আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদেরকে প্রদত্ত সাক্ষাতে রাহ্বার
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৬
যে কেউ মতানৈক্য সৃষ্টিকারী কথা বলছে সে জেনে-বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক, দুশমনের লাউডস্পীকার হিসেবে কাজ করছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি ২৩ মে ২০১৫ তেহরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদেরকে প্রদত্ত সাক্ষাতে বলেন, যে কেউ মতানৈক্য সৃষ্টিকারী কথা বলছে সে জেনে-বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক, কার্যত দুশমনের লাউডস্পীকার হিসেবে কাজ করছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, মায্হাবী মতানৈক্য, শিয়া-সুন্নি মতানৈক্য, আরব ও আজম্ মতানৈক্য এবং বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন ক্বওম ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে মতানৈক্য, সেই সাথে জাতীয়তাবাদী অন্ধত্ব হচ্ছে মুসলিম সমাজসমূহের মধ্যে মতানৈক্য ও বিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে চালিত দুশমনদের অপচেষ্টাসমূহের অন্যতম; তারা এসব বিরোধের অগ্নি প্রজ্বলিত করার চেষ্টা করছে; একে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমরা আশা করি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে আহ্লে কোরআনে পরিণত করবেন। এরপর তিনি বলেন, আমরা জাহেলীয়াতকে এ সুযোগ দেব না যে, আমাদের সমাজ সমূহের ওপরে নিজেকে চাপিয়ে দেবে অথবা চাপিয়ে দিয়ে থাকলেও আমরা তাকে মেনে নেব না।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, আজকের ইসলামী জাহান জাহেলী রাষ্ট্র ব্যবস্থাসমূহের চাপে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে। এ কারণেই আজ ইসলামী জাহান দুর্বল ও দরিদ্র হয়ে পড়েছে এবং বিভেদ, অনৈক্য ও পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমাদেরকে কোরআনী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহের পানে এগিয়ে যাবার জন্য সুদৃঢ় ও অটল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হতে হবে। আমরা যদি এ পথে এক কদম অগ্রসর হই তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বিগুণ শক্তি প্রদান করবেন। আর মুসলিম জাতিসমূহকে এ বিষয়টিই বুঝতে হবে। বস্তুত আমাদেরকে এক কদম এক কদম করে অগ্রসর হতে হবে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, আমরা ইরানী জাতি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং আমরা ইসলাম ও কোরআনের দুশমনদের সামনে আত্মসমর্পণ করি নি, বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আর আল্লাহ্ তা‘আলাও আমাদেরকে শক্তি প্রদান করেন; আমরা যত বেশি প্রতিরোধ করেছি ততই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের সামর্থ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের আশাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটাই হচ্ছে সমস্যাক্লিষ্ট ইসলামী জাহানের নিরাময়ের প্রেসক্রিপশন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, ইসলামের দুশমনরা ইসলামী উম্মাহ্র অভ্যন্তরে যেসব লক্ষ্য হাসিলের জন্য সদা তৎপর রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে বিভেদ, অনৈক্য ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সৃষ্টি। তাই তাদের এ অশুভ লক্ষ্যকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। তিনি বলেন, অবশ্য প্রতিহত করার কথা বলা বেশ সহজ, কিন্তু তা কার্যকর করা বেশ কঠিন, তবে কঠিন হলেও পথ আছে এবং পথ খোলা আছে। এ ধরনের মতানৈক্য বিস্তারের মোকাবিলা করার জন্য মূল যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা হচ্ছে দৃঢ় সিদ্ধান্ত, অটল ইচ্ছাশক্তি ও দূরদৃষ্টি। বিশেষ করে দূরদৃষ্টির সাথে বন্ধু ও শত্রুকে পরস্পর থেকে পৃথক করে চিনে নিতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ সমূহের মধ্যে এমন অনেক দেশ আছে যেসব দেশের পরিচালক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ দূরদৃষ্টির অভাব জনিত ভুলের শিকার হয়ে আছেন এবং এ কারণে তাঁরা তাঁদের বন্ধু ও দুশমনকে সঠিকভাবে চিনে নিতে পারছেন না; তাঁরা দুশমনকে বন্ধু ও বন্ধুকে দুশমন হিসেবে গণ্য করেন এবং এর পরিণামে তাঁরা আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি বলেন, দূরদৃষ্টিবর্জিত এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী যে কোনো দেশই আঘাতের শিকার হয়ে থাকে। তাই দূরদৃষ্টি অপরিহার্য। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন : قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي – ‘(হে রাসূল!) বলুন : এই হচ্ছে আমার পথ; আমি এবং আমাকে যে অনুসরণ করে- আমরা দূরদৃষ্টি সহকারে (লোকদেরকে) আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করি।’ সূরা ইউসুফ : ১০৮
