবং বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক প্রতি বছর এই বাম আর্গটি দেখার জন্যে আসে।

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে এ এলাকায় ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের ঘটনায় ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির বৃহদাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির ধ্বংস হয়ে যাওয়া অংশকে পরবর্তীতে পুনরায় পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। সূত্র: পার্সটুডে