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, দূরদৃষ্টির অধিকারী হলে মানুষ সঠিকভাবে পথ চিনতে পারে। তখন সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও অটল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হতে পারে। তখন সে সহজ পথে চলতে পারে। নুসরাতে ইলাহী বা আল্লাহ্র সাহায্য মানে এটাই। إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ – ‘তোমরা যদি আল্লাহ্কে সাহায্য কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদমসমূহকে সুদৃঢ় করে দেবেন।’ (সূরা মুহাম্মাদ্ : ৭) এর চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট, অধিকতর উত্তম ও দ্ব্যর্থহীন কথা আর কী হতে পারে? আল্লাহ্র সাহায্য মানে এটাই অর্থা- আল্লাহ্র পথের পরিচয় লাভ করা, সে পথকে খুঁজে বের করা ও সে পথে চলা এবং দুশমনের ষড়যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ না করা, তার প্রতারণার শিকার না হওয়া ও তার পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনো কিছু গ্রহণ না করা। কোরআন মজীদ আমাদের জন্য এটাই নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী হাফেয ও ক্বারিগণের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের এ কোরআনি সমাবেশ আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে প্রতি বছরই সফল সমাবেশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে আমাদের সমাজে কোরআন মজীদ নতুন জীবন লাভ করেছে। যাঁরা কোরআনকে ভালোবাসেন, যাঁরা কোরআনকে আঁকড়ে ধরেছেন এবং যাঁরা কোরআনের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন আমাদের সমাজে তাঁদের সংখ্যা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, আমরা কোরআন হেফ্য্ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি, কিন্তু এ কারণে কেউ যেন মনে না করেন যে, কোরআন হেফ্য্ করা ও তেলাওয়াত্ করাই আসল কাজ; আমরা জানি যে, এগুলো আসল কাজ নয়, বরং এগুলো হচ্ছে মাধ্যম, কিন্তু এ সব মাধ্যম ব্যতিরেকে কোরআন মজীদের কাছাকাছি আসা- কোরআন মজীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, যে ব্যক্তি কোরআনের জ্ঞানের সাথে পরিচিত নয় এবং কোরআন নিয়ে চিন্তা ও পর্যালোচনা করে না সে কোরআনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় নি- কোরআনকে ভালোবাসে নি। যে সমাজ কোরআন মজীদের ভিত্তিতে পথ চলতে চায় কি করে এ ধরনের লোকেরা সে সমাজকে পথ দেখাবে? তিনি বলেন, সুতরাং আমাদের সমাজের আলোকিত চিন্তার অধিকারী লোকদেরকে, বুদ্ধিজীবীদেরকে ও যুবকদেরকে কোরআনের সাথে পরিচিত হতে হবে, কোরআনের সাথে তাদের আরো বেশি খাপ খাওয়াতে হবে- কোরআনকে আরো বেশি ভালোবাসতে হবে। মন-মস্তিষ্ক যখন কোরআন ধারণের পাত্রে পরিণত হবে তখন পাত্র থেকে তা-ই চুঁইয়ে পড়বে যা পাত্রের ভিতরে আছে। মন-মস্তিষ্ক যখন কোরআন মজীদের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয় তখন তার প্রভাব ব্যক্তির কথায়, তার কাজে, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে, বিশেষত বড় বড় বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও তার আচার-আচরণে প্রতিফলিত হয়। আর আমাদেরকে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই চেষ্টা করতে হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে আগের মতোই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কোরআনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কেউ যেন এ বিষয়টিকে কোনো ছোট বিষয় বলে মনে না করেন। কোরআন হেফ্য ও ক্বেরাআত্ শিক্ষায় মশগূল যুবকদের সম্বোধন করে তিনি বলেন, তোমরা- প্রিয় যুবকগণ, কোরআন পাঠ শিক্ষার পথে আছ এবং তোমরা কোরআনকে ভালোবাস; তোমরা যেন এ পথে পথচলা অব্যাহত রাখ। তিনি বলেন, কোরআন মজীদ আমাদের সামনে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে। কোরআন আমাদের জন্য সরল, সঠিক, সুদৃঢ় পথÑ সিরাতুল্ মুস্তাক্বীম্কে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছে এবং আমাদেরকে সৌভাগ্যের অধিকারী করছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বর্তমানে ইসলামী জাহান অনেক দুর্বলতার শিকার হয়ে আছে। তবে ইসলামী সমাজসমূহে ইসলাম ও কোরআন মজীদের অভিমুখে যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ইসলামী জাগরণ আত্মপ্রকাশ করেছে তা কখনোই বন্ধ হবার নয়। এ জাগরণ নিজেই সর্বত্র অস্তিত্বমান হবে, ইন্ শাআল্লাহ্। বস্তুত ইসলামী জাগরণ হচ্ছে একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা এবং এ বাস্তবতা, ইন্ শাআল্লাহ্, দিনের পর দিন অধিকতর বৃদ্ধি পাবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, অবশ্য ওলামায়ে কেরামের এবং আলোকিত চিন্তাধারার অধিকারীদের ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। লেখকগণ, জ্ঞান-গবেষকগণ এবং আপনারা যাঁরা হাফেয ও ক্বারী আপনাদের সকলের প্রতিই জনগণের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে এবং এ কারণে আপনাদের ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। সুতরাং কোরআন মজীদ আপনাদেরকে যে পথের সুসংবাদ দিয়েছে আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে সে পথের ব্যাপারে আশান্বিত করে তোলা। মহান আল্লাহ্ এ কাজে আপনাদেরকে সফলতা প্রদান করবেন এবং আপনাদের কাজের যথার্থতার সত্যায়ন করবেন, ইন্ শাআল্লাহ্।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণের শেষ পর্যায়ে এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ সমূহ ও মুসলিম জাতি সমূহ কোরআন মজীদ থেকে কল্যাণ হাসিল্ করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, ইন্ শাআল্লাহ্, মুসলিম সরকারগুলো ও শাসকগণ কেবল মুখের কথায় নয়, কাজের মাধ্যমেও কোরআন মজীদের সাথে কিছুটা হলেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে নেবেন। ইন্ শাআল্লাহ্, ইসলামী জাহান আগামী দিনে কোরআন মজীদের ছায়াতলে সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।
ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজীদী